গল্প ।। পাদুকাপুরাণ ।। সোমা চক্রবর্তী
ছবিঋণ- ইন্টারনেট
পাদুকাপুরাণ
সোমা চক্রবর্তী
চটিজোড়ায় পা গলালেই ঘটনাটা ঘটছে। একেবারে সাধারণ, বাইরে পরার চটিজুতো। গোড়ালির কাছে একটুখানি ক্ষয়েও গেছে। বেশ অনেকদিন ধরেই পরছি চটিজোড়া। এতদিন তো সব ঠিকঠাক ছিল। হঠাৎ করে দু'দিন ধরে চটিজোড়ার যেন ইচ্ছেবোধ তৈরি হয়েছে। সে যেন নিজের ইচ্ছায় চলতে চাইছে। হয়তো লাইব্রেরী যাবো বলে বেরোলাম, কখন দেখি জিলিপির দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে আছি। নাঃ, জ্বালালো দেখছি!
বাজারে যেতেই হবে। ঘরে তেমন কিছু নেই। আজ না হয় যেমন তেমন করে চলে যাবে। কিন্তু কাল বলে একটা কথা রয়ে যায় সবসময়। বাজারের ব্যাগ নিয়ে বেরোলাম ব্যাজার মুখে। ভাবলাম বেশী বেশী কিনে আনব যা পাই। এরকম করোনা আবহে রোজ রোজ কার আর বেরোতে ভালো লাগে! "ওয়ার্ক ফ্রম হোম" সবাইকে কম-বেশী কুঁড়ে বানিয়ে তুলেছে। আমার তো বাইরে বেরোনোর অভ্যাস প্রায় চলেই গেছে। ভাবতে ভাবতে দেখি, বাজারের কাছাকাছি এসে পড়েছি। চওড়া খালটার ওপারে বাজার। অবাক হয়ে দেখি, আমার চটিজোড়া বাজারের দিকে না নেমে সোজা চলেছে সামনের দিকে। ওদিকে একটা বস্তি আছে- চিরকাল জানি। আমি নিজে যাইনি কখনও। চটিজোড়ার লক্ষ্য দেখি সেদিকে। আমি বাধা দিতে পারছি না। বস্তির মধ্যে পৌঁছে প্রথম দুটো বাড়ি ছেড়ে একটা বাড়ির সামনে চটি দাঁড়াল। কি করব বুঝতে পারছি না। বাইরে কেউ নেই। ভেতর থেকে হালকা কথা, চাপা গলায় কাশির শব্দ শোনা যাচ্ছে। হঠাৎ একটা অল্প বয়সী মেয়ে বাইরে আসতে গিয়ে আমাকে দেখে ভেতরে চলে গেল। আস্তে আস্তে কাউকে কিছু বলল। ভেতর থেকে দুর্বল গলায় আর কেউ 'কে' বলে বাইরে বেরিয়ে এলো। দেখি রিক্সাওয়ালা নিতাই। নিতাইকে আমি খুব চিনি। স্টেশনে যাতায়াতের সময় যারা আমাকে সবচেয়ে বেশী নিয়ে যায়, নিতাই তাদের মধ্যে একজন। মুখে একটা চাদর চাপা দিয়ে নিতাই দরজার একটু কাছে এসে জিজ্ঞেস করল, -দিদি আপনি এখানে?
কি উত্তর দেব বুঝতে পারছি না। কোনমতে বললাম, -কেমন আছো নিতাই?
-ভালো না দিদি। বাড়ি শুদ্ধু লোকের করোনা। গায়ে জ্বর- কাজে যাচ্ছি না আজ চারদিন হয়ে গেল। কাল থেকে খাওয়া প্রায় বন্ধ।
-বলে কি! কাল থেকে সপরিবারে উপোস করে আছে ছেলেটা? অবশ্য কিই বা করবে! রিক্সা চালিয়ে রোজগার। কাজ করতে না পারলে তো এমনটাই হবে। শুনলাম, শুধু ওরাই নয়। এখানকার প্রায় সব বাড়িতেই এক অবস্থা। অসুধ খাচ্ছে কিনা জিজ্ঞেস করতে আর সাহস হলো না। জানিই তো, কি উত্তর পাব। কিছু শুকনো খাবার আর জ্বরের অসুধ কিনে দিয়ে তখনকার মতো বিদায় নিলাম। কিন্তু মনের অশান্তি আমার কাছ থেকে বিদায় নিল না। পায়ে পায়ে যেদিকে আমাদের ক্লাব আর লাইব্রেরী সেদিকে এগোলাম। আমি এমনিতে বেশ আত্মকেন্দ্রিক, শান্তিপ্রিয় মানুষ। কিন্তু মনে মনে নিজেকে বেশ মহান, পরোপকারী ব্যক্তি বলে ধারণা করতে পছন্দ করি। ঝামেলায় বিশেষ জড়াতে চাই না। আবার লোকে আমাকে যাতে মনুষ্যত্বহীন মনে না করে, সেই ভয়ও পাই। অবশ্য কাউকে কষ্ট পেতে দেখলে আমারও কষ্ট হয়। সে কষ্টের উপশম হোক তাও আমি চাই। মোটের ওপর, খুব একটা খারাপ মানুষও আমি নই। তবে ঘরের খেয়ে পরের মোষ তাড়িয়ে বেড়িয়েছি- এই অপবাদ কেউ দেবে না আমাকে। এখন অবশ্য নিজের চটিজোড়ার কল্যাণে অবস্থা আমার করুণ। সে এখন ক্লাবের পথে। অগত্যা আমিও।
ক্লাবে এসে সবাইকে সব বললাম। ভাগ্য ভালো, সেখানে হুল্লোড়বাজ কিছু স্কুল-কলেজের ছেলেমেয়ে পেয়ে গেলাম- যারা বইয়ের সংজ্ঞার সাথে তাল মিলিয়ে শুধুমাত্র ভালো হয়ে ওঠার প্রতিযোগিতায় ব্যস্ত ছিল না তখন। দেখা গেলো, একবেলার মধ্যে চাঁদা উঠলো মন্দ নয়। একটা কমিউনিটি কিচেন আর ডাক্তারের ব্যবস্থা করা হল। কয়েকদিন কেমন যেন ঝড়ের মতো কেটে গেল। আমরা হাতে গ্লাভস আর মুখে মাস্ক এঁটে ঘরে ঘরে পৌঁছে গেলাম। আমার অবশ্য না গিয়ে উপায় নেই। বাকি ছেলেমেয়েরা গেল সদিচ্ছায়। আরও বেশ কিছু মানুষ- না, 'উদার, ভালো মানুষ' বলা উচিত- তাঁরা স্বেচ্ছায় আমাদের সঙ্গে যোগ দিলেন। করোনা তার প্রথম, দ্বিতীয়, তৃতীয় ঢেউ নিয়ে আছড়ে পড়তে লাগলো। আমরাও সে ঢেউ প্রতিহত করতে চেষ্টা করতে লাগলাম। আনন্দ যে হলো না, সে কথা বলব না। তবু ভেতরের নির্বিরোধী, ছা-পোষা সত্ত্বাটি সর্বদাই আমার 'হতভাগা চটিজোড়া'র মুন্ডুপাত করে ফিরত মনে মনে। চটিজোড়ার কিন্তু ভ্রুক্ষেপ নেই। সে দিন দিন আরও স্বাধীন, আরও নির্বিকার হয়ে উঠছে। আমি সম্পূর্ণ ভাবে তার ইচ্ছাধীন। এর মধ্যে কতবার ভেবেছি, হতভাগাকে বিদায় করে দিই। সেইমতো নতুন, সুন্দর একজোড়া চটি কিনেও এনেছি। কিন্তু বেরোনোর সময় যেই নতুন চটিজোড়ার দিকে তাকাই, পা মহোদয়রা গিয়ে পুরোনো চটিজোড়াতেই ঠিক সেঁধিয়ে যায়। হতাশ হয়ে মনে মনে ভাবি, সঙ্গদোষই হবে!
এইভাবেই নিতাই, কাদের, পরেশ, বিধুপিসি- একে একে সবাই সেরে উঠল। তারই সঙ্গে একটা ম্যাজিক ঘটল এই যে, যারা সেরে উঠল তাদের মধ্যে থেকে বেশীর ভাগ লোকই আমাদের সঙ্গে যোগ দিতে এলো। ফলে আমাদের দল ক্রমশই বড় হতে লাগল। বাড়তে লাগল সাধ্য।
দেখতে দেখতে দূর্গাপূজা এসে পড়ল। খবর পেলাম, সপ্তমীর সন্ধ্যাবেলা পূজামন্ডপের সামনে নাগরিক কমিটির পক্ষ থেকে নাকি আমাদের সম্বর্ধনা প্রদান করা হবে। ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা তো খুব খুশী। খুশী আমরা সবাই। বড় বড় মানুষদের লম্বা লম্বা বক্তৃতার পর আমাদের মঞ্চে ডাকা হল। সবার সঙ্গে হাসি হাসি মুখে ছবি তোলার সময় মনে হলো, স্বর্গের পদ্মবনে একরাশ তাজা, ফোটা পদ্মের মাঝখানে যেন আমি দাঁড়িয়ে রয়েছি। ছবিখানা আজও আমার বসার ঘরে সুন্দর করে বাঁধিয়ে, টানিয়ে রাখা আছে। তবে সৌভাগ্যের বিষয় হল, আমার সেই হতভাগা চটিজোড়াকে সেই ছবিতে একেবারেই দেখা যাচ্ছে না!
---------------------------------------
Kalikapur, Taki road,
Darun
উত্তরমুছুনFantastic...khub sundor
উত্তরমুছুন