সু,
তোমরা সকলে আমার জীবনে শুধু 'সু' হয়েই থেকো। অন্তত, তোমাদের সঙ্গে আমার সম্পর্ক কখনো যেন 'কু' হয়ে না ওঠে। জানো তো, আমার মতো কিছু ছন্নছাড়া, সৃষ্টিছাড়া পৃথিবীতে জন্মায়, যারা জীবনের সব সম্পর্কের দ্বারাই প্রতারিত হয়। এর কারণ হয়তো, তাদের মন এতো সূক্ষ্ম হয় যে, সম্পর্কের ভারী বোঝাটা তাদের বহন করার ক্ষমতাই থাকে না। তার ভারেই তারা ভেঙে পড়ে। তাই, তোমাদের সঙ্গে আমার সম্পর্ক যেন ভারী করে তুলো না, এই মিনতি। তুমি তো জানো, সকলের তুলনায় আমার জায়গা কোথায়, তা নিয়ে আমি মোটেই চিন্তিত নই। তবে পাঠকের চোখে আমার স্থান কোথায়, তার একটা বিশেষ অবদান তো আছেই। তোমাদের দৃষ্টিভঙ্গিই তো গল্পকারের জীবন তরী বেয়ে চলার বৈঠা।
তোমরা আমাকে বলেছিলে, একটা সত্যিকারের গল্প লিখতে। বলেছিলে, আমার গল্পের চরিত্রগুলো বাস্তবে নেই। আমি যেন একটা বাস্তব চরিত্র নিয়ে গল্প লিখি। কিন্তু সু, আমার গল্পের সকলেই তো এই বাস্তব সমাজেরই এক একজন। এখানকার সমস্যা, এখানকারই ভালোবাসা, চোখের জল- এই সবকিছুই তো আমার গল্পের মালায় গাঁথা। আমার গল্পগুলো কোনো অমরাবতীর রূপকথা নয়, এ কথা তো তোমরা নিশ্চয়ই মানবে! তবু, তোমাদের বলা কথা রাখতে, তোমাদেরই জন্য আমি বাস্তব গল্পের খোঁজে নেমেছি। এমন একজনের কথা তোমাদের শোনাবো, যে আমার নিজের চোখে দেখা একজন মেয়ে।
ট্রেনে করে কর্মস্থলে চলেছি। দুই দিনের প্রচন্ড বৃষ্টির পর আজকের সকালটায় বৃষ্টি হয়নি। বর্ষণক্লান্ত মেঘলা আকাশ অভিমানী মেয়ের মতো মুখ ফুলিয়ে রয়েছে। সূর্য এসে, ভালোবেসে, রোদের স্পর্শে আদর করে, তার জলভরা চোখে হাসি ফোটাচ্ছে। ভিড়ের মধ্যে চিঁড়ে চ্যাপটা হয়ে দাঁড়িয়ে, কোনমতে সারসের মতো গলা বাড়িয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে এই রকম কতকিছু ভাবছি, এমন সময় কম্পার্টমেন্টের সাধারণ সব আওয়াজ ছাপিয়ে জোরে জোরে অনেকগুলো গলার স্বর শুনে ফিরে তাকিয়ে দেখি, জানলার পাশের একটা সিটে পা তুলে বেশ কায়েম হয়ে বসে আছে একটি মেয়ে। সেই মুহূর্তে, তাকে দেখে শুধু 'মালিনী' বলতেই ইচ্ছে হলো আমার। আমি তো তার নাম জানিনা, তাই আমার এই ছোট্ট গল্পের স্বল্প পরিসরে আর তোমাদের সকলের কাছে 'মালিনী' নামেই ওর পরিচয় থাক। আমার এই গল্প থেকে বেরিয়ে, আমার দেওয়া এই নাম, পরিচয় মুছে ও একসময় হারিয়ে যাবে হাজার লোকের ভিড়ে। কেউ ওকে আর কোনদিনই খুঁজে পাবে না। যেই আমি ওকে এই ক্ষুদ্র পরিসরে অমর করে রাখতে চাইছি, সেই আমিও আর ওকে খুঁজে পাবো না সাধারণের ভিড়ে। তবু, তোমরা তো তাই চেয়েছিলে! একটা সত্যিকারের গল্প!
মালিনী একটা লম্বা সূচে সুতো পরিয়ে এক মনে মালা গাঁথছে- রজনীগন্ধা আর গাঁদা ফুল মিশিয়ে। আমাদের বাড়ির মতোই কোনো বাড়ির মহিলারা ঠাকুর পূজোর জন্য হয়তো ওর কাছ থেকে এই মালা কিনবে। এখানে কিন্তু ভুল কোরো না তোমরা। 'মালিনী' নাম ওকে আমি দিলেও, রবি ঠাকুরের সুধা মালিনী কিন্তু ও নয়! এটা যে সত্যিকারের গল্প। একে অতিরঞ্জিত করার অধিকার আমার কোথায়? তাই ওর কপালের ওপর এসে পড়েছে অযত্নে বেড়ে ওঠা আগাছার মতো এলোমেলো রুক্ষ, লাল চুলের গোছা। ওর মুখটা দারিদ্র্যের সঙ্গে আপোষহীন সংগ্রামে শক্ত, সুষমা বর্জিত। পরনের কাপড়টাও অত্যন্ত অপরিষ্কার। জায়গায় জায়গায় ছেঁড়া। রোদে পোড়া গায়ের রঙ। ফাটা গোড়ালিতে আবছা আলতার দাগ ওর জীবনের কোনো বিশেষ দিনকেই শুধু মনে পড়ায়। গলায় একটা খুব পুরোনো লাল পুঁতির মালা। মাথায় অনেক দিন আগে দেওয়া সিঁদুর। ও মাথা নীচু করে এক মনে মালা গাঁথছে আর মাঝে মাঝে উদাস হয়ে বাইরের দিকে চাইছে। এ দিক থেকে ওকে পা নামিয়ে সোজা হয়ে বসতে বলে, ভিড় কামরার বাকি মহিলাদের মধ্যে অনেকেই চেঁচামেচি করছে। অনেকেই বলছে, ওর টিকিট নেই। ওকে সিট থেকে উঠিয়ে দেওয়া হোক। ও কিন্তু সেই সবের কোনো উত্তর দেয়নি। একটাও কথা বলেনি। একবার ফিরে তাকায়নি পর্যন্ত। আমি ওর চোখ দেখতে পাচ্ছিলাম না। সেই চোখে বিশেষ কোনো বিষন্নতার ভাষা ছিল কিনা তাও আমি জানিনা। তবু আমি ওর দিকে তাকিয়েছিলাম। এক একটা স্টেশনে ভিড় খানিকটা পাতলা হয়ে যাচ্ছে, আবার কখনো বেড়ে যাচ্ছে। ঢেউয়ের মতো লোক উঠছে আর নামছে। মহিলা কামরার রীতি অনুসারে, হকারের আনাগোনা লেগেই আছে। চারদিকের নানারকম শব্দের মধ্যে মালিনী শুধু এক ভাবে বসে মালাই গেঁথে চলেছে। ওর প্লাস্টিকের ব্যাগটা ওর গাঁথা মালা দিয়ে ক্রমশ ভরে উঠছে। কোলের ওপর তখনও অনেকগুলো ফুল।
কিছুক্ষণ পর একটা স্টেশন থেকে এক ভদ্রমহিলা উঠলেন ট্রেনে। ওর কাছাকাছিই এসে দাঁড়ালেন। বললেন,
- ভালো আছো?
এতক্ষণে ও মুখ তুলে তাকালো। ভদ্রমহিলার মুখের দিকে তাকিয়ে হাসলো একটু। উনি ওকে সোজা হয়ে বসতে বললেন না। সিট ছেড়ে উঠে যেতেও বললেন না। বরং জিজ্ঞেস করলেন, ওর স্বামী এখন কেমন আছে! মালিনীর মুখটা আবার ম্লান হয়ে গেলো। ও মাথা নেড়ে বললো, "ভালো না।"
- তুমি হসপিটালে নিয়ে গিয়েছিলে?
- গিসলাম। আপনের ডাক্তারনী তো আলেন না।
- ও একটু অসুস্থ। ছুটিতে আছে। তাই তোমার সঙ্গে দেখা হয়নি। আচ্ছা, কাল তুমি এই ট্রেনেই উঠবে তো? আমি একটা চিঠি দেবো তোমাকে। তুমি গিয়ে বড়ো ডাক্তার বাবুকে দিও।
- বড়ো ডাক্তার আমার কতা শোনবেন?
ভদ্রমহিলা হাসলেন। তারপর আশ্বাসের ভঙ্গীতে বললেন,
- নিশ্চয়ই শুনবেন। আমার বোন থাকলে নিজে তোমাকে নিয়ে যেতো। তুমি আমার দেওয়া চিঠিটা দেখিও, কেমন?
মালিনী মাথা নেড়ে সায় দিলো। চুপ করে রইল কিছুক্ষণ। নীরবে কয়েকটা ফুল মালায় গেঁথে, আবার জানলার দিকে ফিরে কী যেন ভাবলো খানিকক্ষণ। তারপর ভদ্রমহিলার দিকে ফিরে জিজ্ঞেস করলো,
- উই ডাক্তারনী আপনের বুইন?
ওর দুই চোখে অবিশ্বাস উপচে পড়ছে। ভদ্রমহিলা হয়তো ওর পূর্ব পরিচিতা। ওর রকম দেখে উনি হাসতে হাসতে বললেন,
- হ্যাঁ।
ভদ্রমহিলার চেহারায় আভিজাত্যের সঙ্গে মাতৃত্বের ছায়া মিশে আছে। মুখে একটা স্বপ্নীল মেদুরতা। ওঁকেও বোধহয় সাধারণ মানুষের সোজা অঙ্ক দিয়ে হিসেব করা যায় না। তাই না হলে, ট্রেনের দরিদ্রা সহযাত্রিনীর প্রতি তাঁর এতো সহানুভূতি আর আন্তরিকতা থাকে? এইটুকু কথোপকথনের মধ্যেই আমি মনে মনে ওনার প্রতি শ্রদ্ধাশীল না হয়ে পারলাম না। সু, সত্যিকারের ভালো নিশ্চয়ই এতো খারাপের মধ্যেও আছে। আমাদের সব সময় চোখে পড়ে না বলেই আমরা ভুল ধারণা করি।
শুনতে পেলাম, ভদ্রমহিলা মালিনীকে জিজ্ঞেস করছেন,
- হসপিটালের ডাক্তারবাবু কি বলেছেন? কি হয়েছে তোমার স্বামীর?
- বলিচে, লিবারের দোষ আচে। অসুদ লিকি দেচে। আর কতগুলান বড়ি দেচে। বড়িগুলান খাওয়াচ্চি। অসুদ একনো কিনতি পারিনি।
- সেকি! কেনোনি কেন?
- কি করি কিনব, দিদি? বাদলার জন্যি তো ঘরের বার হতি পাল্লেম না। বিক্কিরি-বাটা না হলি....।
একটু থেমে গেলো মালিনী। তারপর গলায় দ্বিধা নিয়ে বললো,
- অত গুলান ট্যাহা! আমি যে কি করি!
- তুমি ওষুধের নাম লেখা কাগজটা আমাকে দাও তো। আমার বোনের বাড়িতে দেখবো আমি। জ্বর হচ্ছে এখনো?
- জ্বর তো হয়। আবার কাল সাঁঝ থিকে বমি করতেছে। ওরে দেকি আমার ভয় করে গো দিদি। আমার আর কতো খ্যামতা, বলেন?
বলতে বলতে এতক্ষণের অবিচলিত মেয়েটি প্রায় কেঁদে ফেললো। মলিন আঁচলটা দিয়ে চোখ দুটো মুছে ফেলে আবার শক্ত হয়ে বসলো। দেখলাম, ওর চোয়ালটা শক্ত হয়ে উঠছে। নিজের সঙ্গে অবিরত যুদ্ধ করার ক্লান্তিটাকে চাপার চেষ্টা করছে হয়তো! ভদ্রমহিলা ওর কাঁধে একটা হাত রাখলেন। ওঁর অসঙ্কোচ আন্তরিকতা দেখে মালিনীও বোধহয় বিস্মিত হয়ে গেলো। অবাক চোখদুটো তুলে ওঁর মুখের দিকে চাইতেই, উনি মাথা নেড়ে বললেন,
- ভেঙে পড়লে চলবে না। তোমাকেই তো শক্ত হতে হবে। তাছাড়া, তোমার স্বামীর এমন কিছু হয়নি। লিভারের অসুখ অনেকেরই হয়। ঠিকমতো চিকিৎসা হলে আবার সেরেও যায়। তুমি বড়ো ডাক্তারবাবুর সঙ্গে দেখা করো। আমার বোনও হসপিটালে যাওয়া শুরু করুক। ওরা তোমাকে সবরকমের সাহায্য করবে। তুমি হসপিটাল থেকে যাতে আরো ওষুধপত্র পাও, আমি তার ব্যবস্থা করবো।
মালিনীর উচ্ছাস বোধহয় আর বাঁধ মানলো না। ভদ্রমহিলার হাতদুটো ধরে আর্দ্র গলায় ও বললো,
- আর জম্মে তুমি আমার মা ছিলে গো!
- আর এই জন্মে কেউ নই বুঝি?
ভদ্রমহিলা শান্ত, স্নিগ্ধ স্বরে বললেন। মালিনীর শীর্ণ মুখে আবার একটু হাসি দেখা গেলো। আঁচল দিয়ে চোখ মুছে ও মাথা নীচু করে আবার ফুল গাঁথতে লাগলো মালায়। ভদ্রমহিলা একটু পরেই সহজ গলায় জিজ্ঞেস করলেন,
- তোমার ছেলের বয়েস কতো যেন হলো?
- বোশেকে তিনি পড়িচে।
- ওকে কোথায় রেখে আসো?
- আমাদের দুই ঘর পিছনে দেওরেল ঘর। কোনোদিন সেকেনে, আর কোনদিন পাশের পড়শীর কাচে। আজ পাশের ঘরে রয়িচে।
এরপর আর বিশেষ কথা হলো না দুজনের। পরের একটা স্টেশনে ভদ্রমহিলা নেমে গেলেন। মালিনী ওনার চলে যাওয়ার পথের দিকে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। ওই পথেই ও একটা ক্ষীণ আলোক শিখার সন্ধান পেয়েছে, যার সাহায্যে ওর আশার প্রদীপ আবার জ্বলতে পারে! ট্রেন ছাড়তেই, সূচসুতো গুটিয়ে মালিনী উঠে দাঁড়ালো। পরের স্টেশনে ও নামবে। পরের স্টেশনে আমিও নামবো। ওকে আরো কিছুক্ষণ দেখবো বলে, আমি ওর পরে চললাম। ভিড় ঠেলে, মাথায় বিশাল একটা বোঝা নিয়ে ও দরজার দিকে এগিয়ে চললো।
সারা রাত ধরে বৃষ্টি হয়েছে। তখনো বাতাসে আর্দ্রতার ঠান্ডা ছোঁওয়া। গল্পের খোঁজে গিয়ে আমার মন এমন হারালো যে, নিজের পথে চলতে চাইছে না আর। আমার আগে আগে চলেছে মালিনী। উঁচু করে কাপড় পরা, রোগা, নির্জলা চেহারা নিয়ে দুদ্দাড় করে ছুটছে। ভীষণ তাড়া ওর। বাজারে সবচেয়ে ভালো জায়গাটা দেখে বসতে হবে ওকে। সারাদিন চিৎকার করে কর্কশ গলায় ডাকতে হবে ক্রেতাদের। ইনিয়ে বিনিয়ে কথা বলে দৃষ্টি ফেরাতেই হবে পথচলতি ব্যস্ত জনতার। কথার মারপ্যাঁচে প্রমাণ করে দেখাতে হবে যে, বাজারে ওর কাছেই রয়েছে সেরা ফুলের মালা গুলো আর তার দাম ওর কাছেই সবচাইতে কম। যদিও ওর ফুলগুলো আজকের সকালের মতোই আধ-ঘুমন্ত।
সু, আমরা তো দুঃখের বিলাসিতা করি! লড়াইয়ের মহড়াই শুধু নিই। জীবনের সত্যিকারের লড়াইয়ের সম্মুখীনই তো হয়না বেশীরভাগ মানুষ। দারিদ্র্যের সঙ্গে, অসুস্থতার সঙ্গে, অন্ধকারের সঙ্গে কেমন করে লড়তে হয়, প্রিয়জনের রোগক্লীষ্ট মুখের দিকে চেয়ে, তাদের হাহাকার শুনে কেমন করে বাঁচতে হয়, কি হাতিয়ার দিয়ে এ লড়াই লড়তে হয় দেয়ালে পিঠ দিয়ে- তা তো বেশীরভাগ মানুষই জানে না। প্রিয়জনের মুখে পেটভরানোর মতো খাবার তুলে দিতে না পারার জ্বালা কেমন করে সহ্য করতে হয়- আমি যেমন জানি না, তেমনই তুমি জানো না, প্রিয়জনের জ্বরে পুড়ে ওঠা শীর্ণ দেহখানা বুকে জড়িয়ে ধরে, ওষুধের দোকানের রঙচঙে ট্যাবলেট, ক্যাপসুল দেখতে দেখতে কেমন করে চোখের জল চোখেই আটকে রাখতে হয়। তাকে যে বেরোতে দিতে নেই, সু। তার বেরোবার অধিকার নেই।
স্টেশন থেকে বেরিয়ে দেখি, সাবওয়েতে জল জমে রয়েছে। হঠাৎ আমার মনে হলো, ফিরে যাই! তখনই চোখে পড়ে গেলো, এক হাঁটু জল ঠেলে ঠেলে মাথায় মস্ত বড়ো বোঝাটা নিয়ে ততক্ষণে অনেকটাই এগিয়ে গেছে মালিনী। মনে হলো, আমিই বা এতো সহজে হেরে যাবো কেন? জলের মধ্যে দিয়ে আস্তে আস্তে চলতে চলতে ভাবলাম, এই হলো জীবন যুদ্ধের পার্থক্য। আমার মতো অনেক লোকের পালিয়ে যাবার একটা বিকল্প থেকে যায়। মালিনীর মতো যোদ্ধাদের সেটা কখনোই থাকে না। ওকে, ওদের মতো মানুষদের হেরে যাওয়া দানটাও শেষ পর্যন্ত খেলতেই হয়।
স্টেশনের বাইরে এসে মালিনী আর আমার পথ সম্পূর্ণ ভিন্ন দিকে। যতটুকু পথ ওর সঙ্গে এলাম, তার গল্প বলা তো হয়ে গেলো। এবার তো ওর জগত আর আমার জগত একেবারে আলাদা। আমার দেখা জগত ছাড়িয়ে ও চলে যাবে ওর কর্মজগতে।
ধরে নিলাম, এরপর কোনো ব্যস্ত বাজারে, আসা-যাওয়ার পথের ধারে ও সাজিয়ে বসেছে ওর ফুলের পসরা। হয়তো, সারাদিন হাঁক ডাক করে ওর সব ফুল বিক্রি হয়ে গেছে। টাকাগুলো গুনে গেঁথে নিয়ে, সন্ধ্যাবেলায় ফেরার ট্রেন ধরেছে মালিনী। ট্রেনটা ছাড়তেই, একটা কোণায় বসে পড়ে, মাথাটা নীচু করে বিশ্রাম নিচ্ছে ও। হয়তো সারাদিনের মধ্যে এক টুকরো রুটি খেয়েছে ও। তন্দ্রাচ্ছন্ন চোখে ধোঁওয়া ওঠা একথালা গরম ভাতের স্বপ্ন নেশা ধরিয়ে দিচ্ছে ওর ক্লান্তিতে।
ট্রেন এসে যখন এসে মালিনীর স্টেশনে দাঁড়ালো, তখন হয়তো অন্ধকার গাঢ় হয়ে গেছে। প্ল্যাটফর্মের বাইরে এসে, রাতের কোটরে হারিয়ে যাওয়া পথটা ধরে রবারের তালিমারা চটির ফট ফট আওয়াজ তুলে নিজের ঘরের দিকে যাচ্ছে এখন মালিনী। পাশের বাড়িতে তার তিন বছরের ছেলে সারাদিন ধরে খেলা করে, ধূলো মেখে, ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে আছে বারান্দায়, হয়তো আদুল গায়ে।
মালিনী তাকে কোলে তুলে নিয়ে, ছেলের ধূলিমলিন মুখের সঙ্গে নিজের মুখ ছুঁইয়ে দিয়ে, ছেলেকে বুকের মধ্যে জড়িয়ে ধরলো। তারপর ভেজানো দরজা ঠেলে ঢুকলো নিজের ঘরে। ঘরে তার জ্বরগ্রস্থ স্বামী চৌকিতে শুয়ে পথ দেখছে, কখন সেই চেনা পায়ের শব্দ পাওয়া যায়। তারই প্রতীক্ষায় উৎকর্ণ হয়ে আছে সে সারাদিন।
ঘুমন্ত ছেলেকে তার বাবার পাশে শুইয়ে দিয়ে, মালিনী হয়তো লম্ফ জ্বালালো। হয়তো সেই লাল আলোতে সারা ঘরের জমাট অন্ধকার হঠাৎ ভেঙে চুরে ঘরের আনাচে কানাচে গুটিয়ে লুকিয়ে পড়লো। মালিনীর স্বামী চেয়ে আছে স্ত্রীর দিকে। মালিনী এসে বসলো অসুস্থ মানুষটির পাশে। মাথার চুলে হাত বুলিয়ে দিয়ে তাকে জিজ্ঞেস করলো,
- কেমন আছো?
হয়তো নিরালা সেই ঘরে মালিনীর কর্কশ স্বর বড়ো মধুর হয়ে বেজেছিলো। হয়তো অসুস্থ, একলা মানুষটা অকারণ অভিমানে বলেছিলো,
- ভালো নেই।
মালিনী সস্নেহে স্বামীর মাথায় হাত রেখে বসেছিলো তার দিকে তাকিয়ে। হয়তো দুজনেই হেসেও উঠেছিলো কোনো এক সময়।
তারপর তো ঘরকন্নার আসর। রান্না-খাওয়া আরও নানা রকম কাজের পালা। এবার আমি ওকে 'মালিনী' নামটা থেকে মুক্ত করে দেবো। এই ঘরে ওর পরিচয় হোক ও নিজেই। এখানে অন্য কোনো পরিচয়ের আর ওর প্রয়োজন নেই। এই ঘরে ও ওর ছোট্ট ছেলের মা, ওর রুগ্ন স্বামীর স্ত্রী। এই ঘরে ওই সর্বময়ী, সবার প্রাণকেন্দ্র, তা সে যে নামেই ওকে ডাকো না কেন। এই ঘরে ও সর্বসাধারণ, আবার এখানেই ও অনন্যা, মহিয়সী।
সু, তোমাদের কথা রাখতে গিয়ে সত্যিকারের গল্পের খোঁজে নেমে দেখলাম, গল্প শেষ করার আগেই সত্যিকারের দেখা ফুরিয়ে গেলো। কিন্তু গল্প শেষ না করলে তোমরা তো খুশী হবে না। তাই চোখ যে পথে চলতে পারলো না, মনকে সে পথে চালিত করে দিলাম আমার গল্পের নায়িকার পিছু পিছু। আমি চাই, তোমরাও নিশ্চয়ই চাইবে যে, ওর স্বামী ভালো হয়ে উঠবে একদিন। ওর ছেলে ঘুম ভেঙে উঠে খিলখিল করে হাসবে। ওদের জীবনের দুঃখের রাত কেটে গিয়ে এক আশার ভোর আসবে। সেই ভোরে ওরা দুজন খুশীর নেশায় মেতে, সবল দেহ আর সুস্থ মনে কাজ করতে বেরোবে। আর ছোট্ট ছেলেটি পড়তে যেতে পারবে তার বইখাতা নিয়ে।
আমি আশাবাদী, সু। আমি প্রচন্ড আশাবাদী। জানি, সফলতা সবসময় বাস্তবে আসে না। তবু, সফলতার স্বপ্ন দেখা তো অবাস্তব নয়। যদি আমার এই গল্পকে সত্যিকারের গল্প বলে স্বীকৃতি দিতে না চাও, তবে দিও না। তবু আমার গল্প আশাবাদের পথ ধরেই চলতে চাইবে। ওই মালিনীরাও সুখ চায়। চায় একটু ভালো থাকতে। আমার গল্পে ওদের না হয় সাধ মিটিয়ে সুখীই করলাম। আমি তো বিধাতা নই! তাই কঠিন হতে বাধ্যও নই কোথাও। যদি তোমাদের মনের মতো না হয়, তর্ক করে আমাকে আঘাত করো না। মেনে নিও, যদি পারো!
ইতি-
তোমাদের
মিথ্যেকারের গল্পকার।
---------------------------------------
Khub bhalo laglo... excellent writting
উত্তরমুছুন