চিত্ত রঞ্জন গিরি
--- "ও দাদা, ঘন্টুকে পাঠাবে? আমার ছেলের সাথে সেও পার্কে ঘুরে আসবে। আমি নিয়ে যাব।"-- কথাগুলো এক নিঃশ্বাসে বলে শম্পা রেলিংয়ের ওপারে দাঁড়িয়ে তার ছেলে শুভকে নিয়ে।
আমি পেপার পড়ছিলাম। পেপারটা রেখে, "দাঁড়াও,ছেলেকে ডেকে দিচ্ছি।"
ততক্ষণে ঘরের ভেতর থেকে শম্পার আওয়াজ শুনে সে বেরিয়ে এসে আমার দিকে তাকিয়ে বলে, "বাবা যাই?" মাথা নেড়ে সম্মতি দিলাম।
শম্পা তিন বছর ধরে আমার বাড়ি পেছনে রতু বাবুর ঘরে ভাড়া থাকে ছোট চাঁছড়ার বাড়িতে। ও প্রায় ওর ছেলেকে নিয়ে যাতায়াত করে। ঘন্টুর সাথে ওর ছেলে শুভ একই ক্লাসে পড়ে। স্ট্যাটাসে দুটো ফ্যামিলি অনেক তফাৎ থাকলেও এই ছেলে দুটো কিন্তু একই স্কুলে পড়ে।
ঘন্টু আগে ইংলিশ মিডিয়াম কিডজি স্কুলে পড়তো। ওখান থেকে পড়া শেষ করে অন্য নামি স্কুলে ভর্তি হতে ব্যর্থ হয়। কোথাও না পেয়ে ওকে শম্পার পরামর্শে ওর ছেলের স্কুল বিনোদবিহারী তে ভর্তি করায় দুজন ওয়ানে পড়ে। দুজনের মধ্যে যেমন ভাব তেমনি মারপিট, কিন্তু ক্ষণিকের জন্য! আবার ঠিক হয়ে যায়।
শুভ মারকুটে টাইপের। স্কুল থেকে বহুবার গার্জেন কল হয়েছে। কাকে মারছে! কার টিফিন খাচ্ছে! কাকে ফেলে দিচ্ছে!... এই রকম কত নালিশ। তার মা ও নাজেহাল হয়ে যায়! যখন তখন তার মা ছড়ি দিয়ে ব্যাপক পেটায়। তবুও তার কোন পরিবর্তন হয় না।
আমরা তাকে বোঝাই -- ছেলেকে বেশী মারলে ওর ভয় জিনিসটা কেটে যায় কোনো ভালো ফল পাওয়া যায় না। ছেলেকে না মেরে অন্যভাবে যেমন -- কথা না বলে, রাগী মুডে থেকেও ছেলেকে শাসন করা যায়। তাতে ভালো ফল হয়।
আমার স্ত্রী মিঠু। সেও খুব বিরক্ত হয় যখন আমার বাড়িতে এসে বল বার করে একা একা মারতে থাকে। কখন দেওয়ালের ঘড়ি ভাঙ্গে, কখন বল মেরে ঠাকুরের সিংহাসন উল্টে দেয়, কখন খাট চেয়ার টেবিল ডিঙিয়ে লাফায়! কখনো কখনো আমরা বিরক্ত হয়ে নালিশ করলে আমাদের সামনে প্রচুর পেটায় আর সেটাও খুব কষ্টকর! এমনিতেই তার ছোট চাঁছড়ার বাড়ি, বাচ্চার খেলাধুলার পরিবেশ নেই। আমাদের বড় বাড়ি, বড় বারান্দা, বড় ব্যালকনি ও বাইরে উঠানে খেলার মত জায়গা আছে -- এই ভেবে ছেলেটাকে আসতে দেয়া হয়। ঘন্টু ও ওর সাথে যখন তখন খেলতে পারে।
তাছাড়া শম্পার স্বামী প্রায় বাইরে থাকে শম্পা লোকের বাড়িতে রান্নার কাজ করে। রাত্রে ছেলে একা একা থাকবে, শুভ একা থাকতে ভয় পায়! তাই সেই সময় ও আমাদের বাড়িতে পাঠিয়ে দেয়। ওর বাড়িতে টিভি ও নেই যে দেখবে!
একদিন রাতে অর্থাৎ সাড়ে আটটার নটার দিকে সব কাজ সেরে আমার স্ত্রীও বাচ্চার সাথে ওরাও জি বাংলা সিরিয়াল দেখতে থাকে। শুভ ঘন্টুকে কানে কানে ফিসফিস করে কি একটা বললো তা শুনে দু জন ড্রয়িংরুমে এসে বল বার করে খেলতে থাকে। সেই সময় আমি খাতায় পেনে হিসেব করছিলাম। প্রথম প্রথম তাদের খেলা কে গুরুত্ব না দিয়ে হিসেবে মন ছিল। একবার বল এসে ধাক্কা মারে। ঠিক তারপরেই আবার বলটা এসে আমার পেনের ডগায় পড়ে!
চিৎকার করি -- "ঘন্টু.. বল খেলতে হবে না। যাও টিভির ঘরে।"
ওঘর থেকে শম্পা ও চিৎকার করে, "শুভ.. খেলা বন্ধ কর্!"
কে শোনে কার কথা! ঘন্টু খেলা বন্ধ করে দিলেও শুভ একা একা বল খেলে। এদিক ওদিক এলোপাথাড়ি বল মারতে থাকে! প্রচুর ডিস্টার্বে হিসেব গন্ডগোল হতে থাকে।
তখন আমি তাকে থামাতে না পেরে বলি, "শম্পা, দেখে যাও তোমার ছেলেকে। কি বিচ্ছু রে বাবা!"
সিরিয়ালটা শেষ হল। সেই সময় দুজন বেরিয়ে এসে আমার কাছাকাছি বসে সংসারের নানান গল্প করতে থাকে। তারই ফাঁকে শুভকে বারবার মানা করতে থাকে। কিন্তু কে শোনে কার কথা! শুভ ঠিক বল নিয়ে খাট চৌকি টেবিল চেয়ারের ওপর দিয়ে লাফালাফি করতে থাকে। তার মা কাছে থাকলে বেশি সাহস পায়। বারবার বারণ করে ব্যর্থ হয়ে হিসেব গুটাতে বাধ্য হলাম।
মুখ থেকে বেরোয়, "এই ছেলেকে কন্ট্রোল করাও কঠিন। কি বিচ্ছুরে বাবা! এই রকম ছেলে কোনদিন কারোর না হয়। কেমন ছেলে - কারোর কথা শুনবে না।"
আর তখন শম্পা বেশ কয়েক ঘা পটাপট শুভ কে দিয়ে দেয়। চিৎকার করে কাদেঁ ছেলেটা।
আমার স্ত্রী বলে, "তুমি এটা বলতে গেলে কেন! তোমার জন্য ছেলেটা মার খেলো।"
শম্পা তখন ছেলেকে বকতে বকতে তার বাড়ি নিয়ে যায়। এবার স্ত্রীর চিৎকার, "বলছি না, তার মার সামনে শুভর নিন্দা করবে না। কোনো মা তা মেনে নিতে পারে না। সেই যন্ত্রণায় আমাদের সামনে ছেলেটা এতটা মার খেলো!" মনে মনে ভাবলাম, "মিঠু কথাটা খারাপ বলেনি।" আমি চুপ করে গেলাম। মনে মনে কষ্ট হলো শুভ টা এতটা মার খেলো!
পরের দিন আগের মত বন্ধুর সাথে খেলতে শুরু করেছে। তার সাথে পাশের বিল্ডিং এর মাম, সুশ্রী এসে দলে ভিড়েছে। ঘরে, বারান্দায় ব্যাপক চিৎকার! এরকম বেশ কিছু সময় কেটে যাওয়ার পর কোলাহলের আওয়াজটা অতিরিক্ত। 62 ডেসিবেল কে ছাড়িয়ে গেছে! আর সহ্য না করতে পেরে, "যাও, যে যার বাড়ি যাও। কে শোনে কার কথা! বারবার চিৎকারে কাজ না হওয়াতে মিঠু রান্নার গরম খুন্তি নিয়ে তাড়া করতে সবাই পালিয়ে যায়। কিন্তু শুভ না গিয়ে আমার কাছে চলে আসে। আমি বারান্দার দিকে ড্রইংরুমের মুখটা ব্যবসার হিসেব করছিলাম। ও এসে আমার মাথাটা টিপে মেসেজ করতে শুরু করেছে। শুভর একটা কৌশল -- যখন আমার বাড়িতে ওই সময় আসতে না বলা হয়, সে আমার কাছে অযাচিতভাবে এসে মেসেজ করে অর্থাৎ মেসেজ করার নাম করে ঘরে ঢোকে। তারপর ঘন্টুর যেখানে বল খেলার গাড়ি আছে, সেগুলো বার করে খেলতে শুরু করে। এখন সেই কৌশল নিয়ে আমার মাথায় মেসেজ করতেও বেশ আরাম বোধ হচ্ছিল। পেছনে পেছনে গরম খুন্তি নিয়ে মিঠু বলে, "যা তোকে আর মেসেজ করতে হবে না।" আমি কিছু বলবো ভেবে শুভ আমার দিকে তাকায়। কোন উত্তর না পেয়ে রেগে কটমট করে চলে যায়। যাওয়ার সময় আমি পেছন থেকে বলি, "শুভ, রাস্তার দিকে গেটটা বন্ধ করে দে, না হলে কুকুর ঢুকে যাবে।" তার পেছনে পিছনে খুন্তি নিয়ে মিঠুকে দেখে সে গেটটা ইচ্ছে করে বন্ধ করলো না।
মিঠু চিৎকার করে, "গেটটা বন্ধ করবি না??"
উত্তর মুখ গোমরা করে চিৎকার, "না.. পারব না!" বলে বাড়ির দিকে রওনা হয় শুভ।
পিছন থেকে মিঠুর চিৎকার, "আসিস আবার! ঠ্যাং খোঁড়া করে দেব!"
আবার বিকেলে তিনটের দিকে গ্রিলের ওপার থেকে "ঘন্টু.. ঘন্টু.." বলে ডাক দেয়।
তার আওয়াজ শুনে আমি চাবি নিয়ে গ্রিল খুলতে গেছি, ঠিক সেই সময় ছড়ি নিয়ে মিঠু তাড়া করে তাকে। সে কিছুদূর গিয়ে -- "মোটা মানি.. খারাপ মানি.. মোটা! মোটা! মোটা! বাজে মানি.."
মিঠুর শরীর এমনিতে খুব মোটা আর শুভ মিঠুকে মানি বলে ডাকে। ও যখন সুর করে রাস্তার চিৎকার করে বলে মোটা মানি.. রাস্তার লোক গুলো কথাগুলো শুনে আমার বাড়ির দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে যায়। এই অবস্থায় মিঠু আমাকে শোনায়, "দেখেছ, বস্তি বাড়ির ছেলে তার আসল রূপ টা দেখো! এদেরকে কখনো পরিবর্তন করা যাবে না। সাধেই বলে -- বস্তির ছেলের চরিত্র বস্তির মতো হবে! ওর কথাটা রাগের কথা না হলে তো ডারউইন মিথ্যে হয়ে যাবে। যোগ্যতমের উদবর্তন এ বলা হয়েছে, সুষ্ঠু পরিবেশ দিলে ভাবনাচিন্তা চরিত্র পাল্টে যায়। কিন্তু এটাও ঠিক আগেরগুলো লুপ্ত হলেও পুরোপুরি হয় না। কিছুটা গৌণ অবস্থায় থেকে যায়।
কিছু মানুষ আছে গরীব হলেও প্রচন্ড সৎ। দারিদ্রতাই তার অলংকার। শম্পা সেই রকমই একটা মেয়ে। কোনো কিছু কাজের প্রয়োজনে সব সময় সে সাহায্য করার জন্য উন্মুখ। কারোর কারোর বাড়ির অনুষ্ঠানে কাজ করার জন্য 500-700 টাকা নেয়। এটা তার এক ধরনের ঠিকা কাজ। ঘন্টুর জন্মদিনে দুদিন আগে থেকে তাকে নিমন্ত্রণ করা হয়। অনুষ্ঠানের আগের দিন পর্যন্ত সে অনুষ্ঠানের কাজকর্ম বিনা পারিশ্রমিকে এ মিঠু কে সাহায্য করে। কিন্তু হঠাৎ দেখা গেল অনুষ্ঠানের দিনে সবাই এসেছে ও আসেনি। তারই অতিমাত্রায় অপেক্ষা -- না আসতেই মিঠু জানলা দিয়ে চিৎকার, "শম্পা, এই শম্পা.. কেক কাটা হবে। তোমরা আসছ না কেন??" কোন সাড়াশব্দ নেই। আবার চিৎকার, "শম্পা, এই শম্পা...."
বেশ কয়েকবার ডাকার পর দরজা খুলে বের হয়ে,
"কি হয়েছে??"
--- "আরে.. আসছ না কেন??" সে শুকনো মুখে বলে, "তুমি আমাকে সকাল থেকে ডেকেছো কি?"
তখন আমরা অবাক হই।
মিঠু বলে,"এ কি বলছ! তোমাকে দুদিন আগে নিমন্ত্রণ করেছি আর এখন বলছো এই কথা! যাও, এক্ষুনি বেরিয়ে এসো।"
একগাল হাসি নিয়ে বলে, "আচ্ছা যাচ্ছি। আমরা সাজগোজ করে যাচ্ছি।"
মিঠু আমাকে বলে," দেখেছ কি ধরনের মেয়ে! দুদিন আগে ডেকেছি আর এখন কি বলছে দেখ!" মনে মনে ভাবলাম ,"শম্পার মনে একটাই ইগো যেন সে গরীব বলে তাকে অবহেলা করা হচ্ছে!"
অথচ তিন দিন ধরে অনেক খেটে গেল, টাকা দিতে চাইলেই বলে, "আমাকে আপনারা এতটা পর ভাবেন!" এরপর কি টাকা দেওয়া যায়?!
অল্প বয়সী শম্পার বাবা অন্য মহিলার টানে বাড়ি ছাড়ে। মা আর মেয়ে মিলে জীবন। 16 পেরোতে না পেরোতেই তার বিয়ে হয় সুরজের সাথে, ইলেকট্রিক মিস্ত্রি। এখন বাইরে বাইরে থাকে। এক মাস দু মাসে কিছু টাকা ধরিয়ে দিয়ে চলে যায়। সেই টাকায় কুলোয় না। ছেলের পড়াশোনা, সংসারে খরচা, প্রচুর টাকা টান পড়ায় সে লোকের বাড়িতে বাড়িতে কাজ করে। এক সময় দেখি নানা রকম খাবার করে নিয়ে আমাদেরকে দেয়। তা দেখে মিঠু যখন তখন রান্না করে তাকে দেয়। আবার দেখি একটা কোন কিছু যেমন টমেটো, পেঁয়াজ, আদা ইত্যাদি ইত্যাদি অভাব পড়লে মিঠু শম্পার কাছ থেকে চেয়ে নেয়। দিতে গেলে একবারেই নেয় না। ফলে আমি মিঠুকে বারণ করে দিয়েছি ওর কাছে নেবে না।
যতই মিঠু শম্পার সাথে ঘনিষ্ঠভাবে মিশুক না কেন, তবু কখনো ওর মুখ থেকে শুনেছি, "ওদের বস্তির চলন চলন আমাদের সাথে কখনো মিল খাবে না।" তার উপর শুভর কতগুলো বদমাইশি ব্যবহার মিঠুকে আরো ক্ষিপ্ত করে তোলে।
এমনি করে দিন কাটে। হঠাৎ একদিন শম্পা ছুটে আসে টাকার প্রয়োজনে। কি একটা জিনিস কিনবে দু হাজার পাঁচেক টাকার প্রয়োজন, ধার চাইছে। এত কিছু না ভেবে দেওয়ার জন্য উঠতে যাচ্ছি, মিঠু বলে দেয়, "এখন এত টাকা হবে না, কালকে কিছু যদি ম্যানেজ করা যায় তাহলে দেওয়া হবে।"
তা শুনে শম্পা চলে যায়। -- "ঠিক আছে, কালকে নেবো।"
ও চলে যেতেই মিঠু বলে, "তুমি এত ঠকেও কি তোমার কোন শিক্ষা হয়না! চন্দনা বৈরাগীকে টাকা দিয়েছিলে দু-তিন বছর হয়ে গেছে, তারা কি আজও ফেরত দিয়েছে?!" তারপর বলে, "তোমার টাকা তুমি যা পারো করো।"
সত্যি তো, ওরা তো টাকা ফেরত আজও দেয়নি। আবার ভাবলাম, 5000 দিয়ে যদি না দেয়, তার চেয়ে বরং দু হাজার টাকা দেই, না যদি দেয় তাহলে কম এর উপর যাবে।
পরের দিন শম্পা টাকা চাইতে এলে 2000 দিয়ে বললাম, "আর ম্যানেজ করতে পারলাম না। বাকিটা তুমি অন্য কোথাও ম্যানেজ করে নিও। কিছু না বলেই খানিকটা মুখ শুকনো করে ওই টাকা নিয়ে চলে গেল।"
মনের ভিতর খানিকটা স্বস্তি এল 15 দিন পর সব টাকা যখন শোধ করে দিল। মনের ভিতরটা যেন কেমন হয়ে উঠল -- মনে হল, পুরো টাকাটা দিলে ভালো হতো। চন্দনা বৈরাগীকে দিয়ে সব মানুষকে বিচার করা উচিত নয়। এরই মধ্যে মিঠু ঘন্টু কে নিয়ে বাপের বাড়ি যায়।
সকাল বেলা ভোরে উঠে পেপার পড়ছি, শম্পা চা বিস্কিট নিয়ে ঘরে ঢুকে বলে, "দাদা, বউদি তো নেই চা টা খেয়ে নিন।"
আমি বললাম, "তুমি আবার আনতে গেলে কেন!" চটজলদি উত্তর -- "আপনাদেরকে আপন ভাবি বলেই।" রেখে বাড়ি চলে যায়। দুপুর বেলা প্রেসার কুকারে ভাত বসিয়েছি, জানলার বাইরে শুভ তার দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আমাকে দেখতে পেয়ে বলে, "জেঠু আজ আমার বাড়িতে খেয়ে যাবে।" তারপর তার মার উদ্দেশ্যে বলে, "মা, জেঠুর জন্য খাবার ব্যবস্থা কর।"
তৎক্ষণাৎ আমি বলি," আরে না না.. আমি ভাত বসিয়েছি।"
কিছুক্ষণ পর তরকারির ঝোল নিয়ে শুভর সাথে শম্পা হাজির। অগত্যা কি আর করা যায়। মনের মধ্যে বিশ্বাসের স্তর যেন গারো হতে থাকে। এমনি করে যায় কিছু দিন।
শম্পা রা তো ভাড়া থাকে, তারা একটা জায়গা কেনার চেষ্টা করে। আমাকে বলে যদি হাজার 50 টাকা ধার দেন তাহলে জায়গা টা কিনতে পারব। তা আপনাকে সুদ সহ ধীরে ধীরে শোধ করে দেব। কথাটা বলতে ইচ্ছে করছিলো -- অতটা না হলেও কিছুটা দিতে। মিঠু চিৎকার করে, "তুমি টাকা টা কেন দিতে চাইছ! আমরা যখন কোন গয়নাগাটি তৈরি করার জন্য চাই তখন শুধু নেই নেই বলো, এখন টাকাটা আসছে কোথা থেকে! তার ওপর এ টাকা যে শোধ করবে কি করে! লোকের বাড়িতে রান্নার কাজ করে কত টাকা পায়, একবারে টাকা দেবে না বলে দিলাম। না হলে তুলকালাম করব। ওরা আজ এখানে ভাড়া আছে, কালকে অন্য কোথাও চলে যাবে। তুমি কোথায় খুঁজবে তাকে! খবর্দার বলে দিচ্ছি একদম দেবে না।"
মহা মুশকিলে পড়লাম! কি করি! বাধ্য হলাম স্ত্রীর কথা শুনতে।
পরেরদিন শম্পাকে বললাম, "তুমি অন্য কোথাও ধার করার চেষ্টা কর। আমার কাছে একদম নেই। ও শুকনো মুখে মাথা নেড়ে বলে নেই যখন আপনি দেবেন কি করে! ঠিক আছে অন্য কোথাও যদি পাই কিছু, তাহলে হবে।" --বলে চলে যায়। মনটা খারাপ হলেও আমার করার কিছু নেই। টাকাটা দিয়ে যদি চোট যায়, তাহলে তো ঘরে স্ত্রী ভূমিকম্প তৈরি করবে।
এর কয়েক দিনের মধ্যে একদিন সন্ধ্যায় আমি পেপার পড়ছিলাম। ঠিক সেই সময় রান্নাঘরে মিঠু টিফিন এর ব্যবস্থা করছিলো। সেই সময় শুভ ঢুকে ঘন্টুর সাথে খেলতে থাকে।
আমাকে মিঠু ডেকে রান্না ঘরে বলে," তুমি শুভকে বাইরে পাঠাও। ছেলের জন্য চাউমিন করেছি।"
আমি বললাম ,"ওকে না হয় একটু দেবে।"
ও গর্জে ওঠে -- "যা বলছি শোনো। চাও এর পরিমাণ কম। তুমি ওকে পাঠিয়ে দাও।"
কি করি! -- "তুই বাড়ি যা। পরে আসবি। ঘন্টু এখন পড়ছে।"
শুভ তখন মুখ শুকনো করে বলে, "মা কাজে গেছে। ঘরে একা থাকতে ভয় করে। আমি একটু থাকি?"
মিঠু গর্জে ওঠে, "তোর জন্য কি ঘন্টুর পড়া নষ্ট হবে! যা.. বাড়ি যা।"
শুভ কাচুমাচু হয়ে আমাকে বলল, "মা তালা লাগিয়ে এখানে আমাকে দিয়ে কাজে গেছে। আমি কোথায় এখন যাব। রাত হয়ে গেছে। অন্ধকার।"
মিঠু তা শুনতে পেয়ে আবার গর্জে ওঠে, "যা বলছি না!
তোর জন্য কি ঘন্টুর পড়া নষ্ট হবে!" কথাটা শুনে আর কিছু না বলে চুপচাপ চলে যায়। মনটা খারাপ লাগলো বারান্দায় এসে দেখি রাস্তার গলির অন্ধকারে ও যেন মিলিয়ে গেল।
পেছন থেকে, "এই শুনছো, টিফিন নাও।"
মাথা ঘোরাতে দেখি খাবার টেবিলে তিনটে প্লেটে চাউমিন। পরিমাণটা কম নয়। খাওয়ার দিকে তাকাতে শুভর মুখটা ভেসে ওঠে। ওকে কিছু দেওয়া যেতে পারত। মাথা নেড়ে নেড়ে নিজের যন্ত্রণা নিজেই চাপলাম। শুধু একবার বললাম, "এর থেকেও তো শুভকে দেওয়া যেতে পারত!"
ও নিজস্ব স্বভাবে গর্জে ওঠে বলে, "চাও অনেক কমে যেত। তাছাড়া আমাদের প্রাইভেসি বলে তো কিছু আছে। যা রান্না করব তাকে দিতে হবে নাকি! আর কেনইবা ও যখন তখন আসবে! অসহ্য! মুখের ওপর আর আসতে না বলে দিতে পারতাম। শুধু তোমার জন্য পারি না।"
ঠিক দিন পাঁচেক পরে তুলসী মন্দিরে ঠাকুরকে জল দিচ্ছি, পাশে ঘন্টু "শুভ শুভ" বলে ডাক দেয় ।শুভ বেরিয়ে এসে বলে, "মা চাওমিন করছে। খেয়ে যাচ্ছি।"
--- "চাওমিন খাচ্ছিস?"
--- "হ্যাঁ দাঁড়া। মাকে বলি।" বলে ঘরে ঢুকে, "ঘন্টুকে চাওমিন দাও তো। আমার কাছ থেকে একটু নিয়ে নাও।"
আমি অবাক হয়ে গেলাম। চিৎকার করে বললাম, "না না। দিতে হবে না। সকালে অনেক কিছু খেয়েছে।" -- বলেই ঘন্টু কে নিয়ে ঘরে ঢুকি।
তার কয়েক মিনিট পর শুভ ও তার মা একটা বড় বাটিতে করে চাওমিন নিয়ে আমার ঘরে ঢুকে, "নিন দাদা। চাওমিন নিয়ে এসছি, খান। ঘন্টু, তোদের জন্য চাউমিন নিয়ে এসেছি।" তা দেখে ঘন্টুর কি আনন্দ! ওরা দিয়ে চলে যায়। আমি হাঁ করে তার চলে যাওয়ার দিকে তাকিয়ে থাকি। দেরি হলেও বহুকষ্টে টাকাগুলো ম্যানেজ করে রেজিস্ট্রি দিন ঠিক করে শম্পা ঐদিন সব টাকা দেওয়ার কথা। জমি সার্চিং তথ্য সব ঠিকঠাক আছে। আজ শনিবার। আগামী সোমবারই রেজিস্ট্রি হবে। যাই হোক আর কতদিন ভাড়া বাড়িতে থাকবে! জায়গাটা কিনলে শম্পার থাকার কূলকিনারা হবে। আমার ভালো লাগলো।
এদিকে গত দুদিন ধরে ঘন্টুর জ্বর, বমি, মাথা যন্ত্রণা। তা নিয়ে মন মেজাজ ভালো নেই। দুপুর থেকে মাথা যন্ত্রণা। আর এত বাড়াবাড়ি হতেই রথীন ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাই। গত তিন চার দিন ধরে দেখছেন। নিয়ে যেতেই যন্ত্রণার বাড়াবাড়ি শুনে বলে, আমরি বা পিয়ারলেস বা কোনো ভালো নার্সিং হোমে নিয়ে যেতে। কিন্তু কি করব! আমরিতে ভর্তি হতে গেলে অনেক টাকার দরকার। হাজার 30 এর মত কাছে ছিল। অত কিছু তোয়াক্কা না করে আমরি তে ভর্তি করলাম। পরেরদিন নানান পরীক্ষা ট্রিটমেন্টের জন্য লাভ দেড়েক দরকার। এদিক ওদিক থেকে প্রায় 70-80 হাজার ম্যানেজ করতে পেরেছি। কি করি!! আমি ও মিঠু দুজনেই টাকার সন্ধান করতে থাকি। সব জায়গা থেকে কেউ আশার বাণী শোনালো না। কি করে ছেলেকে বাঁচাবো, নানান চিন্তা জমি টাকে বিক্রি করে দেব। তাও খরিদ্দার নেই। কি করবো, পরে নাহয় টাকাটা পাওয়া যাবে। এই রবিবার ব্যাংক বন্ধ অথচ অত টাকা কেউ দিতে পারছে না।
হাসপাতালে শুকনো মুখে স্বামী স্ত্রী মাথা নিচু করে ভাবছি, এই সময় শম্পা বলে, "দাদা আমি টাকাটা দেব।" আমি অবাক হয়ে বললাম," এ কি বলছ তুমি! কালকে তোমার জমির রেজিস্ট্রি। তোমার অনেক দিনের স্বপ্ন, তোমার একটা জায়গা হোক। আর তুমি কিনা টাকা দিয়ে দেবে!"
ও হেসে বলে, "অবশ্যই স্বপ্ন। কিন্তু টাকার জন্য তোমরা ছটফট করছো, ছেলেকে কিভাবে বাঁচাবে! আর কাছে টাকা আছে, কালকে তা দিয়ে জমি কিনবো। তার চাইতে এই টাকা দিয়ে ঘন্টু যদি সুস্থ হয় আমি অনেক অনেক বেশি আনন্দ পাবো। জানি তোমরা এই টাকা মারবে না। আমাকে পরে পরিশোধ করে দেবে। আমি ভাড়াটে আছি না হয় আরও দু-তিন বছর থাকবো। কিন্তু এই বিপদের সময় আমার জায়গা চাইতে তোমার ঘন্টুর সুষ্ঠু হওয়া টা খুব জরুরি।"
মিঠু তখন হাঁ করে তাকিয়ে থাকে শম্পার দিকে। চোখ থেকে ফোঁটা ফোঁটা জল গড়িয়ে পড়ে।
ছবিঋণ- ইন্টারনেট ।
----------------------------
My address
Chitta Ranjan Giri
C-03 Sreenagar paschimpara panchasayar road
Post -panchasayar
Kolkata 700094
West Bengal India