'তোমার কোন শোক হয় না?' ভূদেব বললো। আকাশে আজ মেঘ। চারপাশের রং ছেলেবেলার সিলেটের মতো।
'কাদের জন্য শোক করবো? 'রতন বললো।চোখ বড় বড় করে।
'কেন তোমার বড় মেয়ে যে আত্মহত্যা করলো, তার জন্য। কথাটা বলে আকাশের দিকে তাকালো ভূদেব। বৃষ্টি হবে কি? গরমও পড়েছে। বৃষ্টি হলে ভালো হয়। সব ভালো হচ্ছে কই ?
'আমি শোক করলে কি মেয়ে ফিরে আসবে? 'রতন পাল্টা প্রশ্ন করলো।
'সে আসবে না। সেদিন তোমার বউ কেঁদে ভাসালো, কিন্তু তোমার চোখে একফোঁটা জল ছিল না। 'আমি খুব আশ্চর্য হয়েছি।
'তাই তুমি বলছো আমার কোন শোক নেই? রতন ভূদেব এর দিকে তাকালো। তারপর বলল,
দেখ ভূদেব, সবাই শোকে কাঁদে না। কেউ কেউ পাথর হয়ে যায়। '
'তা তুমি বুঝি পাথর হয়ে গেছো বুঝি? 'পাথরেও ফুল হয়।
'না। পাথর হতে গেলে সাধনা লাগে। আমার কতটুকু ক্ষমতা যে শোকতাপের উপরে উঠে যাবো। তবে চেষ্টা করি। '
'কি রকম? '
'সে কথা বললো তুমি বুঝবে না ভূদেব। বাদ দাও ওসব কথা। '
'তা তোমার মেয়ে আত্মহত্যা করলো কেন? 'ভূদেব চোখ সরু করে রতনের দিকে তাকালো।
'সে আমি কি করে বলবো? ওর মনের ভিতর কি হয়েছিল কে জানে। 'আকাশের দিকে আবার তাকালো রতন। বৃষ্টি হবে কি? বড্ড গরম। সহ্য হয় না।
'কিছু তো একটা হয়েছিল। তুমি টের পাও নি? গোয়েন্দাদের মতো জেরা শুরু করল ভূদেব। '
'এক জনের মনের সন্ধান কি আর একজন পায়? উদাসীন চোখে কথাটা বলল রতন।'
'পুলিশ তো খোঁজ খবর করছিল, তারা কিছু বলেনি?
'পুলিশ বলছে তদন্ত চলছে। ঘটনাটা এখনও রহসময়।'
'ঘরের মধ্যে সিলিং থেকে ঝুলে পড়ল তোমরা দুজনের কেউ টের পেলে না? এটা কেমন করে হলো রতন? '
'আমারা তো তখন ঘুমে। অত সকালে এমন কান্ড করবে কে জানতো! কেন করলো? কি হয়েছিল ওর কে জানে?
'একটা ছেলের সংগে ভাব ভালোবাস ছিল তো? '
'সে তো ছিল'।
'পুলিশ তারে ধরেনি?
'ধরেছে তো। নানা প্রশ্ন করেছে। কী উওর দিয়েছে কে জানে। 'এখন পুলিশই পারে এর রহস্য কী?
'পুলিশ। সেই পুলিশ কি আছে? এখন নেতাটেতাকে ধরে সব চাকরি পায়। '
'মানুষ সম্পর্কে এতো নিচু ধারনা করো না ভূদেব। সবাই ধরেটরে চাকরি পায় না। কই আমার ছেলের তো চাকরি হয়নি। কত বছর তো পাটি করছে। কত নেতাকে তো ধরলো। হলো কি? '
বন্ধুর কথায় ভূদেব বলে, 'নেতারা কী বলছে? '
'হবে হবে বলছে। কবে হবে কে জানে? একটা বিড়ি দাও তো। রতন বিড়ি ধারায়। ধোঁয়া ছাড়ে।'
'নেতারা তো ঐকথা বলবে। জানে চাকরি পেলে আর পার্টির কাজ করবে না। তাই হবে হবে বলে। এ অনেকটা মুখের কাছে খুড়োর কল ঝুলিয়ে রাখা।
'তোমার কথাটা পুরো সত্য বলে মেনে নিতে পারছি না। তাহলে তো আমার মেয়েটার কর্পোরেশন চাকরি হতো না। কাউন্সিলার চাকরিটা দিয়েছিল। তুমি তো জানো ভূদেব আমার অভাবের সংসার। তা একদিন কাউন্সিলরকে গিয়ে ধরলো। বললো সমস্যার কথা। কাউন্সিলার বললেন, 'পরে দেখা করো। পরে দেখা করতে হয়নি। কাউন্সিলার নিজে ডেকে চাকরিটা দিয়েছে। হোক নিচু পোষ্ট।
সে তো দু বছরের জন্য। পার্মানেন্ট নয়। '
রতন বললেন 'তুমি কি পার্মানেন্ট?
'কোন খানে? অফিসে?
'না। এই পৃথিবীতে? ধাক্কা খেল ভূদেব। এমন একটা প্রশ্নের জন্য সে প্রস্তুত ছিল না। কিছুখন চুপ করে থেকে ভূদেব বলল, ''
'সে তো আমারা কেউ পার্মানেন্ট নই । '
'তখন তো কোন অভিযোগ থাকে না।। চাকরির বেলায় কেন থাকবে? এই যা পাচছো তা নিয়ে দিন চালাও। কাল কি হবে কাল ভেবো। আমার চাকরিটা পার্মানেন্ট করে দিন বলে ঘ্যানোর ঘ্যানোর করলে চাকরিটা চলে যেতে পারে। যা পাচ্ছিল তাও গেল। আর ধরো পার্মানেন্ট করে দিল। দু দিন পরে একটা একসিডেনট হতে পারে কিংবা কোন বড় অসুখে মারা গেলে। তথন সেই পার্মানেন্টর কি দাম থাকলো? রতন জোরে জোরে বিড়িতে টান দিতে থাকলো।
ডূদব অবাক হয়ে বলেন', তুমি যে মাঝে মাঝে কি বলো আমি থই পাই না। এক সময় তো যাত্রাপালা করতে। বাউল গানও
গেয়েছো। যাত্রায় বিবেকের পাট করোছো। কাশিতে কোন এক সাধুর কাছে ক বছর কাটিয়ে এলে। কত কিছুই তো করলে।
তোমার স্ত্রী ছিল বলে ছেলে মেয়ে দুটো ভেসে যায়নি। '
'তা যা বলেছো। 'রতন শেষ টান দিয়ে বিডিটা ফেলে দিল।
'সেই স্ত্রী মারা গেল। একফোঁটা জল বের হলো না তোমার চোখ দিয়ে।তুমি এক আশ্চর্য মানুষ রতন! '
'কিসের জন্য চোখের জল ফেলবো বলো তো? তাকে তো আমার অদেয় কিছু ছিল না। যাত্রা দলে সেও অভিনয় করতো। দু জনের মনের মিল হলো। বিয়ে করলাম। সংসার করলাম। সন্তান দিলাম। একটা মেয়ে মানুষের আর কি চাওয়ার থাকতে পারে? রতন আকাশের দিকে তাকালো। মেঘ গুলো ভারি পাজি। বাউন্ডুলের মতো এদিক ওদিক ঘুরছে। এক জায়গায় হচ্ছে না।
'তা পঁচিশ বছর ঘর করলে তার মৃত্যুতে এতটুকু শোক প্রকাশ করবে না? এ কেমন কথা রতন!
'কেন করবো? কি কষ্টই না পাচ্ছিল। ক্যান্সার বলে কথা। মরন তো তাকে মুক্তি দিয়েছে। একটা দীর্ঘ শ্বাস ছাড়লো রতন। হাতে পড়তে বুঝতে পারলো বেশ গরম। '
'হোক ক্যান্সার। তাবলে দু:খ করবে না? '
রতন উদাসিন গলায় বলেন, 'দেখ এই যে মানুষ শোক দু:খ করে এহলো মানুষের মোহ ছাড়া আর কিছু নয়। সবাই আমরা জানি একদিন চলে যাবো তবু কেন এই কান্নাকাটি?
'তুমি বড় অদ্ভূত কথা বলো রতন। আমরা তো সবাই জানি একদিন মরে যাবো তাবলে কি মানুষ ঘরবাড়ি বানায় না?
রতন আকাশের দিকে তাকিয়ে কিছু সময় চুপচাপ থাকলেন। তারপর নির্মোহ গলায় বললেন, 'মানুষ কোনদিন কোকিল হতে পারবে না। কোকিল যে সত্যটা বুঝেছে মানুষ লেখাপড়া শিখে সেই সত্যটা বুঝলো না। তাই মানুষের এতো দু:খ কষ্ট যন্ত্রনা। 'তাহলে তুমি বলতে চাইছো মানুষ ঘর বাঁধবে না? অন্যের বাসায় গিয়ে সন্তান বড় করবে?
'আগেই তো বললাম ভূদেব মানুষ কোনদিন কোকিল হতে পারবে না। '
'মানুষ কোকিল হলে এই যে অপূর্ব সংসার, এটা তো গড়ে উঠতো না। '
রতন একটু বিরক্তি নিয়ে বললেন, 'কে বলেছে সংসার অপূর্ব?
'তাহলে তুমি কেন মালিনীকে নিয়ে সংসার বেঁধে ছিলে? '
'তোমার মতো তখন আমারও মনে হয়েছিল, সংসার অপূর্ব। '
'তা এখন তোমার কি মনে হয়? 'ভূদেব রতনের গিকে তাকায়। তারই সমান বয়সি। ষাট পার করেছে। চেহারায় এখন কোন জৌলুস নেই। একসময় ছিল। কার্তিকের মতো সুন্দর। এখন ওর চোখে ধূষর এক চাউনি। বললেন, 'এখন মনে হয় সংসার এক আগুন। তুমি বেঁচে আছো কিন্তু সব পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। '
'তবু তো মানুষ সংসার করে। '
'তুমি কি জানো ভূদেব আসামের দিকে এক ধরনের পাখি আছে যারা জেনে বুঝে সেই আগুনে ঝাঁপ দেয়। '
"কেন? '
'আগুনের যে এক সৌন্দর্য আছে। সেই রুপের আগুনে আত্মহত্যা করে। '
'মানুষ তো কোনদিন পাখি হতে পারবে না রতন। '
'কেউ কারো মতো হয় না ভূদেব। '
'এখন তোমার স্ত্রী নেই, মেয়ে নেই। ছেলে গেছে আরব দেশে কাজে। সে ফিরবে কিনা কে জানে। '
'সব পাখি কি বাসায় ফেরে ভূদেব? '
'তুমি শুধু পাখি পাখি করো কেন রতন? '
'কে জানে। মানুষ কি সব জানে। ভাবে সব জানে। করে অহংকার। আসলে সব মিথ্যে। '
'যা বলতে চাইছি রতন এখন কি তোমার একা একা লাগে না? '
'না। লাগে না। 'রতন কঠিন গলায় বলে। কি বলবে সে বন্ধু ভূদেব কে। তার দিকে তাকালো। সম বয়সি। তবে ভূদেব এর স্বাস্থটা ভালো। খাটতে পারে। জমিতো চাষি মুনিশ সব আছে। তবু ভূদেব জমিতে যাবে। দেখবে কেউ কাজে ফাঁকি দিচ্ছে নাকি। ফসলে পোকা লাগলো নাকি। শ্যালোমেশিন ঠিকঠাক কাজ করছে কিনা। জমিতে একটা চালাঘর আছে। সেখানে গিয়ে বসে থাকবে। বিড়ি টানবে। আর জমির দিকে তাকিয়ে থাকবে। যখন পাকা ফসলে মাঠ ভরে থাকে তখন তো সারাদিন জমির চালা ঘরে থাকে। বসে বসে দেখে। কি সুখ পায় কে জানে। বউ ডেকে নিয়ে আসে। রাতে আবার জমির চালাঘর চলে আসে। সারারাত জেগে থাকে। ফসল বড চুরি হয় যে। ভূদেব এর ভরা সংসার দুই ছেলে। ছেলের বউ। নাতি নাতি। জমজমাট পালাঘর। এসব মোহ। ভূদেব এখন বুঝতে পারছে না। একদিন বুঝবে। সবাই কি বোঝে?
'ও রতন কি ভাবছো?
'কিছু না।
, 'তাহলে তোমার একা লাগে না?
'না। এতটুকু না।
'কেন? '
'একা বলতে তুমি কি বলতে চাইছো ভূদেব? '
ভূদেব থতমত খায়। বলেন', এই যে একা একা বেঁচে আছো, নি:সঙ্গ লাগে না তোমার? '
রতন দূরের মাঠের দিকে তাকায়। আকাশের নিচে মাঠ একা একা শুয়ে আছে। বলেন, 'মানুষের জীবন ঐ মাঠের মতো। '
'কি রকম? '
'মাঠে চাষি সারাদিন চাষ করে ঘরে ফিরে যায়। তখন মাঠ একা পড়ে থাকে। জীবনও ঠিক তাই। তবে কি—
'থামলে কেন রতন?
রতন আপন মনে ভাবে, সব মানুষই জানে, জীবন মানে বিষ আর অমৃত। কিন্তু অমৃত কতোটুকু? বিষই সব। তোমার সারা শরীর বিষে ডুবে আছে। তবু মানুষ সংসার করবে। সন্তান করবে। তাকে বড় করবে লালনপালন মায়ামমতা দিয়ে। হাসছে গান গাইছে। অভিনয় করছে। জানে এসব কিছু না। বিষই সত্য। আর সব অলীক।
ও রতন আবার কি ভাবছো?
কিছু না।
বললেই হবে। সারাদিন তুমি শুধু ভাবো ।পালাগান করে তোমার এই স্বভাব হয়েছে। আগে তো তুমি এমন ছিলে না। হঠাৎ হঠাৎ যে কোথায় চলে যায় তোমার মন বুঝতে পারি না।
আমি কি তোমার বুঝতে পারি। আমারা কেউ কাউকে বুঝতে পারি না। শুধু দেখতে পারি। ভিতরটা নয় বাইরের টা দেখি।
কেন একা লাগে না তোমার?
কেন লাগবে বলো তো। যারা আমার জীবনে এসেছিল বউ ছেলে মেয়ে কেউ আমার ছিল না। কোনদিন আমার হয় না। আমরা মিথ্যে সুখ নিয়ে ঘুরি। তারপর একদিন হোচট খেয়ে মুখ থুবড়ে পড়ি। রক্ত বের হয়। চমকে উঠি। ভয় পাই। রক্তপাত কিন্তু অনেক দিন'ধরে হচ্ছে নি:শব্দে। টের পাইনি।
সব কথা তোমার বুঝি না রতন। '
বলছি 'অন্য দিক দিয়ে যদি দেখ তবে দেখবে কোন মানুষ একা নয়। '
ভূদেব আশ্চর্য হয়। বলেন, 'মানুষ একা নয়? '
'না। মানুষের ভিতর মানুষের মিছিল। '
'বুঝলাম না'
'আজ অনেক রাত হয়েছে ভূদেব। তুমি বাড়ি যাও। আমি এখন কথা বলবো। '
'কথা বলবে? কার সংগে? '
'ঐ যে বললাম মানুষের ভিতর মানুষের মিছিল। '
---------------------
Debdas kundu
6D GORAPADA sarkar Lane
kol 67