প্রণয় বহুবছর গ্রামের বাড়ি থেকে বাইরে । প্রণয়ের বদলির চাকরি । ষ্টেট ব্যাঙ্কের ম্যানেজার। দুবছর বিহারে তো দুবছর আন্দামানে । বদলির চাকরির জন্য ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে ঘুরে বেরিয়েছে । পুজোর সময় ও শীতের সময় এক সপ্তাহের ছুটি নিয়ে বাড়ি আসে । এছাড়া সুযোগ সুবিধা পেলে অফিসের কাজ নিয়ে কলকাতায় আসলেই দুদিন গ্রামের বাড়িতে থেকে যেত। গ্রামের বাড়িটা ছিল প্রণয়ের জন্মভিটে ও ভালবাসার বাড়ি । এই গ্রামের বাড়িতেই তার জন্ম ফলে যেখানেই থাকুক সুযোগ পেলেই বাড়ি আসার জন্য মুখিয়ে থাকত। প্রণয় ভারতের সমস্ত রাজ্য ঘুরে ঘুরে যখন কলকাতায়এসে পাকাপাকি ভাবে চাকরিতে থেকে গেল তখন কলকাতায় একটা ফ্ল্যাট কিনে নিল । আর এদিকে প্রণয়ের বাবা স্কুলের শিক্ষকতা থেকে রিটায়ার করেছেন । দেখাশোনার সুবিধার্থে বয়স্ক বাবা-মাকে কলকাতায় নিজের ফ্ল্যাটে রাখতে চেয়েছিল । প্রণয়ের বাবা ও মায়ের অতিপ্রিয় ছিল এই গ্রামের বাড়ি ও গ্রামের মানুষজন । আর এই গ্রাম ছেড়ে কোথাও গিয়ে থাকার কথা মনেও করতেন না । প্রণয়রা তিন ভাইবোন । প্রণয়ের এর দাদা বিদেশে থাকেন এবং বছর পাঁচেক পর একবার গ্রামের বাড়িতে আসে ।বোনেরও বিয়ে হয়ে গেছে । প্রণয়ের বাবা যতদিন বেঁচে ছিলেন ততদিন পাকাপাকি ভাবে প্রণয়ের কাছে গিয়ে থাকেন নি । মাঝেমধ্যে গিয়ে কিছুদিনের জন্য প্রণয়ের কাছে থেকে আসতেন । গ্রামের বাড়িতে ফুলের বাগান, সব্জির বাগান আছে । এছাড়া নারকেল , সুপুরি গাছ দিয়ে ঘেরা। একটি ছোট পুকুর ও আছে । পুকুরে অনেক মাছ আছে । ফাল্গুন, চৈত্র ও বৈশাখ মাসে পুকুর থেকে মাছ তুলে গ্রামের সবাইকে দিত এবং নিজেরা সবাই খেত । গ্রামের পাকাবাড়ি বলতে প্রণয়দের বাড়ি আর কয়েকটা পাকাবাড়ি ছিল ছড়িয়ে ছিটিয়ে । এছাড়া বেশির ভাগ বাড়ি বেড়া দিয়ে ঘেরা ও টালির চাল। গ্রামের লোকেরা প্রণয়ের বাবাকে খুব সন্মান করত । প্রণয়দের গ্রামের প্রত্যেক মানুষের মধ্যে ছিল প্রচুর আন্তরিকতা । পুজোর সময় প্রণয়দের গ্রামে একটিমাত্র দুর্গাপূজা হত , আর সেখানে গ্রামের সবাই একসাথে মিলে কাজ করা , খাওয়া হৈচৈ করে খুব আনন্দ হত । তবে গ্রামের রাস্তা মাটির ছিল বলে বর্ষাকালে জল জমে রাস্তায় কাঁদা হয়ে যেত । একসময় গ্রামের সবাই মিলে ঠিক করা হয়েছিল রাস্তায় ইট ফেলে পাকা রাস্তা তৈরি করা হবে । পাকা রাস্তা তৈরির ব্যাপারে প্রণয়ের বাবা অজয় মাস্টারমশাইয়ের সাথে গ্রামের বড়রা সবাই আলোচনা করেছিল। মাস্টারমশাইকে এতটাই সন্মান করত যে গ্রামের কোন কাজই মাস্টারমশাইয়ের মতামত ছাড়া করা হত না । বেশ কয়েক বছর বাদে গ্রামের রাস্তা পাকা হল ঠিকই কিন্তু অজয় মাস্টার মশাইয়ের আর দেখে যাওয়া হয় নি । কেননা তার আগেই মাস্টারমশাই নার্ভের অসুখ হয়ে এক বছর কষ্ট পেয়ে সবাইকে ছেড়ে স্বর্গে চলে গেলেন ।
দাদা ও বোন দূরে থাকে আর বাবা মারা যাওয়ার পর মা একা হয়ে গেল ফলে মার অনিচ্ছা স্বত্বেও প্রণয় মাকে কলকাতার ফ্ল্যাটে নিয়ে গেল । বাড়ি বাগান, পুকুর ফেলে এমনকি গ্রামের মানুষজনকে ছেড়ে যেতে খুব কষ্ট হয়েছিল প্রণয়ের মার । তবে প্রণয় অফিসের ছুটি দেখে মাসে একবার করে মাকে নিয়ে গ্রামের বাড়িতে এসে দুদিন থেকে যেত । আর তখন বাগানের সবজি ও পুকুরের মাছ তুলে গ্রামের সবাইকে দিয়ে নিজেরা কিছু নিয়ে যেত কলকাতায় । ক্রমশ অপিসের কাজের চাপে এছাড়া ছুটির দিনে অনান্য কাজের ব্যস্ততায় গ্রামের বাড়িতে প্রণয়ের মাকে নিয়ে আসা হয়ে ওঠে না । পাশের বাড়ির লালটুকে বাড়িটা দেখশুনার জন্য বলা হয়েছিল । লালটু ভালই দেখেশুনে রাখছিল । মাঝেমধ্যে গ্রামের বাড়ি থেকে ফসল ও মাছ নিয়ে কলকাতার ফ্ল্যাট বাড়িতে দিয়ে আসত । আর প্রণয়ের মা নারকেল,সুপুরি, লিচু ও আম গাছগুলি এবং গেটের সামনে মাধবীলতা,ও শিউলি গাছ কেমন আছে সবকিছুর খবর নিতেন লালটুর কাছ থেকে । এইভাবে দশবছর পার হয়ে গেল। একসময় লালটু জানালো ও নিজের কাজের চাপে বাড়িটা ভাল করে দেখাশুনা করতে পারছে না। ফলে বাড়িটা জঙ্গলে ভরে গেছে , পুকুরটা আগাছায় ভরে গেছে। অনেকটা জীর্ণ পোড়ো বাড়িতে পরিণত হয়েছে । লালটু বাড়িটাকে হয় বিক্রি করতে , নাহলে প্রমোটারের কাছে ফ্ল্যাট তৈরির জন্য দিতে বলল ।
লালটুর কথা শুনে প্রণয় গ্রামের বাড়িতে যাওয়ার কথা ভাবলো । মার সাথে কথা বলে গ্রামের বাড়িতে যাওয়ার জন্য রওনা হল প্রণয়। প্রায় দশ বছর বাদে প্রণয় গ্রামের বাড়িতে ফিরছে । গ্রামে ঢুকতে ঢুকতে চারিদিক দেখছে আর প্রণয়ের মনে হচ্ছে অন্য কোনো নতুন গ্রামে ঢুকছে । গ্রামের এখন পিচের রাস্তা হয়েছে , বেড়া ও টালির চালের বাড়িগুলোর জায়গায় ইটের দালান বাড়ি উঠেছে । রাস্তার পাশে যে পুকুরগুলি ছিল সেই পুকুরগুলি মাটি দিয়ে বুজিয়ে মাঠ তৈরি করে তাতে চার পাঁচতলা ফ্ল্যাটবাড়ি উঠেছে । গ্রামের দুর্গামন্দির ও শিবমন্দির পাকা হয়েছে । খেলার মাঠগুলো সুন্দর পাঁচিল দিয়ে ঘিরে দেওয়া হয়েছে । একপাশে বাচ্চাদের জন্য পার্ক তৈরি করা হয়েছে। গ্রামে ঢুকতে ঢুকতে প্রণয় তার ছোটবেলার পাড়াটাকে চিনতে পারছিল না । পথের দুধারের গাছগুলিকে কেটে রাস্তাটাকে চওড়া করা হয়েছে । প্রণয়দের বাড়িতে নানারকমের ফুল ও ফলের গাছ আছে আর সেই গাছগুলোতে সকাল হতেই কত রঙের ও কত রকমের পাখি এসে বসতো আর সেইসব পাখিদের ডাক শুনতে খুব ভাল লাগত । প্রণয়দের বাড়ির পুকুরটায় দুপুরবেলা পাড়ার অনেকে স্নান করতে আসত আর পুকুরের চারপাশে পেয়ারা ও কুল গাছ থেকে ফল পেড়ে খেত । অনেকে মিলে পুকুরে সাঁতার কাটা , বড়শি দিয়ে পুকুর থেকে মাছ ধরা কি যে আনন্দ হত । তারপর পাড়ার বন্ধুরা একসাথে ঘুড়ি ওড়ানো , ফুটবল খেলা , জল কাঁদা মেখে বাড়ি ফেরা সে যে কি মজা ভাবা যায় না । এখন সেই খেলার মাঠ গুলোতে পার্ক হয়েছে , তাতে দোলনা ,ঢেঁকি ও স্লিপার বসেছে । প্রণয়দের সামনের বাড়িটা প্রদীপদের বাড়ি। প্রদীপ প্রণয়ের বন্ধু । প্রদীপদের ছোট টিনের চালের বাড়িটার জায়গায় সুন্দর পাকাবাড়ি উঠেছে । রাস্তায় ভ্যানগাড়ি , রিক্স খুব কম চলে তার পরিবর্তে বাইক, ট্যাক্সি ও টোটো গাড়ির শব্দ দিনরাত কান ঝালাপালা করে দিচ্ছে । পাশে মহামায়াদের বাড়ির আম বাগানটার কথা খুব মনে পড়ছে । ঝড়বৃষ্টি হলে প্রচুর আম পড়তো আর গ্রামের বাচ্চারা বৃষ্টিতে ভিজে ভিজে ঝড়ের মধ্যে আম কুরাত । সেই আমবাগান আর নেই । আম গাছ কেটে পরিষ্কার করে ক্লাবঘর বানিয়েছে । সেখানে নানারকমের পুজো ও অনুষ্ঠান হয় ।
গ্রামের পথে আসতে আসতে যাদের সাথে দেখা হচ্ছিল তারা সবাই প্রণয়ের বাবার কথা জিজ্ঞাসা করছিল । মাস্টারমশাই নেই শুনে সবাই দুঃখ প্রকাশ করছিল । আর সবাই একই কথা বলছে , কি ভাল মনের মানুষ ছিলেন । গ্রামের কত ছেলেমেয়েকে এমনিই পড়িয়ে দিত । তারা সবাই এখন ভাল চাকরি করছে , কেউ বা ব্যাবসা করছে । প্রণয় ওদের বাড়িটার সামনে এসে দাঁড়িয়ে দেখছে নিজেদের বাড়ি নিজেই চিনতে পারছে না । সমস্ত বাড়ি জঙ্গলে ভরে গেছে , দরজা জানলায় কোথাও কোথাও উইপোকা উঠেছে । ঘরের চারপাশ ধুলো বালি ময়লায় ভরে গেছে । ফুলগাছগুলি ও সবজি গাছগুলি অযত্নে মাথা নিচু করে দাড়িয়ে আছে ।
প্রণয় আসার সময় লালটুকে খবর দিয়ে এসেছিল । প্রণয় বাড়িতে আসার পর পরই লালটু এসে হাজির হল আর বলল নিজের কাজের চাপে দেখভাল করতে পারে নি । বাড়িটার খুব খারাপ অবস্থা ।
প্রণয় বলল , হ্যাঁ তা তো দেখতেই পারছি গ্রামের খুব উন্নতি হয়েছে কিন্তু আমাদের বাড়িটার অবস্থা জীর্ণ হয়ে এসেছে ।
লালটু বলল , গ্রামের উন্নতি হয়েছে তো মলয়ের জন্য । মলয় ভোটে জিতে পার্টির নেতা হয়েছে । ওই গ্রামের রাস্তা মেরামত করেছে । এছাড়া গ্রামের যত উন্নতি দেখছ সব মলয়ের জন্য হয়েছে । মলয়দা তোমাদের বাড়িটার কথা বলছিল । যদি তুমি বাড়িটা বিক্রি করতে চাও বা ফ্ল্যাট তুলতে চাও তাহলে মলয়দা বলেছে তোমার সাথে দেখা করবে । কিন্তু এখন তোমাদের বাড়িটা থাকার অবস্থায় নেই । তুমি আমাদের বাড়িতে দুদিন থেকে সব ঠিকঠাক করে যাও ।
প্রণয় বলল একটা লোক দেখে দাও আমাদের বাড়ির একটা ঘর পরিস্কার করে দেবে । তাহলে আমি আমাদের বাড়িতেই থাকব ভাবছি । আর আমি মার সাথে কথা বলে নেব । মা যা বলবে সেইমত বাড়িটাকে নিয়ে ভাবব ।
ঠিক আছে আমি লোক এনে তোমার জন্য একটা ঘর পরিস্কার করে দিচ্ছি কিন্তু খাবার আমাদের বাড়ি থেকে দিয়ে যাব কেমন । প্রণয় বলল তাই হবে ।
মাকে ফোনে সব কথা বলে মার মতামত জানতে চাইল প্রণয়। মাস্টারমশাই মারা যাওয়ার পর প্রণয়ের মা ছেলের উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছিলেন । তাই উনি ছেলেকে বলেই দিলেন 'তুই যা করবি তাতেই আমার মত আছে ।' মায়ের কথা শুনে একটু নিশ্চিন্ত হোল প্রণয়। তারপর ঘরে ঢুকে দেখল আলো জ্বলছে না । লালটুকে ডাকল । লালটু এসে বললে ইলেকট্রিকের লোক এসে লাইন কেটে দিয়েছে । আমি তোমাকে মোমবাতি ও দেশলাই দিয়ে যাচ্ছি । কিছুক্ষণ পরে লাল্টুর পাঠানো লোক এসে ঘর পরিষ্কার করে দিয়ে গেল । ঘরে তেমন কিছু ছিল না, একটি খাট ও আলমারি ছিল তাতে ধুলো পরে আছে । চারদিকে উইপোকা বাসা করে আছে । তবে বাড়ির চাপা কলটা ভাল আছে । কেননা পাড়ার সবাই এই কল থেকে খাবার জল নেয় । এক্টু বাদে লাল্টু এসে মোমবাতি , দেশলাই , জল, খাবার ও একটি বালিশ ও একটি চাদর দিয়ে গেল । সন্ধ্যে হতেই প্রণয় মোমবাতি জ্বেলে দিল । ঘরে বসে প্রণয়ের ছোট বেলা থেকে বাইরে যাওয়ার আগে পর্যন্ত সব কথা একে একে মনে পড়ছে । ছোটবেলায় বাবার হাত ধরে স্কুলে যাওয়া, কত মজা হত , মা তার পছন্দের টিফিন বানিয়ে দিত । আর স্কুলের বন্ধুদের সাথে সেই টিফিন ভাগ করে খাওয়া । স্কুল ছুটির দিনে পাড়ার বন্ধুদের সাথে মাঠে গিয়ে ফুটবল খেলা , বন্ধুরা মিলে সবার গাছ থেকে ফল পেড়ে খাওয়া ,সেসব ছিল খুব মজার দিন । প্রণয়দের বাড়ির সামনে প্রদীপদের বাড়ির সকলের সাথে খুব ভাল সম্পর্ক ছিল । মাসীমা মার অনেক কাজে সাহায্য করে দিত । এখন মাসীমা ওমেসমশাই কেউ বেঁচে নেই । প্রদীপ ও পরিতোষ দুই ভাই একসাথে ভালোই আছে । নানা স্মৃতির কথা ভাবতে ভাবতে রাত আট টা বেজে গেল । প্রণয় খাবার ও জল খেয়ে খাটের উপর চাঁদর বিছিয়ে শুয়ে পড়ল । কিন্তু সারারাত প্রণয়ের ভাল ঘুম হল না । যখনই চোখে ঘুম আসছে তখনই মা বাবা ও তিন ভাইবোনের একসাথে থাকার কথা মনে আসছে । সবাই মিলে পুজোর জন্য জামাকাপড় কেনা , ভাই ফোটার দিন কত আয়োজন হত বাড়িতে । বোন আমাদের কত আদরের ছিল । এখন বিয়ের পর বোন অনেক দূরে থাকে । দাদাও বিদেশে থাকে । সবাই মিলে আগের মত একসাথে আর আনন্দ করা হয়না । এরকম নানাকথা ভাবতে ভাবতে শেষ রাতে চোখে যেই না ঘুম জড়িয়ে আসছে স্বপ্নের মতো দেখতে পেল বাবা এসে মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলছে "কিরে ভাল আছিস খোকা ? বাড়িতে এসে পুরনো সব কথা মনে পড়ছে জানি । জানিসতো এই বাড়িটা আমার আর তোর মায়ের খুব সখের এবং ভালবাসার বাড়ি। আর এটা যে তোদের জন্মভিটে । খোকা বাড়িটা বিক্রি করিস না । বাড়িটা মেরামত করে নিয়ে মাকে নিয়ে এসে মাঝেমধ্যে থাকবি । দেখবি তোর মায়ের খুব ভাল লাগবে আর আমিও খুব শান্তি পাব । " প্রণয়ের ঘুম ভেঙে গেল আর খাটের উপর বসে স্বপ্নে দেখা বাবার কথাগুলো নিয়ে ভাবতে লাগল । কিছুক্ষণ পরেই সকাল হলে ফ্রেস হয়ে ড্রেস পরে নিল । লাল্টু চা বিস্কুট দিয়ে গেল । আর জঙ্গল পরিস্কার করার জন্য লোক আসবে বলে গেল । বেলা ১১টার সময় জঙ্গল পরিস্কারের লোক আসলে প্রণয় বলে দিল কোনো গাছ না কেটে শুধু বাড়ি পরিস্কার করে দিলেই হবে । প্রণয়ের মাথার মধ্যে স্বপ্নে দেখা বাবার কথাগুলো গুরপাক খেতে লাগল । আর এদিকে বাড়ি পরিস্কার হচ্ছে দেখে পাড়ার অনেকে এসে বলতে লাগল " প্রণয় শুনলাম তোমাদের বাড়িটা নাকি বিক্রি করে দেবে ।"
"না ঠিক সেরকম কিছু ভাবি নি , তবে কি করব সেই নিয়ে চিন্তা ভাবনা করছি । "
আমরা বলছি কি " বাড়িটা তোমার বাবা অনেক কষ্ট করে বানিয়েছিলেন এবং তোমার মা বাবার খুব সখের বাড়ি । বাড়িটা বিক্রি না করে যদি মেরামত করে মাকে নিয়ে এসে মাঝে মাঝে থেকে যাও । তাহলে আমাদের খুব ভাল লাগবে । "
ঠিক আছে , " মার সাথে কথা বলে দেখি কি করা যায় ---"
প্রণয় মনে মনে ভাবতে লাগল যে গ্রামের মানুষজন এখনো ওদের এত ভালভাসে । সত্যি প্রমোটারের কাছে বাড়িটা দিলে বাগানের গাছপালা কিছুই আস্ত থাকবেনা আর এত সুন্দর বাড়িটাকে ভেঙে ফ্ল্যাট বাড়ি তৈরি করবে । অবশ্য মা, দাদা ও বোন সবাই একই কথা বলেছে যে আমি যা করব তাই হবে । এরকম নানাকথা ভাবতে ভাবতে দুপুরের খাবার খেয়ে একটু বিশ্রাম নিয়ে বিকেলে বাড়ির বাগানটা ঘুরে দেখতে লাগল । মার হাতে লাগানো পদ্ম গাছটায় কত পদ্ম ফুল ফুটে আছে , আর বাবার হাতে লাগানো বাতাবি লেবু গাছটায় কত বাতাবি লেবু হয়ে আছে দেখে প্রণয়ের খুব ভাল লাগছে কিন্তু বাগানের ভিতর ঢুকতেই প্রণয়ের মনে হতে লাগল গাছগুলি ওকে দেখে যেন খুশিতে ডালপালা নাড়তে লাগল আর গাছের ফুলগুলো যেন হাসতে হাসতে বলছে "আমরা খুব আনন্দ পেয়েছি তুমি এসেছ বলে । আমাদের কেটে নষ্ট করে দিও না ।" বেলা পড়তেই সন্ধ্যে হয়ে আসল । প্রণয় হাত পা ধুয়ে ঘরে এসে মোমবাতি জ্বেলে খাটের উপর বসল । কিছুক্ষণ পরেই লাল্টু রাতের খাবার ও জল দিয়ে গেল । কিছুক্ষণ মার সাথে ফোনে কথা বলে ৯ টার সময় খেয়ে ঘুমিয়ে পড়ল ।
পরদিন সকাল হতেই প্রণয় দেখল লাল্টু চা নিয়ে এসেছে আর সঙ্গে করে দুজনকে সাথে করে নিয়ে এসেছে । প্রণয় জিজ্ঞাসা করল কাদের নিয়ে এসেছ ?
গ্রামের দুটো ছেলেকে নিয়ে এসেছি , তোমাদের বাগানের গাছগুলোকে কাটার জন্য । বড় গাছগুলোকে বেচলে ভাল টাকা পাওয়া যাবে ,ফলে তোমারও লাভ হবে আর আমরাও কিছু পাব । প্রণয় একটু মুচকি হেসে বলল সব বুঝতে পারছি তবে এখনই কোনো গাছ কাটার দরকার নেই কেমন। ঠিক আছে দাদা তুমি যা বলবে তাই হবে । তাহলে আমরা আসছি , দুপুর বেলা এসে খাবার দিয়ে যাব। প্রণয় ভাবছে পাড়া প্রতিবেশীরা এখনো তাদের বাড়িটাকে ও তাদেরকে এত ভালবাসে , না আসলে বুঝতে পারতনা । তাই বাড়িটাকে বিক্রি করা বা প্রমোটারের হাতে দেওয়া কোনোটাই প্রণয়ের পচ্ছন্দ হচ্ছে না । রাতে ঘুমোতে গিয়ে প্রণয় ভেবে নিল বাড়িটা সে বিক্রি করবে না । বাড়িটাকে মেরামত করে মাকে নিয়ে মাঝে মাঝে এসে থেকে যাবে । মা, বাবা ও ভাই বোনেদের প্রচুর স্মৃতি আছে বাড়িটাতে । আর মা গ্রামের বাড়িতে এসে আবার থাকতে পারবেন জানলে খুব খুশি হবেন । এইসব ভাবতে ভাবতে প্রণয় ঘুমিয়ে পড়ল ।
পরদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে প্রণয় সব গুছিয়ে নিল কেননা অফিসের ছুটি শেষ । কলকাতায় ফিরেই অফিসে যেতে হবে । হঠাৎ দেখল লক্ষ্মী এসে হাজির । লক্ষ্মী প্রণয়দের বাড়িতে অনেক বছর কাজ করেছে । প্রণয়ের মা ও বাবাকে মা বাবা বলে ডাকত আর সবাইকে নিজের মনে করে ভালবাসত । বাবা নেই শুনে লক্ষ্মীর চোখে জল চলে এসেছে । প্রণয়কে বলল "দাদা শুনলাম বাড়িটা নাকি বিক্রি করে দেবে তোমরা ।"
"নারে লক্ষ্মী এখনো কিছু কথা হয় নি । "
"তোমাদের বাড়ির সাথে অনেক দিনের সম্পর্ক । এই বাড়ি ও তোমাদের ওপর খুব মায়া আমার । তাই বলছি বাড়িটা বিক্রি না করে ঠিকঠাক করে মাকে নিয়ে মাঝে মধ্যে এসে থেকে যেও । দেখবে আমি এসে মার সব কাজ করে দেব । "
"ঠিক আছে লক্ষ্মী তোর কথা রাখার চেষ্টা করব । " আজ আমি কলকাতায় ফিরে যাচ্ছি। আমি মাকে নিয়ে আসলে তোকে জানাব ।
লক্ষ্মী চলে যাবার পর লাল্টু খাবার নিয়ে আসল আর বলল " বিকেলে মলয় আসবে তোমার সাথে বাড়ি বিক্রি নিয়ে কথা বলার জন্য ।"
প্রণয় বলল " আজ আমি কলকাতায় ফিরে যাচ্ছি । মলয়কে বলে দিস বাড়ি বিক্রি করব না । বাড়িটা মেরামত করে ও রঙ করে নিয়ে মাঝেমধ্যে এসে থাকব। তুমি বাড়িটা একটু দেখে রেখ। কেউ যেন গাছগুলিকে না কাটে ।"
লাল্টু অবাক হয়ে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বলল "কলকাতায় থাকার পর তোমরা গ্রামে এসে থাকতে পারবে ? তোমাদের অসুবিধে হবে না ? "
"নিশ্চয় এসে থাকব । এটা যে আমাদের ভাই বোনের জন্মভিটে । আর আমাদের ছোটবেলার সব স্মৃতি যে এই বাড়িতে । আমার মা ও বাবার প্রানের বাড়ি । এমনকি এই গ্রামের বাতাস ও মানুষের ভালবাসা আমাদের অনেকদিন বাঁচতে সাহায্য করবে ।"
-------------------------------
অঞ্জনা দেব রায়
৫৫৩ পি মজুমদার রদ, কলকাতা ৭৮