Click the image to explore all Offers

গল্প।। রেডিও ।। কাকলী দেব


 

রেডিও

 কাকলী দেব 


নীতার একটা রেডিও কেনার খুব শখ। নিজের স্কুলের চাকরির যা মাইনে তাতে কোনও শখ বা বিলাসিতা আর সম্ভব হয়না। সে মেয়ে অন্ত প্রাণ ! তার একমাত্র পাঁচ'বছরের মেয়ে কে,সে যে কত যত্নে আর আদরে বড় করছে তা একমাত্র সেই জানে। সুশীল রাজনীতির কাজে আরও জড়িয়ে পড়ছে। সংসারে সামান্য টাকা দিয়ে, নিজের সিগারেট খাওয়া আর যাতায়াতের খরচাটুকু রেখে পুরো টাই পার্টির ফান্ডে দিয়ে দিচ্ছে। রেডিও র কথা কখনো বললে, সুশীলের কঠোর জবাব শুনতে হয়, "রেডিও কিনে কি হবে, ওসব বিলাসিতার মধ্যে কেন যাব?" 
নীতা ভাবে, তাহলে ভাড়া বাড়ি ছেড়ে এই সরকারী ফ্ল্যাটে উঠে আসা, সেটা ও কি সংগ্রামী রাজনীতির কাছে বিলাসিতা নয়? এই একটা কাজ নিজে উদ্যোগ নিয়ে সুশীল করেছে, এই ফ্ল্যাট টা জোগাড় করা!
একটু একটু করে কিছুটা টাকা জমেছে, একটা রেডিও এবার কিনে ফেলতেই হবে!কিন্ত সারা সকাল স্কুলের পরে দুপুরে বাড়ীতে এসে অনেক কাজ থাকে। সংসার টা গুছিয়ে করতে তার ভালই লাগে! তারপর  মেয়ে ছোট ,তাকে অনেক টা সময় দিতে হয়! মেয়েকে আদর করে, খুকুমনি বলে ডাকে আর ভাল নাম রেখেছে, 'মননীতা',নিজের নামের সঙ্গে মিল রেখে। এ পর্যন্ত লেখাপড়া শেখা, সব মা নীতার কাছেই। কাছের ভাল স্কুলে ভর্তি হয়েছে ক্লাস ওয়ানে। আগের পাড়ায় এক প্রাইমারী স্কুলে নার্সারি আর কেজি পড়েছিল। বিকেল, সন্ধ্যে, মেয়ের সঙ্গেই কেটে যায়।
মেয়ের স্কুলে ভর্তির আগের সময়টা, যখন সে আরো ছোট ছিল তখন, তার মর্নিং স্কুল বলে, বাড়ীতে না ফেরা পর্যন্ত সুশীলই সব দায়িত্ব হাসিমুখে পালন করেছে। মেয়েকে খুব ভালও বাসে, কিন্ত এখন এই বড় হওয়ার সময় যে বাবা মায়ের দায়িত্ব আরও বেড়ে যায়, সেটা ও বুঝতে পারছেনা। 
এক শনিবার স্কুলের ছুটি, নীতা ভাবল, বেশ বিকেল বিকেল বেরিয়ে নিউ মার্কেট গিয়ে রেডিও টা কিনে নিয়ে আসবে। মেয়ে র বেড়াতে যাবার খুশীতে তাড়াতাড়ি দুপুরের খাওয়া হয়ে গেল, নাহলে খাবার নিয়ে বসে থাকে। স্কুলের টিচার বন্ধুদের কাছে শুনেছে যে নিউ মার্কেটে খুব ভাল রেডিও র দোকান আছে। ওদের বেলেঘাটা থেকে আসতে দুবার বাস বদলাতে হল। এমনিতে তার মেয়ে খুব শান্ত, কিন্ত আজ মার হাত ধরে নিউ মার্কেট ঘুরতে ঘুরতে একবার এদিক, একবার ওদিক দৌড়ে দৌড়ে দেখছে!এত রকমারী চোখ ধাঁধানো দোকান ও এর আগে দেখেনি। অবশেষে বড় একটা ইলেকট্রনিক জিনিসের শোরুমে ঢুকল। কত যে জিনিস সেখানে! নীতারই অবাক লাগছে দেখে! কিন্ত ওর চাহিদা খুব স্বল্প, ক্ষমতা ও সীমিত!সোজা রেডিও র সেকশনে গিয়ে দেখতে চাইল! সেলসম্যান তাকে বিভিন্ন মডেলের গুনাগুন বোঝাতে লাগলেন। অনেক কটা দেখার পরে মাঝারি গোছের একটা রেডিও অবশেষে নীতার পছন্দ হল। এটা ওর সাধ আর সাধ্য দুটোই পূরণ করবে।নীতা দরদাম করতে পারেনা। 
দোকানের লোক বিল বানিয়ে দিলে নীতা দাম দিয়ে, পেছন ফিরে খুকুমনি কে খুঁজল! এতক্ষন এত মন দিয়ে রেডিও দেখাদেখি করতে গিয়ে আর মেয়ের কথা মনে নেই! খুব সামান্য সময় সেটা! মেয়ে তার কাছেই দাঁড়িয়ে ছিল। কিন্ত এখন কোথায় গেল!নীতা দোকানের ভেতরে চারিদিক দেখে মেয়েকে দেখতে না পেয়ে অস্থির হয়ে ওর নাম ধরে ডাকতে ডাকতে দোকানের বাইরে বেরলো, সবাইকে জিজ্ঞেস করতে লাগল, একটি লাল রঙের ফ্রক পরা মেয়েকে কেউ দেখেছে কিনা! নাঃ, কেউ বলতে পারছেনা। দোকানের কর্মচারীরা ও দৌড়াদৌড়ি শুরু করে দিয়েছে। সবাই ডাকছে, নাম ধরে, উৎকন্ঠিত হয়ে। কোথায় গেল বাচ্চা মেয়েটা? নীতা দোকানের সিঁড়ি তে বসে আছে মাথায় হাত দিয়ে, 'একি হল তার জীবনে, তার মেয়ে কি হারিয়ে গেল? এরকম তো সিনেমা গল্পে হয়, তার ই জীবনে হল? খুকুমনি কে ছাড়া তো নীতা বেঁচেই থাকবেনা। এই মেয়ের জন্য ই তার জীবনের সব আনন্দ! আর সুশীল কে কি করে মুখ দেখাবে? 'যখন এইরকম ভয়ে, হতাশায়, ব্যাথায় ,নীতার চোখ থেকে অঝোরে জল পড়ছে, চারিপাশে জড়ো হওয়া লোকেরা কেউ বলছে, পুলিশে খবর দিতে, কেউ বলছে, ছোট বাচ্চাদের চুরি করে সঙ্গে সঙ্গেই পাচার করে দেয়, তাকে খুঁজে পাওয়ার আশা বৃথা, তখন দূর থেকে একজন ভদ্রলোক একটি লাল জামা পরা মেয়েকে কোলে নিয়ে এদিকেই আসছেন। কে ও? নীতা দৌড়ে যায়, সৌম্য দর্শন মাঝবয়সী লোকটি, নীতার কোলে খুকূমনি কে দিয়ে বলেন, "খুব মিস্টি আর বুদ্ধিমতী মেয়ে আপনার! একটু ঘুরতে গিয়ে হারিয়ে গেছিল, কিন্ত কান্নাকাটি না করে চুপ করে ঐ দূরের কোনার দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে ছিল! আমার কীরকম সন্দেহ হওয়াতে এগিয়ে গিয়ে জিজ্ঞেস করি, এখানে একা কেন দাঁড়িয়ে আছে সে! কি সুন্দর, তখন গুছিয়ে বলল, "আমার মা আর আমি রেডিও কিনতে এসেছিলাম, মা যখন রেডিও কিনছিল তখন আমি সামনের পুতুলের দোকানে পুতুল দেখতে গেছিলাম কিন্ত তারপর আর ঐ রেডিওর দোকান টা খুঁজেই পাচ্ছিনা ।"
"ভাবুন, কি সাহসী মেয়ে আপনার, শুধু বিপদ টা তখনই হত, যদি কোনও বাজে লোকের নজরে পড়ে যেত! খুব ভাগ্য ভাল, তা হয়নি। "
মেয়ে কে বকবে কি, ওকে বুকে জড়িয়ে, বুকের ধকধক আওয়াজ টা বন্ধ করার চেষ্টা করল! ভদ্রলোক কে ধন্যবাদ দেবার ভাষা খুঁজে পাচ্ছেনা! চারিদিকের ভীড় কমে যেতে লাগল, কেউ বেশ হতাশ হয়ে গেল, একটা ভয়ঙ্কর পরিনতি খুঁজে পেলনা বলে! কেউ আবার সত্যিই তার আনন্দে খুশী হয়ে উঠল, মেয়ের গাল টিপে, মাথায় হাত বুলিয়ে অনেকে আদর করে দিল! সাহসিনী খুকুমনি এখন সব সাহস হারিয়ে ,মা কে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে, মার বুকে মুখ লুকিয়ে আছে। 
দোকানের লোকজন ও যেন নিশ্চিন্ত হল ,মালিক নিজে এসে রেডিও র বাক্স টা দিয়ে গেলেন। দাম আগেই দেওয়া হয়ে গ্যাছে । এবার তাড়াতাড়ি বাড়ী ফিরতে হবে। 
ভদ্রলোক তখনও পাশেই দাঁড়িয়ে আছেন। বললেন, "কিভাবে ফিরবেন, কোথায় যাবেন? আকাশের অবস্হা দেখছেন তো? বাস টাস পাওয়া মুশকিল হয়ে যাবে!"
নীতা এতক্ষন লক্ষই করেনি যে, কি ভীষণ কালো মেঘের ঘনঘটা আকাশে! দেখতে দেখতেই মুষল ধারে বৃষ্টি নামল! বুঝতে পারছে না কি করবে সে, নীতার চিন্তিত মুখের দিকে তাকিয়ে ভদ্রলোক, জিজ্ঞেস বলেন, আপনি এখানেই থাকুন, আমি দেখছি যদি কোন ভাবে ট্যাক্সি পাই!বৃষ্টির মধ্যেই ভিজে ভিজে উনি অনেক চেষ্টা করলেন, একটা ট্যাক্সিও এই দুর্যোগে বেলেঘাটা যেতে রাজী হলনা, ইতিমধ্যে ঘড়িতে দেখছে সাত টা বাজে! ভদ্রলোক বললেন, "আপনার রিকশায় যেতে আপত্তি নেই তো? রিকশা হয়তো যাবে। " নীতা বলে, আমাকে একটা রিক্সা ধরে দিন, তাহলেই হবে, আমি চলে যেতে পারব!" "না না, কি বলছেন, তাই হয় নাকি, এই দুর্যোগে ছোট বাচ্চা নিয়ে আপনার একা যাওয়া টা ঠিক হবেনা। আমি যাব, আপনাকে একেবারে বাড়ী তে পৌঁছে দেব।" 
নীতা নিজেও বুঝতে পারছে, কেউ একজন থাকলে সত্যিই খুব সুবিধা হয়! মেয়ে এখন কোল থেকে নামতেই চাইছেনা, একহাতে রেডিও র বাক্স! 'কিন্ত এই লোক টি কে তো সে চেনেই না! কোনও খারাপ লোক নয়তো! এত আগ বাড়িয়ে উপকার করতে চাইছে কেন?'
অবশেষে বেশী টাকার লোভ দেখিয়ে এক টা রিকশা জোগাড় হল! নীতা, মেয়ে কোলে উঠে বেশ দূরত্ব বজায় রেখে বসার চেস্টা করল,ভদ্রলোক উদাসীন ভাবে পাশে বসলেন, বললেন,বাক্স টা আমাকে দিন, আমি ধরছি। "সারা টা পথ তেমন বিশেষ কথা কিছু হলনা, আবহাওয়া আর কলকাতার বিরক্তিকর যানবাহন নিয়ে  কথা ছাড়া। মেয়ে তো প্রায় ঘুমিয়েই পড়ল!
যখন নিজের ফ্ল্যাট এর সামনে এসে পৌঁছাল তখন যেন নিঃশ্বাস ফেলে বাঁচল! ভদ্রতা করে বলল, "আসুন না বাড়ীতে, একটু চা খেয়ে যান " লোকটি স্মিত হেসে বললেন, "আপনি ঘরে যান, আমিও এখনই ফিরব, এই রিকশা তেই, আমার বাড়ী অবধি অবশ্য রিকশা যাবেনা, আমার বাড়ী বেহালায়!" 
সুশীল তখনও ফেরেনি, বোধহয় ঝড় জলে আটকে পড়েছে, মেয়ে ও ঘুম থেকে জেগে উঠে বলে, "মা,ঐ ভাল কাকু টা চলে গেল? আর আসবে না?"
স্তব্ধ হয়ে বসে থাকে নীতা,' মানুষ তাহলে আজও একেবারে নিঃস্বার্থ হয়?'
পরবর্তী কালে তার এত কষ্টের জমানো টাকা দিয়ে কেনা রেডিও টার দখল যখন শতকরা নব্বই ভাগ সুশীল আর দশ ভাগ,  মা মেয়ের ভাগে জুটল, তখন মাঝে মাঝে ঐ মানুষ টা র কথা, নীতার মনে পড়ত! উনি না আসলে, না তো নিজের মেয়ে কে ফিরে পেত, আর না হত রেডিও কেনা!

ছবিঋণ- ইন্টারনেট ।

 
-----------------------------

             কাকলী দেব , কলকাতা। 

Post a Comment

0 Comments
* Please Don't Spam Here. All the Comments are Reviewed by Admin.