Click the image to explore all Offers

গল্প।। দোটানা ।। মহুয়া বসু সিনহা


 

 দোটানা 

 মহুয়া বসু সিনহা 


মধ্যবিত্ত  পরিবারের  মেয়ে  শমিতা । কষ্ট  করে  লেখাপড়া  শেখার  পর  এখন একটা  নার্সিং সেন্টারে ট্রেনিং নিচ্ছে ।পাশ করে  একটা  চাকরি  পেলে  সংসারের  দায়িত্ব  কিছুটা  কাঁধে  তুলে  নিতে  পারলে বাবার  কষ্ট  কিছুটা  কমবে এই আশায় নিরন্তর  পরিশ্রম  করে  চলে । এরই মধ্যে  বাসে যেতে  যেতে  আলাপ  হয় রাজীবের  সাথে ।ও একটা  প্রাইভেট  ফার্মে চাকরি  করে ।ধীরে  ধীরে  আলাপচারিতা  রূপ  নেয় প্রেমের ।একসময় রাজীব  বিয়ের প্রস্তাব  দিলেও সংসারের  কথা  ভেবে সে  তৎক্ষণাৎ তার  সিদ্ধান্ত  জানাতে  পারেনি।দু'দিন  সময় চেয়েছিল।রাজীব বলেছিল,"তোমার  বাবা, মা আমার  মা এদের  সকলের  দায়িত্ব  আমরা  দুজনে  ভাগ করে  নেব।"ওদিকে  বাড়িতে মেয়ের মুখ  শুকনো দেখে  মা সবকিছু  জানতে  চান ।শমিতা  সবকিছুই  মাকে  জানায়।
মা বলে, "আমরা দুটো  মানুষ  ,আমাদের  ঠিক  চলে  যাবে । তুই আর  এই  দোটানায় থাকিস না ।রাজীবকে তুই  হ্যাঁ বলে দে।" ইতিমধ্যে  একটা  নার্সিংহোমে চাকরিও পাকা  হয়ে  যায়। রাজীব খবরটা  জানতেই ,বলে "দেখলে তো আমি  তোমার  জীবনে  কত lucky।বিয়ের কথা  বলতেই  তোমার  একটা  চাকরি  হয়ে  গেল ।বিয়েটা  হলে আরও  কত কি  না  হবে!"কথা  শুনে  সলজ্জ  হাসি ফুটে  উঠে  শমিতার মুখে ।
এরপর  ছোট  একটা  অনুষ্ঠানের মধ্য  দিয়ে  চারহাত  এক হয়। ভালমন্দের তালে দুলতে  দুলতে  কয়েকটি  বছর  বেশ  ভালোই  কাটল।কিন্তু  বাচ্চা  হবার  পর  শমিতার  শরীর  ভাঙতে থাকে ।রাজীব  বলে,"তুমি  এখন চাকরি  ছেড়ে  দাও।মেয়ে  বড় হতে হতে  তোমার  শরীর  ঠিক  হয়ে যাবে, তখন না হয় আবার  একটা  চাকরি  খুঁজে  নিও।
"কিন্তু  চাকরি  ছাড়লে চলবে  কি করে? বাচ্চার খরচ রয়েছে ।তাছাড়া ......"
"তোমাকে  অত ভাবতে  হবে  না ।আমি  ঠিক  চালিয়ে  নেব।"সত্যি  দিন ঠিক  চলেই যাচ্ছিল।কিন্তৃ  একদিন  মাথায় আকাশ ভেঙে  পড়ে  শমিতার ।হঠাৎই  এক বাস দুর্ঘটনা  কেড়ে নেয় তার  প্রিয় মানুষটিকে ।একদিন  যে বাসই ছিল  তাদের  প্রেমের  প্রথম  সাক্ষী সেই  কি না  এক মুহূর্তে  একটি  ভারী কালো পর্দা  টেনে  দিল  তাদের  পাঁচবছরের দাম্পত্যে!!

 কিছুদিন  শোকে  বিবশ থাকার  পর সে  বোঝে ভাগ্য তাকে  আজ এক কঠিন  পরীক্ষার মুখোমুখি  দাঁড় করিয়েছে।আর এই পরীক্ষায় পাশ  করতে হলে একটা  চাকরি  নিতান্তই  দরকার ।-এই ভেবে সে আবার  চাকরির সন্ধান  করতে থাকে ।কিছুদিন বাদে  একটা  নার্সিংহোমে  চাকরিও  পায়।
সময়স্রোতে দীর্ঘ  কুড়ি বছর  কিভাবে  যেন  কেটে যায়! আজ তার  মেয়ে  বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী ।পড়াশোনার  পাশাপাশি নানা  সামাজিক  কাজকর্মেও  সর্বদা ঝাঁপিয়ে  পড়ে ।বর্তমানে এই কঠিন  সময়ে  বন্ধুদের  সাথে  প্রায়ই  বিপদে পড়া মানুষগুলোর পাশে ছুটে  যাচ্ছে ।কখনো  কোন  বাড়িতে খাবার  পৌঁছে  দিচ্ছে, কখনো অসুস্থ  কাউকে  হাসপাতালে  নিয়ে  ছুটছে।সে মেয়েকে  বলে"একটু সাবধানে থাকিস। চারিদিকে  বড় বিপদ ।"
"ওদেরও বড় বিপদ  মা।সামনে  যদি  হাতটা  বাড়িয়ে  দিই,ওরা  খড়কুটোর মত সেটাই  আঁকড়ে  ধরে ।বেঁচে  থাকার  ইচ্ছেটা  যেন একটু  ভরসা  পায়।তুমিও তো  মা তাই করছ।নিজের  কথা  কি ভাবতে পারছ?"মায়ের গলা  জড়িয়ে  বলে  মেয়ে।শমিতা  সব শুনে  চুপ  করে  থাকে ।তবে মনটা  এক অজানা  আশঙ্কায় মোমবাতির শিখার মত তিরতির করে  কাঁপতে  থাকে ।আশঙ্কাই একদিন  সত্যি  হল।জ্বরে কাবু মেয়ে, কিন্তু  চাকরির বাধ্যতায়  রোজই তাকে নার্সিংহোমে  যেতে  হয়,ছুটি  পায় না ।এমনই একদিন  ডিউটির সময়  পাশের  বাড়ির  মেয়েটির থেকে  ফোন ,"কাকিমা, রশ্মিকে তোমাদের  এখানেই নিয়ে  এসেছি।জ্বরের  সাথে  শ্বাসকষ্টও বেড়ে গেছে ।তুমি  শিগগির  বাইরে  এসো।"এক বিদ্যুতের  ঝলকানি  ওর বুকটাকে যেন চিরে দিয়ে  চলে  যায়। রশ্মিকে ভর্তি  করা  হয় ICCU তে। সেখানে  প্রায় তারই বয়সী একটি মেয়ে ভর্তি  হয়েছে কিছুক্ষণ  আগে, সে   তিনমাসের  অন্তঃসত্ত্বা।
কয়েক মিনিট  পরেই মাকে একটিমাত্র  ইঞ্জেকশন  সিরিঞ্জ হাতে  একা আসতে দেখে  মেয়ে কিছু  একটা  বুঝতে  পারে। কারণ মায়ের এই চলার ছন্দ  তার  বড় চেনা! কোন  দোটানায় পড়লেই মায়ের পা যেন  সরতেই চায় না, কোনমতে  পা ঘষে ঘষে চলে । আজও সেইভাবে  হাঁটছে মা!মেয়ের কাছে  আসতেই অনেক কষ্টে  ও বলে,"ওর দেহে  আরেকটা  প্রাণ আছে  মা। তাকে মায়ামমতা জড়ানো এই পৃথিবীকে দেখতে  দাও।আমার  মতোই মায়ের আদর -ভালোবাসা  পেতে দাও।"
চোখের  ইঙ্গিতে  মেয়েটিকে  দেখিয়ে মায়ের সমস্ত  দোটানার অবসান  ঘটিয়ে  ধীরে  ধীরে  চোখের পাতা  বন্ধ  করে  রশ্মি।

ছবিঋণ- ইন্টারনেট ।

------------------------------------ 

লেখিকা- মহুয়া বসু সিনহা। 

কালিপুর, ডানকুনি , হুগলী।


 

Post a Comment

0 Comments
* Please Don't Spam Here. All the Comments are Reviewed by Admin.