হবিষ্যির ভাত রাঁধছে কঙ্কনা। চারটি ইঁট দিয়ে তৈরী অস্থায়ী উনুনে পাটকাঠির আগুন দাউদাউ করে জ্বলছে আবার ক্ষনেকে নিভেও আসছে, আবার উস্কে দিতে দিতে ........ উস্কে দিল মনের ভেতরের আগুনকে। স্মৃতির শিখা প্রজ্জ্বলিত। ঊর্ধ্বমুখী লেলিহান শিখা মনে পড়িয়ে দিচ্ছে কত কথা....। বাড়ির দুপাশে দুই বিয়েবাড়ি। বাজনা বাজছে.....। ছোটোবেলার ছড়া মনে পড়ছে .. 'দুইপাশে দুই কলাগাছ মধ্যিখানে মহারাজ!' আজ তা উল্টো স্রোতে... 'দুইপাশে দুই ভোজবাড়ি মধ্যিখানে হবিষ্যির হাঁড়ি'।
ভাত ফুটছে........ হবিষ্যির ভাত। ফুটছে বেদনা টগবগ টগবগ....... ওদিকে বাজনা বাজছে ঢম ঢম ঢম ঢম ।
সেদিনও বাজনা বাজছিল .. বরযাত্রীর দল এসে উপস্থিত হতেই কনে পক্ষের মেয়ের দল উঠে পড়ে লেগেছিল বরযাত্রীদের সাথে আলাপচারিতায়। বিয়েবাড়ি মানেই তো রঙ্গ-তামাশার মঞ্চ। বিয়েবাড়ি মানে কনে দেখার গোধূলীলগ্ন।
কঙ্কনার জ্যাঠতুতো দিদির ননদের বিয়েতেই তার বিয়েটা পাকা হয়ে গেল। প্রবাল রেলে চাকরি করে, স্বচ্ছল পরিবারের ছেলে, কঙ্কনার দিদির শ্বশুরবাড়ির সামনেই ওদের বাড়ি। কঙ্কনারা বিয়ের দিন যখন দিদির শ্বশুরবাড়ি এল তখনই পাকা দেখা হয়ে গেল। শুধু পাকা দেখা নয়, পরদিনই ছেলেকে একেবারে আশীর্বাদ করেই ফিরল কঙ্কনার বাবা মা। একেবারে "উঠ ছুঁড়ি তোর বিয়ে"। দিন পনেরোর মধ্যেই রূপ পাল্টে গেল কঙ্কনার । গায়ে লাগল হলুদ, পরনে লাল চেলী, সিঁথিতে সিঁদুর। কদিন আগের কঙ্কনা আর কদিন পরের কঙ্কনা...... চেনাই দায়। বসন্তে রাঙা হয়ে উঠল হেমন্তের আবছা প্রকৃতি।
শুরুর দিনগুলো কি মিষ্টি ছিল। দুবছরের মাথায় কোল আলো করে এল ফুটফুটে কন্যাসন্তান কণা। সমস্ত ভাবনা চিন্তা কেন্দ্রীভূত হল শিশুকন্যাকে ঘিরে। দূরত্ব বাড়ল বাড়ির অন্যান্য সদস্যদের সাথে। একান্নবর্তী পরিবার ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে গেল। আর এর দায় সম্পূর্নভাবে এসে পড়ল কঙ্কনার মাথায়। এক বাড়িতে তৈরী হল ছোট ছোট স্বাধীনতার ঘর — পায়রার খোপের মতো পাঁচ ভাইয়ের জন্য 'ভাগের ঘর'। ছেলেদের উপর অধিকার খোয়ালো বাবা মা। গ্রামের বাড়িতে বাণপ্রস্থ যাপন করছিল একান্ত নিভৃতে। তবু শান্তি ছিল না মনে। সমস্ত বিষয়আশয় ছেলেদের মধ্যে ভাগ করে দিয়েও প্রতীক্ষায় দিন কাটছিল অশান্তিতে। যে সন্তানেরা তাদের মা বাবার মর্যাদা দিয়েছে তারাই এখন পর। তাদের জীবদ্দশায় তাদের বিষয় নিয়ে কাড়াকাড়ি - মারামারি। বাবা-মাকে নিয়ে কারো কোনো ভাবনা নেই। কেউ খোঁজও করে না ভুলে-ভ্রান্তে । মনঃকষ্টে চাহিদা শুকিয়ে যখন রঙ রস খোয়ালো তখন মৃত্যুর কোলে আশ্রয় নেওয়াই একমাত্র পথ। তবে মৃত্যুর আগে তাদের শেষনিঃশ্বাসে শেষ অভিমান ঘোষিত হয়েছিল.. ছেলেরা যেন কেউ তাদের মুখাগ্নি না করে।
কিন্তু বাবা মায়ের শেষ ইচ্ছেকেও তোয়াক্কা করেনি ছেলেরা। বাবার মৃত্যুর পর প্রবালই শেষকৃত্য সম্পন্ন করেছে নিয়মরক্ষার্থে। মাস কয়েকের মধ্যে মা ও চলে গেলেন । ভাইরাও পৃথক — চারদেওয়ালের গন্ডীতে মুখ দেখাদেখি বন্ধ। এককালে বাড়িটার হেঁসেল থেকে বৈঠকখানা —সবই জমিদারি ফ্যাশনের মোড়কে মোড়া ছিল — আজ সেই বাড়ির কোনো কোনো ঘরে নুন আনতে পান্তা ফুরোয় অবস্থা। কোনো কোনো ভাই অভাবের তাড়নায় নিজের অংশটুকু বিক্রি করে গ্রামে ফিরে গেল। কেউ কেউ উঠে গেল ভাড়া বাড়িতে, নিজেদের অংশ বিক্রি করে।
ভুলটা কে করেছিল? তাদের বাবা? ছেলেদের শিক্ষিত করে মানুষের মতো মানুষ করবে ভেবেই তো শহরের বাড়িটা কিনে তাদের শহরের বাড়িতে স্থায়ী ঠিকানা করে দিয়ে নিজেরা পড়ে রইলো গ্রামের বাড়িতে জমিদারি আগলে.. ছেলেদের প্রয়োজন মেটানোর মেশিন হয়ে। টাকা- পয়সা, খাদ্যসামগ্রী গ্রাম থেকে সরবরাহ হতে লাগল শহরের বাড়িতে।
কিন্তু ছেলেরা মানুষ হল কই? শহুরে ফ্যাশনের স্বাদ পেতে গ্রামীন সভ্যতাকে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করল। পড়াশোনাও বেশিদূর এগোলো না। মাঝপথে গতিপথ হারিয়ে নাকানিচোবানি অবস্থা। গ্রামে থাকলে অন্ততঃ বিষয়আশয় চালানোর প্রক্রিয়াটি রপ্ত করতে পারতো। গায়ে ধনীর রক্ত প্রবাহিত হলে, যে কোনও কাজ করা মৃত্যুর সমান। তাই তো একটু একটু করে নিঃশেষিত হয়ে গেল একটা গোটা পরিবার। ভাগ্যিস, প্রবাল হায়ার সেকেন্ডারি পাশ দিয়ে রেলের চাকরিটা পেয়ে গিয়েছিল তাইতো স্ত্রী ও কন্যার ভবিষ্যত নিশ্চিন্ত হল । কিন্তু সত্যিই কি ভবিষ্যৎ নিশ্চিন্ত হয়েছিল?
বাবা-মা -ভাইদের চোখের জল কি তাকে ভালো থাকতে দিয়েছিল! আনন্দ কোলাহলে সময় কাটছিল। স্ত্রী কন্যার প্রতি কর্তব্যপালন করছিল ঠিক ঠিক। কিন্তু মনে মনে কি উদ্বিগ্ন ছিল না প্রবাল? যদি না থাকে তবে কেন ঐ ভয়াবহ রোগটি বাসা বাঁধল তার শরীরে! সুগার, প্রেসার এগুলো নরম্যাল অসুখ। কিন্তু ক্যান্সার —! শেষপর্যন্ত ক্যান্সার এসে ছিবড়ে করে দিল প্রবালের সুন্দর সুঠাম শরীরটাকে ।
দীর্ঘ রোগভোগের পর কলকাতার নার্সিংহোম থেকে প্রবালের মরদেহ যখন বাড়িতে এসে পৌঁছোলো তখন কাক পক্ষীও টের পেল না। মুখাগ্নি করল একমাত্র কন্যা। ভাইদের সাথে সম্পর্কচ্যুত প্রবালের আর কেই বা আছে স্ত্রী-কন্যা ছাড়া? মেয়েটি এম.এ. পাশ দিয়েছে। রেলকর্তৃপক্ষ নিশ্চয়ই তাকে একটা চাকরি পাইয়ে দেবে। স্ত্রীর জন্য পেনশনের সুব্যবস্থা। নিশ্চিন্তেই চোখ বুজেছে প্রবাল। এখন থেকে একা চলার পথে পা বাড়াবে চব্বিশ বছরের কন্যা কণা আর আটচল্লিশ বছরের সদ্য বৈধব্যের সাজে সজ্জিতা কঙ্কনা। এ পথটা কতটা কঠিন তার আঁচ টের পাচ্ছে এখনই।
উনুনের আঁচটা কমে এসেছে। দুপাশের বিয়ে বাড়িতে তুমূল হৈচৈ। বাতাসে ভাসছে রকমারি রান্নার গন্ধ। নানা স্বাদের স্বাদিষ্ট গন্ধ ভেদ করে হবিষ্যি পোড়া গন্ধটা নাকে পৌঁছতেই কঙ্কনার টনক নড়ল। ভাতের হাঁড়ি নামিয়ে পোড়াভাত ঢেলে দিল কলাপাতায়। নিবেদন করল মেয়ে তার বাবার উদ্দেশ্যে।
.......................... #.........................
কলমে : রীতা রায়
মালদা, পশ্চিমবঙ্গ, ভারত