ছোটগল্প।। কলঙ্কিনী।। বিশ্বনাথ প্রামাণিক
১
বাপ মা হারা সাত বছরের ছোট বোনটার সঙ্গে, তার থেকে তিন বছরের বড় বাবলুটা যে রাতে হারিয়ে গেল সেদিনই বোঝা গিয়েছিল এ গ্রামে মানুষ নেই কো। স্বার্থপরতার এহেন চূড়ান্ত নিদর্শন শুধু যে গাজীপুরের ঘরে ঘরে তা নয়, আশেপাশে আরও পাঁচটা গাঁ ঘুরলে ওই একই কথা লোকে বলবে- একদিন নয় দু’দিন নয়,সারাজেবন দুটো ছেলেমেয়ে পুষবো সে সামর্থ্য ঠাকুর কি আমাদের দিয়েছে গো? দুঃখ কি হয় না? দুঃখ পাওয়া এক জিনিস আর পরের ছেলে মেয়ে পোষা আর এক জিনিস। তারপর ওই মেয়ে বড় হবে, গায়ে-গতরে হবে, পাঁচজনের দৃষ্টি পড়বে… এত ঝামেলা সাধ করে কে আর পোহায় বল……
না, এজন্য অবশ্য তাদের দোষ দেওন ঠিক নয়। ওই তো সব চাষাভুষোর দল। যতক্ষণ খাটে ততক্ষণ খাওয়া।
- বাপ মার বা কি আক্কেল? এই কচি কচি দুটো ছানাপোনা রেখে কোন আক্কেলে তুমি চোখ বজো?
রাবেয়ার মার কথা শুনে হেসে ওঠে সবিতা বউ- আক্কেল বলে আক্কেল! একেবারে বেআক্কেলে! রাবেয়ার মা বলে- যাই বলো তাই বলো বোন, তোমাদের ওই বাবলুটা কিন্ত বোনটারে বড় ভালোবাসে। বোনের এতোটুকু দুঃখ সে সইতে পারে না গো।
তারি কথার রেশ ধরে সবিতা বউ বলে- তা আমি মিছে কথা কইবুনি দিদি। তা বাসে… এই তো সেবার অমাবস্যার দিন, খেন্তিদের আমবাগানে দুপুরবেলা আম পাড়তে গেল। না… কি? না, বোনটা ওর কাছে কাঁচা আম খাওয়ার বায়না ধরেছে! গেলি তো গেলি আমাদের হেবলোটার সঙ্গে নিয়ে যা, তা নয়। একেবারে ভরদুপুরবেলা হন হন করে একলা গেলি! আর ফিরে অব্দি সেই যে শুলো তা উঠবার নাম নেই কো…
রাবেয়ার মা চোখ ছানাবড়া করে বললে- অ্যাঁ! বোশেক মাসের দুপুরবেলা ক্ষেন্তিদের বাগানে? মাগো! ছোড়াটার বুকে ভয় ডর বলে কিছু নেই কো?
-তবে আর বলছি কি? সেই রাত থেকে ধুমজ্বর। তা
হবে নে? বাবারে বাবা, এত করে বলি- ওরে মা টা তোর অপঘাতে মরেছে, এখনো ডালে পালায় ঘুরে বেড়াচ্ছে। এমন দিনে দুপুরে আগানে-বাগানে
ঘুরিসনি,তা শুনলে? শুনলে সে কথা? সেই তো ভুতে ধরিয়ে বাড়ি ফিরলি!
তারপর কিঞ্চিৎ গলা খাটো করে সে প্রায় কেঁদে উঠে বলে- ছেলেপুলে নিয়ে ঘর করি দিদি, তুমি বল চিন্তা হয় কি না হয়!
রাবেয়ার মার চোখে বিস্ময়। এতবড় শত্রুতা যে
কেউ করতে পারে তা যেন তারও ভাবনার অতীত - তা তোমাদের বংশী ওঝা কি বলে বউ?
সবিতা বউ মুখে একপ্রকার কুৎসিত ইঙ্গিত করে বলে- হু! সবকিছু কি আর মাগনায় পাওয়া যায়? বংশী আর কি বলবে? বলে নাকি ওর মার দৃষ্টি পড়েছে, ঝাড়ফুঁক করতে হবে। পাক্কা একশ টাকার কমে সে আসতে চায় না। তা এতো টাকা আমি এখন কোত্থেকে জোগাড় করি দিদি? আমার কি রাজা- উজির অবস্থা?
রাবেয়ার মা দীর্ঘশ্বাস ফেলে – হ্যাঁ, তা তুমি বা সবসময় এত টাকা পয়সা কোথায় পাবে?
-বলদেন দিদি? ওই মেয়ে কেঁদে কেঁদে সাতপাড়ার নোক এক জায়গায় করছে। তা দিলে কেউ দুটি পয়সা?
রাবেয়ার মা আঁচল টেনে চোখ মোছে- আমার কি আর সে ক্ষমতা আছে বোন যে পাড়া-পরশির বেপদে দুটি সাহায্য করব?
আবার চোখ থেকে আঁচল নামিয়ে বলে- ওদের মা মাগিটা আর ছেলে মেয়ে দুটোকে ছেড়ে যেতে পারলে না সবিতা বউ। তোমাদের বন্নের ভুত-পেত বড় মায়াবী হয়। ছেলে-মেয়ের দুঃখ তারা ভুলতে পারে না। একেবারে এঁটুলির মতো পেছন পেছন ঘুরবে। তুমি ঘাটে যাও, সেখানে যাবে, তুমি মাঠে যাও, সেখানেও যাবে…
-তা আর বলতে? ওই ছেলে আর মেয়েটাই যে মাগির পরান ছিল গো। নিজের চোখে তো দেখেছি বাবলুর বাপটা গাড়ি চাপা পড়ে মরে যাওয়ার পর, ও দিনরাত আগলে রাখতে ওদের। এমন কপাল, সে সুখ সইল না ও দুটোর কপালে।
-আহারে! তারপর সবিতা বউয়ের আরো ঘন হয়ে ফিসফিস করে বলে- তবে শুনলুম নাকি বাবলুর মার ক্ষয়রোগ ছিল। হ্যাঁ বউ, কথাটা কি সত্যি?
যেন তেলে ফোড়ন পড়ার মতো চরবড়িয়ে ওঠে সবিতা বউ- ক্ষয়রোগ না আর কিছু...
তারপর রাবেয়ার মার কানের কাছে মুখটা এনে ফিসফিস করে বলে- কারো কাছে বলুনি দিদি, সে সব কথা বলবার নয়…
রাবের মা কৌতুহলী হয়ে ওঠে।
সবিতা বউ হঠাৎ দু’হাত কপালে ঠেকিয়ে আকাশের দিকে মুখ করে গুনগুন করে বলে- ক্ষমা করো বাবুলের মা। জানি তুমি এখন সব শুনতে পাও, দেখতে পাও। তাই তো এত কাল পেটের ভেতর নুক্কে রেখে ছিলুম সে কথা। এখন যে সে সব বেরোবার জন্য বড় হ্যাচড়-প্যাচড় করছে গো। পেট ফুলে মরি। তা মুখ ফসকে যদি বা দুটো কথা বেরিয়ে পড়ে তুমি যেন দোষ নিও নি।
রাবেয়ার মার কৌতুহল বাড়তে থাকে।
উৎকন্ঠিত হয়ে চেয়ে থাকে সবিতা বউয়ের দিকে। তার আর তর সয় না। এক সময় সে বলেই ফেলে- তাহলে যা শুনতে পাই সেসব মিথ্যে নয়?
-কি শুনতে পাও তুমি? সবিতা বউ প্রশ্ন ছুড়ে দেয়।
-নাকি মিত্তিরদের ছোটবাবুর সঙ্গে নুক্কে নুক্কে ইয়ে... মানে...
গলা খাটো করে ফিসফিস করে বলে সবিতাবউ- গেরাম শুদ্ধু সবাই জানে, আর তুমি শোননি? ও তো রতন মিত্তিরের অ্যাঁড় গো....
-কী?
-আঃ, বোঝ না নাকি? নেকী!
- ও… তাই বল! তারপর দীর্ঘশ্বাস ফেলে আবারো বলে- হ্যাঁ, পেটের জ্বালা, বড় জ্বালা বোন… ছেলেমেয়ে দুটো না খেতে পেয়ে পথে পথে ভিক্কে করে বেড়াবে আর কোন মা চোখ বুজে তা দেখতে পারে বল দেখি?
-তাই বলে এই পাড়াগাঁয়ে....? তা বাঁচাতে পারলি তো! নিজেই তো চলে গেলি। এখন ওদের কি দশা হবে?
-আহা! কপাল...
- সেইজন্য তো কেউ রাখতে চাইলে না। সব বলা-কওয়া
করে ও মেয়ে বড় হয়ে না ওর মায়ের স্বভাব পায়।
-চুপ চুপ, শত্তুরটা ঠিক টের পেয়েছে। পাশের ঘরের দরজার দিকে ইঙ্গিত করে সবিতা বউ ইঙ্গিতে রাবেয়ার মাকে থামতে বলে।
২
এক পাশে ছোট্ট একচিলে মাটির ঘর। তারি একটা কাঠের দরজার ভাঙা পাল্লা থেকে ক্যাঁচর ক্যাঁচর আওয়াজে ওঠে। কান খাড়া করে শুনে সতর্ক হয়ে ওঠে সবিতা বউ। দরজার পাল্লাটা একদিকে ঠেলে দিয়ে বেরিয়ে আসে কচি মেয়েটা। কী এক মায়াবী বিষণ্ণতায় আচ্ছন্ন সে। মাথার দু’দিকে ঝুলে পড়েছে এলোমেলো চুলের গুচ্ছ। রোগা-পাতলা মেয়েটা এ ক’দিনে যেন কত বড় হয়ে গেছে! পায়ে পায়ে বাইরে বেরিয়ে এসে দাবার খুঁটি ধরে দাঁড়ায় সে। পাশের বাড়ির দাবায় বসে গল্প করছে সবিতা কাকি ও রাবেয়ার মা। সে ইতস্তত করে দাবার সিঁড়ি পোট বেয়ে নিচে নেমে আসে। তারপর একেবারে তাদের সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে বলে ওঠে- কাকিমা একটা ছেঁড়া গামছা দিতে পারো? আর...
তার কথা শেষ হবার আগেই সবিতা বউ খেকিয়ে ওঠে- ওখানে আছে, যা নিয়ে যা। আবার এই অবেলায় গামচা দিয়ে কি হবে শুনি?
-ভিজিয়ে দাদার মাথায় জলপট্টি দিব। জ্বর হলে মা দিত যে..
- হা হা হয়েছে। আর ব্যাখ্যা দিতে হবে না। যা বাটি-ফাটি দিতে পারবনি। খোলা-মালা যা আছে ওতে করে জল নিয়ে যা। পুটি চুপি চুপি একফালি ছেঁড়া গামছাটা দড়ির ভাড়া থেকে টেনে নিয়ে চলে যাচ্ছিল। তাকে এক প্রকার শুনিয়েই সবিতা বউ বলে ওঠে- কোথা থেকে কোন ভুতে ধরিয়ে বাড়ি আসবে… আর তুমি এখন গুষ্ঠি শুদ্ধু খেটে মরো!
পুঁটি কিছু বলে না।
রাবেয়া
বউকে শুনিয়ে সে আবারো বলে- ছেলেপুলে নিয়ে ঘর করি দিদি, আত-দিন ভয়ে মরি। তারপর গলাটা
একপ্রকার জোর করেই বলে- আবাগির বেটি, বংশের মুখে কালি দিয়ে তো মরে বেঁচেছে। আর এ দুটোকে রেখে গেছে আমার হাড় মাস
জালিয়ে খাওয়ার জন্যে… মরন ও হয় না? মর... মর...
পুঁটি রান্নাঘর থেকে নেওয়া দস্তার বাটিটায়
একটু জল নিয়ে গামছা ভিজিয়ে দাদার মাথায় জলপট্টি দিতে দিতে ডাকে - দাদা… ও দাদা ওঠ।
আমাদের যে যেতে হবে দাদা, ওঠনা রে, ওঠ…
সে কথায় কান করে না বাবলু। জ্বরের ঘোরে সে ভুল বকতে থাকে - মা ডাকছে রে… আমাকে যে এখুনি যেতে হবে বোন। এই তো মা আমি আসছি। খানিক চুপ করে থেকে সে আবারো বলতে থাকে- একটা… দুটো… তিনটে… সবগুলো পেড়ে দাও মা। কী বড় বড় আম! পুঁটিটা যে বড্ড ছোট। ও যে আম খেতে বড় ভালবাসে…
- এই যাঃ… ডালটা যে ভেঙে গেল মা! আঃ আঃ … তুমি যে
পড়ে যাবে মা। মা…আ ...আ...
-দাদা দাদা! কী হয়েছে তোর! মা মাগো তুমি কোথায়? আমার যে বড় ভয় করছে মা… আমি যে এখন কী করি… অঝোর কান্নায় ভেঙে পড়ে পুঁটি।
----------
২৪/০৯/২১
সকাল। সোনারপুর।