বিড়ালটা ফিরে আসার পর থেকেই আমাদের বাড়িতে নানারকম ভৌতিক ঘটনা ঘটছে। শুকনো উঠোনে সেদিন শুধু আমার ঠাকুরমা পড়ে গিয়ে কোমর ভেঙে শয্যাশায়ী হয়েছে তাই নয়, আর একদিন হঠাৎ ঝড় নেই, জল নেই, ভূমিকম্প নেই, মাছের অ্যাকোরিয়ামটা ভেঙে পড়ে যায়। মাছগুলো পড়ে ছটফট করতে থাকে আর বিড়ালটা ভয়ঙ্কর একটা দৃষ্টি নিয়ে মাছগুলোর উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে এবং মুহুর্তের মধ্যে খেয়ে সাবাড় করে সেগুলোকে। তখন তার আচরণে একটা পৈশাচিক ব্যাপার-স্যাপার পরিলক্ষিত হচ্ছিল। আমি খুবই অবাক হলাম। বিড়ালকে আমি কোনদিনই পয়া মনে করিনা। আর তার ওপর ও ফিরে আসার পর থেকেই এই সমস্ত ঘটনা ঘটছে। ঘটনাটা চরম অবস্থায় দাঁড়ালো যখন সেদিন মাছ কাটতে গিয়ে মায়ের আঙ্গুল কেটে রক্তারক্তি হলো। আমরা মাকে নিয়ে ব্যস্ত। সেই সময়ে হঠাৎ চোখ গেল বিড়ালটার দিকে। তাকিয়ে দেখলাম বিড়ালটা ভয়াবহ এক দৃষ্টিতে একবার মাছের দিকে দেখছে, আর একবার দেখছে মায়ের কাটা আঙ্গুলের দিকে। পারলে মায়ের আঙুলটাকে যেন চিবিয়ে চিবিয়ে খায়, তেমনই তার ভাবসাব। আমি তো বিড়ালটার ওপর বেজায় রেগে গেলাম এবং এ সমস্ত ঘটনার জন্য অপয়া বিড়ালটাকে-ই দায়ী করলাম। এবং সেজন্য ঠিক করলাম বিড়ালটাকে এমন একটা জায়গায় পাচার করে দিয়ে আসবো যে সেখান থেকে আর কোনদিন ফিরতে পারবে না ব্যাটা। সেই মতো বিড়ালটাকে নিয়ে একদিন আমি রওনা দিলাম।
*** *** *** ***
সাত দিন মত কেটে গেছে। বিড়ালটা আর ফিরে আসেনি। আমার তো মহানন্দ, অপয়া বিড়াল বাড়ি থেকে বিদায় হয়েছে, বাঁচা গেছে। হঠাৎ একদিন খেয়াল করলাম যে বাড়ির আশেপাশে একটি বিড়াল ঘোরাফেরা করছে, তাকে দেখতে পাচ্ছি কিন্তু ধরতে গেলেই সে অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছে। কোন যাদুবলে সে কোথায় যে লুকিয়ে পড়ছে তার কিছুতেই খুঁজে পাচ্ছিনা। অদ্ভুত ব্যাপার! এটুকু হলে তাও ঠিক ছিল, তারপর থেকেই আমি দুঃস্বপ্ন দেখতে শুরু করলাম। ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে রাত্রে দেখলাম ওই ছোট্ট বিড়ালটি ক্রমাগত বড় হয়ে হয়ে বাঘের মতন আকার ধারণ করল এবং আমার বুকের উপর উঠে আমার গলায় দাঁত বসিয়ে রক্ত পান করতে লাগল। আমি তো ভয়ে চিৎকার করে উঠলাম। ঘুম ভেঙে গেল। ঘরে একটা বিজাতীয় গন্ধ পেলাম, অনেকটা মড়া পচা-পচা গন্ধ। তারপরের দিন থেকেই আমার শরীর খারাপ করতে লাগল। সারা শরীরে কি যেন একটা বিজাতীয় অনুভূতি, কাউকে ঠিকমত বলতে পারিনা। এভাবে মাস খানেক চলার পর একদিন মা, ঠাকুমা এবং আত্মীয়-স্বজনরা সবাই বলতে লাগলো যে আমার চেহারা খুব খারাপ হয়ে গেছে, আমি রক্তশূন্য হয়ে পড়ছি, আমার মেজাজ খিটখিটে হয়ে গেছে। কারণ কি আমি কিছু খুলে বললাম না। আমি যে বিড়ালটিকে পটাশপুরের শ্মশানে ছেড়ে দিয়ে এসেছিলাম সেটা কারো কাছে প্রকাশ করলাম না। আমার চেহারা ক্রমশ খারাপ হয়ে যেতে লাগলো অবশেষে আমাকে না জানিয়ে মা ওঝার কাছে গেলেন। আমাদের এলাকায় অতুল্য হালদার নামকরা ভূতের ওঝা। সে মাটিতে আঁক কেটে গণনা করে জানালো -- তোর ছেলে বিড়ালটাকে নিয়ে গিয়ে পটাশপুর-এর শ্মশানে রেখে এসেছিল। ঠিক সেই মুহূর্তেই একটা ভয়ঙ্কর প্রেতাত্মা সেখানে দিয়ে যাচ্ছিল। সেই প্রেতাত্মা বিড়ালটার উপর ভর করে এবং প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য সে ফিরে আসে। তারপর বাড়িতে এ সমস্ত ঘটনা ঘটছে। শুনে মা বললেন, সে না হয় মেনে নিলাম অতুল ঠাকুর। কিন্তু আমার ছেলেটি তো ঐ প্রেতাত্মার প্রতি কোনও অন্যায় অবিচার করেনি, তাহলে?
--- তা হয়তো করেনি, কিন্তু বিড়ালটিকে ওখানে রেখে আসার সময় বস্তার মধ্যে থাকতেই বিড়ালটিকে দূর দূর করে চার-পাঁচটি লাথি মেরেছিল। তাতে করেই প্রেতাত্মাটি আরও ক্ষেপে যায় এবং তার প্রথম প্রতিশোধ তোর ছেলের উপর দিয়েই নিতে চাইছে। এভাবে চললে তোর ছেলে কিন্তু বেশিদিন বাঁচবে না। মা কেঁদে পড়তেই অতুল ঠাকুর একটু নরম হয়, তারপর একটি প্রতিষেধক দেয়। মা সেটিকে নিয়ে সোজা বাড়িতে ঢোকে, তারপর থেকে মাকে দেখলেই বিড়ালটি পালিয়ে যেতে থাকে। কিন্তু সমস্যার সমাধান হয় না। আমি দুঃস্বপ্ন দেখতেই থাকি। দেখতে থাকি যে বিড়ালটা আমার আশেপাশে ঘোরাফেরা করছে যেন সুযোগ পেলেই আমার উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে টুঁটি কামড়ে ধরবে। অগত্যা মা আবার অতুল ঠাকুরের কাছে গেলেন এবং তার পরামর্শ মতো আমাকে নিয়ে এবং বেড়ালটিকে নিয়ে রওনা দিলেন পটাশপুর শ্মশানের দিকে। তারপর মায়ের কথামতো যেখানে আমি বিড়ালটিকে ছেড়ে রেখে এসেছিলাম সেখানে আবার গিয়ে বেড়ালের উদ্দেশ্যে পুজো দিলাম এবং ক্ষমা প্রার্থনা করলাম। ঠিক সেই মুহুর্তে একটি গাছের ডাল ভেঙে পড়ল। মা প্রণাম করলেন, বললেন -- অতুল ঠাকুরের কথা মিলে গেছে। এটাই ঘটবে বলেছিল।
সত্যিই অতুল ঠাকুরের কথা ফলেছিল। তারপর থেকে আমি আর কোনও দিন বিড়ালের দুঃস্বপ্ন দেখিনি।
=======================
স্বরচিত অপ্রকাশিত মৌলিক ভৌতিক গল্প।
প্রেরক: গোবিন্দ মোদক।
সম্পাদক: কথা কোলাজ সাহিত্য পত্রিকা
রাধানগর, কৃষ্ণনগর, নদিয়া।
পশ্চিমবঙ্গ, ভারত --- 741103
ফোন/whatsapp: 8653395807