অনারিয়াম
অনিন্দ্য পাল
"নারান এসে গেছে, এই লাল্টু পড়তে বসে যা। একদম দেরি করবি না।" -- কথাগুলো বলে সাইকেলটা নিয়ে বেরিয়ে গেলেন নটরাজ। আজ তার নাইট ডিউটি। পাঁচটার ট্রেনটা ধরতেই হবে।
নারান, ঠিকঠাক উচ্চারণ করলে নারায়ণ, লাল্টুর গৃহ শিক্ষক। মাস ছয়েক হল পড়াচ্ছে। লাল্টু ক্লাস এইটের ছাত্র। ওর বিজ্ঞান বিভাগটা দেখায় নারান। মাসে দুশো টাকা মাইনে। নটরাজ প্রতিমাসের পাঁচ তারিখে আগের মাসেরটা দিয়ে দেবার সময় বলেন, "তোমার অনারিয়ামটা "। নারান প্রথম মাসে বুঝতে পারে নি। বন্ধুদের সঙ্গে আলোচনা করে জানতে পেরেছিল, ভদ্রলোকেরা ওই টাকাটাকে "মাইনে" বলে না, "অনারিয়াম" কিংবা সাম্মানিক বলে। সেই প্রথম নারায়ণ নিজেকে সম্মানিত মনে করেছিল।
--আসুন স্যার।
লাল্টু ওদের বাড়ির সামনের মাঠে বন্ধুদের সঙ্গে ক্রিকেট খেলছিল। বাবার ডাক শুনে চলে এসেছে, এবার হাত-পা ধুয়ে পড়তে বসে যাবে। ভালো ছাত্র লাল্টু। ওর সঙ্গে নারায়ণের সম্পর্কটাও খুব ভালো। বারান্দায় রাখা বালতি থেকে মগে করে জল নিয়ে পা ধুয়ে চৌকির উপর বসলো নারায়ণ। কিন্তু বসতেই একটা চাপ অনুভব করে তলপেটে -- অনেকক্ষণ ধরে চেপে রাখা তরল পদার্থ শরীর ত্যাগ করে বেরোনোর জন্য আকুল হয়ে উঠেছে। টয়লেটে যেতেই হবে একটু, নাহলে পড়াতে পারবে না। কিন্তু এই সব ভাবতে ভাবতেই লাল্টু বইপত্র নিয়ে এসে বসে পড়লো। বেশ অস্বস্তিতে পড়লো নারায়ণ।
ঘন্টা দুয়েক পড়ায় নারায়ণ। এক ঘন্টা অঙ্ক, তারপর ভৌতবিজ্ঞান, জীবনবিজ্ঞান। আজ অঙ্ক প্রায় শেষ হয়ে এসেছে, "হাইট- এন্ড - ডিসট্যান্স" এর শেষ অঙ্কটা করছে লাল্টু, ওটা হয়ে গেলেই আজকের মত অঙ্ক শেষ।
এবার খানিকটা মরিয়া হয়ে উঠলো নারায়ণ। লাল্টুর অঙ্কটা শেষ হয়ে যেতেই ওকে বললো,
-- লাল্টু, আমি একটু টয়লেটে যাবো। কোন দিকে গো?
লাল্টু কয়েক মুহূর্ত তার দিকে তাকিয়ে দেখলো, তারপর মুখটা হাসি হাসি করে বললো,
-- ওই তো স্যার, কিচেনের পাশ দিয়ে চলে যান, একদম শেষে, লাল দরজা।
নারায়ণ একটু ইতস্তত করে চৌকি থেকে নেমে এগিয়ে গেল বাথরুমের দিকে।
বেশ বাঁধানো বাথরুম। টাইলস গুলো বেশ চোখ টানে।
টয়লেট করে একটু হালকা হতেই সঙ্গে সঙ্গে বেশ খিদের অনুভূতি হল নারায়ণের। একটা প্রাইভেট স্কুলে পড়ায় নারায়ণ। সকাল দশটা থেকে চারটে চল্লিশ পর্যন্ত হাড় ভাঙা খাটুনির পর শরীরটা অবসন্ন হয়ে আসে, খিদেও পায় খুব। বাড়ি ফিরে একগাল মুড়ি আর এক কাপ চা খায়। তারপর আবার সন্ধ্যায় বসে চাটাই পেতে। জনা দশেক আসে পড়তে। তবে সংখ্যা যাই হোক, এই পাড়া-গাঁয়ে 'মাইনে' খুবই কম। তার উপর সবাই যে দেয় তাও নয়। অনেকে তিন মাস পর এক মাসের দেয়। নারায়ণ কখনো এই নিয়ে কোন ছাত্রছাত্রী কে কিছু বলতে পারে নি। তার এই লাজুক স্বভাবের জন্য অনেক প্রাপ্যই হাতছাড়া হয়ে গেছে।
বাথরুম থেকে বেরিয়ে জামাটা একটু ঠিক করে নিয়ে আবার ফিরে আসছিল নারায়ণ। রান্নাঘরের ঠিক পাশে আসতেই কানে এল মৌলি বৌদির গলা। ফোনে কথা বলছেন বোধ হয়। রান্নাঘরের দরজাটা পেরোতেই কানে এল,
-- না, নারন পড়াতে এসেছে তো। তোমাকে কতবার করে বলে দিলাম চা পাতা নেই, শেষ হয়ে গেছে, তুমি এত ভুলো যে ভুলেই মেরে দিয়েছ।
ওপাশ থেকে কেউ একজন কিছু বললো, সেটা আর নারায়ণের কানে গেল না, ও পা বাড়াতে যাবে, ঠিক তখনই কানে এল মৌলি বৌদির গলা,
-- না, সে নারানকে আমি চা দিয়ে এসেছি। সকালের চা করার পর ফোটানো পাতা গুলো রেখে দিয়েছিলাম। ওটাই ফুটিয়ে দিয়েছি ওকে। নারানকে তো ওভাবেই দিই রোজ, ওকে নিয়ে চিন্তা নেই কিন্তু কাল সমরবাবু আসবে বিকেলে, ওনাকে তো এরকম দেওয়া যাবে না, কাল সকালে ফেরার সময় অবশ্যই চা পাতা নিয়ে আসবে মনে করে।
সম্ভবতঃ ফোনটা কেটে গেল। নারায়ণ অনুভব করলো ওর কান দুটো ক্রমশ গরম হয়ে উঠছে।
ফিরে এসে চৌকিতে বসে নারায়ণ দেখলো তার সামনে এক কাপ ধূমায়িত ধূসর রঙের চা।
গলার কাছটা কেমন যেন তেতো হয়ে গেল নারায়ণের।
-- এই নাও নারান, তোমার 'অনারিয়ামটা'। আজ পাঁচ তারিখ, কিন্তু দাদা তো তাড়াহুড়ো করে বেরিয়ে গেছে, তোমাকে দিয়ে যেতে পারে নি।
মৌলি নারায়ণের হাতে একটা সাদা খাম ধরিয়ে দিয়ে আবার রান্না ঘরের দিকে পা বাড়িয়েও একটু থমকে দাঁড়াল। পিছন ফিরে বললো,
-- নারান চা টা তাড়াতাড়ি খেয়ে নাও, ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে।
নারায়ণ ঝাপসা চোখে দেখলো, তার " অনারিয়াম" এক কাপ ধূমায়িত চায়ের সঙ্গে গুলে গিয়ে একটা অত্যন্ত অদ্ভুত থকথকে দুর্গন্ধী তরল তৈরি করছে আর সেটা আস্তে আস্তে তাকে চার দিক থেকে গ্রাস করে নিচ্ছে।
ছবিঋণ- ইন্টারনেট ।
===========
অনিন্দ্য পাল
সোনারপুর , দক্ষিণ চব্বিশ পরগনা
পশ্চিমবঙ্গ।