শতশব্দে অণুগল্প ।। ইভেণ্ট-৩
শতশব্দে অণুগল্প
১) ধূপ জ্বেলে যায়
মোয়াল্লেম নাইয়া
বছর বাইশের সাত্যকি রকমারী ধূপ নিয়ে ট্রেনে ট্রেনে হকারি করে ৷ ধূপের গন্ধে ট্রেনের প্রতিটি কামরা যেন ম ম করে ওঠে ৷ অনেকেই তার ধূপ কিনে নিয়ে যায় ৷ তার ধূপের গন্ধের প্রশংসাও করে ৷ সমগ্র কামরা জুড়ে ভেসে বেড়ানো গন্ধ অষ্টাদশী রমার মনেও গন্ধ বিলায় ৷ তাকেও রোজ ভোরে কাজের জন্য ট্রেনে উঠে গ্রাম থেকে শহরে ছুটতে হয় ৷... সেদিন কয়েকটি ধূপ ও সাত্যকির কাছ থেকে নিয়ে বাড়িতে ফেরে ৷ সন্ধ্যায় ধূপ জ্বালিয়ে সন্ধ্যারতি করার পর,চোখ বুজে ঈশ্বরের উদ্দেশ্যে দুহাত তুলে প্রার্থণা করতে গিয়ে সে চমকে ওঠে ৷…. তার মানসপট জুড়ে এক বাইশ বর্ষীয় যুবক ! যে ধূপ জ্বেলে দিয়ে যাচ্ছে তার হৃদয় মন্দিরের প্রতিটি প্রকোষ্ঠে ৷
২) খই পোড়া আগুন
দেবশ্রী সরকার বিশ্বাস
নিজের পোড়া মুখটাকে ঘোমটায় আড়াল করে পালিত মেয়ে নিপার বিবাহ আসরে এসে দাঁড়াল লতা! খই পোড়ানোর সময় এবার ,লতা ঘোমটার আড়ালে থেকে হাক দেয় 'খুব সাবধানে আগুন যেন বেশি না হয়!'এই খই পোড়ার আগুন শাড়িতে লেগে শরীরের কিছু অংশ ও মুখের এক দিকটা ঝলসে যায় লতার! অসম্পূর্ণ বিয়েটা সম্পূর্ণ করতে অতনু আর ফিরে আসেনা! তবুও প্রতীক্ষায় দিন গোনে লতা, দশ বছরের প্রেম ওদের এতটাই ঠুনকো ছিল! মনের টান বলে কি কিছুই নেই? লতার বিশ্বাসকে মর্যাদা দিতে ফিরে আসেনি অতনু! লতা চায় না তার মতো চির-প্রতীক্ষার প্রহর আর কেউ গুণুক!
৩) ওষুধ
শঙ্কর নাথ প্রামাণিক
হাসপাতালের বেডে ছটফট করছিল ছোট্ট পলাশ। মাঝে মাঝে চিৎকার করে উঠছিল,"আমার আর ভালো লাগছে না,মা। এতো বই পড়তে একদম ভালো লাগছে না। রিংকী আন্টি,মালহোত্রা আন্টি আমাকে খুব মারে। আমি আর স্কুলে যাবো না,মা। বিকেলে কম্পিউটার ক্লাসটাও ভালো লাগে না। আমাকে একটা বল দাও, আমি একটু খেলবো মা।"
বাবা হন্তদন্ত হয়ে নার্সকে গিয়ে বললেন,"ছেলেটা ভুল বলছে দিদি। আপনি কিছু করুন।"
নার্স ধীরে ধীরে বললেন," ও ভুল বলছে না। আপনি ভুল করছেন।ওকে একটু খেলতে দেবেন।ওটাই ওর ওষুধ।"
৪) খিদে
চন্দ্রানী চট্টোপাধ্যায়
সকাল থেকেই সূর্য যেন কোন এক অজানা কারনে
অভিমানে মুখ ঢেকেছে৷ তাই একটা যেন ভ্যাপসা গরম৷ জয়ের আজ সকাল থেকে প্রচুর কাজ। আজ
প্রফেসর হাজরার লেকচার কোনমতেই মিস করা যাবে না। ভেবেছিলো ক্যান্টিনে কিছু খেয়ে নেবে
কিন্তু তাও আর হয়ে উঠলো না। নতুন টিউশন ধরেছে। সবশেষ করে বাড়ি ফেরার পথে জয়৷ শরীরটা
যেন আর চলছে না। পেটের ভেতরে ছুঁচো ইদুর সব দৌড়চ্ছে। বাড়ি ফিরে কোনরকমে শার্টের বোতাম
খুলতে খুলতে বলে--মা কিছু খেতে দাও। খুব খিদে পেয়েছে গো। আজ কিছু খাওয়া হয়নি জানো!
হঠাৎ মনে পড়ে পেছন ফিরে তাকায়, টেবিলের
ওপর মালা পরানো সুসজ্জিত মায়ের ছবি৷ চোখের জলে ঝাপসা হয়ে যায় সবকিছু জয়ের।
৫) রেশন
মিনাক্ষী মন্ডল
পাড়ায়, বাজারে পরিতোষ বাবুর খুব নিন্দে । একজন প্রফেসর হয়ে রেশন দোকানে বিনা পয়সার রেশন নেয়। তাও আবার এর ওর কাছে রেশন কার্ড সংগ্রহ করে।
সেদিন কলকাতা যাচ্ছি ট্রাফিক জ্যামে গাড়িটা দাঁড়িয়ে যাওয়ায় আমিও নেমে পরি।
সামনে কিছুটা জায়গায় সাপুড়িয়ারা তাবু টাঙ্গিয়ে
কিছুদিন থেকে বাস করছে। তাকিয়ে দেখি সবাই লাইন করে দাঁড়িয়ে আছে, কিসের লাইন ভালো
করে নজর করতেই হঠাৎ দেখি পরিতোষ বাবুর সেই লাইনে থাকা মানুষগুলোকে কী যেন দিচ্ছে ।
গাড়িটা সাইড করে সামনে এগিয়ে গিয়ে দেখি সেই রেশনের চাল- ডাল। পরিতোষ বাবু আমার দিকে
তাকিয়ে হেসে বললেন অনেকেই রেশন নেয় না , সেই কার্ডগুলো আমার এই ভাবে কাজে লাগে।
৬) প্রস্ফুটিতা
পর্ণা বসু
নার্সিংহোমের বেডে শুয়ে সনৎ বাবু। কর্কট রোগ বাসা বেঁধেছে তার শরীরে। প্রথম অবস্থায় ধরা পড়েছে, হয়তো উন্নত চিকিৎসার সাহায্যে আবার জীবন কিছুদিন চলবে।
কাবেরী এসে জানলার পর্দা সরিয়ে পরম মমতায় সনৎবাবুকে ওষুধ খাইয়ে তাঁর জলখাবার আনতে গেল।
ছয় বছর আগে পড়ার টিউশন থেকে ফেরার পথে কাবেরী
চারজন নরপশুর হাতে ধর্ষিত হয়ে বিপর্যস্ত হয়ে ফিরলে বাড়িতে জোটেনি কোন সহানুভূতি,
এই মেয়ের জন্য যদি বাকি তিন মেয়ের জীবনে বিপর্যয় হয়, এই অজুহাতে বাবা বাড়ি ছাড়া
করেছিলেন তৃতীয় মেয়েটিকে।
না হেরে গিয়ে জীবনের কঠিন লড়াই পেরিয়ে আজ কাবেরী নিজের চেষ্টায় শহরের এই নার্সিংহোমের নার্স। ভালো ব্যবহারে অনেক বড়ো ডাক্তারের প্রিয়পাত্রী কাবেরী তার বাবা সনৎ বাবুর চিকিৎসা সঠিক সময়ে শুরু করতে পেরেছে।
৭) শীতঘুম শেষে
সুদীপ দাশ
তুমি আজ সুপার স্টার। তাতে কি? আমরা তো ওই পার্কের নিভৃতে একদিন বসেছিলাম। তোমার আজ কত আলো! আমি আজ এই কুঠুরির আঁধারে। তুমি নাকি সাংসদ? ভাষণ দেবে নাকি রাজ্যসভা চ্যানেলে? আমি আজও রেখে দিয়েছি তোমার প্রথম প্রেমপত্র আমার মনের গহীনের সেই ডিবেতে,যেথা রাজকন্যার প্রাণভোমরা খাবি খায়। অপেক্ষায় আছি,কবে শীতঘুম শেষে সোনার কাঠির ছোঁয়ায় তোমার ঘুম ভাঙে---
৮) লিপস্টিক
অনামিকা মিত্র বসু
উষ্ণ দীর্ঘশ্বাসে ঝাপসা আয়নাটা হাতের টানে সাফ করে,অনেকক্ষণের মেকআপ চটা, ধ্যাবড়ানো কাজুলে চোখ, চৌত্রিশের মুখে খুঁজছে একুশের প্রেমকে….
---তোর লিপস্টিকে কি ভিটামিন আছে রে?
কপট রাগে ঋজুতা চোখ মোটা করতেই..
---আহা অন্যভাবে নিচ্ছিস কেন? অত সুন্দর ঠোঁট..., লাল লিপস্টিকে তোকে দারুণ লাগে।
ঋতমের ঐকথায় নানা শেডের লাল লিপস্টিক ভিড় জমিয়েছিল ড্রেসিং-টেবিলে।ঋজুতার লিপস্টিক সাক্ষর রেখেছিল ঋতমের শার্টে,রুমালে,বাদামী চামড়ায়।ঋতম হার্ভার্ডে যাওয়ার পর লিপস্টিকের দাগ ফিকে হয়ে একসময় রঙ হারিয়েছিল।সায়নের জুনিয়ারের বিয়েতে বরের আসনে আজ বারো বছর পর দেখল ঋতমকে।
বাড়ি ফিরে ঋজুতার সিঁথিতে সায়নের সিঁদুর দেখছে..ঋতমের উপহার দেওয়া এক্সপায়ার্ড চেরি-রেড লিপস্টিকটা দিয়ে আদর করে ঠোঁট রাঙাচ্ছে ঋজুতা।
৯) ভয়ংকর স্টেশনের রাত
প্রিয়ব্রত চক্রবর্তী
কল্যাণী থেকে চাকরির পরীক্ষা দিয়ে ট্রেনে শিয়ালদায় নেমে দক্ষিণের শেষ রাতের ক্যানিং লোকালে উঠে ঘুমের ঘোরে তালদি স্টেশনে নামলাম। ঘুমের ঘোরে মালপত্র নিয়ে চায়ের দোকান বন্ধ করার সময় যেতেই দূরছার করে তাড়িয়ে দিল। সেখান থেকে তাড়া খেয়ে টিকিট মাস্টারের কাছে গেলাম যদি আশ্রয় পাই, এই ভেবে। সেখান থেকেও আমাকে দূর্ দূর্ করে তাড়িয়ে দিল। অগত্যা স্টেশনে রাত কাটানো। ঘুটঘুটে রাতের অন্ধকারে আমি একা। ও না! বেশ ঘণ্টাখানেক পরে শুনতে পেলাম একটা মেয়ে কাঁদতে কাঁদতে লাইন ধরে ছুটতে ছুটতে বাঁচাও, বাঁচাও! তারপর আমার কাছাকাছি লাইনের উপরেই দু-তিনজন মিলে মেয়েটাকে ধর্ষণ করছে। আর মেয়েটা গোঙাচ্ছে। আমি থরথর করে কাঁপতে কাঁপতে স্টেশনের উপর বসেই অজ্ঞান হয়ে গিয়েছি। সকালে জ্ঞান ফিরে দেখি মালপত্রহীন অর্ধনগ্ন অবস্থায় ক্যানিং থানার লকআপে। কিন্তু কেন? উত্তরটা অস্বাভাবিক!
১০) শহীদ
শুভদীপ ভট্টাচার্য্য
ছেলের ছোটবেলার অনেক কথাই আজ অপরাজিতা দেবীর মনে পড়ছিল আর চোখ থেকে জল পড়ছিল। বাপ মরা ছেলেটা কিছুতেই ডাক্তারি পড়তে চাইত না। খালি বলত বাবার মতন দেশের জন্য লড়াই করবে। শহীদ হবে।
আজ অভিমন্যুর শেষকৃত্য। অপরাজিতা দেবীর মনটা হঠাৎ শান্ত হয়ে গেল। ছেলের তো মনোস্কামনা পূর্ণ হয়েছে! বাপ কার্গিল যুদ্ধে শহীদ হয়েছিল। আর ছেলে করোনা যুদ্ধে শহীদ।
১১) রাখিবন্ধন
সংকলিতা তাম্বুলী চন্দ্র
আজ মেজাজটা একদমই বিগড়ে রয়েছে মৃদুলার। এরকম একটা দিনে বাকিদের মতো ছুটি নেওয়ার কোন কারণ না থাকায়, অফিস এসেছে সে।
সীটে বসে একটু জিরিয়ে নিচ্ছে এমন সময়ে...
"মৃদুলাদি…"
উফফ এই কাজের সময়ে, এই লাজুক ছেলেটা এখানে কি করছে!! ও কেন আজ অফিস এসেছে!!
"কি ব্যাপার বল্।"
"হাতটা বাড়াও, তোমার জন্য রাখী এনেছি!"
"রাখী? সে তো মেয়েরা ছেলেদের পড়ায়!"
"না, এটা একটা সম্পর্কের সাক্ষর বলতে পারো দিদি, তোমার যেরকম ভাই বা দাদা নেই; আমারও তেমনি কোন দিদি বা বোন নেই। তাই আমি দুটো রাখী কিনেছি। একটা আমি পরিয়ে দিচ্ছি। আর এইটা…"
"ওটা তুই পড়বি।" দুজনের চোখদুটোই ছলছল করছে!!
ভাগ্যিস, রাখীপূর্ণিমাটা উইকডেইজে পড়েছিলো!!
১২) প্রতিদান
সৌমিক ঘোষ
সুবিনয়বাবু ধারের ঘরে। মাঝেরটায় স্ত্রী রমলা। ছোট্ট স্টাডিরুমে ছেলে অনয়। লকডাউন, টীকা নেওয়ার ঝামেলা, মিডিয়ার খবরের ছকে ফ্ল্যাটে আটকে থাকা জীবনের রুটিনে আসে করোনা। টেস্ট, ওষুধ, খাবার, দেখশোনায় ব্যস্ত হয়ে পড়ে চন্দনা। রমলার কথায় আর এগারো বছরের কাজের মায়ায় ক্যানিং-এ বাড়ি ফেরা হয়না। আশঙ্কার চোদ্দ দিনে চন্দনা যেন ব্যস্ত মোড়ের ট্র্যাফিক পুলিশ। এ ঘরে রিডিং, সে ঘরে ওষুধ, ও ঘরে এঁটো বাসন নেওয়ার মাঝে গ্লাভস্, মাস্কে দম আটকে যায়। চন্দনার জ্বর। সুবিনয়বাবুরা সকলে সুস্থ। রমলা ওকে বাড়ি পাঠিয়ে দেন। মাসের শেষে চন্দনার ছেলে বিল্টু এলে গ্লাভসে ঢাকা হাতে দরজার হাতলে টাকার প্যাকেটটা রেখে রমলা বললেন– মাকে আর আসতে হবে না।
১৩) স্বাবলম্বী
ঈশিতা পাল পট্টনায়ক
আজ যেন হাওয়ার বাঁধ ভেঙেছে।পাতাগুলো কেমন তিরতির করে নড়ছে, ফুলগুলো অহেতুক গন্ধ বিলোচ্ছে, ভিজে জামা-কাপড়গুলো অনুশাসন মানছেনা মোটেই! এইসব ভাবতে ভাবতেই বারান্দা থেকে উঠে বাজারের থলে হাতে নিলেন বিনায়ক।
সুদীর্ঘ অবসরের পর পঞ্চাশ বছরের পুরোনো দাম্পত্য ঝালিয়ে নেবার সময় এসেছে। নড়বড়ে হাতে কেবল মনের জোরেই নিভা, হয়তো নব পরিনীতার মতোই হেঁসেল ঠেলবে! পুরোনো সংসারের কয়েকটা অপ্রয়োজনীয় বাসনপত্র উপহার স্বরূপ তারা পেয়েছেন বটে,তাই অনেক!
বার্ধক্য বড়ো বালাই! তবুও ছেলেমানুষের মতোই আত্মজের হাতধরতে কে না চায়! পুত্রেরা অপারগ, গত রাতের আসরেই তা স্থির হয়েগেছে। নাঃ,আর দেরী নয় -বলে হনহনিয়ে এগিয়ে গেলেন বর্তমানে সদ্য পৃথক নিভার স্বামী স্বাবলম্বী বিনায়ক সেন ।
১৪) লাঠি
দীপঙ্কর বেরা
লাঠি বলল - কেউ হাতে ধরলে তবে আমি কারো মাথায় পড়ি। মনে হয় লোকটির হাতেই ছিলাম।
লোকটি বলল - আমি লাঠি ধরি। তবে এবার ধরেছিলাম কিনা মনে নেই। আমি উনার আণ্ডারে কাজ করি।
উনি বললেন - আমি কাজ পাই কাজ করাই। লাঠি সাহায্য করে। যারা কাজ দিয়েছিল তারা বলতে পারবে কাজের প্ল্যানে লাঠি কোথায় ছিল।
প্ল্যানার বলল - দেশের উন্নতির জন্য কাজটা দরকার। সেটা কিভাবে হবে তা দেশের পুরোভাগে যাঁরা তাঁরা বলতে পারবেন।
পুরোভাগ বললেন- দেশের উন্নতির জন্য লাঠি লাগবেই। এত হৈচৈ-এর কি আছে?
তাই লাঠি কে ধরেছিল চিহ্নিত করা যায়নি। বেকসুর খালাস। লাঠি স্বমহিমায় আবার হাতে হাতে।
ভিকটিমরা রক্তমাখা মাথায় হাত চেপে হাসপাতালের বারান্দায়।
১৫) ঝাপসা স্মৃতি
চন্দন চক্রবর্তী
সকালে হাঁটতে বেরিয়ে সৌমেনবাবু বাড়ির সামনে ময়লা গাদায় পুতুলটা দেখে চমকে উঠলেন । মা মরা মেয়েটার যখন বয়স পাঁচ,পুতুলটা কিনে দিয়েছিলেন । তাতে অনেকটা কাজ হয়েছিল । ওকে বগল দাবা করে সারাদিন ঘুরে বেড়াতো । একটুও কাছ ছাড়া করত না । রাতে শুতে গিয়েও পাশে রাখতো ।
মেয়েটা প্রেম করে বিয়ে করল । চরম অশান্তিতে শেষে নিজেই গায়ে আগুন দিল নাকি দেওয়া হল বোঝা গেল না ! কোর্ট কাছারি করেও ফল হল না ।
কি হলো দাঁড়িয়ে কি দেখছ আমাকে কোলে নেবে না !
সৌমেনবাবু চমকে উঠলেন। তাড়াতাড়ি পুতুলটাকে তুলে পরম স্নেহে ঝাড়তে ঝাড়তে বাড়ি ফিরে এলেন।
গলাটা বুজে আসছে।
১৬) স্বপ্নশিশির
মৃণাল কান্তি দেব
অডিটোরিয়াম থেকে আস্তে আস্তে বেরোলো মেয়েটি । হতাশা আর মন খারাপের কালো মেঘ তাকে ঘিরে। নিখুঁত গেয়েও ভয়েস অফ বেঙ্গল এর মঞ্চ থেকে বিদায় নিতে হলো তাকে ষড়যন্ত্রের শিকার হয়ে। বিপর্যস্ত মেয়েটি ভাবতে লাগলো, তার সাধনা আর স্বপ্নের এখানেই ইতি হলো।
একদিন ভোররাতের স্বপ্নে মেয়েটি তার দাদানকে দেখতে পেলো। দাদান বলছে,
" দিদিভাই, এটুকুতেই ভেঙে পড়লে চলবে? স্বপ্নের কাছে পৌঁছতে, লক্ষ্যে পৌঁছতে অনেক ষড়যন্ত্রের বেড়াজাল টপকাতে হবে। তোমার সাধনাই তোমার স্বপ্নপূরণের চাবিকাঠি, সাধনা করো দিদিভাই। "
ঘুম ভেঙে গেলো। স্বপ্নকে ছোয়ার জন্য আরো গভীর সাধনা শুরু করল সে।
মঞ্চে সেরা গায়িকার পুরস্কার নেবার পর কথাগুলি বললেন শ্রীমতি নীলাশা মুখার্জী।
সেদিনকার সেই "মেয়েটি" আজ স্বপ্নশিশিরকে ছুঁয়েছে।
১৭) ইনকিলাব
সোমা চক্রবর্তী
গভীর রাতে বেজে উঠলো গোপন ইমার্জেন্সী লাইনটা। একটু আগেই পদত্যাগপত্র জমা দিয়েছেন। কালই নতুন প্রেসিডেন্ট শপথ নেবে। কেমন সরকার গঠন করবে ওরা, কি হতে চলেছে দেশবাসীর- এইসব ভাবছিলেন। চোখে ঘুম নেই। সবকিছু ঠিকঠাক হবে তো? একটু এদিক-ওদিক হলেই সব শেষ। ভাবতে ভাবতে গোপন কোডটা অস্ফুটে উচ্চারণ করলেন বিদায়ী রাষ্ট্রনেতা।
- হ্যালো, ওল্ডফ্রেন্ড! রূপকথা শোনো।
আন্তর্জাতিক প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের সচিবের গলা।
- বলো। ঘুম আসছে না।
- শিকারী বাজের বাসায় ঈগলের আক্রমণ। পায়রারা যেন তৈরী থাকে।
- বাজের নখ ধারালো, দৃষ্টি প্রখর।
- ইঁদুরেরা মাটির নীচে তাড়াতাড়ি এগিয়ে যায়। ডলফিনরাও ভালোদের বন্ধু!
- অন্ধকারে পেঁচার চোখ জ্বলে।
- জঙ্গলের সব পশুপাখি একত্র হয়েছে। আর ভয় নেই।
১৮) দৈবাদেশ
মানস দেব
সকালে দরজা খুলতেই ঘোষ গিন্নি দেখতে পেলেন দরজার পাশে একটি কার্তিক ঠাকুর । তিনি অবাক হয়ে ভাবলেন - " নিশ্চয়ই বাড়িতে কার্তিক আসবে । " তাড়াতাড়ি ঠাকুরটি ঠাকুর ঘরে রেখে গেলেন স্নান করতে । ঠাকুর ঘর খুলতেই দেখতে পেলেন কার্তিকের পাশে একটি লক্ষ্মী ঠাকুর বসানো । " হে ভগবান কিভাবে এসব ঘটছে ! " ভাবতে ভাবতেই দেখলেন পাশে একটি কাগজ পড়ে রয়েছে ।
কাগজ খুলে দেখলেন তাতে লেখা রয়েছে - " পৃথিবীর আলো দেখার আগেই গতবার বৌমার গর্ভের লক্ষ্মীকে হত্যা করেছিল তোর স্বামী । এবার যেন আমার প্রতি কোনো অবহেলা না হয়। সকলেই যেন এই বার্তা পায় কন্যা সন্তান ও পুত্র সন্তান দুই-ই সমান । ভ্রুণ হত্যা মহাপাপ । "
১৯) প্রতিশোধ
রুবি সেনগুপ্ত
আজ বিজয়া দশমী।একটু পরে আরম্ভ হবে সিঁদুরখেলা। জোরকদমে তারই প্রস্তুতি চলছে কনকপুর গ্রামের গাঙ্গুলি বাড়ির ঠাকুরদালানে।হঠাৎ ই বাড়ির বড়গিন্নি লতিকার বুকফাটা আর্তনাদে চমকে উঠার পর বাড়ির সদস্যরা উপস্থিত হয় দোতলার একটি ঘরের সামনে।ঘরের পালঙ্কের মধ্যে পড়ে রয়েছে লতিকার একমাত্র ছেলে আটাশ বছরের আকাশের নিথর দেহ।ত্রিশূলখানা গাঁথা রয়েছে তার বুকের মধ্যে।রক্তে ভেসে যাচ্ছে সারা শরীর।আনন্দ উৎসব এক নিমেষে পরিনত হয়েছে মৃত্যুশোকে।
বাড়ির রাঁধুনি শর্বরী সেন বেজায় খুশি। তিনবছর
আগে ওই নরপিশাচটা তার একমাত্র মেয়েকে ধর্ষন করার পর নৃংশভাবে খুন করেছিল।তাই সমাজের
জ্যান্ত অসুরবিনাশ করে প্রতিশোধ নিয়েছে সে।
২০) ভালবাসার স্বপ্ন
অঞ্জনা দেব রায়
তমাল নিজের ও বাড়ির প্রয়োজনে রঞ্জনাকে বিয়ে করেছিল। কিন্তু রঞ্জনা তার সমস্ত ভালবাসা দিয়েও বিশ্বাস করে এবং বন্ধু হয়ে সংসার জীবনের সারাটা পথ তমালের সাথে চলতে চেয়েছিল। রঞ্জনা দেখতে খুব সুন্দরী না হলেও বেশ ভালো দেখতে এবং শিক্ষিত মধ্যবিত্ত বাড়ির মেয়ে। বিয়ের পাঁচ বছর বাদে যখন জানতে পারল তমাল অন্য একটি মেয়েকে ভালবাসে তখন রঞ্জনার সংসার জীবনের ভালবাসার স্বপ্নকে খড়খুটোর মত ভাসিয়ে দিতে হয়েছে। বৃষ্টির জলে ধুয়ে গেছে ভালবাসার সংসার স্বপ্ন।
অবশেষে আজ রঞ্জনা অশ্রাব্য গালিগালাজ আর মানসিক পীড়নের ঘন কালো মেঘকে পিছনে ফেলে এসেছে, জীবনে নতুন আলোর আশায়।
২১) মিলন
সুতপা ব্যানার্জী (রায়)
সদ্য বিয়ে হয়ে লিরিল ভুজের সেনা আবাসে ওর স্বামীর কর্মক্ষেত্রে গেছে। ওর বর বিজিত সারাদিন ব্যস্ত থাকে। লিরিলের বাড়ি ছেড়ে অতো দূরে গিয়ে ভাল লাগছে না। সে সব বিরক্তি বিজিতের ওপর বর্ষন করে। এরকমই একটা দিনে বিজিত অফিস থেকে ফিরতেই লিরিল বলল-"আমি এখানে বেশী দিন থাকতে পারব না,তুমি কলকাতায় বদলি নাও।"
"এই বদলি কি আমার হাতে নাকি? আর তুমি তো জেনেই বিয়ে করেছ? "কথা কাটাকাটির মধ্যে ওদের কোয়ার্টার ভূমিকম্পে কাঁপতে শুরু করল। লিরিল ভয়ে দিশেহারা হতে বিজিত ওকে পাঁজাকোলা করে বাইরের মাঠে নিয়ে আসার সঙ্গে সঙ্গে ঘরবাড়ি তাসের ঘরের মতো ভেঙে পড়ল। অস্থায়ী তাঁবুর ভেতরে বিজিতের পাশে ঘন হয়ে সজল কৃতজ্ঞ চোখে অনিমেষ চেয়ে লিরিল। ১০৪
২২) একটি কাল্পনিক চরিত্র
মহুয়া বসু সিনহা
এত রাতেও বসার ঘরে আলো জ্বলছে দেখে কণিকাদেবী এগিয়ে আসেন।দেখেন রঞ্জা তখনও একমনে কাগজে বারবার কী লিখছে আর কাটছে।
----অনেক রাত হলো, শুতে গেলি না?
---না, উপন্যাসের শেষটা নিয়ে একটু দোটানায় আছি।
---কেন? কাল শুনলাম, পরিণতিটা বেশ ভালোই হয়েছে ।
---আসলে,পাঠকেরা রঞ্জাবতীর সংসার ছেড়ে চলে যাওয়া মেনে নিতে পারবে ?
---পারবে ।তুই যেভাবে চরিত্রটা তৈরী করেছিস তাতে সবকিছু মেনে নিয়ে স্বামীর সাথে সংসার করাটা অবাস্তব লাগত।
পঞ্চাশ বছর সংসারের সবকিছু মেনে-মানিয়ে থাকার পর মানুষটি এখনও এতটা যুক্তিবাদী, আত্মসম্মানপ্রিয়--একথা ভেবে রঞ্জা মুগ্ধ ।কিন্তু নিজের ছেলের সবকিছু জানার পর একইভাবে সিদ্ধান্ত নিতে পারবেন তো? ভাবতে ভাবতে উপন্যাসের সমাপ্তিটা লিখতে বসে রঞ্জা।
২৩) সারপ্রাইজ
মানসী গাঙ্গুলী
আজ ওদের বিবাহবার্ষিকী। ঘুম ভেঙে বিছানাতেই দু'জনে ওরা ভালোবাসাবাসি করেছে। দইবড়া খেতে সোহম খুব ভালবাসে তাই ব্রেকফাস্টে বুবলি দইবড়া বানিয়েছে।
৩৫ বছরের বিবাহবার্ষিকীতে সোহমকে সারপ্রাইজ দেবে বলে ব্রেকফাস্ট হলে বুবলি একাই বেরল মার্কেটে। সোহমের বিয়ের হিরের বোতামটা হারিয়ে গেছে। তাই বুবলি সোহমের জন্য হিরের বোতাম কিনল। সোহম সঙ্গে থাকলে কিছুতেই কিনতে দিত না। ফেরার পথে রাতে বাইরে ডিনারের প্ল্যান করতে করতে বাড়ী এসে গেল। মনে মনে সোহমকে সারপ্রাইজ দেবার খুশীতে ঘরে ঢুকে নিজেই সারপ্রাইজড হয়ে গেল। রিমোট হাতে সোহম ঢলে পড়ে আছে সোফায়, টিভিতে খেলা চলছে আপনমনে। তার হৃদয়বিদারক চিৎকারে একটা কালো বেড়াল লাফ দিয়ে জানলা দিয়ে বেরিয়ে গেল।
২৪) গুপ্তধন
অঙ্কিতা পাল
পুকুর পাড়ে মন্দির নির্মাণের কাজ আজ থেকেই শুরু হয়েছে। মিস্ত্রিরা মাটি খুঁড়ছে, এমন সময় উদ্ধার হল একটি গয়নার বাক্স। সারা পাড়ায় শোরগোল পড়ে গেল, সবাই ভাবলো কোনও রাজ রাজাদের হবে হয়তো। তদন্তের জন্য গ্রামের লোক পুলিশে খবর দিলেন। পুলিশ এসে বাক্সটি ভালো করে নিরীক্ষণ করলো। অবশেষে বাক্সটি তালা ভাঙার পর প্রতীক্ষার অবসান হলো, সবাই অবাক..............
কি ভেবেছিল আর কি হলো, একি আশ্চর্য ঘটনা,
শুধুই তো একটা কাঠের বাক্স!
২৫) স্বাধীনতা দিবস
জয়তী ব্যানার্জি মুখার্জি
“কাল বুলাদিকে ছুটি দিয়ে দাও মিতু” চায়ের কাপটা সেন্টার টেবিল থেকে তুলে দরাজ গলায় বলে ওঠে রূপক ।
“ ছুটি? কিন্তু বুলাদি তো বাড়ি চলে গেছে । ছুটি কেন বলোতো?”
“আরে বাবা! কাল স্বাধীনতা দিবস না! সরকারি- বেসরকারি অফিস-কাছারি সব ছুটি । ওরাই বা কেন ছুটি পাবে না বেচারা!”
“কিন্তু,,,,”
“আরে কিন্তু কী! ফোন করে দাও, ওতে বেশি খুশি হবে ।“
“তা ঠিক “
“ঠিকই তো! ইলিশ, খাসির মাংস সব এনেছি । কাল জমিয়ে রান্না করো আর টিভিতে ইন্ডিয়ান আইডলের ফিনালে দেখো । চুটিয়ে ছুটি কাটানো যাকে বলে!”
হারমোনিয়ামটা বহুদিন বেরোয় না মিতুর তবু মিতু সারাদিন গুনগুন করে গান গায় । বিভিন্ন সিচুয়েশনে , বিভিন্ন গান- নিজের কথা বসিয়ে । এই যেমন এখন গান ধরলো-
“ আমার মুক্তি তেলে, মশলায়, এই রান্নাঘরে,,, আমার মুক্তি,,,, হুঁ হুঁ হুঁ হুঁ “।
২৬) ভুয়ো
তপতী মণ্ডল
সকালে ঝলমলে রোদ উঠেছে। ছোট্টু খুব ভোরে উঠে পড়তে বসেছে। বেলা এগারোটা থেকে বিজ্ঞান পরীক্ষা। ওদের ষষ্ঠ শ্রেণির বিজ্ঞান প্রশ্নপত্রে পাঠ্য বিষয়ের সাথে সাধারণ জ্ঞান ও কারেন্ট অ্যাফেয়ার্সের প্রশ্নও থাকে। শেষ প্রশ্ন ছিল--তোমার এলাকার একজন বিশিষ্ট ব্যক্তির নাম লেখো। অনেক ভেবে ছোট্টু লিখল--নবারুণ পাল--আই পি.এস অফিসার। ছোট্টুর বিধায়ক বাবার সঙ্গে বেশ পরিচয় আছে তাঁর। কিন্তু খাতায় এই উত্তরটি কেটে দেওয়ায় ছোট্টু স্যারকে কারণ জিজ্ঞাসা করে। স্যার অবাক হয়ে বললেন--জানো না! উনি একজন ভুয়ো অফিসার। গত পরশু ধরা পড়েছেন। এখন জেলে। ছোট্টুর স্বল্প বোধ আর সরল বিশ্বাসের ভেতর থেকে অস্ফুটে বেরিয়ে এল--ভুয়ো!!
--------------------------------