মোয়াল্লেম নাইয়া
ঘন অন্ধকারে মা-ছেলে মুখোমুখি বসে ৷ মা... সুমনা, ছেলে…. ঋজু ৷ হঠাৎ ঋজু প্রশ্ন করে...
আচ্ছা মা, মিলি পিসি মারা যাওয়ার পর বাবা এত কাঁদছিলেন কেন!আমার অবাক করে দিচ্ছে এটা যে, দাদু দিদা মারা গেলেন অথচ বাবার চোখ থেকে এক ফোঁটা জলও বের হোলনা ৷ কিন্তু মিলি পিসির মৃত্যুতে বাবা কেমন যেন শোকে আকুল হয়ে পড়লেন! যেটুকু জানি,উনি তো বাবার রক্তের সম্পর্কের কেউ নন! তাহলে….?
সদ্য মৃত মিলিকে নিয়ে একটু আগে সবাই চলে গেছে ৷ ঋজুর বাবাও গেছে সঙ্গে, বাড়ির আনাচে কানাচে এখনো শোকের চিহ্ন লেগে আছে ৷ সুমনারও যে কষ্ট হচ্ছে না তা নয়, কিন্তু তার তো কষ্ট হওয়ার কথা নয়! তবুও বুক জুড়ে এত কান্না, এত যন্ত্রনার কারণ কি! এ প্রশ্নটা ঋজু তাকেও করতে পারতো! কিন্তু করেনি, সে শুধু বাবার কান্নাটা দেখেছে আর কিছু দেখতে পায়নি ৷ তাছাড়া ওর দেখার এখন সেই বয়সটাও হয়নি ৷ যে বয়সে মানুষকে এক পলকে দেখলে…. তার বুকের মধ্যে জ্বলতে থাকা চিতা, নিঃশেষ হওয়া কাঠ কয়লা ঠিক খুঁজে পেত! যেমন সেও আজ খুঁজে পেয়েছে ৷ মানব মনের মনস্তত্ত্ব এই চোদ্দ বছর বয়সে ও আর কতটুকুইবা বুঝবে!সুমনা একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলল ৷ অন্ধকার ভেদ করে সে নিঃশ্বাস ঋজুর কানেও পৌঁছেছে ৷ মায়ের এই নিস্তব্ধতা আর দীর্ঘ নিঃশ্বাস ঋজুকে কিছুটা অবাক করল ৷ সে মায়ের এই নিঃস্ব নিমগ্নতা ভাঙার জন্য প্রশ্ন করে... মা, তুমি কি কিছু ভাবছো?
-- সুমনা সামলে নিয়ে বলল, না,তেমন কিছু নয় ৷ তুই তো শুনতে চাইছিলিস, পিসির মৃত্যুতে বাবা কেন এতো কাঁদছিল? জানিনা তুই কতটা বুঝবি ৷ তবু বলছি শোন….
মিলি পিসি ছিল তোর বাবার কলেজের বান্ধবী ৷একটা সময় কলেজ রাজনীতি করতে গিয়েই উভয়ের সঙ্গে সম্পর্ক ৷ সেই সম্পর্ক সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ক্রমশঃ দানা বাঁধতে থাকে ৷ কথাটা কেনো এক সময় তোর দাদুর কানে পৌঁছালে উনি এই সম্পর্ক কোনো মতে মেনে নিতে চাননি ৷ ফলে একরকম জোর করে ওই সম্পর্কের বন্ধন ছিন্ন করার তাগিদে আমার সঙ্গে তোর বাবার বিয়ে ৷…. কিন্তু যার মন পড়ে আছে অন্যদিকে তার মৃত শরীর নিয়েইবা আমি কতদিন বাঁচব ৷ একটা সময় এই অসহ্য জীবন যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পেতে আমি খুঁজতে থাকি তোর এই মিলি পিসিকে ৷ ওর হাতেই তোর বাবাকে সমর্পন করে চলে যেতে চেয়েছি অনেক দূরে ৷ অজানা কোনো দেশে ৷... কিন্তু পারিনি ৷এই মায়ার ভুবনকে ছেড়ে কোথাও যেতে পারেনি ৷... প্রতিদিন আমার এভাবে উদভ্রান্তের মত ঘুরতে দেখে একদিন তোর মলিপিসি নিজেই ডেকে নিল ৷ তারপর অন্ধকার গলিঘুঁজি পার হয়ে আমাকে একটা ঘরের কাছে এনে দাঁড় করালো।...যার পাশ দিয়ে ময়লা ড্রেন অবিরাম ধারায় শহুরে আবর্জনা বয়ে নিয়ে চলেছে ৷ মশা মাছির ভনভনে আওয়াজে মনে হয় কখনো সূর্যের আলো এসব এলাকায় প্রবেশ করেনি ৷কাশতে কাশতে একটা দুর্বল চর্মসার দেহ দরজা খুলে পথ করে দিল ৷বুঝতে পারলাম...উনি ভীষণ অসুস্থ ৷তোর মলিপিসি হাত মুখ ধুয়ে আমার ওর নিজের এবং অসুস্থ বয়স্ক ব্যক্তির জন্য চা করে আনলেন ৷...চা খেতে খেতে পিসি জানাল ৷ সুমনা তোমার কোনো চিন্তা নেই আগামীকাল আমরা চলে যাচ্ছি ৷ ইনি আমার বাবা ৷ উনি মারণ রোগ ক্যান্সারে আক্রান্ত ৷ চাইছিলাম না ওনাকে এ কটাদিন টানা হেঁছড়া করতে ৷ কিন্তু তোমার যন্ত্রণা, তোমার কষ্ট আমি প্রতিদিন দেখি, অনুভব করি ৷আমিও তো একজন মেয়ে !...কি করে পারি একটা মেয়ে হয়ে অপর একটি মেয়েকে তিল তিল করে শেষ করে দিতে!কি করে পারি তার স্বপ্নকে ভেঙে চুরমার করে দিতে! দেখি এই কথাগুলো বলতে বলতে মিলির দু চোখ বেয়ে শ্রাবণ নেমে এসেছে একটু থেমে সে আবার বলা শুরু করলো,..সজলকে অনেকবার বুঝিয়েছি, কিন্তু ও শোনেনি ৷তাই বাধ্য হয়ে তোমার কথা ভেবে আর এখানে থাকতে চাইনা সুমনা?...তুমি সজলকে একটু যত্ন নিও , দেখবে ও একদিন ঠিক তোমার হয়ে উঠবে ?
…..আমি সেদিন স্তব্ধ বিস্ময়ে বিস্ফোরিত চোখে এক হিতাকাঙ্খী মানস প্রতিমাকে প্রত্যক্ষ করেছিলাম ৷ যার মধ্যে কোন চাওয়ার ছিল না ,পাওয়ারও ছিল না শুধু ত্যাগ এবং তিতিক্ষাই ছিল যেন তার জীবনের পরম পাওয়া ৷...সেদিন অনেকক্ষণ ওর কাছে বসে ছিলাম ৷তারপর ও আমাকে এগিয়ে দিয়েছিল রাস্তার মোড় পর্যন্ত ৷বিদায় নেওয়ার আগে ওকে আমি জড়িয়ে ধরে শুধু বলেছিলাম, যদি ঈশ্বর থাকেন,তাহলে পরজন্মে তুমি যেন আমার দিদি হয়েই জন্মিও৷ শুধু স্মিত হেসে আমার কপালে একটা চুমু দিয়ে অন্ধকারে অদৃশ্য হয়ে গিয়েছিল ৷ আমি হতভম্বের মত কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে ফিরে এসেছিলাম ৷
এরপর অনেকটা সময় অতিবাহিত হয়ে গেল ৷ প্রথম প্রথম তোর বাবাকে দেখতাম সারাদিন ঘুরে ঘুরে বাড়িতে এসে কেমন ঝিম মেরে বসে থাকতো৷ কারো সঙ্গে কোনো কথা বলতো না ৷ শুধু আপন মনে আওড়ে যেত…তুমি যদি চলেই যাবে এ বন্ধন তবে কিসের তরে! রাতকে রাত জেগেই কাটাত ৷ কাছে গেলে বিরক্ত হত ৷ তবুও ওর সঙ্গে আমি সারারাত জেগে থাকতাম ৷ এমনি করে অন্ধকারে বসে থাকা, ঘুমে ঢোলে পড়া বা জেগে থাকা দেখে হয়তো ওনার মায়া হোত ৷ তাই কোনো কোনো দিন বারণ করলেও আমি শুনতামনা ৷ এভাবেই ক্রমশঃ আমাদের কাছে আসা, বন্ধুত্ব হওয়া ৷ তারপর একটা সময় তোর মিলি পিসিকে উনি ভুলেই গেলেন ৷ তোর জন্মের ঠিক চার বছরের মাথায় শহর ছেড়ে অনেকটা দূরে তোর বাবা আর আমি ওকে আবিষ্কার করলাম ... মেদিনীপুরের এক অখ্যাত স্টেশানে ৷ ফেলে দেওয়া জঞ্জালের মাঝে প্রায় অর্ধে উলঙ্গ অবস্থায়, কি যেন খুঁজে চলেছে !.... ওই অবস্থায় ও কিন্তু তোর বাবাকে ঠিক চিনতে পেরেছিল…, তুমি সজল না! খবরদার তোমার বউ আমার বোনের মতো... ওর ক্ষতি আমি করতে দেবনা ! যাও যাও এখন থেকে চলে যাও ৷মিলি পিসিকে এই অবস্থায় দেখে তোর বাবা ভীষণ ভেঙে পড়লেন,আমারও মায়া হল ৷...অনেকের সাহায্য নিয়ে ওকে বাড়িতে ফিরিয়ে আনলাম ৷ ততদিন তোর দাদু দিদা ওনারাও মারা গেছেন ৷ ডাক্তার দেখিয়ে সুস্থ করার পর যখন জানতে পারল যে… আমাদের বাড়িতে এসে উঠেছে তখন কিন্তু ও ফিরে যেতেই চেয়েছিল ৷ শুধু আমার একান্ত অনুরোধেই তোর পিসি সেদিন থেকে গিয়েছিল ৷ তবে, কখনও তোর বাবার মুখের দিকে মিলি তাকাতো না ৷হয়তো অনেক অভিমান ওর বুকের মধ্যে মেঘ হয়ে জমে ছিল ৷ কোনদিন বৃষ্টি হওয়ার সুযোগ পায়নি ৷ বৃষ্টি হতে পারেনি বলেই আজ সেই মেঘ হয়ে মিলিকে বিদায় নিতে হল ৷….
বলতে বলতে সুমনার দুচোখ বেয়ে শ্রাবণধারা নেমে এল। ঋকও তার সদ্য যৌবনে ঢোকা বয়সেও বুঝল, কেন বাবার এমন নিরব অশ্রু মোচন ৷ এমন আকুল হয়ে পড়া ৷
-------০০--------
নাম- মোয়াল্লেম নাইয়
গ্রাম+পোস্ট- ইমামদ্দী পুর
থানা- ঢোলাহাট
জেলা- দক্ষিণ২৪ পরগণা
পিন-৭৪৩৩৯৯