ছোটগল্প ।। বুভুক্ষা।। সান্ত্বনা ব্যানার্জী
স্টেশনের ডাউন প্লাটফর্মে অস্থির ভাবে পায়চারি করছিলো মিতা। ট্রেনটা এত লেট! বার বার মনে পড়ছে ছোটো পিসেমশাই এর মুখটা। নিজের পিসেমশাই কে তেমন মনেও পড়েনা। খুব অল্প বয়সেই স্বামী হারিয়ে বিধবা পিসিমা দেওর জা এর সঙ্গে একান্নবর্তী পরিবারেই ছিল বহুকাল। ওই দেওরকেই মিতা ছোটো পিসেমশাইও জাকে ছোটো পিসিমা বলে। পিসিমার বাড়িতে মিতার যাতায়াত একটু বেশীই। তার কারণ একঝাঁক সমবয়সী পিসতুতো দাদা,দিদি,ভাই বোন আর অবশ্যই দুই পিসিমা আর ছোটো পিসেমশাই এর নির্ভেজাল স্নেহ আদর। মিতা বাড়িতে ঢুকলেই পিসেমশাই এর হাঁকডাক শুরুহয়ে যায়,"ও বৌদি,তোমার মিতা এসেছে গো!ওতো আবার মাছ ছাড়া ভাত খেতে পারে না! মাছ আছে না জাল ফেলে ধরে নিয়ে আসবো?"পিসিমার শ্বশুরবাড়ি খুব অবস্থাপন্ন। জমি জমা,পুকুর বাগান, গোয়াল ভরা গরু, দূধ, ঘী ,মাখন ফল শাক সবজি, কোনো কিছুরই অভাব নেই. মিতার পিসিমা বাইরের কাজ কর্ম, জন কিষানএর তদারকি করে বেশি,রান্নাঘরের দায়িত্ব সামলায় ছোটো পিসিমা আর ছোটো পিসেমশাই। এত গুলো ছেলেমেয়ে, তাদের আবদার, এসোজন,বসোজন, ওদের কোনো বিরক্তি নেই।......কাকীমা ডাল দাও তো..... ও মা, এক গ্লাস জল দাও না,......তাড়াতাড়ি ভাত দাও মা, স্কুলের দেরী হয়ে যাবে....এই সব ফরমাস আর পিসিমার সঙ্গে সঙ্গে উত্তর,.......এই যে দিই বাবা!....মাছ ভাজা হয়ে গেছে, উঠে পড়িস না, আর একটা মাছ ভাজা দিই?.....দাঁড়া, তরবর করিস নে, চাটনী দেবো,..... ও মিতা ধীরে সুস্থে খা,মা! আর একটু চাটনী দেবো? ঘরে পাতা মিষ্টি দই আছে, না খেয়ে উঠবি না কিন্তু.!......কোনো ক্লান্তি নেই! আর সর্বদা রান্না ঘরের দরকারি জিনিসপত্র জোগান দেয় ছোটো পিসেমশাই। বাড়ীর কালী পুজোর সময় তার আর ছুটোছুটির অন্ত থাকে না। দাঁড়িয়ে থেকে রাধুনীকে দিয়ে রান্না করানো,সবাইকে খাওয়ানো,পুজোর জোগাড়, সব দিকেই তার নজর।সব চেয়ে মজার তার বিজয়ার দিন বাজনার তালে তালে নাচ! এত আমুদে প্রাণখোলা মানুষ মিতা খুব কম দেখেছে। দুজনেই মিতার বড়ো প্রিয় মানুষ! সেই ছোটো পিসিমার আজ বড়ো দুর্দিন।
তিনতলার ছাদ থেকে নিজের তৈরী ফুল বাগান বিভোর হয়ে দেখছিলেন ছোটো পিশেমশাই। একটু বোধহয় বেশী ঝুঁকে পড়েছিলেন, টাল সামলাতে না পেরে পড়ে গেছেন একেবারে নিচে। হসপিটালে ভর্তি,অবস্থা খুব খারাপ। এই দুঃখের দিনে ছোটো পিসিমার কাছে পৌঁছানোর জন্য অস্থির হয়ে পড়েছে মিতা!আর আজই ট্রেন আসতে এত দেরী করছে। গিয়ে যে কি শুনবে কে জানে!এমন সময় ট্রেনের খবর হতে স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে মিতা। ট্রেনে উঠে জানলার ধারে একটা সিট পেয়ে বসে পড়ে। মনের মধ্যে সব স্মৃতি যেন ছবির মত ভেসে উঠছে! সেবার ছোটদার মাছ ধরা দেখে মিতারও খুব শখ হলো মাছ ধরার। ছোটো পিসেমশাই ছিপ বড়শি মাছের চার ব্যবস্থা করে দিলেন।মনের সুখে খুব মাছ ধরেছিল মিতা,বড়ো বড়ো পুঁটি,বাটা, চারাপোনা। সন্ধ্যাবেলা সে সব মাছ ভাজা খাওয়া হলো মজা করে।পড়তে বসেই ঢুলতে শুরু করতো ছোটদি,আর একই লাইন বলে যেত ......বাবরের পুত্র হলো হুমায়ূন.... বাবরের পুত্র হলো হুমায়ূন.......,!ছোটো পিসেমশাই পিছন থেকে এসে বিনুনী ধরে টেনে ছোটদির ঘুম ভাঙিয়ে দিতো। যৌগ্রাম স্টেশন আসতেই নেমে পড়ে মিতা। মিনিট দশেকের পথ,অজানা এক আশঙ্কায় বুক দুর দুর করতে থাকে। খোলা দরজাদিয়ে ঢুকে দেখে রান্নাঘরের দাওয়ায় চুপ করে বসে আছে পিসিমা,বাড়ী ফাঁকা,সবাই হসপিটালে।কয়েক বছর আগে আদি বাড়িটার পাশেই আর একটা বাড়ী করেছে ওদের বড়ো ছেলে খোকা দা, ছোটো পিসিমা ওই বাড়িতেই আছে। মিতাকে দেখেই কেঁদে ওঠে পিসিমা,"কি বিপদ ঘটালেরে ঠাকুরপো! ওই বাগান করাই ওর কাল হলোরে!"...ছোটো পিসিমার কাছে তাহলে যাই আগে!.....যাবি?একটু কিছু খা,কলেজ থেকে আসছিস,আর চা করে দিচ্ছি ছোটো বউয়ের জন্য নিয়ে যা,কিছুতো খায়নি.....বলে পিসিমা চায়ের জল বসায় গ্যাসে।.......আর তখনই কাঁদতে কাঁদতে আসে ছোটো পিসিমা,...... ও দিদি!হাসপাতাল থেকে ফোন এইচে বড়ো খোকার দোকানে,তোমার দেওর ভালো নেই গো!জ্ঞান আসেনি, কি হবে গো দিদি!
......অবাক হয়ে দেখে মিতা, পিসিমা গ্যাসের জল নামিয়ে দিয়ে একটা অন্য বাটি বসিয়ে দিয়ে থালায় ভাত বেড়ে প্রায় টানতে টানতে বসালে ছোটো পিসিমা কে,ভাতের ওপর ঢেলে দিলে গরম করা মাংস, পাতের পাশে দিলে মাছের টক!হতবাক মিতার উপস্থিতির কথা একেবারে ভুলে গিয়ে বললে" তাড়াতাড়ি ভাত ক'টা খেয়নাও ছোটো বউ,পাঁচটার ট্রেন টা ধরবো।"আরও অবাক হয়ে দেখে মিতা এক হাতে চোখের জল মুছতে মুছতে ভাত খাচ্ছে ছোটো পিসিমা! কি এক অব্যক্ত যন্ত্রণায় কুঁকড়ে যায় মিতার সমগ্র চেতনা!ওই ফোনে হয়তো এসেছে ছোটো পিসেমশাই এর মৃত্যু সংবাদ,আর সেটা হয়ত বুঝে গেছে দুজনেই।তাই কি অল্প বয়সে বিধবা, সকল প্রকার আমিষ খাদ্য থেকে বঞ্চিত পিসিমার এত আকুতি ছোটো পিসিমাকে শেষবারের মত ওই খাবার গুলো খাওয়ানোর! আর ছোটো পিসিমার মধ্যেও স্বামী বিয়োগ এর আশঙ্কার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে জয়ী হয়েছে শেষ বারের মত ওই খাবার খাওয়ার আকাঙ্খা আজও সেই ঘটনা মিতার মনে এনে দেয় এক অব্যক্ত যন্ত্রণা! না,পিসিমার আকুলতা, ছোটো পিসিমার লিপ্সা,কোনোটার জন্যই কাউকে অপরাধী ভাবতে পারে না মিতা। শুধু মর্মে মর্মে অনুভব করে সামাজিক বিধিনিষেধের পরিপ্রেক্ষিতে কী করুন, নিষ্ঠুর হতে পারে তার পরিণতি! আর বুকের মধ্যে সেই একই যন্ত্রণা উপলব্ধি করে বার বার!
----------------------
Santwana Banerjee
Post+vill Boinchigram
Dist. Hooghly