ছবিঋণ- ইন্টারনেট
ওরা পারে
প্রদীপ বিশ্বাস
-----বাদাম - - - চাই, বাদাম - - - -! এ--বাদাম-----
বিচিত্র সুরে কথাগুলো বলতে বলতে বাসু এগিয়ে চলে বনগাঁ লোকালের পাশ দিয়ে।
-----এই বাদাম দে তো পাঁচ টাকার!
বাসু একটা ঠোঙায় গুটিকয়েক বাদাম তুলে লোকটার হাতে দেয়।
------একি রে! মাত্র এ'কটা বাদাম!! এ তো সোনা-রূপোর দাম রে! তোদেরই তো রমরমা।
------ চাকরি না করে এটা করলেই ভালো করতাম রে! খৈনি ডলতে ডলতে পাশ থেকে আর একজন ফুটুনি কাটে।
বাসু কিছু বলে না। লোকটার হাত থেকে দশ টাকার নোটটা নিয়ে পাঁচ টাকার একটা কয়েন ফেরত দিল।
ওসব কথা গায়ে মাখতে নেই। ওসব শুনতে শুনতে গা-সওয়া হয়ে গেছে। বৃথা তর্ক করে কোনো লাভ নেই সে তা ভালো করেই জানে। পাঁচ টাকার বাদাম কিনে পঞ্চাশ - একশো টাকার নোট ধরিয়ে দেয়। বাধ্য হয়ে নিতে হয়, ভাঙানি গুছিয়ে দিতে হয়। না দিতে পারলে ঠাট্টা টিটকারিও শুনতে হয়। হকাররা যেন কোনো ভিন্ন গ্রহের জীব ঐ সব লোকেদের কাছে। তাদের মান সম্মান থাকতে নেই, লাজ-লজ্জার বালাই থাকলে চলবে না। তর্ক করা যাবে না, কথা শুনতে হবে। না হলে মাল বিক্রি হবে না। এমনকি অনেক সময় পিঠ বাঁচাতে হিমসিম খেতে হয়।
তাছাড়া বাসুর আজ ওসব আরও শুনতে নেই। বেশি কিছু বাদাম আজ তড়িঘড়ি বিক্রি করতে হবে। তারপর ছুটতে হবে ওষুধের দোকানে।
মতি ডাক্তার সপ্তা'দুই আগে প্রেসক্রিপশানটা ধরিয়ে দিয়ে বলেছিল - ওষুধগুলো এনে এখনি খাওয়াতে শুরু কর বাসু, নইলে বিপদ আছে।
বাসু বলতে পারেনি মতি ডাক্তারকে "অত পয়সা তার হাতে নেই"। ভেবেছিল বাড়তি পরিশ্রম করে ওষুধ কেনার পয়সাটা সে জোগাড় করবে।
কিন্তু, তা আর হয়ে ওঠেনি। নুন আনতে পান্তা ফুরোয়। তায় দু'দিন আবার ট্রেন ঠিকমত চলেনি। পরিস্থিতি ভীষণ জটিল!ট্রেন অবরোধই যেন সমস্ত সমস্যা সমাধানের উপায়!কিছু করার ছিল না বাসুর। ট্রেনের চাকার সাথেই যে তার মত হকারদের জীবনের ভাগ্যের চাকা বাঁধা পড়ে আছে। ট্রেনের চাকা বন্ধ হলে তার মতন যারা তাদের নিত্যদিনের জীবন-চলার চাকা থেমে যায়। আর তাই বাসু অসুস্থ মাকে ওষুধ কিনে দিতে পারেনি।
আজ যে করে হোক ওষুধ সে কিনবেই। পকেটে হাত দিল, প্রেসক্রিপশানটা ঠিকঠাক আছে কি না দেখে নিল।
বাদামের উপর হাত বুলাল,ছোট বড় সাইজ করে নিয়ে হাঁক দিতে দিতে এগিয়ে গেল তিন নম্বর প্লাটফর্মের দিকে। এই মাত্র নৈহাটি লোকাল ঢুকেছে।
বাদামের ঝুড়িটা মাথায় নিয়ে কনুইয়ের গুতো খেতে খেতে এগিয়ে চলে বাসু একটু ফাঁকা জায়গার দিকে।
এক থেকে নয় নম্বর প্লাটফর্ম পর্যন্ত দৌঁড়-ঝাপ করে অতি দ্রুত বাদাম বিক্রি করে বাসু। একসময় সে বুঝতে পারে তার টার্গেটটা মোটামুটি পূরণ হয়েছে। প্লাটফর্মের ঘড়ির দিকে তাকাল। পাঁচটা বেজে পঁয়তাল্লিশ। ছয়টার হাসনাবাদ তাকে ধরতেই হবে।
দ্রুত বাইরে আসে বাসু। নির্দিষ্ট জায়গায় ঝুড়িটা জমা দেয়। দু'পা বাড়াতেই দেখে দাদা (!) খৈনির পিক ফেলছে । আড়চোখে তাকে দেখেও নিয়েছে। তাড়া থাকলেও তার পাশ কাটিয়ে যাওয়া হ' ল না। এখানেই তো তাকে করেকম্মে খেতে হবে! মনে মনে বিরক্ত হলেও নির্দিষ্ট পয়সাগুলো গুনে দিল দাদার হাতে। সময় নষ্ট করার মত সময় তার হাতে ছিল না যে!
বাসু দৌড়ে যায় ফার্মেসিতে। দু' তিনজন খদ্দের দাঁড়িয়ে আছে। প্রেসক্রিপশানটা এগিয়ে দিয়ে বলে- দাদা ছ'টার ট্রেন ধরব, একটু তাড়াতাড়ি দেবেন।
-------এখানে সবাই তাড়াতাড়ি করে দাদা! এত তাড়া যখন, আর একটুকুন আগে আসতে পারতেন। শ্লেষ ভেসে এল।
এদের কী করে বোঝাবে বাসু তাদের মত যারা, সময় হাতে করে আসা তাদের কাছে কত দুরূহ। মিনতি-ভরা চোখে তাকিয়ে থাকে শুধু। মনটা তার ছটফট করতে থাকে।
--------সবগুলো নেবেন?
--------হ্যাঁ, কত দাম!
--------সব একসঙ্গে নিলে অনেক, তার চে বরং তিনদিনের ওষুধ নিয়ে যান।
--------তাই দিন। অত ভাববার সময় ছিল না বাসুর। মা'র পেটে ওষুধটা তো পড়বে আজ!
দাম মিটিয়ে ওষুধ নিয়ে বেরিয়ে পড়ে বাসু। ঘড়ির দিকে তাকায়, পাঁচটা বেজে আটান্ন।দৌঁড়তে শুরু করে। ছ' টার হাসনাবাদ তাকে ধরতেই হবে। নইলে বাড়ি পৌঁছতে অনেক দেরি হবে!---না জানি মা আজ কেমন আছে! চোখ ভিজে ওঠে বাসুর। বুকটা আবার হালকাও হয়ে ওঠে, মায়ের জন্য আজ সে ওষুধ নিয়ে যাচ্ছে।
হাতের চেটোয় চোখ মুছে দৌঁড়তে থাকে বাসু, কার যেন পা মাড়িয়ে দেয়। বিচ্ছিরি একটা গালাগালি শুনতে হ'ল তাকে। ওসব দেখার সময় এখন তার নেই। এই ট্রেনটা তাকে ধরতেই হবে।
ইস্টিশানে পা দিয়ে বাসু শুনতে পায় সাত নম্বরে হাসনাবাদ লোকাল হুঁইসেল মারছে!
বাসু দৌঁড়য়।ট্রেন ছেড়ে দিয়েছে। বাসু দৌঁড়চ্ছে। ট্রেনটা তাকে ধরতেই হবে।
- - - - দাদা, পারবেন না! কে একজন বলে ওঠে।
--------ওরা পারে! এটা ওদের নিত্যদিনের অভ্যেস। আর একজন বলে।
--------দাদা আর একটুখানি! ভেতর থেকে আওয়াজ ভেসে এল।
-------ছিনতাইবাজ এমনি করে ওঠে। বিশেষজ্ঞের মতামত।
সব কথা কানে আসে বাসুর। ট্রেনের হাতলটা প্রায় ধরে ফেলেছে। হঠাৎ পা পিছলে গেল। ফসকে গেল ট্রেনের হাতল। ছিটকে পড়ে বাসু।
'গেল গেল' করে চেঁচাল লোকজন। হাসনাবাদ লোকাল ছুটে চলেছে। প্লাটফর্মে পড়ে রইল বাসুর সঙ্গাহীন দেহ। ডানহাতে উঁকি মারছে তার মায়ের জন্য সদ্য কেনা ওষুধগুলো!
-----------------------