Click the image to explore all Offers

নিবন্ধ ।। খাগের কলমে সোনার অক্ষর : মহাশ্বেতা দেবী ।। রবীন বসু



 

খাগের কলমে সোনার অক্ষর : মহাশ্বেতা দেবী 


 রবীন বসু   

 

                 

বাংলা সাহিত্যকে যিনি প্রান্তিক মানুষের কাছে নিয়ে গিয়েছিলেন কিংবা বলা যায় প্রান্তিক মানুষজন যাঁর লেখায় উঠে এসেছিল, তাদের ক্ষোভ বঞ্চনা লড়াই আর বিদ্রোহ নিয়ে, তিনি মহাশ্বেতা
দেবী ( ১৯২৬— ২০১৬ ) l নব্বুই বছরের কর্মময় জীবনে কেবল সাহিত্য সাধনা নয় নানান সামাজিক আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত থেকেছেন, নেতৃত্ব দিয়ছেন l সমাজের প্রান্তিক মানুষ, আদিবাসী সম্প্রদায়, শবর, লোধা, সাঁওতাল—এদের সামাজিক উন্নয়ণ ও পুনর্বাসন তাঁর ধ্যানজ্ঞান ছিল l এক সাক্ষাৎকারে তিনি নিজেই জানিয়েছিলেন, ব্যক্তিগত জীবনের সুখদুঃখ, আশানিরাশা, প্রেম-অপ্রেম নিয়ে সাহিত্যসৃষ্টি তাঁর ইচ্ছা বা অভিপ্রায় কোনটাই নয় l বরং তিনি যে মানুষদের মধ্যে থাকেন, যাদের নিয়ে সংগঠন করেন, তাদের আকাঙ্খা, দাবিদাওয়া, তাদের অধিকারের প্রতিষ্ঠাই তাঁর কাম্য, তাঁর সাহিত্য l প্রান্তিক জনজাতির জীবনেতিহাস, তাদের সংস্কৃতি, তাদের গাথা-গল্প, জনশ্রুতি —সবই তিনি গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করেছেন l তাঁর সাহিত্যে সেই প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা ও পর্যবেক্ষণ এক মেদহীন সরল অথচ ঋজু গদ্যভাষায় বর্ণিত হয়েছে l আপাত নিরস ও রুক্ষ  হলেও সে ভাষার অর্ন্তনিহিত মাধুর্য  তার আন্তরিক সাবলীলতা আমাদেরকে মুগ্ধ করে l তাই মহাশ্বেতাদেবীর গল্প-উপন্যাসের বিষয়ভাবনার সঙ্গে তাঁর ভাষা অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িয়ে l তীক্ষ্ণ মর্মভেদী সে ভাষা তীরের ফলার মত আমাদেরকে বিদ্ধ করে l সচকিত করে l

        আর মহাশ্বেতাদেবীকে শুধু মাত্র সাহিত্যিক হিসেবে দেখলে চলবে না l তিনি সমাজসেবী, নারীমুক্তি আন্দোলনের একজন  দিক্ নির্দেশিকা, মানবতাবাদী l  "খেড়িয়া শবর কল্যাণ সমিতি"-র প্রতিষ্ঠাতা l ভারতবর্ষের ভূমিপুত্র আদিবাসী, সাঁওতাল, শবর, লোধা—এদেরকে অরণ্যের অধিকার ফিরিয়ে দিতে, ভূমির অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে তিনি আজীবন সংগ্রাম করে গেছেন l এমনকি কৃষককে তার জমি থেকে ইচ্ছার বিরুদ্ধে উৎখাত করার সরকারি প্রচেষ্টারও তিনি তীব্র বিরোধিতা করেছেন l ক্ষেত্র-সমীক্ষার মাধ্যমে প্রান্তিক মানুষজনের জীবনচিত্র সাহিত্যে তুলে আনা তাঁরই উদ্যোগ l এজন্য তিনি "বর্তিকা" নামে একটি পত্রিকা প্রকাশ ও সম্পাদনা করেন l

        অধ্যাপনা আর সাংবাদিকতার নিশ্চিত পেশাগত জীবন ছেড়ে একদিন তিনি সাহিত্যের অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দিকে ঝাঁপ দিয়েছিলেন l "ঝাঁসির রানী" উপন্যাসের মধ্য দিয়ে  যে যাত্রার শুরু, তা ক্রমে ক্রমে "অরণ্যের অধিকার", "চোট্টিমুণ্ডা এবং  তার তীর", "তিতু মীর", "অগ্নিগর্ভ," "হাজার চুরাশির মা"—বাংলাসাহিত্যের সীমা ছাড়িয়ে ভারতীয় সাহিত্যের এক একটি উজ্জ্বল রত্ন l

'স্তনদায়িনী', 'ভাত', 'রুদালি', 'চোলি কে পিছে', 'দ্রৌপদী'র মত বিশ্বমানের গল্প লিখেছেন l উচ্চবর্ণের মানুষের নিম্নবর্ণের উপর অত্যাচার, জাতপাতের বিভেদ, নারীনির্যাতন, প্রান্তিক উপজাতি মানুষদের অধিকারের লড়াই, এই সমস্ত তাঁর খাগের কলমে সোনার অক্ষরে লেখা হয়েছে l তাঁর গল্প- উপন্যাস পৃথিবীর বিভিন্ন ভাষায় অনূদিত হয়েছে l ভারতবর্ষের প্রায় সব আঞ্চলিক ভাষায় তাঁর গল্প উপন্যাস অনুবাদ হয়েছে l  বলতেন, পদ্মভূষণ, পদ্ম-বিভূষণ, জ্ঞানপীঠ, রামোন ম্যাগসাইসাই আমাকে তা দিতে পারেনি, যা দিয়েছে আদিবাসী শবর লোধা ওই কালো শীর্ণ বঞ্চিত মানুষগুলোর মুখের হাসি l 

তারাশংকর, সতীনাথ, অদ্বৈত মল্লবর্মন সৃষ্ট পথে হেঁটেও তিনি একক এক ধারার সর্বোৎকৃষ্ট ফলক l তাঁকে কেউ মহিলা সাহিত্যিক বলার দুঃসাহস দেখাতে পারবে না l যত দিন যাবে তাঁর প্রাসঙ্গিকতা আমরা উপলব্ধি করতে পারব l বঞ্চিত নিঃস্ব অসহায় প্রান্তিক মানুষরা তাঁর রচনায় যেমন আপন মুখচ্ছবি দেখতে পায়, তেমনি তাদের সংগ্রামের পথ খুঁজে পায় l

 

                            ••••••••


রবীন বসু

১৮৯/৯, কসবা রোড

ফোন + হোয়াটসঅ্যাপ: ৮০১৭১৩৫৪৮৫

e-mail: rabindranathbasu616@gmail.com



Post a Comment

0 Comments
* Please Don't Spam Here. All the Comments are Reviewed by Admin.