গল্প ।। অডিশন ।। অঞ্জনা দেব রায়
মেয়েকে নিয়ে অলির একটা টেনশন তো থাকেই কিন্তু ইদানিং একটা মানসিক কষ্ট খুব যন্ত্রনা দিচ্ছে । তবে এই কষ্টের কথা কাউকে বলা যায় না , কাউকে বোঝানও যাবে না আর কেউ গুরুত্বও দেবে না । কাউকে বললে বলবে সামান্য একটা কারণে ভেঙে পড়ার কোনো কারণ নেই । কিন্তু অলির কাছে কারণটা মোটেই সামান্য নয় । আসলে মেয়ে বনির মুখটা দেখলে মনে হয় কি একটা ব্যর্থতার যন্ত্রনা নিয়ে ঘুরে বেড়ায় ফলে অলিও মনে মনে খুব কষ্ট পায় । স্কুলে যাচ্ছে , বন্ধুদের সাথে ফোনে ঘণ্টার পর ঘণ্টা গল্প করছে , টিভিতে সিরিয়াল ও গানের রিয়েলিটি শো দেখছে কিন্তু বনির মুখটা দেখলে মনে হয় যেন কোন হতাশার যন্ত্রনা প্রতি মুহূর্তে মনের উপর চাপ সৃষ্টি করছে , কাউকেই মন খুলে বোঝাতে পারছেনা । তবে বনি যে কষ্টকে সাথে করে দিন কাটাছিলো সেটা অনেক উঠতি গায়িকাদের মধ্যেই খুঁজে পাওয়া যাবে ।
বনির তিন বছর বয়েসে গানের শুরু হয় অলির কাছে । তারপর চার বছর বয়েসে গুরুজি রবি সরকারের কাছে শাস্ত্রীয় সংগীত শেখা শুরু করে । গুরুজি খেয়াল, ও পাল্টা শেখানোর সাথে সাথে বিভিন্ন ধরনের ভজন, শ্যামাসঙ্গীত,
রাগপ্রধান, নজরুলগীতি মাঝেমধ্যে শেখাতেন । খুব উৎসাহ নিয়ে গুরুজির কাছে গান শিখত বনি । গুরুজির গান শেখার দিনটা বনির কাছে এতটাই গুরুত্ব ছিল যে কোন কিছুর জন্যই সে কামাই করত না ।এইভাবে পাঁচ বছর গুরুজির কাছে শেখার পর গানের পরীক্ষা দেবার ইচ্ছে হল বনির । কিন্তু গুরুজি পরীক্ষা দেওয়া পছন্দ করত না বলে অলি নূপুর আনটিকে বাড়িতে সপ্তাহে একদিন করে আসার জন্য ডেকে ছিল । নূপুর আনটি অলিদের বাড়ির কাছাকাছি থাকত আর আনটির একটি গানের স্কুল আছে । গানের পরীক্ষা দেবার জন্য আনটি সবরকম সাহায্য করত । গানের সঙ্গে তবলায় তালিম দিত রঞ্জিত দাদু ।
শাস্ত্রীয় সংগীত শিখতে শিখতে বনি নিজে নিজেই বড় বড় শিল্পীদের গান ফোন থেকে শুনে শুনে গলায় তুলে মিউজিকের সাথে প্র্যাকটিস করে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে গাইত । নূপুর আনটি বনিকে ভাল ভাল অনুষ্ঠানে গান করার জন্য সুযোগ করে দিত ।
বনির বাড়িতে ও মামাবাড়িতে গানের একটা সুন্দর পরিবেশ ছিল । বনির মা অলি , মাসিমনি,দিদা, ও ছোট মামি সবাই গান করে । বনির বড়মামা গীটার বাজায় আর ছোট মামা তবলা বাজায় । মামাবাড়ির সবার কাছ থেকে বনি গানের জন্য খুব উৎসাহ পায় । অলির তো খুব ইচ্ছে বনি পড়াশুনার সাথে সাথে গানের চর্চা করে যাবে এবং গান নিয়েই যেন প্রতিষ্ঠিত হতে পারে ।
ক্লাস ফাইভ থেকে বিভিন্ন কম্পিটিশনে গান করা শুরু করে বনি । আকাশবাণীতে অডিশন দিয়ে গল্প দাদুর আসরে ও শিশুমহলে গান করার সুযোগ পায় । কিন্তু ক্লাস সিক্স থেকে বেশ কিছু বড় বড় কম্পিটিশনে ও দূরদর্শনে গান গাওয়ার জন্য অডিশন দিয়েছে । কোন জায়গায় প্রথম রাউণ্ডে পাশ করে দ্বিতীয় রাউণ্ডে আবার কোন জায়গায় দ্বিতীয় রাউণ্ড থেকে তৃতীয় রাউণ্ড পর্যন্ত পাশ করে কিন্তু ফাইনাল অডিশনে গিয়ে সিলেক্ট হতে পারে না ।' অনেক দিনের গান ' অনুষ্ঠানে বনির খুব গান গাওয়ার ইচ্ছা কারন ' অনেক দিনের গান ' অনুষ্ঠানের ফাইনাল রাউণ্ডে পাশ করতে পারলে টিভিতে গান গাওয়ার সুযোগ পাবে । প্রতিটি গায়ক গায়িকাদের তো স্বপ্ন থাকে দূরদর্শনে ও ফ্লিমে গান গাওয়ার। বনিও তাই মনে মনে ভাবে কবে ফাইনাল রাউণ্ডে মনোনীত হলে দূরদর্শনে 'অনেক দিনের গান' অনুষ্ঠানে' গান গাইতে পারবে আর ওর একটা স্বপ্ন পূর্ণ হবে ।
বনি আস্তে আস্তে বড় হয়ে স্কুলের গণ্ডি পার হয়ে কলেজে প্রবেশ করল । আর একের পর এক কলকাতায় বিভিন্ন হলে, বড় বড় মঞ্চে ও কম্পিটিশনে গান গেয়ে সমস্ত মানুষের মন জয় করতে লাগল । কিন্তু দূরদর্শনে বিভিন্ন চ্যানেলে বিভিন্ন গানের অনুষ্ঠানে কিংবা কম্পিটিশনের অডিশন দেওয়ার পর বিচারকদের কাছে জানতে পারে ফাইনাল রাউণ্ডে বনি মনোনীত হয় নি ।
বনির মনের ভিতর একটা অনুশোচনাবোধ হয় । কিছুদিন বনি চুপচাপ থেকে বিভিন্ন রকমের হিন্দি ও বাংলা গানের তালিমের জন্য বেশ স্বনামধন্য গায়ক অরুপ রায় কাছে গিয়েছিল । অরুপ রায় গানের জন্য জাতীয় পুরুষকার পেয়েছেন । বিভিন্ন মিউজিক কোম্পানি ও বিভিন্ন সিনেমার পরিচালকরা তাকে দিয়ে গান করানোর জন্য ব্যস্ত থাকত । অত্যন্ত সফল ও জনপ্রিয় এই আরুপ রায়ের কাছে গান শেখা শুরু দশ বছর বয়স থেকে । অরুপ রায় দশ বছর বয়সের নিচে বাচ্চাদের গান শেখাতেন না । উনি অনেক গানে নিজেই সুর করতেন এবং উনার সুর করা গান শোনার জন্য শ্রোতারা অপেক্ষা করে থাকত ।
বনিদের বাড়ি বরাবরই খুব রক্ষণশীল । মাধ্যমিক পাশ করার আগে বড়দের বই হাতে নেওয়ার অধিকার ছিল না । বনি কখনো একা একা কোথাও যেত না । সব গুরুজির কাছেই মা নিয়ে যেতেন । বাবার সময়হত না কারণ বাবা সরকারি চাকরি করার পর লেখালেখির জগত মানে সাহিত্যচর্চা করে ফলে বাড়ির কাজে ও মেয়েকে সময় দিতে পারে না । গুরুজিদের যতক্ষণ গান শেখানো না শেষ হয় ততক্ষণ মা গুরুজির বাড়িতে বসে থাকত । গান শেখা শেষ হলে মা সাথে করে বাড়ি নিয়ে আসত। দূরে কোথাও অনুষ্ঠান থাকলে তখন বাবা মার সাথে যেত ।
বনি একটু চাঁপা স্বভাবের । সবার সাথে মন খুলে কথা বলতে পারত না । ওর অনেক বন্ধু আছে কিন্তু বনির মা হল ওর ভাল বন্ধু । মার সাথে প্রায় সব কথা শেয়ার করত । তবে বনির একটা স্পেশাল বন্ধু ছিল । তার নাম অভিরুপ যার কাছে যাবতীয় মনের কথা, ইচ্ছে-অনিচ্ছে, ভাললাগা না লাগার সবকিছু শেয়ার করত । বাড়িতে বাবার শাসনটাই বেশী ,মা শাসন করে পড়া ওগান ঠিকঠাক না করলে । এছাড়া মা বনির খুব ভাল বন্ধু । বনির বয়স এখন আঠারো । বনি বার ক্লাস পাশ করে কলেজে ভর্তি হয়েছে । এখন বাবার শাসন অব্যাহত । বনি কখনো বায়না করত না, যা কিছু দরকার হত সঙ্গে সঙ্গে মায়ের কাছে বলত । আর অভিরুপকেও বনি খুব ভরসা করত । অভিরুপের বাড়ি বনিদের বাড়ি থেকে এক ঘণ্টা দূরত্ব । অভিরুপ বনির থেকে মাত্র দু বছরের বড় ।
" কিরে তোর মুখটা দেখে আজ মুড অফ মনে হচ্ছে " ? অভিরুপ বনির হাতের ওপর নিজের হাত রাখল । 'হ্যা' খুব ছোট করে উত্তর দিল বনি ।
"কেন ? কী হয়েছে ?"
কিছুক্ষণ চুপ করে করে থেকে বনি বলে , এবারেও গানের অডিশনের ফাইনাল রাউণ্ডে মনোনীত হতে পারি নি । দূরদর্শনের অফিসে ফোন করে জানতে পারলাম।
অভিরুপের মনটা খারাপ হয়ে গেল । মুখটা কালো করে চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল। বনি দুঃখ পেলে ওর মনটাও খারাপ হয়ে যায় । বনির দুঃখ কষ্ট ও সবসময় ভাগ করে নিতে চায় ।
" তুই কি কখনো অডিশনে যে গানগুলি করেছিস সেই গানগুলি গুরুজিকে অডিশনে যাওয়ার আগে শুনিয়েছিস ? আর দূরদর্শনের কর্তাদের সাথে কথা বলেছিস যে কেন বারবার এরকম হচ্ছে ? "
অভিরুপের প্রশ্নের উত্তরে বনি বলল না । দূরদর্শনের কর্তাদের সাথে সহজে কথা বলা যায় না । আর আমার মত একজন অনামী গায়িকার সঙ্গে উনারা কথা বলবেন কেন ? আর গুরুজির কাছে ভয়তে যাই নি । তবে অভিরুপের কথাগুলো খুব ভাবাচ্ছিল বনিকে । আর কথাগুলো মাথার মধ্যে একটা অনুরণন তুলছিল ওর । মনে মনে ভাবছে অভিরুপের পরামর্শটা একেবারে উরিয়ে দেওয়া যায় না। সত্যিই তোকোন অনুষ্ঠানে বা অডিশনে যে গানগুলো গাইব সেই গানগুলো যদি গুরুজির কাছে গিয়ে সামনাসামনি গুরুজিকে শোনানো যায় তাহলে গুরুজি ভুলগুলি ধরিয়ে দেবেন ফলে সঠিকভাবে এগোতে পারব।
অভিরুপের কথামত একটা রবিবার দেখে গুরুজি রবি সরকারের বাড়ি বনি মাকে নিয়ে গেল । গুরুজির গানের স্কুলের নাম ছিল ভূপালী । গুরুজি সকাল নটা থেকে রাত দশটা পর্যন্ত গান শেখাতেন। গুরুজি যে ঘরটায় গান শেখান সেই ঘরটায় প্রবেশ করলে মনটা এতটাই ভাল হয়ে যায় যে গান ছাড়া আর অন্য কিছু মাথায় আসে না তখন । গুরুজির গান শেখানোর ঘরটা ছিল বড় হল ঘরের মত আর সে ঘরে বিবেকানন্দের বড় একটা ছবি আর আছে রামকৃষ্ণ ও সারদামায়ের ছবি । ঘরের একপাশে হারমোনিয়াম ,তবলা, তানপুরা দিয়ে সাজানো সে একটা অপূর্ব পরিবেশ না দেখলে বোঝা যাবে না । আর এই ঘরেই বসেই গুরুজি অসাধারন সব গানের সুর সৃষ্টি করেন । খেয়াল গান , রাগপ্রধান, শ্যামাসংগীত প্রভৃতি গানের অপূর্ব সুর , ছন্দ ও তালের মেলবন্ধন করে থাকেন । যাইহোক বারো ক্লাস পরীক্ষার জন্য গুরুজির কাছে বেশ কিছুদিন যাওয়া হয় নি। তবে গুরুজির বাড়ি যাওয়ার পর গুরুজি বনিকে দেখে খুব খুশি হলেন । গুরুজি বনির গাওয়া গান খুব পছন্দ করেন । গুরুজি অনেকদিন বাদে বনিকে দেখে জিজ্ঞাসা করেন কি ব্যাপার ? বনির মনের মধ্যে একটু ভয় ও নানা চিন্তা ভিড় করে আসছিল গুরুজিকে কি বলবে ভেবে । বনি ভাবছে ওর মনের আকাঙ্ক্ষা পূর্ণ করার জন্য গুরুজি কি সাহায্য করবেন ? মনে হয় না । কারণ গুরুজি কোনো দিন কারোর জন্য সুপারিশ করেন না । খুব কড়া ধাতের মানুষ । সব ছাত্রছাত্রীদের বলেই দিতেন যে " আমি তোমাদের গান শেখাব সঠিক পথে কিন্তু কোথাও অডিশনে চান্স পেতে হলে নিজের যোগ্যতায় করতে হবে । এ ব্যাপারে আমি কোন সাহায্য করতে পারব না " । যাই হোক গুরুজিকে বনি কথাটা বলেই ফেলল যে দূরদর্শনের অডিশনে গান গাইবার জন্য কিছু গান সিলেক্ট করে এনেছি ,সেগুলো ঠিকঠাক আছে কিনা তাই । গুরুজি শুনে খুব খুশি হয়ে গানগুলো ভুল ঠিক করে তৈরি করে দিলেন । দুটি গান গুরুজির দেওয়া সুরে গাইবে বলে বেশি খুশি হয়ে মাথায় হাত দিয়ে আশীর্বাদ করে দিলেন । গুরুজির বাড়ি থেকে ঘুরে এসে বনি নিশ্চিন্তে খেয়ে ঘুমিয়ে পড়ল ।
ঘুম থেকে উঠে দেখল অভিরুপ এসেছে বনিদের বাড়িতে । বনির মা গরম গরম কফি নিয়ে এসেছে বনি ও অভিরুপের জন্য । আভিরুপ বনির দিকে তাকিয়ে রইল কিছুক্ষণ । তারপর হঠাৎ করে বলে উঠল খুব খুশি খুশি লাগছে আজ তোকে বনি । বনি বলল হ্যাঁ তোর কথামত গুরুজির কাছ থেকে সব গান ঠিক করে এসেছি তাই মনে খুব আনন্দ হচ্ছে । এরপর অভিরুপ কিছুক্ষণ গল্পকরে বাড়ি চলে গেল । অভিরুপ চলে যাওয়ার পর বনি তানপুরা খুলে হোল্ডিং নোট ও পাল্টা রেওয়াজ করতে বসে গেল । বেশ কিছুক্ষণ বাদে বনির বাবা অফিস থেকে এসে চিৎকার করে বলতে লাগলো শুধু গান করলেই হবে পরাশুনা করতে হবে না । তাই শুনে বনি সঙ্গে সঙ্গে গান থামিয়ে পড়তে বসে গেল। কিন্তু কিছু পরে বাবা কাছে এসে বসলে বনি বাবাকে বলল যে সে গান নিয়ে প্রতিষ্ঠিত হতে চায় । আর একবার প্রতিষ্ঠিত হতে পারলে অনেক নামডাক হবে পরিচিতি বাড়বে , আর বিভিন্ন অনুষ্ঠানে গান গেয়ে ভাল রোজগার ও করতে পারব । বনির বাবা অজয় সব শুনে বনিকে বোঝাল গান নিয়ে প্রতিষ্ঠিত হতে অনেক সময়ের ব্যাপার । পড়াশুনা করে আগে নিজে রোজগার করবে তারপর গানতো সাথে সাথে থাকবে । এছাড়া কত অডিশনে গানতো করলে ,কিন্তু মনোনীত হতে পারলে কি ?
বনি বাবার কথায় মনেমনে একটু দুঃখ পেলো ঠিকিই কিন্তু নিজেকে সামলে নিয়ে বাবাকে বোঝাল গান যদি লেখাপড়ার মত প্রতিদিন সাধনা করা যায় তবে ঠিক তার লক্ষ্যে সে পৌঁছাবে । আর ভাল গান জানলে গানের টিচার হয়া যাবে । এবার ও গুরুজির কাছ থেকে সঠিক পদ্ধতি শিখে এসেছে । পরের অডিশনে ও মনোনীত হবেই এবং এতটাই কনফিডেন্স ওর আছে । অজয় বনির কথা শুনে চুপচাপ নিজের ঘরে চলে গেল ।
অজয় ঘরে চলে যাবার পর বনি কিছুক্ষণ চুপ করে বসে রইল । অভিরুপ এসে বনিকে ডাকতে লাগলো কিন্তু বনি এমন অন্যমনস্ক ছিল অভিরুপের ডাক শুনতে পাচ্ছিল না । অভিরুপ যেই বনির ঘাড়ে হাত রাখল অমনি চমকে গিয়ে বনি বলল কিরে কখন এসেছিস । অভিরুপ বলল এইতো কিছুক্ষণ , কিন্তু তুই কি এত চিন্তা করছিলি যে আমার ডাক শুনতেই পাচ্ছিলি না । ও কিছু না। কিছু না বললে চলবে , তোকে আমি কখনো এতটা অন্যমনস্ক হতে দেখিনি । তুই তো আমাকে সব কথা বলিস্ তাইনা । হ্যাঁ সত্যি বলেছিস , তোকে সব মনের কথা না বললে আমার ঘুম হয় না । অভিরুপ তখন বনির চোখে চোখ রেখে ভাবতে লাগল ওর চোখ দুটো সত্যিই সুন্দর । যাকে বলে কাজল নয়না । অনেকটা দুর্গা ঠাকুরের মতো । যেন সব সময় হাজার ওয়াটের আলো জ্বলছে । চোখে চোখ পড়লে হৃদয়ে উষ্ণ একটা ভাললাগা জন্মায় । এছাড়া বনি হাসলে অভিরুপের মনে হয় মুক্তো ঝরে পরে। বনির কথায় রিনরিন শব্দে কোথাও জলতরঙ্গ বেজে ওঠে । এরকম অনেক কথা বনিকে নিয়ে ভাবতে লাগল অভিরুপ । বনি তখন অভিরুপের হাত ধরে বলল কি এতো দেখছিস আমার দিকে তাকিয়ে ,আমার কথা শুনবি না । না কিছু না , বল শোনার জন্যই তো তাকিয়ে আছি ।
বাবা বলছিল কত অডিশন তো দেওয়া হল কিন্তু কিছুই হল না তার চেয়ে লেখাপড়ায় মন দাও । তাই মনটা একটু খারাপ হয়েছিল । অভিরুপ বলল আংকেলের উপর রাগ না করে মন দিয়ে লেখাপড়া কর প্রতিদিন, আর দুঘণ্টা করে গানের সাধনা কর তাহলেই হবে । কাছকাছি কোন তো অডিশন নেই । ঠিক আছে এখন কিছু ভাল লাগছে না চল না মলে ঘুরে আসি । দ্বারা আংকেল অ্যান্টির কাছ থেকে আগে পারমিশন নিয়ে নে । যদিও অলি ও অজয় অভিরুপকে খুব পছন্দ করে , সুতরাং বনি অভিরুপের সাথে কোথাও গেলে সঙ্গে সঙ্গে পারমিশন পেয়ে যায় । তাই পারমিশন পেয়ে দুইজনে বেড়িয়ে পড়ল ঘুরতে ।
বেশ কিছুক্ষণ মলে ঘুরে বাড়ি ফিরে অলির বানানো লুচি, ছোলারডাল ও মিষ্টি খেয়ে অভিরুপ ওর বাড়ি চলে গেল । বনি একটু রেস্ট নিয়ে গান প্র্যাকটিস করতে বসে গেল । ওদিকে অলির ফোন বেজে উঠল। অলি ফোন অন করার সঙ্গে সঙ্গে অন্য প্রান্ত থেকে অপু মানে অলির দিদির গলা ভেসে আসলো । কেমন আছিস , কি করছিস বলেই দিদি বনির গানের খবর জিজ্ঞাসা করছিলো , আর কবে গানের অডিশন আছে খোঁজ নিচ্ছিল । দিদি অবশ্য বনির গান খুব পচ্ছন্দ করে । আর বলল, দেখিস বনি একদিন গান গেয়ে প্রতিষ্ঠিত হবে এবং সব মানুষ ওকে চিনবে । অলি দিদিকে বলল দ্বারা কবে আবার অডিশন হবে আগে জানি আর সেই অডিশনে পাশ করে ফাইনালে উঠুক তারপর তো । দিদি বলল দেখবি এবার বনি ফাইনালে গাইবে এবং ফাস্ট পজিশনে থাকবে । অলি বলল দেখ আমি বেশি আশা করিনা , শুধু ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করি ফাইনালে পাশ করে টিভিতে গান গাওয়ার সুযোগ পায় যেন, তাহলে সব মানুষ ওকে চিনবে এইটুকু । ঠিক আছে আজকে রাখছি , পরে কথা হবে বলে দিদি ফোনটা রেখে দিল ।
অলি রান্নাঘরে গিয়ে কফি তৈরি করে নিয়ে এসে অজয়কে দিয়ে নিজেও এক কাপ কফি নিয়ে টিভিতে খবর শুনতে বসে পড়ল । খবরের মাঝখানে বিজ্ঞাপন বিরতির সময় ' অনেক দিনের গান' অনুষ্ঠানের অডিশনের তারিখ দেখানো হচ্ছে । অলি একটা খাতা কলম নিয়ে এসে তাড়াতাড়ি করে অডিশনের তারিখ, ঠিকানা ও সময় লিখে নিয়ে বনির ঘরে গিয়ে খাতাটা ওর সামনে ধরল । বনি গান থামিয়ে খাতাটা সামনে নিয়ে দেখে মাকে বলল ঠিক আছে খাতাটা আমি রেখে দিচ্ছি, এখনো তো দুমাস বাকি আছে । অলি বলল ভাল করে প্র্যাকটিস কর বনি । আর গুরুজির সঙ্গে ফোনে যোগাযোগ করে গানের ব্যাপারে যা যা জানার আছে সব জেনে নেবে । গুরুজি খুব ভাল মনের মানুষ । ফোন করলে কখনো বিরক্ত হন না । আর গুরুজি যে গানগুলো করতে বলবে সেই গানগুলিই করবে। বনি বলল ঠিক আছে মা । অলি ঘর থেকে যাওয়ার পর বনির ফোন বেজে উঠলো । ফোন তুলে কানে নিলে অন্য প্রান্ত থেকে অভিরুপের গলার স্বর ভেসে আসল । বনি অডিশনের তারিখ ও সময় দিয়ে দিয়েছে জানিস । বনি বলল হ্যাঁরে মা খাতায় টিভি থেকে সবকিছু লিখে নিয়েছে । ঠিক আছে আমি এখন আর কথা বলছি না । তুই ভাল করে প্র্যাকটিস করতে থাক ।আমি কাল আসব কেমন । বনি ফোনটা রেখে গানের খাতা খুলে গান সিলেক্ট করতে বসে গেল । কিছুক্ষণ পরে মা খাবারের জন্য ডাকল । রাতের খাবার খেয়ে বনি শুয়ে পড়ল ।
পরদিন সকালে বনির ঘুম ভাঙল অন্যদিনের তুলনায় অনেক তাড়াতাড়ি । অন্যসব দিন সকাল আটটার পরে ঘুম থেকে ওঠে । খুব খুশিমনে বিছানা থেকে উঠে মার কাছে গিয়ে বসলো । অলি জিজ্ঞাসা করল আজ যে খুব খুশি খুশি লাগছে কি ব্যাপার ? বনি বলল জানতো মা আমি একটা ভাল স্বপ্ন দেখেছি তোমাকে বলছি শোনো – টি ভির বড় একটা গানের কম্পিটিশনের ফাইনালে আমি গান করছি আর বিচারকের আসনে অনেকের সাথে গুরুজিও বসে আছে । আমি চোখ বুজে গুরুজির সুর দেওয়া শ্যামাসংগীতটা গাওয়ার পর চোখ খুলে দেখলাম অন্যান্য বিচারকের সাথে গুরুজিও দাঁড়িয়ে হাততালি দিচ্ছে , আনন্দে আমার চোখে জল চলে আসল , আর সেই কম্পিটিশনে আমি প্রথম স্থান লাভ করেছি । তখন মনে হল আমার জীবনের লক্ষ্যের কিছুটা পৌঁছাতে পেরেছি । অলি তখন বলল স্বপ্ন দেখা ভাল কিন্তু স্বপ্ন সার্থক করার জন্য প্রচুর পরিশ্রম করতে হবে । তখন দেখবে জীবনের লক্ষ্যের অনেকটা তুমি পৌঁছাতে পারবে । আর যদি তুমি পরিশ্রম না করে ফাঁকি দাও তাহলে তোমার লক্ষ্যে পৌঁছাতে কখনই পারবে না । সবসময় গুরুজির সাথে যোগাযোগ রাখবে । অলির কথা শেষ হতে না হতেই দরজার কলিং বেলটা বেজে উঠল । দরজা খুলে দেখল অভিরুপ বনির পছন্দের ব্ল্যাক ফরেস্ট কেক নিয়ে এসে হাজির । বনি তাই দেখে আনন্দে অভিরুপের হাত থেকে কেকটা নিয়ে টেবিলে রাখল। মা ও বাবাকে ডেকে সবাই মিলে কেকটা খেয়ে নিল । অভিরুপ বলল অডিশনের গান কেমন তৈরি করেছিস । বনি বলল এবার গুরুজির নির্দেশমত তৈরি করেছি ,জানিনা অডিশনে কেমন গাইতে পারব । অভিরুপ বলল টেনশন করবিনা , নিজের উপর কনফিডেন্স রাখবি কেমন । দেখবি ভালই হবে ।অডিশনেরতো আর এক সপ্তাহ বাকি আছে । গলাটা ভাল রাখিস । এবার অডিশনে আংকেল অ্যান্টির সাথে আমিও যাব । এসব কথা বলে অভিরুপ বনিকে আদর করে বাড়ি চলে গেল ।
অবশেষে আর একদিন মাত্র বাকি অডিশনের দিন । বনি মাকে নিয়ে আগের দিন গুরিজি ও গুরুমাকে প্রনাম করে আসল। সকাল দশটায় অডিশন শুরু হবে । বনি মনে মনে একটু টেনশন করছিল কিন্তু কাউকে বুঝতে দিল না । সকাল আটটার মধ্যে প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র নিয়ে তৈরি হয়ে গেল । অলি ও অজয় তৈরি হয়ে নিয়েছে । অভিরুপও ঠিক সময় মত এসে হাজির হল । অজয় আগে থেকে গাড়ি ঠিক করে রেখেছিল । গাড়ি ঠিকসময়ে চলে এসেছিল । অডিশনটা ছিল দক্ষিণ কলকাতার যোধপুর হাই স্কুলে । বনিরা সাড়েনটার মধ্যে পৌঁছে গেল অডিশন সেন্টারে । সবার সাথে লাইনে দাঁড়িয়ে স্কুলের ভিতরে চলে গেল । বনির হাতে একটা মোবাইল ফোন দিয়ে দেওয়া হয়েছিল । যখন অডিশন দিতে ঢুকবে তখন ফোন করে জানাবে । বাইরে অজয় অলি ও অভিরুপ অপেক্ষা করে থাকবে । তিনজনে একটা গাছের নীচে বসে আছে । আর অনেকে যারা এসেছে তাদের অনেকের সাথে আলাপ হল অলিদের । অনেক দূর দূর থেকে এসেছে সবাই । কিছুক্ষণ বসে থাকার পর সাড়ে এগারোটা নাগাদ অলিকে ফোন করলো বনি যে অডিশন দিতে ঢুকছে । সঙ্গে সঙ্গে অলি আশীর্বাদ করে দিল ফোনের মধ্যে আর অজয় ও অভিরুপ 'বেস্ট অফ লাক' বলে দিল । অলিতো টেনশন করছে আর ঈশ্বরকে ডাকছে । এক ঘণ্টা বাদে বনি হাসতে হাসতে বেরিয়ে এসে মাকে জরিয়ে ধরে বলল ও ফাইনাল রাউণ্ডে গান গাইবার সুযোগ পেয়েছে । ফাইনাল রাউণ্ডে পাশ করতে পারলে দূরদর্শনে গান গাইবার সুযোগ পাবে । ফাইনাল রাউণ্ডের অডিশন কবে হবে সেটা ফোন করে জানিয়ে দেবে । অলি বলল ঠিক আছে এবার বাড়ি চল । অভিরুপ বলল চিন্তা করবি না আর টেনশন করবি না আমার মন বলছে এবার তোর স্বপ্ন পূরণ হবেই । অভিরুপ অলিদের সাথে হাত মিলিয়ে বাড়ি চলে গেল । অলিরাও তিনজনে বাড়ি চলে আসল । বনি বাড়ি এসে গুরুজিকে ফোন করে জানালে গুরুজি খুব খুশি হয়ে আশীর্বাদ করে বলল ফাইনাল অডিশনেও ভাল করবে টেনশন করবে না । গুরুজির কথা শুনে বনি একটু সাহস পেল । চারদিনের মাথায় ফোন করে কর্তৃপক্ষের থেকে জানিয়ে দিল ফাইনাল অডিশনের দিন । ফাইনাল অডিশনের তারিখটা জানার পর বনি মনে মনে একটু টেনশন করছিল কিন্তু মা ও বাবা এসে যখন উৎসাহ দিচ্ছিল তখন বনি মনে মনে খুব সাহস পেল ।
যথারীতি ফাইনাল অডিশনের দিন চলে আসল । ফাইনাল অডিশনটা ছিল গড়িয়ার একটা স্টুডিওয় । বাড়ি থেকে অনেকটা দূরে বলে সকাল সাতটায় বেরোতে হয়েছিল । বেলা এগারটায় অডিশন শুরু হবে । বনিরা দশটায় পৌঁছে গেল । স্টুডিওয় একটা ঘরে অডিশনের আগে বসতে দিয়েছিল সঙ্গে একজন গার্জেনকে । বনির সাথে ওর মা বসেছিল । বাবা ও অভিরুপ বাইরে বসেছিল । ঠিক এগারটায় অডিশন শুরু হল । বনির নাম দশ নাম্বারে আছে ফলে কিছুক্ষণ পরে ডাক আসবে । বাবা ও অভিরুপ ফোন করে 'বেস্ট অফ লাক ' জানিয়ে দিল । বাইরে থেকে সবার গান শোনা যাচ্ছিল। সবাই খুব ভাল গাইছিল । বনির একটু টেনশন হচ্ছিলো কিন্তু কাউকে বুঝতে দেয় নি । বনির ডাক আসল বেলা বারোটার পর । মাকে নমস্কার করে অডিশনের ঘরে ঢুকে পড়ল । বনির মনের ভিতর টেনশন থাকলেও প্রথম মান্নাদের একটা গান দুর্দান্ত গাইল। তারপর আরো চারটে গান বনিকে বিচারকরা গাইতে বলল। বনি সবকটা গানই খুব ভাল গাইল। বিচারকরা বনির কাছে জানতে চাইল কার কাছে গান শেখে। বনি গুরুজি রবি সরকার ও গুরুজি অরুপ রায়ের নাম বলার পর বিচারকরা নড়েচড়ে বসলেন আর বলে দিলেন দূরদর্শনের গানের কম্পিটিশনের জন্য বনি মনোনীত । বনিতো জয় গুরুজি বলে লাফিয়ে উঠল । গুরুজির নামের যে এত মাহাত্ব এটা বনি বুঝতে পারল । কেনোনা অনেকবার ভাল গান গেয়েও বনি ফাইনালে পোঁছাতে পারে নি । তবে অলি ও অজয় খুব আনন্দিত হল । অভিরুপতো আনন্দে বনিকে জরিয়ে ধরল । অভিরুপ বনিকে একটা কথা বলল দেখ বনি যতই ভাল গান করিস না কেন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কথা হল যে কত নামী গুরুর কাছে গান শেখ তুমি তাইতো। বনি বলল বুঝলাম । কিন্তু বনি বলল আমি খুব খুশি যে আমার অনেক দিনের স্বপ্ন দূরদর্শনে গান গাইতে পারছি এবং অনেক অনেক মানুষ আমার গান শুনবে ও আমার পরিচিতি বাড়বে । সুতরাং বনির মনের ভিতর চাঁপা কষ্টটা আর রইলো না । বনির মনে এখন খুব খুশি। বাড়ি এসে অলি ও অজয় বনির দূরদর্শনে গান গাওয়ার জন্য মনোনীত হওয়ার খবরটা ফোন করে সবাইকে জানাতে লাগল ।
--------------------------------------------------------------------
কলকাতা - ৭৮