Click the image to explore all Offers

গল্প।। যোগাযোগ।। ঋতম সাহা

 


 


 

         6.52 রানাঘাট লোকাল, বাড়ি ফিরছি। আজকে সমীর আসেনি, অখিল অবসর নিয়েছে কয়মাস আগেই, তাই আজক অগত্যা একাই একাই৩৩ বছরের এই অফিসের কর্মজীবনে কোনোদিন এরম হয়নি কেও না কেও সাথে থাকতই, আর সমীর ও অখিলতো অবশ্যই, আমার এই অফিসের শুরুর দিন থেকে কলিগ ওরাদেখতে দেখতে আমারও অবসর নেয়ার সময় হয়ে এলো।

আজকে এইসব ভাবতে ভাবতে ভীড় ট্রেনেও বেশ একাকীকত্ত্ব অনুভব করছিলাম, আর একটা জিনিস দেখলাম যেটা ট্রেনে বসে আমাকে খুব ভাবিয়েছিলো। না কথাটা আমার কর্মজীবনের না, কথাটা একটা প্রজন্মের, একটা পদ্ধতির, একটা পরিবর্তনের।

 

ট্রেনে আমার পাশে বসে থাকা যুবকের হাতে থাকা ফোনের দিকে নজর চলে যাচ্ছিলো, তাই বলে আবার ভাববেন না আমার আড়িপাতা বা লোকের হাড়ির খবর নেয়ার স্বভাব আছে, আসলে ক্লান্ত শরীরে একা একা ফেরার পথে একটু মনোরঞ্জন বা সময় কাটানোর লোভেই এদিকে ওদিকে চোখ চলে যায় এমনি । যায় হোক আসল কথায় আসি, পাশে থাকা যুবকটি একটি মেয়ের সাথে বেশ হাসিঠাট্টার কথা বলছে, অন্তত নাম দেখে তাই বুঝলাম। আবার পরক্ষণেই আরেকটা ছেলের সাথে কথা বলল, কত সাবলীল ভাবে একই সময়ে একাধিক ব্যক্তির সাথে কথা বলা যায়, আবার মনের ভাব প্রকাশ করার জন্যে ঐ যে বদনসংকেত প্রকাশ করা যায়। আবার চোখ দুটো ট্রেনের এদিকে ওদিক ঘোরালাম, দেখি বেশিরভাগ যুবক যুবতী হয় ফোনে ব্যস্ত না হয় নিজের বন্ধুবান্ধবদের সাথে কথায় ব্যস্ত, সত্যি বর্তমান সময়ের যোগাযোগ মাধ্যম মানুষের একে ওপরের কাছে পাওয়াটাকে কত সহজ করে দিয়েছে। হাতে থাকা ফোনেই আজ কত সম্পর্ক বদ্ধ।

 

আর আমাদের সময় হত দিনের শেষে , সপ্তাহের শেষে আড্ডার ঠেক, নাহলে চিঠি টেলিফোন বাড়িতে তো অনেক পরে, যেখানে দাঁড়িয়েও ঘন্টার পর ঘন্টা নিজের কথা বলা যেত না। যৌবনের সেইসব আড্ডার কত স্মৃতি এখনো মনে আছে, কারণ আমাদের তো এত কথা বলার বা সবার সাথে সবসময় যোগাযোগ রাখার সুযোগ ছিলোনা। আমাদের কাছে সম্পর্ক প্রতিস্থাপন করাটা হয়তো এত সহজ ছিলোনা, কিন্তু চাইলেও কোনো সম্পর্কে সহজে দূরেও করতে পারতাম না যোগাযোগ ব্যবস্থার প্রতিকূলতার জন্যেই হয়তো সম্পর্কের মূল্যটা বুঝতাম যেটা হয়তো এখন অনেককে বুঝতে দেখি না এই যোগাযোগ ব্যবস্থার এত সহজতার জন্যেই হয়তো

 

ট্রেন সোদপুর ছাড়লো, দেখলাম এক যুগল ট্রেনে উঠলো।  আমার প্রেমিকার কথা মনে পড়লো, অবশ্য সে আমার সাথে বেশীদূর যেতে পারেনি, একপ্রকার বেকারত্ব ও আর্থিক প্রতিকূলতার কারণেই তবুও সেই তার সাথে সম্পর্ক স্থাপন করতে কত যে চিঠির আশ্রয় নিতে হয়েছে সেটা আমার কলমগুলোই জানে। কলেজে পড়াকালীন এক বান্ধবীর হাত দিয়ে প্রথম চিঠি দিই, ক্রমাগত তিনটে চিঠির পর ওদিক থেকে উত্তর আসে, তারপর সম্পর্ক চলে, এবং চিঠির মাধ্যমেই অনেক কথা হয়, কারন সেই সময় মেয়েরা এত সহজে বাড়ির বাইরে বেরোতে পারতো না, তাই অগত্যা পড়ার সময় যেহেতু দেখা না লুকিয়ে চুরিয়ে কিংবা চিঠি লিখে সেটা কারোর হাত দিয়ে পাঠানো আবার কখনো  কাগজে লিখে সেটার মধ্যে ঢিল বেধেও বাড়ির ভেতরে ছোড়া, চিঠি সত্যই তখন একপ্রকার সেতুবন্ধন, মানে তখন সম্পর্ক টিকিয়ে রাখতে গেলে তার অনেক মূল্য দিতে হত। এখন এসবের অভাব দেখি আমি অনেক জুটিতে, তবে অনেক জুটিও দেখেছি যাদের দেখলে আমাদের সময়ের কথাও মনে পরে যায়। এখন কোনো ভাবে পছন্দের মানুষের নাম্বার পেলেই কেল্লাফতে, দুবেলা কথাতো বলা যাবে অন্তত, মনের ভাব প্রকাশ করা যাবে। রাগ হলে একাউন্টের ছবি ডিলিট করা যাবে, আবার প্রেম হলে নামি অনেকে আবার ফেসবুকে স্ট্যাটাস দেয়, আমাদের সময় সবই ছিলো চিঠি ভিত্তিক, বাড়ির টেলিফনে প্রেম সংক্রান্ত কোনো কথা বলাও একটা ভয়ের ব্যাপার ছিলো আমাদের কাছে।

 

 

তারপর বিয়ের পরেও বৌ যখন বাপের বাড়ি তখন তাকে চিঠি লেখা, বা আমাকে কাজের সূত্রে বাইরে যেতে হয়েছে তখন চিঠি লেখা বা তার গলার আওয়াজ শোনার জন্যে টেলিফোনের ৫ মিনিটের কথা এখনো আমার স্মৃতিতে অমলিন, আর এখন কত সহজ, আমার ছেলে বাইরে গেলেই কত সহজেই ফোনে বা ভিডিও কলে কথা হয় ঘন্টা ধরে

 

আমার জীবনের সব থেকে প্রিয় দুটো চিঠি হল আমার বর্তমান চাকরির জয়েনিং লেটার , আমার কাজের সূত্রে কয়দিন শিলিগুড়ি থাকাকালীন একটা চিঠি পাই যেখানে জানতে  পারি আমার স্ত্রী গর্ভবতীযেই দুটো চিঠি এখনো হয়তো আমার ফাইলে কোথাও খুজলে পাওয়া যাবে। যখন জানতে পারি সে গর্ভবতী তার মুখখানি দেখার জন্যে ভেতর থেকে এত কাতরাচ্ছিলাম সেই দিন ভোলার না। আর এখন এই জাতীয় কোনো সুখবর হলেই সঙ্গে সঙ্গেই জানা যাবে, আর নিজের মানুষের মুখ দেখার জন্যেও ছটফট করতে হয়না। কখনো কখনো মনে এই আধুনিকতা মানুষের সম্পর্কগুলোকে কত কাছে নিয়ে এসেছে, যেখানে আগে কোনো চিঠি লিখলে তা পেতে পেতে দুদিন চারদিন দশদিনও লেগে যেতো একএক জায়গায়। টাটকা অনুভূতি সঞ্চারনের অভাবটা সেই সময় একটা আক্ষেপের জায়গা, অবশ্য সেই প্রথার এখন বিলোপ ঘটেছে এবং এটা অনেক বড় একটা জয় প্রতিটা সফল সম্পর্কের পেছনে, সেটা সুখ হোক বা দুঃখ, ভালো হোক বা খারাপ ।

 

ট্রেন নৈহাটি ছাড়লো, ভীড় হালকা হল হঠাৎ ট্রেনের এক বই বিক্রেতা হকারকে দেখে মনে পড়ে গেলো রানারের কথা হ্যা আমি জীবদ্দশায় রানার দেখিনি তবে শুনেছি, আর চিঠির কথা যখনই উঠবে তখনই উঠবে রানারের কথা, যারা রাত দুপুরের হাতে লন্ঠন নিয়ে পিঠের ঝোলাতে মানুষের সুখ দুঃখের খবর বিলি করে বেরাতো, নিজের জীবনের পরোয়া না করেই আমার বাবা এক রানারের কথা বলতেন তাকে অবশ্য কোনোদিন আমি দেখিনি তবে শুনেছি সেই রানার নাকি বাবাদের স্বাধীনতা আন্দোলনের সময় অনেক সাহায্য করেছেন বিভিন্ন চিঠি পৌছে দিতে, কারন বাবা বা তাদের লোকেরা সব জায়গায় সব সময় যেতে পারতো না, তাই রানারের হাত দিয়েই বিভিন্ন গোপন চিঠি পৌছানো হত

 

ট্রেন বারবার হর্ন দিচ্ছে যার কারনে আমার ভাবনাতেও ব্যাঘাত ঘচ্ছে মাঝে মাঝেতখন পাশে অনেকে বর্তমান শাসকদলের নিন্দাপ্রশংসায় মত্ত এ জিনিস নিত্য দিনের ট্রেনের মধ্যে কিছু আলোচনা হয়েই থাকে চিরকালের তার মধ্যে পরে পলিটিকাল আলোচনা, কেউ বিষয়ের গভীরতা বুঝুক না বুঝুক, বুলি সবাই আওড়ায়

এই ভাবতে ভাবতে আমার যৌবন ও পরবর্তী জীবনে রাজনীতির কথা মনে পড়ে গেলো, আমি তখন পার্টি ক্যাডার কত চিঠি এদিক ওদিক করতে হয়েছে।

দাদার মুখে শোনা, তখন সাল ১৯৬০ বাংলার রাজনীতিতে খাদ্য আন্দোলনের দায়ে তালমাতাল অবস্থা, তাদের সংগঠন করার জন্য কত গোপনীয় ঠিকানা আশ্রয় নিতে হয়েছে, বারবার কত গোপন চিঠি পারাপার করতে হয়েছে জীবনের ঝুকি নিয়ে, কত সংগ্রামের সম্মুখীন তারা ঠিক একই ঘটনা ঘটলো আবার ১৯৬৮-১৯৭২এর ছাত্র আন্দোলনে, কিছুটা বড় হয়েছি, বুঝতে শিখেছি দাদার লেখা ও দাদার কাছে আসা কত চিঠি পরেছি, গায়ে কাটা দিয়ে ওঠে এখনো ভাবলে সেই চিঠির কি দাম, কত আগুন জ্বালিয়েছে তারা, সেই  চিঠি শুধু প্রেমালাপ বা সম্পর্ক প্রতিস্থাপন না, এভাবেই কত বিপ্লবের জন্ম দিয়েছে, মানুষকে পথ দেখিয়েছে তখনকার দিনের চিঠি

এখন সেই সব জিনিসের অভাব খুজে পায়, ছেলেমেয়েরা নিজেদের অধিকারের লড়াই এখনো চালাচ্ছে, চিঠির বদলে এসেছে জিমেল, পিটিশন বা অন্যান্য আরো তবুও কোথায় যেন এরা সেই চিঠির আগুনকে ছুতে  পারছে না হাঁ, মিডিয়ার অনেক ক্ষমতা, কিন্তু সেই দিনের চিঠি গুলোর কাছে মাঝে মাঝে ফিকে মনে হয়। 

হাঁ, এটার একটা নেগেটিভ আছে, যেমন এখনকার দিনের মত তখন সংগ্রামের বার্তা মানুষের কাছে পৌছাতো না, বা সোশ্যাল মিডিয়ার মত এর ছড়াতে পারতোনা তখন চিঠি যেমন সবাই সবাইকে দিতে পারতো না, এখন আবার জিমেলে এই সুবিধা হয়েছে কিন্তু কতক্ষেত্রে সেই জিমেল ওপেন করে মানুষের দাবি দেখা হয় সেটাই জানা দরকার

 

রবীন্দ্রনাথ, নেতাজি, ভগত সিং, মাস্টারদা এবং তাদের সহকর্মীদের কত চিঠি, আমাদের বাঙালি জাতির গর্ব সেইসব চিঠি আজ হ্যা হয়তো আজকের দিকে থাকলে সেইসব বার্তা বেশি ছড়াতে পারতো, অবশ্য সেটাও নির্ভর করছে বর্তমান প্রজন্মের সমাজের প্রতি দায়বদ্ধতার ওপর

 

এসব ভাবতে ভাবতে ট্রেন কল্যানী ছাড়লো, দেখি বাড়ি থেকে ফোন করেছে কোথায় আছি জানার জন্যে। এখন কত সহজেই খোঁজ নেয়া যায়, দূরের আত্মীয়দের সাথে কথা বলা যায়, আর আমাদের সময়? সে ত আশা করি বুঝেই গেছেন ওপরের লেখা গুলো পরে।

 

আসতে আসতে সিট ছেড়ে এগোতে লাগলাম, সাথে ভাবনাগুলো মিলিয়ে যেত লাগলো, গেটের সামনে হাওয়াতে একটু ফুরফুরে লাগলো।

 

ট্রেন আমার স্টেশনে ঢুকছে, স্টেশনে নামলাম, হাটতে হাটতে সমীরকে একটা ফোন লাগালাম, কাল আসবে কিনা, বলল আসবে। আমার কাছ থেকেও আজকের অফিসের খবর নিয়ে নিলো। বাড়ি ঢুকলাম, নাতি এসে দরজা খোলে প্রতিদিন।

আধুনিকতার ধাঁচে যাতে সম্পর্কগুলোকেও নতুন মোড় দেয়া যায়, সেটাই এই বর্তমান প্রজন্মকে বুঝতে হবে, কারন তারাও একদিন বুড়ো হবে, আমাদের মত তারাও এই সময়টাকে মনে করবে।

কোনো কাজ বা লক্ষ্যের প্রতি পৌছানোর পদ্ধতি সহজ হতে তাকে তাহলে সেখানে গা ছেড়ে না দিয়ে বরং সেটাকে আগের মত এফোর্ট দিয়েই এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে। আমাদের সময় চিঠির যেই গুরুত্ব ছিলো সেটা প্রেম হোক বা রাজনীতি, বাবা-মাকে মিস করা হোক বা ছোটবেলার বন্ধুর সাথে স্মৃতিচারণ ,সেই গুরুত্ব এখনো একই আছে শুধু পদ্ধতিতা পালটে গেছে, তাই কোনো বিষয়ের ক্ষেত্রেই গাফিলতি না দিয়ে আগের মতই চালিয়ে নিয়ে যেতে হবে। আর চিঠির গুরুত্ব কোনোদিনই কমবে না, হয়তো সেটার রূপ পরিবর্তন হতে পারে। তাই চিঠি হোক বা জিমেল, সোশাল মিডিয়া সময়ের সাথে সাথে সবকিছুর পরিবর্তন ঘটে, কিন্তু এই পরিবর্তনের ফাকে যেন নিজেদের পরিচয় আর সমাজের প্রতি দায়বদ্ধতার পরিবর্তন না হয়ে যায় সেটা খেয়াল রাখতে হবে।

--------------------------


ঋতম সাহা,

চাকদহ, নদীয়া। 


Post a Comment

0 Comments
* Please Don't Spam Here. All the Comments are Reviewed by Admin.