রবিবার বিকেলে নন্দিতা রাজেশকে বললেন, তুমি যে বলেছিলে রিয়ার জন্য হীরের আংটি কিনতে টাকা দেবে। তার কি হলো ?
হ্যাঁ, বলেছি যখন তখন তো দেবই।
কবে দেবে ? আজ তো রবিবার। আজ দেবে কী ?
আজ - ই।
হ্যাঁ,
আজ তো রবিবার। টাকা দিলে ভালো হয়। অন্নপূর্ণা জুয়েলারি হীরের গয়না
কেনার উপর ভালো অফার দিচ্ছে। আজ বিকেলেই যাব।তোমার তো আবার সময় হবে না।
মাছ ধরতে যাবে বন্ধুদের সাথে। রোজ রোজ কি যে মজা পাও জানিনে। নেশা বটে
তোমার। রোববার ছুটির দিনেও তোমাকে যদি কোনো কাজে পাওয়া যায়।
তোমার
আর জেনে কাজ নেই। টাকা নিয়ে এসেছি। বের করে দিচ্ছি। দেখে শুনে যাচাই করে
নিও। হীরের আংটি বলে কথা। আজকাল যা সব ফ্রট হচ্ছে চারদিকে। নন্দিতাকে
সাবধান করে রাজেশ আলমারি খুলে মানিব্যাগ বের করে দেখেন দশ হাজার টাকার
প্যাকেটটা একেবারে খালি। যে টাকার প্যাকেটটা কন্ট্রাকটর কাঞ্চন সেন তাকে গত
সপ্তাহে দিয়েছিল। টাকা তো অফিসের আলমারিতে রাখা ছিল। তাহলে সে টাকা গেলো
কোথায় ?
তিনি
অবাক হয়ে ভাবেন, টাকা কি আমি কাউকে দিয়ে দিয়েছি। কাকে দিতে পারি ? এই
জিজ্ঞাসায় রাজেশ ভাবতে থাকেন আজ কাল পরশুর মধ্যে হয়তো কাউকে কোনো পেমেন্ট
দিয়েছি। কিন্তু কাকে যে তিনি দশ হাজার টাকা দিয়েছেন সেটা মনে করতে পারেন
না কিছুতেই। শেষে অনেক ভাবনার পর তাঁর মনে পড়ে ওই দশহাজার টাকা কী তাহলে
তিনি স্বপ্নাকে দিয়েছেন ভুল করে।
মানিব্যাগ হাতে মুহূর্তের জন্য হতবাক হয়ে দাঁড়িয়ে থাকার জন্য নন্দিতা তাঁর কাছে গিয়ে বলেন, কি হলো, টাকা দাও।
নন্দিতার তাগাদায় চটজলদি উপস্থিত বুদ্ধিতে রাজেশ বলেন, টাকা তো তোমাকে এখন দিতে পারছি না।
কেন দিতে পারছ না ?
পুরো টাকা এখন আমার কাছে নেই। দশহাজার কম আছে।
কম আছে মানে ? তোমার কথা তো আমি কিছুই বুঝতে পারছি না।
না
বোঝার কিছুই নেই। ওই টাকা রাখা আছে অফিসের আলমারিতে। নিয়ে আসতে ভুলে
গেছি। তুমি বরং সোমবার সন্ধার পরে যেও। আগে একবার মনে করিয়ে দিও। তাহলে
আমার আর ভুল হবে না।
নন্দিতা পরাশরের কথা মেনে নিয়ে বলেন, ঠিক আছে কি আর করা যাবে। সোমবার আমি তোমাকে মনে করিয়ে দেব।
পরাশর
নন্দিতাকে ম্যানেজ করতে পারলেও নিজেকে বোঝাতে পারেন না। তার এত বড় ভুল তো
হবার কথা নয়। আগে কোনদিন হয়নি। সত্যি কি তিনি ভুল করে একশো টাকার পাঁচ
খানা নোটের বদলে দু ' হাজার টাকার পাঁচ খানা নোট স্বপ্নাকে দিয়ে দিয়েছেন।
এ রকম ভুল তো তাঁর হবার কথা নয়। স্বপ্না কি যাদু জানে, না অন্য কোনো
দুর্বলতা। সেই রাতে তো লোড শেডিং ছিলো। কমজোরী মোমের আলোয় তাড়াতাড়ি করতে
গিয়ে হয়তো এমন একটা ভুল করেছেন। সেই লোডশেডিংয়ের অন্ধকারে কেনই বা
স্বপ্নাকে টাকা দিতে গেলেন ! সেই রাতে আলো ছিলো না ।কিন্তু আকাশে বসন্ত
পূর্ণিমার মায়াবী চাঁদ ছিলো। আর কন্ট্রাকটর কাঞ্চনের জন্য অপেক্ষা
করছিলেন। কাঞ্চন তাকে গাড়িতে করে কোনো রেস্টুরেন্ট কাম বারে নিয়ে যাবে
বলেছিল। তিনি কাঞ্চনের জন্য অপেক্ষা করছিলেন । এমন সময় একেবারে বেসামাল
হয়ে আলুথালু বেশে স্বপ্না এসে পড়েছিল। কেঁদে কেটে সে তার একমাত্র ছেলে
বাবলুর চিকিৎসার জন্য চাঁদা চাইতে আসে।
স্বপ্না অনেকদিন থেকে এই অফিসের স্টাফদের কাছে মশলা - পাতি, চানাচুর, আচার আরো এটা সেটা বিক্রি করে।
দেখে
বোঝা যায় না যে সে সধবা না বিধবা না স্বামী পরিত্যক্তা। একমাত্র ছেলেই
তার আশা ভরসা। সেই ছেলের পেটে অসহ্য ব্যথা। যন্ত্রণায় ছট ফট করছিল দেখে
পাড়ার ক্লাবের ছেলেরা তাকে তাদের এক পরিচিত ডাক্তারের নার্সিংহোমে ভর্তি
করে দিয়েছে। ক্লাবের ছেলেরা বলেছিল, বৌদি আমরাই টাকার ব্যবস্থা করে দেব।
পরে আবার বলেছে, বৌদি আমরা যা পারি চাঁদা তুলে দেব। তবু আপনি আমাদের ভরসায়
চুপ করে বসে থাকবেন না। আপনার চেনা জানা পরিচিতদের কাছে যান। যার কাছ থেকে
যা পান চেয়ে চিনতে টাকার জোগাড় করুন। পলাশ ডাক্তার বলেছেন, অপারেশন করতে
হবে। তাতে অনেক টাকা লাগবে। আর টাকা ছাড়া পলাশ ডাক্তার আপনার ছেলেকে
অপারেশন টেবিলে তুলবে না। দিন দিন কেমন যেন অমানবিক হয়ে যাচ্ছে। হয়তো
আমাদের কথা এখন শুনবে না। ক্লাবের ছেলেদের কথায় স্বপ্না বেরিয়েছিল তার
একমাত্র ছেলেকে বাঁচানোর জন্য টাকার জোগাড় করতে । প্রথমেই যায় তার একান্ত
ভরসায় জায়গা রাজেশের কাছে।
স্বপ্না
এই অফিসে প্রথমে আসে সিকিউরিটি চাঁদের শরণাপন্ন হয়ে। ফর্সা, রোগা,
ঢ্যাঙা মত চেহারা। ঢিলেঢালা শার্ট - প্যান্ট পরা বাঁহাতের তালুতে খৈনি ডলতে
ডলতে স্বপ্নাকে একেবারে সোজা রাজেশের চেম্বারে নিয়ে গিয়েছিল চাঁদ।
বলেছিল,
বাবু, এ স্বপ্না ভাবী বহুত ভালো ঘি, মধু, আচার আর মশলা বিক্রি করে। আপনি যদি
এই ভাবির থেকে ঘি, মধু , আচার নেন তো খুব ভালো হয়। আপনি নিলে আমি বাকি
সকলকে বলিয়ে দিব ভাবির থেকে নিতে।
শুধু স্বপ্না বৌদি নয়। এইভাবে এই অফিসে কোনো কিছু বিক্রি করার পারমিশন পায় সবাই।
সেদিন
চাঁদের কথায় রাজেশ বাবু স্বপ্নার পা থেকে মাথা পর্যন্ত জরিপ করে চাঁদের
দিকে তাকিয়েছিলেন। চাঁদ কিছু একটা ঈশারা করেছিল।তারপর রাজেশ স্বপ্নাকে
বসতে বলেছিলেন। তারপর থেকে স্বপ্নার রাজেশের অফিসে যাওয়া আসা চলতে থাকে ঘি,
মধু, আচার সহ আরো হরেক রকম দ্রব্য সামগ্রী নিয়ে।
প্রথম
প্রথম তো স্বপ্নাকে দেখে বোঝা যেত না যে সে সধবা না বিধবা, না স্বামী
পরিত্যক্তা। জিজ্ঞাসা করলে বলতে চাইত না। পরে চাঁদের কাছ থেকে অনেকেই জানতে
পরে যে, স্বপ্নার স্বামী থেকেও নেই।
বাংলা
দেশে স্বপ্না র শ্বশুর বাড়ির অবস্থা খুবই সচ্ছল। নিকট আত্মীয় স্বপ্না র
বাবার অকাল প্রয়াণের পর স্বপ্না পলাশদের বাড়িতে পরিচারিকার কাজে আশ্রিতা
ছিল। পলাশ স্বপ্নাকে ভালোবেসে বিয়ে করে ইন্ডিয়াতে চলে আসে। কিন্তু
রেডিমেড কারখানায় কাজ করতে করতে সে স্বপ্নাকে স্বপ্ন দেখায় দেশের বাড়ি
থেকে টাকা এনে সে নিজেই একটা রেডিমেড কারবার শুরু করবে। নাম দেবে "
স্বপ্না গার্মেন্টস " । স্বপ্না র সেই স্বপ্নকে রূপসার জলে বিসর্জন দিয়ে
পলাশ তার বাবার পছন্দ করা পাল্টি ঘরের একমাত্র মেয়ে সুমনাকে বিয়ে করে ঘর
জামাই থেকে যায়। শ্বশুরের টাকায় রেডিমেড কারখানা করে সে এখন ওপারে বেশ
আছে।
আর
এপারে স্বপ্না ছেলেকে বাঁচাতে প্রথমে সে আবার পরিচারিকার কাজ শুরু করে।
পরে নিজের সিদ্ধান্তে সে এই কারবারে নামে। শুরু করে সে বাড়ি বাড়ি গিয়ে।
পরে অফিসে অফিসে।যোগাযোগের পরিধি বাড়তে থাকলে ঘি, মধু, আচারের সঙ্গে স্বপ্না মশলাপাতি ও আরো এটা সেটা বিক্রি করতে শুরু করে।
রাজেশ
বাবুর অফিসে এইরকম একটা ঘটনা ঘটে যাবার পর রাজেশ বাবু স্বপ্না র উপর ভীষণ
রেগে যান। তিনি পরদিন অফিসে গিয়ে চাঁদকে ডেকে কড়া মেজাজে বলেন, চাঁদ তুমি
বলো, ওই কেপমারী স্বপ্না র কাছ থেকে তুমি কত টাকা হিস্ - সা নিয়েছ ?
আজকের পর থেকে অফিসে সব ফেরিওয়ালাদের প্রবেশ বন্ধ। যতসব ঠগ, জোচ্চোর আর
কেপমারির আড্ডা। বলো, তোমার স্বপ্না ভাবী কোথায় কোন বসতিতে থাকে। তুমি
আমাকে তার বাড়ি নিয়ে চলো। ওকে আমি পুলিশে দেব। ও ভেবেছে কী?
রাজেশ
বাবুর কাছে আদ্যপান্ত সব কথা শোনার পর চাঁদ বলে,আপনি এ কী বাত বলছেন বড়ো
বাবু। আপনি জানেন ভাবির একমাত্র ছেলে বাবলু মারা গেছে। ঠিক সময়মতো টাকার
জোগাড় করতে পারেনি বলে ও ডাক্তার কোনো চিকিৎসা করেনি।
ওসব কোনো বাহানা আমি শুনতে চাই না চাঁদ। তুমি যেখান থেকে পার ধরে নিয়ে এসো তোমার ভাবীকে। আমার টাকা ফিরিয়ে দিয়ে যাক। না হলে ....
আপনার টাকা....
হ্যাঁ, আমার টাকা। দুই একশ নয়। দশ হাজার টাকা। হজম করতে পারবে না।
সেই
কথা বলবেন তো। এই নিন। ভাবী আপনার সব টাকা ফিরিয়ে দিয়ে গে ই চে। এই নিন
আপনি। বলে, চাঁদ তার প্যান্টের পকেট থেকে রাজেশ বাবুর পুরো দশ হাজার টাকা
বের করে টেবিলের উপর রেখে দিয়ে বলল, ভাবী সকালে এসে আপনার টাকা ফিরিয়ে
দিয়ে বলে গে ই চে চাঁদু ভাই, আমার বাবলুকে যখন বাঁচাতেই পারলাম না তখন আর
এই টাকা দিয়ে আমি কি করব। এই টাকা তুমি রেখে দাও। বাবু এলে দিয়ে দিও। উনি
ভুল করে আমাকে অনেক বেশি টাকা দিয়েছেন। বড়বাবুর মত ভালো মানুষ হয় না।
স্বপ্না
র ছেলে মারা গেছে বিনা চিকিৎসায়। চাঁদের কাছে সে কথা শোনার পর রাজেশ বাবু
টেবিলে রাখা টাকার দিকে তাকিয়ে থাকেন অদ্ভুত দৃষ্টিতে। তাঁর মনে পড়ে
সদ্য সন্তান হারা মায়ের কথা। বুকের ভিতরটা কেমন মোচড় দিয়ে ওঠা
যন্ত্রণায়। মুহূর্তের জন্য তিনি কেমন যেন হয়ে যান। বার বার তাঁর চোখের
সামনে ভেসে ওঠে পুত্রহারা শোকসন্তপ্ত স্বপ্না। যে সন্তানকে বাঁচানোর জন্য
কত আকুলি বিকুলি কান্নায় ভেঙে পড়েছিল সে। কিন্তু তাঁর সে ভাবনায় বাঁধা
পায় টেবিলে রাখা টেলিফোন বেজে উঠতে ই। চটজলদি রিসিভার তুলে তিনি নন্দিতার
গলা শুনতে পান।
হ্যালো, তুমি অফিসে পৌঁছে গেছ ?
.......
হাই, হ্যালো অফিসের আলমারিতে টাকা পেয়েছ ? ........আজ একটু তাড়াতাড়ি
বাড়ি এসো। তুমি এলে আমি রিয়ার হীরের আংটি কিনতে যাব অন্নপূর্ণা
জুয়েলার্সে।
ছবিঋণ- ইন্টারনেট ।
.............................