গল্প।। জীবনের একটি সহজ সত্য।। চন্দন মিত্র
মাত্র দিন পনেরো হল জয়েন করেছেন। এর মধ্যে এমন একটি অস্বস্তিকর পরিস্থিতির সম্মুখীন হওয়ার কথা স্বপ্নেও ভাবেননি আপনি। সেভেন সি সেকশন-এ প্রভিশনাল ক্লাস। প্রদীপবাবু আসেননি তাঁর পরিবর্তে আপনি যাচ্ছেন। সেভেন সি আপনার রুটিনে নেই। এই প্রথম যাচ্ছেন। লাস্ট পিরিয়ড, ফাইভ-সিক্স ছুটি হয়ে গেছে ছ-পিরিয়ডে, ইলেভেন-টুইয়েলভ-এর ছেলেমেয়েরাও সব পালিয়েছে। স্কুল এখন অনেকটাই শান্ত ও শুনশান। তিনতলার এক কোণে সেভেন সি। তার আগের দুতিনটি রুম ফাঁকা পড়ে আছে। ফলে এই ক্লাসের ছেলেমেয়েরা অনেকটাই স্বায়ত্তশাসন ভোগ করে।
কাছাকাছি পৌঁছেই আপনি একটা হট্টগোল টের পাবেন। ক্লাসে ঢোকার পরও আপনি দেখবেন আপনাকে সম্মান জানানোর জন্য সবাই উঠে দাঁড়ালেও তাদের মধ্যে কী একটা বিষয়ে বিসংবাদ কিন্তু তখনও চলছে। আপনি সবাইকে বসতে বলে নিজেও বসবেন। তারপর যথারীতি বই খুলতে বলবেন। কিন্তু আপনি তাদের ক্লাসে প্রথম গিয়েছেন, আপনার বয়স কম, চেহারা ছোটোখাটো ইত্যাদি কারণে তারা আপনার কথায় কর্ণপাত করবে না। বরং নিজেদের মধ্যে উত্তেজিত হয়ে কী একটা বিষয়ে কথাবার্তা চালিয়ে যাবে। আপনি বিরক্ত হয়ে চেয়ার ছেড়ে দাঁড়িয়ে পড়বেন; টেবিলে হালকা একটি চাপড় মেরে একটু উচ্চস্বরে সবাইকে চুপ করতে বলবেন। তবুও কোনো কাজ হবে না। এই আলোড়ন কিন্তু ছাত্রদের, ছাত্রীদের দিকে একজন ছাড়া সকলেই বই খুলে চু্পচাপ বসে আছে। মাঝেমধ্যে সেই ছাত্রীটির সঙ্গেই ছাত্রদের কয়েকজনের বিতর্ক চলছে। এবার আপনি আপনার গলার সামর্থ্য ছাপিয়ে গিয়েও এক হুংকার ছাড়বেন। কিছুটা কাজ হবে তাতে। সবাই মিনিট খানেক চুপ করে যাবে। অতঃপর মুখ খুলবে সেই দশাসই চেহারার ছাত্রটি, যাকে দেখে আপনার মনে হবে, এর তো এতদিনে স্কুলের গণ্ডি পেরিয়ে যাওয়া উচিত ছিল।
স্যার পড়াশোনা পরে হবে, তার আগে আপনাকে একটা বিচার করতে হবে।
আপনি অবাক হয়ে যাবেন এই প্রথম দিন এসে আপনাকে আবার এদের কী বিচার করতে হবে তাই ভেবে। আপনি বুঝবেন ওই ছেলেটাই ক্লাসের পাণ্ডা ওকে চুপ করাতে পারলেই সবাই চুপ করে যাবে।
— হ্যাঁ বলে ফেলো, কী তোমার বক্তব্য।
— স্যার, সহেলী কেন সবসময় স্বপনের সঙ্গে কথা বলবে। আর আমরা কথা বলতে গেলে পাত্তা দেবে না। আমরাও তো একসঙ্গে পড়ি। এই তোরা সবাই বলবি তো বলে কি না?
ছাত্রদের সবাই সমস্বরে চিৎকার করে উঠবে।
— হ্যাঁ স্যার আমাদের সঙ্গে কথা বলে না, শুধু স্বপনের সঙ্গে। আমরা এর বিচার চাই।
আপনি হতভম্ব হয়ে পড়বেন। মুখগুলোর দিকে তাকিয়ে অবাক হয়ে যাবেন। মুখগুলোতে ছাত্রসুলভ কমনীয়তা নেই, রয়েছে কামনার তাড়না। আপনার বুঝতে অসুবিধা হবে না। মনের কোন জুগুপ্সা থেকে এইসব কথাবার্তা উঠে আসছে।
আপনি আবারও টেবিলে চাপড় মারবেন। মেরে বুঝবেন অতটা জোরে আপনি তার আগে কোনোদিন চাপড় মারার সুযোগ পাননি। তাতে কাজ হবে। আপনি কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়বেন, আপনার মুখ থেকে কথা হারিয়ে যাবে। সামাজিক অবক্ষয় কতটা গভীরে শিকড় চারিয়েছে ভেবে শিউরে উঠবেন। এই অবকাশে ছাত্ররা আবার উত্তেজিত হয়ে উঠবে। আপনি হতাশায় চেয়ারে বসে পড়বেন। হঠাৎ বিদ্যুতের ঝলকানির মতো আপনার মগজে বোধি জেগে উঠবে।
— অনেক হয়েছে এবার থামো সব। সহেলি আর স্বপন দাঁড়াও।
যে ছাত্রীটি এতক্ষণ ছেলেদের সঙ্গে কথাকাটাকাটিতে জড়িয়ে পড়েছিল সে দাঁড়াল। ছাত্রীদের মধ্যে সেইই একটু বেশি ফুটফুটে সপ্রতিভ। প্লাক করা ভ্রূ, একটি চুলের সরু গুছি মুখের সামনে নামানো, চুলে হালকা লাল রঙের আভা। এমন একটি প্রত্যন্ত গ্রামে সেভেনে পড়া একটি ছাত্রীর এমন ধরণ আপনার চোখকে বিস্মিত করবে।
মেয়েটিই আপনাকে জানাবে, —স্বপন আজকে আসেনি স্যার।
আপনি তাকে আর কিছু জিজ্ঞাসা না-করে বসিয়ে দেবেন। তারপর সেই ছেলেটিকে দাঁড় করিয়ে জিজ্ঞেস করবেন—এই তোমার নাম কী ?
— মন্টু স্যার।
— হ্যাঁ, মন্টু শোনো তোমাকে একটা বিষয় শিখিয়ে দিই। যে যাকে পছন্দ করে সে তার সঙ্গেই কথা বলে, এটাই সামাজিকতা। তাই আমাদের উচিত যারা আমাদের সঙ্গে কথা বলতে চায়, তাদের সঙ্গেই কথা বলা এবং যারা আমাদের সঙ্গে কথা বলতে চায় না, তাদের এড়িয়ে যাওয়া। সহেলি ও স্বপন পরস্পরকে পছন্দ করে তাই তারা নিজেদের মধ্যে কথাবার্তা বলে। তুমিও খুঁজে দ্যাখোকে তোমাকে পছন্দ করে।
মন্টু মাথা নীচু করে দাঁড়িয়ে থাকে। সে যেন জীবনের একটি সহজ সত্য আজ উপলব্ধি করল, এতদিন যে সত্য তার অধরা ছিল।