ছবিঋণ- ইন্টারনেট
তিনটে মা
মিনাক্ষী মন্ডল
আজ প্রায় আঠারো বছর পর চৌধুরী বাড়ি আবার দুর্গাপূজা হবে। একথা পাড়ার সকলের মুখে মুখে প্রচার হতে থাকলো। পাড়ার বয়োজ্যেষ্ঠরা সকলেই জানেন- আজ থেকে আঠারো বছর আগে চৌধুরী বাড়ির একমাত্র বংশধর সৌম্যদীপ নিখোঁজ হয়েছিল, তখন চৌধুরী গিন্নি দুর্গা মার কাছে কেঁদে কেঁদে বলেছিল,' আমার ছেলেকে ফেরত এনে না দিলে আমি আর তোমার পূজো করবো না'।
আশেপাশের সবাই ভাবতে থাকে তাহলে কি সৌম্যদীপ ফিরে এসেছে ? আবার এটাও ভাবে- ফিরে এলে তো আশেপাশের লোক জানতেই পারতো।
যাই হোক চৌধুরী গিন্নি পূজোর নেমন্তন্ন করতে এলে পাড়ার লোক জানতে পারে -চৌধুরী গিন্নির বড় মেয়ে মা দুর্গার কাছে মানত করায় ১৫ বছর পর তার ঘর আলো করে কন্যা সন্তান জন্ম নিয়েছে, তাই এই দুর্গাপূজো ।
দুর্গা পূজো হবে, সেই পুরনো পুরোহিত ,পুরনো ঢাকিওয়ালা দিয়েই। পুরোহিতের বাড়ি কাছাকাছি হলেও ঢাকিওয়ালার বাড়ি দূর গ্রামাঞ্চলে, সেখানেই খবর দেওয়া হয়েছে ,তবে সেই ঢাকিওয়ালা নাকি আর বেঁচে নেই তাই ঢাক বাজাবে তার ছেলে ,আসবে পঞ্চমীর দিন।
পূজো হবে ঠিকই কিন্তু চৌধুরী গিন্নির খুব মন খারাপ ।
এই দুর্গামার কাছে মানত করেই সে তার একমাত্র ছেলে সৌম্যদীপকে পেয়েছিল কিন্তু সে পাওয়া ছিল মাত্র তিন বছরের জন্য। আজ থেকে আঠারো বছর আগে দুর্গাপূজার ঠিক দশ দিন পর -ছেলেকে ঘুম পাড়িয়ে চৌধুরী গিন্নি গেছিল স্নানঘরে ।স্নানঘর থেকে ফিরে এসে ঘুমন্ত ছেলে খাটে দেখতে না পেয়ে- খুঁজতে কোথাও বাকি রাখেনি ।আজ আঠারো বছর পরেও চৌধুরী গিন্নির চোখ ছেলেকে খুঁজে বেড়ায়।
মহাষষ্ঠী মায়ের বোধনের দিন। মা তার সন্তানদের নিয়ে মর্তে আগমন করলেন, চৌধুরী গিন্নি দুই হাত মাথায় ঠেকিয়ে দুর্গা মার কাছে মানত করলেন-' হে মা আমার একমাত্র বংশধরকে আমার কোলে ফিরিয়ে দাও মা ,আমি আজও পথ চেয়ে বসে আছি'।
সন্ধ্যা আরতি হচ্ছে, আগের ঢাকির থেকেও তাঁর ছেলে আরো ভালো ঢাক বাজায় পুরোহিত নেচে নেচে আরতী করছে।
হঠাৎ সকলের মাঝখানে যে ছেলেটি ঢাক বাজাচ্ছিল সে পড়ে গেল , আরতী বন্ধ করে সবাই তার দিকে এগিয়ে গেল। চৌধুরী গিন্নিকে যে কাঁসর বাজাচ্ছিল সে বলল- এ ছেলেটির মৃগী ব্যারাম আছে মা।
চৌধুরী গিন্নির এই রোগ সম্পর্কে জানা আছে কারণ তার ছেলেরও এই অসুখটি ছিল, আজ থাকলে এই ছেলেটির মত এত বড়োই হত।
চৌধুরী গিন্নি এগিয়ে গিয়ে ছেলেটি জ্ঞান ফেরানোর ব্যবস্থা করল , আগেই কেউ একজন তার গায়ে জল ঢেলে দিয়েছিল।
চৌধুরী গিন্নি ছেলেটির জামা খুলে দিতেই চমকে উঠলো বুকের ডান দিকে সেই জারুলের দাগ।
কিছু না ভেবেই চিৎকার করে উঠল সৌম্য।
ছেলেটি ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে চৌধুরী গিন্নির দিকে ফ্যাল ফ্যাল করে চেয়ে বলল আমি কানাই।
সেই মুহূর্তেই কাঁসরওয়ালা বলে উঠলো মা আপনি কার কথা বলছেন ?একটু খুলে বলেন তো আমাকে।
তখন চৌধুরী গিন্নি তাকে সব কথা খুলে বল্লে -" কাঁসর ওয়ালা বলে আমার মনে হচ্ছে এটা আপনারই ছেলে আছে মা ,কেননা এটা বিধু ঢাকির নিজের ছেলে না,এটা আমি জানি কারণ আমরা একই গ্রামের লোক ।আপনি যেই সময়ের কথা বলছেন ততদিন আগেই বিধু ঢাকি একটা বাচ্চা নিয়ে গিয়ে গ্রামের মানুষদের বলেছিল -"একে শহরে কুঁড়িয়ে পেয়েছি ,আমার তো কোন সন্তান নাই একে আমি মানুষ করব"। কিছুদিন পরে বিধু ঢাকির মৃত্যু হয়।
এখন এই ছেলে বিধু ঢাকির বউ এর কাছে থাকে ,তাকেই সে মা বলে জানে। আরও বলল- "বিধু ঢাকির বৌ এর কলিজার টুকরা আছে এ ছেলে"।
আপনারা ওর সাথে কথা বলতে পারেন।
চৌধুরী গিন্নি ,লোক পাঠিয়ে বিধু ঢাকির বউকে নিয়ে এলো বাড়িতে, সবকিছু শুনে বিধুরবউ চৌধুরী গিন্নির পায়ে ধরে বলতে লাগলো -'মা আমি কিছু জানি না,আমার স্বামীর অপরাধ আমাকে দিবেন না'।
আমি এই ছেলে ছাড়া বাঁচতে পারব না।
চৌধুরী গিন্নি দুর্গা মার কাছে হাত জোড় করে প্রণাম করে বলল- "মা দুগ্গা মাগো আজ থেকে আমার ছেলের তিনটে মা"।
।। সমাপ্ত।।
✍️ মিনাক্ষী মন্ডল
কথা কাহিনি ই- ম্যাগাজিন পত্রিকার নির্বাচকমণ্ডলীকে জানাই আমার আন্তরিক ধন্যবাদ��
উত্তরমুছুন