রবিবার। আলসেমির চরম পর্যায়ে পৌঁছানোর দিন। সকাল নটা যেন সকাল ছটার সমান। এই দিনে শরীরে ঘুম দরকার নামক বাহানা একটু বেশি ব্যবহার হয়ে থাকে।
এই সব আমার ক্ষেত্রেও খাটে। তাই নিশ্চিন্তে ঘুমাচ্ছিলাম। কিন্তু সুখ সবার সহ্য হয় না। হঠাৎ দরজায় টোকা পড়লো। নাহ, আমার মুখ ফুটে কথা না বেরোলেও চোখ খুলে দরজার দিকে তাকালাম। দেখি আমারই এক দাঁত বের করা বন্ধু সৌমিত্র, যে দাঁত বের না করেই মুখ গম্ভীর করে ঘরে ঢুকে আমায় সরিয়ে আমার বিছানায় পা তুলে বসে পড়লো। নাহ্, কিছু বলিনি, শুধু দেখলাম। কারণ ল্যাদ খুব বড় জিনিস। পাশে থাকা ফোনটায় দেখলাম নটা পনেরো। দুজনেই চুপচাপ। কারোর মুখে কোনো শব্দই নেই। আমি যেই আলতো করে চোখটা আবার বন্ধ করেছি, সঙ্গে সঙ্গে মা ঘরে ঢুকে চিৎকার করে বললো, এগারোটা বেজে গ্যালো, কখন উঠবি?
সৌমিত্র কে দেখিয়ে বললো, 'দেখ তোর বন্ধুকে, কোন সকালে ওঠে, আর তুই...!' হালকা চোখ খুলে দেখলাম এক কাপ চা আর বিস্কুট মা ওর হাতে ধরিয়ে দিয়ে চলে গ্যালো।
সকাল বেলা কেউ আমাদের বাড়ি এলে তার দুধ চা আর মেরি বিস্কুট বাঁধা, তা সে আমার বন্ধু হোক বা বাবার বন্ধু। তবে একটি বই এর নাম দেখেছিলাম, "দুধ চা খেয়ে তোকে গুলি করে দেবো" যেটা বাংলাদেশের বই, যা দেখার পর দুধ চা শুনলেই হাঁসি পায়। শুধু আমার না, বাড়ির সবার।
কড়মড় করে বিস্কুট খেয়ে গোগ্রাসে চা গিলে নিলো সৌমিত্র। আমি তাকিয়ে দেখলাম, বিছানা থেকে নেমে দরজার দিকে গিয়ে পাল্লা দুটো টেনে ভেজিয়ে দিয়ে দৌড়ে আমার কাছে এসে কাঁচুমাচু করে বললো, ভাই ফেঁসে গেছি!
- সেতো তুই প্রতিদিনই ফাঁসিস। এটা আর নতুন কি!
- না ভাই, এটা বেশ চাপের।
- কতটা?
- অনেকটা। ভাই হেল্প লাগবে।
ভুঁড়ু কুঁচকে চোখ ছোটো করে তাকালাম মালটার দিকে। বললাম, বলে ফেল।
- তোদের পাশের পাড়ার পলাশ মল্লিকের বোনের সাথে প্রেম করছিলাম।
- কি বলছিস! পলাশ মল্লিক তো শালা গুন্ডা। পাপ্পু দা নামে গোটা এলাকায় কুখ্যাত, বলে বিছানা ছেড়ে উঠে বসলাম।
- ইয়ে, মানে হ্যাঁ। ওর নাম পলাশী।
- কি!!! আমিতো জানতাম ওর কোনো বোন নেই, একটা ভাই আছে।
- হ্যাঁ, আছে। ব্যাঙ্গালোরে মাসির কাছে থাকে। কিছু মাস হলো এখানে এসেছে। হালকা হেসে উত্তর দিলো সৌমিত্র।
- শালা আর নাম পায়নি। রাতের বেলা নবাব সিরাজ উদ দৌল্লা স্বপ্নে আসেনা?
- কই না তো। সেইরকম কিছু হলে তো বলতো আমায়।
- ওরে বলদ, বল কী হেল্প লাগবে?
- বেশি কিছু না, একটু মুখ্যমন্ত্রীকে ফোন করতে হবে।
বালিশ আর চাদরটা পাশে সরিয়ে রাখার সময় ওর কথা শুনে হালকা করে ওর দিকে তাকালাম। মালটা সিরিয়াস, মুখ চোখে ফুটে উঠেছে। হাঁসি আটকাতে না পেরে হাসতে হাসতে বললাম, সকাল সকাল মুরগী করার আর কাউকে পেলি না!
- ভাই, প্লিজ একটু ব্যবস্থা কর না।
- আচ্ছা, দিদিকে বলো তে ট্রাই করে নয় দেখব। তোর কেসটা বল? হাসতে হাসতে জিজ্ঞাসা করলাম।
- বেশ কিছু মাস ধরে ওর সাথে কথা বলছিলাম। দুই সপ্তাহ আগে বললো আমায় নাকি ওর ভালো লাগে।
- হ্যাঁ, তো?
- আরে ভাই হঠাৎ করে প্রোপোজ ও করে, বলে যে দেখা করতে ওর বাড়ির কাছে। সে জন্যই আজ গেছিলাম।
- তারপর?
- তারপর আর কী! গিয়ে দেখি ওর দাদা কোথা থেকে চলে এসে আমার সাথে পরিচয় করলো। কোথায় বাড়ি জিজ্ঞাসা করলো। কিভাবে পরিচয় হলো ওর সাথে সবটাই জানলো।
- আমার নাম কিছু বলিসনি তো?
- না, তবে ভাবছিলাম বলবো আমার এক বন্ধু পাশের পাড়াতে থাকে। তারপর ভাবলাম নিজে তো কিছু করি, কোনো সময়ে কারোর রেফারেন্স না হলেও চলে। তাই আর বলি নি।
- যাক। হাফ ছেড়ে বাঁচালাম। নাহলে তুই ও মরবি আর আমায় ও পাপ্পু দা ছাড়বে না।
- আরে শোন না, সৌমিত্র বিরক্ত হয়ে বললো।
- হ্যাঁ, বল। শুনছি।
- পলাশ দা আমায় সাইডে নিয়ে গিয়ে জিজ্ঞাসা করলো আমি কি করি, বললাম প্রাইভেট কোম্পানিতে জব করি। জিজ্ঞাসা করলো স্যালারি কত, বললাম বেশি না দশ মতো হবে।
- তারপর। আমি উদগ্রীব হয়ে জিজ্ঞাসা করলাম ওকে।
- তারপর আর কি! পকেট থেকে পিস্তল টা বের করে দেখিয়ে বললো, আমার বোনের পিছনে পড়ে থাকলে শুট আউট করে লাশ এমন ভাবে হাওয়া করে দেবো যে বাড়ির লোক কি, পুলিশ ও খুঁজে পাবে না।
- ব্যাস। এই শুনে পালিয়ে এলি লেজ গুটিয়ে!
- নাহ, আমিও ফুল কনফিডেন্টে বলে এসেছি তোমার বোন আমায় ভালোবাসে আর আমিও। এই প্রেম মরবে না।
আমি জোরে হেসে বললাম, তারপর পাপ্পু দা কি বললো?
- সেইরকম কিছু না, তবে বললো আবার যদি দেখতে পায় গুলি করে দেবে। বলে মাথা নিচু করলো সৌমিত্র।
আমি হাসবো না ওকে সান্ত্বনা দেবো ভেবে পেলাম না। শুধু ওকে বললাম, ভিন ডিজেল হয়ে গেলি আর বিশাল দাদলানি হয়ে ফিরে এলি!
- মানে?
- সেইরকম কিছু না, হেসে উত্তর দিলাম, আর জিজ্ঞাসা করলাম, পলাশী কি বললো?
- কথা হয়নি, তবে মেসেজ করে বললো এই প্রেম অমর থাকবে।
- ভাগ শালা, দুই সপ্তাহের প্রেম দুই দিনে হাওয়া হয়ে যাবে। হাসতে হাসতে বিছানা ছেড়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলাম।
ফ্রেশ হয়ে ঘরে ঢুকে দেখি সৌমিত্র একই ভাবে মুখ গোমড়া করে বসে আছে। বললাম, ভাই বাড়ি যা, অনেক জ্বালিয়েছিস।
আমার কথার কোনো গুরুত্ব না দিয়েই সে বলে উঠলো, একবার মুখ্যমন্ত্রীকে টুইট করে জানালে হয় না, যে আমাদের প্রেমে বাঁধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে ওই শালা গুন্ডা।
- না হয় না।
- কেনো হয় না! তাহলে এম এল এ কে বল না, কাকু তো মিউনিসিপ্যালিটি তে আছেন।
- তুই বাড়ি যা, রেগে বলে উঠলাম।
আমার চিৎকার শুনে সৌমিত্র চুপ করে গ্যালো। কিছুক্ষন চুপ করে বসে থেকে দরজার দিকে এগিয়ে যেতে যেতে বললো, তুই আমার আসল বন্ধু না। বন্ধু তো সেই যে আরেক বন্ধুর বিপদে কাজে আসে। চলে গ্যালো।
আমি হাফ ছেড়ে বাঁচালাম। যদিও এটা নিয়ে সৌমিত্র পঞ্চম বার প্রেমে পড়েছে তাও আবার ভুল মানুষের সাথে আর প্রত্যেকবার এসে আমায় জ্বালিয়ে গেছে। তাই আমিও দেখলাম সৌমিত্র চলে গ্যালো। কারণ বিকাল বেলা আবার ফোন করে মাঠে আসার জন্য ডাকবে।
--------------------------
নাম : রূপঙ্কর চক্রবর্ত্তী
ঠিকানা : মেমারি, পূর্ব বর্ধমান
ফোন : ৯০৮৩৬৯২৬০৮