Click the image to explore all Offers

গল্প।। রুদ্রাক্ষ।। মঞ্জুশ্রী চক্রবর্তী

 

 রুদ্রাক্ষ

মঞ্জুশ্রী চক্রবর্তী


                 উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া  চন্দনকাঠের ছোট্ট বাক্সটায় সযত্নে কী রাখত অনিরুদ্ধ সে এক গোপন রহস্য ছিল। বাক্সটা থেকে সুন্দর একটা গন্ধ পাওয়া যেত। প্রত্যেক রথের দিনে খুব খুশি থাকত অনিরুদ্ধ আর অনেক রাত পর্যন্ত বাক্সটা খুলে কী যেন সব দেখত। মা কিছু একটা আন্দাজ করতেন তবে ছেলের গোপন ব্যাপারে বেশি কৌতূহল দেখাতেন না। 

                       অনিরুদ্ধের পূর্বপুরুষ এককালে ছিলেন এই অঞ্চলের জমিদার, যদিও সে জমিদারীর জৌলুশ বা প্রাচুর্য কোনটাই সে কোনদিন চোখে দেখেনি। জমিদারী রক্তের উচ্ছৃঙ্খলতা নয় বরং বৈরাগ্যজনিত ঔদাসীন্যের ধারা যা এই পরিবারের সদস্যদের মধ্যে বহমান ছিল তাই এই বংশের অর্থোন্নতির পথে অন্তরায় হয়ে দাঁড়িয়েছে কয়েক পুরুষ ধরে। ছোটবেলায় বাবাকে দেখেছে সংসার বা উপার্জনের কথা না ভেবে ফকির- মুর্শিদ বা সাধুসঙ্গে অবলীলায় বাড়ি ছেড়ে দিনের পর দিন তাদের বিভিন্ন আখড়ায় কাটিয়ে দিতেন। তারপর একদিন পাড়ি দিলেন নিরুদ্দেশে পরমপুরুষের সন্ধানে। অনিরুদ্ধ তখন মাত্র আট বছরের। একপ্রকার অর্থাভাবেই দিন কেটেছে তাদের মা ছেলের। সেই রক্তস্রোত তার ধমনীতেও প্রবাহিত এটা বেশ বুঝতে পারে অনিরুদ্ধ। বাড়িতে অর্থাভাব, মায়ের দুশ্চিন্তা কোন কিছুতেই তার বিশেষ হেলদোল নেই। সামান্য জমানো পুঁজিতে কীভাবে মা সবকিছু চালিয়ে নেন তা যেমন জানার প্রয়োজন বোধ করেনি কোনদিন তেমনই ভাতের পাতে যা পড়েছে তাই মুখ বুজে খেয়ে নিয়েছে কখনো উষ্মা প্রকাশ করে জমিদারোচিত দাম্ভিকতার লেশমাত্র প্রকাশ ঘটায়নি।।নদীর ধারে শ্মশানের পাশে অদ্ভুত এক নীরবতার মধ্যে ঘন্টার পর ঘন্টা চুপ করে বসে থাকে প্রাচীন অশ্বত্থের ছায়ায় কিংবা কখনও নিকষ কালো অন্ধকার রাতে কার খোঁজে পথে পথে একাই ঘুরে বেড়ায় তা সে নিজেও জানে না। এ হেন উদাসীন অনিরুদ্ধ ছোট্ট কাঠের বাক্সটায় পরম যত্নে খুব গোপনে কোন এক মহামূল্যবান সম্পদ গচ্ছিত রেখেছে। বাক্সটা খুললে তার মুখে যেন একটা উজ্জ্বল আলো জ্বলে ওঠে। প্রত্যেক রথের দিনে সেই আলো আরও উজ্জ্বল হয়ে ওঠে আর কী যেন একটা ঐ বাক্সে সযত্নে তুলে রাখে। 
                       তাদেরই পূর্বপুরুষের দান করা জমিতে আজও রথের মেলা বসে। দূর দূর থেকে ব্যবসায়ীর সাজানো পসরায় রঙিন হয়ে ওঠে। অনিরুদ্ধর দুটি ঘোরলাগা চোখ একজনকে খুঁজে বেড়ায় যিনি এই মেলার কোলাহল থেকে একটু দূরে পুরোনো বটগাছের নীচে এসে বসেন। সারাদিন সেখানেও কিছু কিছু ভিড় লেগে থাকে, নিজেদের নানা ব্যক্তিগত সমস্যার সমাধান খুঁজতে আর হাসিমুখে যথাসম্ভব সুপরামর্শ দিয়ে সেসব সমাধানের চেষ্টা করে চলেন তিনি কখনো ধৈর্য্যচ্যুতি ঘটেনা। আরও একজন অসীম ধৈর্য নিয়ে একপাশে বসে থাকে, সে অনিরুদ্ধ। অনেক রাতে সবাই চলে গেলে প্রতিবছর একটাই প্রশ্ন করে, " এখনো সময় হয়নি?" তিনি হেসে মাথা নাড়েন আর তার হাতে একটি রুদ্রাক্ষ দিয়ে অনিরুদ্ধের মাথার হাত রাখেন সে স্পর্শে কেঁপে ওঠে সে, স্নেহের শীতলতার সঙ্গে একটা বিদ্যুৎ খেলে যায় যেন। বাড়িতে এসে চন্দনকাঠের বাক্সে এই রুদ্রাক্ষগুলিই তুলে রাখে কারণ তাঁর কঠোর নির্দেশ সেগুলি যেন অনিরুদ্ধ দেহে ধারণ না করে।
                অনেক চেষ্টা করেও বাড়ি ফেরা হল না অনিকের। পঁচিশ বছরে এই প্রথমবার সে রথে বাড়ির বাইরে। মাকে নিয়ে ভীষণ টানাপোড়েন চলল কদিন। রান্নাঘরে কাজ করতে করতে হঠাৎ জ্ঞান হারিয়ে পড়ে যান, হৃদযন্ত্রের গুরুতর সমস্যার কারণে কলকাতার বড় হাসপাতালে ভর্তি করতে হয়। কলকাতা থেকে একশো কিলোমিটার দূরে থেকে রোজ যাতায়াত করা অসম্ভব তাই অনিরুদ্ধকে থেকে যেতে হয় একটি হোটেলে।এরই মধ্যে প্রকৃতি আর অনিরুদ্ধের মনকে অবশ্রান্ত বৃষ্টিধারায় ভাসিয়ে এসে গেল রথযাত্রা। মনখারাপের বৃষ্টি দিনের শেষ বিকেলে যখন হসপিটালের মায়ের বিছানার পাশে গিয়ে বসল তখন মা কী বুঝলেন জানে না তবে তাঁর ক্লান্ত  চাহনি অনেক কিছু বলে দেয়, চোখ নামিয়ে নেয় অনিরুদ্ধ। মনে হয় পঁচিশ বছর কাঠের বাক্সে বন্দী করে রাখা মনটা বোধহয় মায়ের সামনে উন্মোচিত হয়ে পড়েছে, রথে বাড়ি যেতে না পারার অস্থিরতা মায়ের চোখকে ফাঁকি দিতে পারেনি। তবে এতকিছুর পরেও শেষরক্ষা হলো না! একমাসের লড়াই শেষে গঙ্গায় মায়ের অস্থি বিসর্জন দিয়ে একা বাড়ি ফিরল উল্টোরথের আগের দিন।
            একদিকে বাড়িতে এক গভীর শূণ্যতা আর অন্যদিকে প্রাচীন বটগাছতলার সেই সৌম্য কান্তির প্রবল আকর্ষণ পথে বের করল অনিরুদ্ধকে। উল্টোরথে তিনি থাকেন না তবু একটা ক্ষীণ আশা নিয়ে পায়ে পায়ে সেখানে পৌঁছে, বসল ভিড়ের একপাশে। সবাই চলে গেলে অনিরুদ্ধকে কাছে বসিয়ে তার মাথায় আলতোভাবে হাত বুলিয়ে দিতে থাকেন। বুকের ভেতর পাথর ফাটিয়ে একটা ঝর্ণা দুচোখ বেয়ে নেমে আসে অনিরুদ্ধর, তিনি বাধা দেন না, কোন সান্ত্বনাও নয়। একসময় মন শান্ত হয়ে আসে, ওঠার আগে সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে তাঁর মুখের দিকে তাকালে তিনি স্মিত হেসে বলেন, "বাড়ি যাও, এবার তোমার সময় হয়ে এসেছে, আর দরকার নেই।শান্ত মনে মায়ের পারলৌকিক কাজ কর"। ধীরে ধীরে উঠে চলে আসে অনিরুদ্ধ, একটা কথাই কানে বাজতে থাকে…"সময় হয়ে এসেছে…"। 
                    শ্রাদ্ধের কাজ শেষ হতে বিকেল গড়িয়ে গেছে। আত্মীয়-স্বজন ও প্রতিবেশীরা সবাই একেএকে চলে যাওয়ার পর ঘরে এসে শুয়ে পড়ে অনিরুদ্ধ। ক্লান্তিতে কখন ঘুমিয়ে পড়েছে বুঝতে পারেনি। ঘুম ভাঙলো মাথায় একটি হাতের শীতল স্পর্শে। কত রাত ঠিক বুঝতে পারলনা। প্রথমটা চমকে ওঠে কিন্তু এ স্পর্শ তার অনেকদিনের চেনা তাই আস্তে আস্তে উঠে বসে জিজ্ঞাসা করল, "আপনি নিজে এসেছেন, তাহলে কী সময় হল এতদিনে?" 
উত্তর এল, " সন্ন্যাসীকে তো একবারের জন্য নিজের বাড়ি ফিরতেই হয়…" 
বিদ্যুৎ খেলে যায় অনিরুদ্ধর শরীরে! মুখ থেকে একটাই কথা বেরিয়ে আসে, "বাবা!"
গম্ভীর হয়ে জবাব দেন, " সন্ন্যাসীর কোন ব্যক্তিগত সম্পর্ক থাকে না" 
বিমূঢ় হয়ে বসে থাকে অনিরুদ্ধ। সন্ন্যাসী তাঁর ঝোলা থেকে একজোড়া গেরুয়া ধুতি-চাদর বের করে তার হাতে দিয়ে বলেন," পোশাক বদলে নাও, আমাদের বেরিয়ে পড়তে হবে"।
                                  মন্ত্রমুগ্ধের মতো তাঁর নির্দেশ পালন করে অনিরুদ্ধ। আবারও এই বংশের এক পুরুষ রাতের অন্ধকারে ঘর ছেড়ে পথে বের হল পরমাত্মার খোঁজে… সঙ্গে কেবলমাত্র সেই পঁচিশটি রুদ্রাক্ষ। চন্দনকাঠের বাক্সটি আর তার প্রয়োজন নেই।

ছবিঋণ- ইন্টারনেট ।

 
-------------------------------------- 
 
 
মঞ্জুশ্রী চক্রবর্তী
 

 
       সোনারপুর, কলকাতা
                          

Post a Comment

0 Comments
* Please Don't Spam Here. All the Comments are Reviewed by Admin.