পঁচানন্দ মাংস খায় না মাংস মাংস গন্ধ করে বলে, মাছ খায় না মাছ মাছ গন্ধ করে বলে, ডিম খায় না ডিম ডিম গন্ধ করে বলে। তা শুনে নেদা বললো, তাহলে তুই খাস কি?
পঁচানন্দ বললো, এর ক্ষেত থেকে ওর ক্ষেত থেকে বৌ আতাড়ি-পাতাড়ি শাক-সবজি কুড়িয়ে রান্না করে, তাই খাই। আর ভাত খাই।
নেদা ভ্রূ কুঁচকে বললো, শাক-সবজিতে শাক-সবজি শাক-সবজি গন্ধ করে না? ভাতে ভাত ভাত গন্ধ করে না?
পঁচানন্দ কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে বললো, এই দুই খেতে খেতে অভ্যাস হয়ে গেছে তো, সমস্যা হয় না। অভ্যাস খুব খারাপ।
তখন পঁচানন্দের বৌ আনন্দী বের হয়ে এলো আর বললো, এই নেন নেদা দা, এক গ্লাস জল খান, জল শরীরের জন্য মহাপোকারী। বিস্কুট দিতে পারলাম না, ছেহাঁদারামের সংসার জ্বালা
সৌমেন দেবনাথ
পঁচানন্দ মাংস খায় না মাংস মাংস গন্ধ করে বলে, মাছ খায় না মাছ মাছলেটা কান্না-কাটি করবে। ছোট্ট ছেলে তার বিস্কুট আপনাকে দিলে কেমন হয়! নেদা না-সূচক হাত ঝাঁকিয়ে বললো, না, না, আমি আপনার ছেলের খাদ্যে ভাগ বসাতে চাই না।
আনন্দী খুশি হয়ে বললো, বাহ্ বাহ্, কত বিবেকী আপনি। কারো বাসায় যেয়ে এই নাস্তা খাওয়ার লোভ করায় ঠিক না। এসব বাজে অভ্যাস।
আনন্দী ঘরে চলে গেলো। নেদা বললো, পঁচা, বৌদি দেখি ভারি হিসেবি!
পঁচানন্দ বললো, কিসের হিসেবি? কোনটা কত টাকার নোট জানলেই কি হিসেবি হওয়া যায়? একশোর পর তো আর গুণতেই পারে না। মূর্খ।
নেদা বললো, আচ্ছা, বৌদির হাতে কোনো অলংকার নেই কেন?
পঁচানন্দ বললো, আমার বৌ সুন্দরী তো, তাই অলংকার পরে না। যে সুন্দরী তার কি আর সৌন্দর্য বৃদ্ধি করার প্রয়োজন আছে? তাছাড়া অলংকার পরলে পরপুরুষের নজর পড়ে।
নেদা পঁচানন্দের পায়ের দিকে তাকিয়ে দেখে দুই রঙের দুইটি জুতো, বললো, তোর পায়ে জুতো দুটো দুই রকম যে?
পঁচানন্দ বললো, এক কোম্পানির চেয়ে দুই কোম্পানির জুতো এক সঙ্গে পায়ে দেয়া মানে সম্মান কি বাড়লো না? দুই কোম্পানির জুতো দুই পায়ে, আমি একজন বিশিষ্টজন।
নেদা আশ্চর্য হয়ে বললো, দুই কোম্পানির জুতো পায়ে দেয়া বিশিষ্টতা?
পঁচানন্দ বললো, একটি জুতো নষ্ট হলে বাকিটা নষ্ট না হলেও ফেলে দিতে হবে এটা কখনোই সঠিক সিদ্ধান্ত না। কোম্পানি একটি জুতো ভালো করে বানায়, বাকিটা বানায় খারাপ করে। একস্রোতে ভাসবি না, ভালো জুতো ফেলবি না, সবাই এক হলে কোম্পানির লাল বাতি জ্বলবে।
নেদা হেসে বললো, সত্যি বন্ধু তোর বাড়ি না আসলে আমার অনেক কিছু অজানা থাকতো। আচ্ছা, তোর ঘরে ঐ তিনটা কি? মনে হচ্ছে পঁচে গেছে!
পঁচানন্দ বললো, আর বলিস না বন্ধু, ছেলের জন্য এক হালি পাকা কলা কিনেছিলাম। একটা কলা ভেঙে ভেঙে তিনদিন তাকে দিছি। আজ বাক্স খুলে দেখি বাকি তিনটা কলা পঁচে গেছে। পঁচা কলাগুলো যে ফেলে দেবো, কষ্টে বুক ফেঁটে যাচ্ছে। যদি জানতাম পাকা কলা এক সপ্তাহ বাড়ি রেখে খাওয়া যাবে না তবে কি আমি কলা কেনার লোক? আর সেই কলা কিনে আমি বাক্সে রাখি?
নেদা আফসোস করে বললো, পাকা কলা কিনে কাঁচা টাকা নষ্ট করলি!
ঘর থেকে আনন্দী এসে বললো, আপনার বন্ধুর আক্কেল হবে না। একটা হাঁদারাম। বলেছি আধা কাঁচা, আধা পাকা কলা কিনতে। তা না পাকা কলা কিনে এনেছে। ঘরের টাকা কিভাবে যে নষ্ট করে আপনার বন্ধু, বলে বোঝাতে পারবো না।
নেদা বললো, আসলেই আমার বন্ধুটা হাঁদারাম। কাঁচা কলা কিনলে বাড়িতে কলা অনেক দিন টিকতো বৈকি!
বন্ধুকে পৌঁছে দেয়ার জন্য নেদার সাথে কিছুটা পথ গেলো পঁচানন্দ। ফেরার পথে বৌর জন্য গহনা কিনতে দোকানে গেলো। দোকানদারকে বললো, একটা কানের দুল দেন।
দোকানদার আশ্চর্য হয়ে বললো, একটা কানের দুল বিক্রি হয় না। কানের দুল একজোড়া কিনতে হয়।
পঁচানন্দ বললো, আমার লাগবে একটা।
দোকানদার বললো, একজোড়া কিনে বাকিটা ফেলে দেন।
পঁচানন্দ বললো, ও আমাকে নষ্ট করা শেখাচ্ছেন?
দোকানদার বললো, একটা বিক্রি হবে না। রাস্তা দেখেন।
পঁচানন্দ বললো, ব্যবসায়ের পলিসি ভালোই শিখেছেন। মানুষকে এভাবে জিম্মি করে কানের দুল জোড়ায় জোড়ায় বিক্রি করা ঠিক না। অনেকের তো একজোড়া কানের দুল কেনার সামর্থ্য নাও থাকতে পারে। আচ্ছা, নাকের পাতাও তো দুটো, দুটো নাকফুল তো কিনতে হয় না। হাতও দুটো, দুটো ঘড়ি তো কিনতে হয় না। তবে দুটো কানের পাতার জন্য দুটো কানের দুল লাগবে কেনো?
দোকানদার এমন কাস্টমার পেয়ে অত্যাশ্চর্য হলো। বললো, আপনার কাছে একটা বিক্রি করলে বাকিটা আর বিক্রি হবে না। আপনার মত আর একটা কাস্টমার যদি দেশে থাকতো তবে একটা দুল বিক্রি করে দিতাম।
আশপাশে বেশ কজন মানুষ জমে গেছে পঁচানন্দের কাণ্ড দেখতে। একজন মজার ছলে তাকে সমর্থন করে বললো, কানের দুল কিন্তু একটা বিক্রি হয়, আপনাকে সহজ সরল পেয়ে আপনার কাছে দুটোই বিক্রি করার পায়তারা করছে দোকানদার।
পঁচানন্দ চোখ গোল্লা গোল্লা করে বললো, তাই? আপনাকে অনেক ধন্যবাদ। আপনি না এলে আজ বেশ ঠকা ঠকতাম।
বলে সে অন্য দোকানে চলে গেলো। অন্য দোকানে যেয়েও একই কাণ্ড। পঁচানন্দ একটু লজ্জা পেলো আর বললো, আচ্ছা, ঠিক আছে, একজোড়া কানের দুলের দাম কত?
দোকানদার বললো, মাত্র পঞ্চাশ টাকা।
পঁচানন্দ চোখ মোটামোটা করে বললো, আপনি কি কসাই? দাম চাওয়ার ক্ষেত্রে কোনো ইনসাফ নেই। এত জুলুম ঠিক না। দশ টাকা দেবো।
দোকানদার দশ টাকাতেই কানের দুল দিয়ে দিলো। মনে মনে পঁচানন্দ শুধুই বলতে লাগলো, কি ক্ষতিটায় না করলাম। যদি পাঁচ টাকা বলতাম! ছি! ছি!
পঁচানন্দ বাড়ি এসে একটা কানের দুল দিলো। দেখে তার বৌ আনন্দী বললো, একটা কানের দুল এনেছো? হাঁদারাম স্বামী!
পঁচানন্দ কটাক্ষ ভক্ষণ করে বললো, খুব কষ্ট করে কিনেছি। দোকানদার একটা কানের দুল বিক্রি করবেনই না। জোর করে কিনে এনেছি৷ আজ বাম কানে পরবে তো কাল ডান কানে পরবে। দুটো কানই যেন গহনার স্বাদ পায়!
আনন্দী বললো, লোকে মন্দ বলবে যে!
পঁচানন্দ বললো, লোকে কি বলবে না বলবে তা ভাবলে কি হবে? বলবে, আগে তো অলংকার পরতামই না। এখন তো একটা হলেও পরছি। অবস্থার উন্নতি হচ্ছে তো!
এমন সময় স্কুল থেকে ভজানন্দ বাড়ি এলো। পঁচানন্দ বললো, বাবা, পরীক্ষায় কি ফলাফল করেছিস?
ভজানন্দ নির্বিকার চিত্তে বললো, বাবা, দুই বিষয়ে ফেল করেছি।
পঁচানন্দ বললো, মন খারাপ করিস না। তুই তো দুই বিষয়ে ফেল করেছিস। আমি তো পাঁচ বিষয়ে ফেল করতাম। কোনো কোনো বার সব বিষয়েও ফেল করেছিলাম।
ভজানন্দ বললো, পটল কাকা বলেছেন, আমি নাকি ডিগবাজি খেয়েছি! ফেল না হয় করেছি, ডিগবাজি খাবো কেনো?
আনন্দী রেগে বললো, হাঁদারামের ছেলে হাঁদারামই হয়েছে।
এই কথা বলে আনন্দী ঘরে চলে গেলো। পঁচানন্দ ছেলেকে বললো, তোর মা আদর করে মাঝে মাঝে আমাকে হাঁদারাম বলে। তোকেও আদর করে হাঁদারামের ছেলে বলেছে। মন খারাপ করবি না। তোকে স্কুলে যেতেই হবে। কোনটা বই, কোনটা খাতা আর কোনটা কলম মনে রাখার জন্য হলেও তোকে স্কুলে যেতে হবে।
ভজানন্দ বললো, বাবা, পড়াশোনা করলে টাকা খরচ হয়, সময় নষ্ট হয়, পড়াশোনা করে করে টাকা উপার্জনের সময় নষ্ট করা বুদ্ধিমানের কাজ না কিন্তু।
পঁচানন্দ খুশি হয়ে বললো, তোর তো দেখছি আমার মত বুদ্ধি। আমগাছে কলা হয় না। কলাগাছে কলায় হয়।
ভজানন্দ বিরক্ত প্রকাশ করে বললো, বাবা, আমি আর পড়ালেখা করবোই না। লোকে যদি ফেল্টুবাজ বলে ক্ষেপায়?
পঁচানন্দ ছেলেকে আশ্বস্ত করে বললো, প্রয়োজনে তুই স্কুলে যাবি না, তবুও বই নিয়ে এদিক সেদিক রাস্তা, বাজার ঘুরবি৷ মানুষ জানুক তুই ছাত্র।
ভজানন্দ খুশি হয়ে বললো, আচ্ছা বাবা, বই নিয়ে এদিক সেদিক ঘুরবো, তবুও স্কুলে যাবো না৷ স্কুলে গিয়ে বসে থেকে থেকে জীবনের মূল্যবান সময় নষ্ট করা ঠিকই হবে না।
পঁচানন্দ বললো, বর্তমানে যারাই সম্পদশালী তারা কেউ ঠিকঠাক লেখাপড়া করেনি। আর তাই লেখাপড়া করে সম্পদশালী হওয়া থেকে বঞ্চিত হওয়ার কোনো মানে হয় না।
এমন সময় আনন্দী ঘর থেকে বের হয়ে এসে বললো, ছেলেকে এসব কি শিখাচ্ছো? পরীক্ষার ফিস দাওনি বলে আমার ছেলে দুই বছর এক ক্লাসে। এবার পরীক্ষা দিয়ে করলো ফেল। এক ক্লাস করে পাশ দেবে আর আমার ছেলে জ্ঞানী হবে। জ্ঞানের সাগর হবে আমার ছেলেটা। হাঁদারামী বুদ্ধি দিও না।
ভজানন্দ বললো, মা, আমি তো মাত্র দুই বিষয়ে ফেল করেছি।
আনন্দী ছেলেকে সান্ত্বনা দিয়ে বললো, খুব ভালো করেছিস, বাবা। কত ছোট তুই, বড় ক্লাসে উঠলে পড়ার চাপ বাড়তো। পড়া বই-ই পড়, মাথায় চাপ কম পড়বে।
পঁচানন্দ হেসে বললো, লক্ষ্মী বৌ আমার, ছেলেটাও হয়েছে লক্ষ্মী। বাবা, প্রাইমারি স্কুল থেকে তুই ম্যাট্রিক পাশ করে কমার্স নিয়ে ডাক্তার হ।
ভজানন্দ খুশি মনে বললো, বাবা, একটা টাকা দাও, মিষ্টি খাবো।
পঁচানন্দ বললো, মিষ্টি খেতে নেই, মিষ্টি মিষ্টি গন্ধ করবে। তাছাড়া মিষ্টি খেলে দাঁতে পোকা লাগে। দাঁতে যদি পোকা ধরে তো জীবন শেষ। কিছু তো চিবিয়ে খেতে পারবি না। কাউকে দাঁত খেজিও দিতে পারবি না। বৌ, যাও ছেলেকে খেতে দাও। যে শাক রেধেছো দুই বেলা করবে। রাতে রান্না করতে তোমার আবার কষ্ট হবে।
ছেলেকে খেতে দিয়ে আনন্দী বললো, কি মিষ্টি খাবি, বাবা?
ভজানন্দ বললো, ভূতের ডিম খাবো।
আনন্দী বললো, ঘোড়ার ডিমের নাম শুনেছি। ভূতের ডিম আছে?
ভজানন্দ বললো, আছে মা। এক টাকায় অনেকগুলো দেয়। মার্বেলের মত। খুব মিষ্টি।
আনন্দী বললো, আচ্ছা এই নে এক টাকা। ভূতের ডিম কিনে এনে আমার কাছে দিবি। প্রতিদিন আমি একটি দুইটি করে তোকে দেবো।
ভজানন্দ বললো, মা, প্রত্যেকদিন শাক খেতে ভালো লাগে না।
আনন্দী বললো, বাবা, তরি-তরকারির অনেক দাম।
ভজানন্দ বললো, ও তাই! তবে শাকই ভালো।
আবার দুই মুঠো খাবার পর ভজানন্দ বললো, মা, শাক খেতে আর ভালো লাগছে না। খুব খারাপ লাগছে।
আনন্দী বললো, খারাপ লাগতে লাগতে ভালো লেগে যাবে। সব অভ্যাস, বাবা।
ভজানন্দ আবার খেতে লাগলো আর বললো, অন্যান্য তরকারির অনেক দাম, মা?
আনন্দী বললো, হ্যাঁ।
ভজানন্দ বললো, তবে আমাকে পড়তে বলো কেনো? তরকারি চাষ করতে তো বলতে পারো।
আনন্দী বললো, তুই অনেক ছোট বাবা, এখন পড়তে হবে।
ভজানন্দ বললো, বড় হলে আমাকে পড়তে বলবে না তো?
আনন্দী বললো, বড় হলে করবি কি,?
ভজানন্দ বললো, তরকারি চাষ করবো।
আনন্দী বললো, বাবা, তরকারি চাষ করা কঠিন, পড়াশোনা করার চেয়েও কঠিন।
ভজানন্দ বললো, তরকারি চাষ করাও কঠিন, পড়াশোনা করাও কঠিন। তবে এই শাক রান্নায় ভালো, প্লেট ধুয়ে খেতে বসবো। প্লেট ধুতে কষ্ট হলে লুঙ্গি দিয়ে মুছে খেতে বসে যাবো।
'কড়া রোদে জ্যোৎস্না' নামের সিনেমা চলছে। ভীড়ের মধ্যে গিয়ে পঁচানন্দ একজনকে বললো, এখানে এত মানুষের ভীড় কেনো?
সেজন বললো, এটা সিনেমা হল। সবাই টিকেট কিনছে।
উৎসুকের সাথে পঁচানন্দ বললো, টিকিটের দাম কত?
লোকটি বললো, সামনে বসলে পনের টাকা, আর পিছনে বসলে পঁচিশ টাকা।
পঁচানন্দ ঢোক গিলে বললো, ও আচ্ছা। আমি যদি ভেতরে না ঢুকে বাইরে থেকে কেবল সিনেমার শব্দ শুনি তবে টিকিটের দাম কত হবে?
লোকটি ভ্রূ কুঁচকে ভাবলো, এই যুগেও এমন হাঁদারাম আছে?
লোকটি মুখে উচ্চারণ করে বললো, বাইরে থেকে শব্দ শুনলে টিকিটের দাম দশ টাকা।
পঁচানন্দ আবার বললো, যদি হলের কাছে না দাঁড়িয়ে অনেক দূরে দাঁড়িয়ে শব্দ শুনি, তবে?
লোকটি বললো, তবে পাঁচ টাকা।
টিকিট কেনার জন্য পঁচানন্দ পাঁচ টাকার একটি কয়েন দিলো। কিন্তু লোকটি নিয়ে আসার নাম করে ভেতরে যেয়ে আর ফিরে আসলো না। বাড়ি এসে একথা সে সব বৌকে বলে দিলো, সর্বনাশ হয়ে গেছে। একমাস আগে তুমি যে পাঁচ টাকার কয়েনটা দিয়েছিলে তা আজ খোয়া গেছে।
আনন্দী বললো, হায়, হায়! কোথায় বসেছিলে? পাশে কে কে ছিলো? চলো যাই। পাঁ-আঁ-চ টাকার কয়েন!
পঁচানন্দ বললো, একটা লোককে দিয়েছিলাম, সে লোককে আমি চিনি না, পালিয়েছে।
আনন্দী বললো, তুমি অচেনা, অজানা মানুষের হাতে সবচেয়ে বড় টাকার কয়েনটাই দিয়েছো? তোমার কি আক্কেল দাঁত উঠবে না? হাঁদারাম! এভাবে যদি টাকা-পয়সা নষ্ট করো তবে সংসারের উন্নতি হবে কি করে? হায়রে কপাল আমার, এমন নির্বোধ স্বামীর ঘর করি আমি! তুমি কি বুঝতে পারছো, তোমার হাতে কেনো আমি টাকা-পয়সা দিই না?
পঁচানন্দ বললো, আমি আর কখনো আমার কাছে টাকা-পয়সা রাখবো না৷ আমার কাছে টাকা-পয়সা থাকতে চায় না। আমি বুঝতে পারছি, এভাবে টাকা-পয়সা হারাতে থাকলে দিনে দিনে আমরা গরীব হয়ে যাবো।
আনন্দী বললো, আজ রাতে ভাত খাবে না। পাঁচ টাকা উসুল হয়ে যাবে।
পঁচানন্দ বললো, শুধু আজ রাতে? আগামী কাল রাতেও খাবো না। আরো পাঁচ টাকা বাঁচবে।
কুঁড়েঘর থেকে বাবা গজানন্দ বের হয়ে এসে বললেন, বৌমা, মুখ গোমড়া করে বসে আছো কেনো?
আনন্দী কান্নার সুরে বললো, আজ আপনার ছেলে পাঁচ টাকার একটা কয়েন কাকে না কাকে দিয়ে এসেছে। কি ছেলে বড় করেছেন টাকা-পয়সার মর্ম বোঝে না!
গজানন্দ বললেন, বৌমা, পাঁচ টাকা তো? বর্তমান যুগে পাঁচ টাকার কি কোনো মূল্য আছে? মন খারাপ করো না। স্বামীকে বকো না।
আনন্দী কান্নার শব্দ বাড়িয়ে বললো, এমন মিনশের সাথে সংসার করে কি টাকা-পয়সার মুখ দেখা সম্ভব?
গজানন্দ বললেন, বৌমা, যেভাবে বিলাপ করছো মনে হচ্ছে পাঁচ টাকা না, পাঁচ লক্ষ টাকা খোয়া গেছে।
আনন্দী বললো, পাঁচ টাকা আমার কাছে পাঁচ লক্ষ টাকায়। জীবনে টাকা-পয়সা বেহিসেবি হিসেবে ব্যবহার করেছেন বলেই আজও কুঁড়েঘরে থাকেন। টাকা হলো রত্ন, যত্ন করা শিখতে হয়।
পঁচানন্দ বললো, বৌ, কান্না করিস না, আমি সিনেমা হলের সামনে প্রয়োজনে পাঁচ দিন বসে থাকবো ঐ বদমাস, লুটে লোকটাকে ধরার জন্য। আমার পাঁচ টাকা সে হজম করতে পারবে না।
আনন্দী বললো, পাঁচ দিন কাজ বন্ধ করে সিনেমা হলের সামনে বসে জোচ্চর ধরতে গেলে কত টাকা ক্ষতি হবে সে হিসেব করেছো? তোমার কাজ ফাঁকি দেয়ার যত বুদ্ধি! তোমার সাথে সংসার করলে আমি পথে বসবো।
পঁচানন্দ দোটানায় পড়ে বললো, তবে কাজ শেষ করে বিকালে বিকালে বদমাস পয়সা চোরকে ধরতে যাবো।
আনন্দী বললো, হা? বিকালে ঘুরে বেড়ানোর ফন্দি করছো, না? এভাবে ঘুরে ঘুরে বেড়িয়ে শরীরে বাতাস লাগিয়ে আমার সংসারটাকে ধ্বংস করবে তুমি?
পঁচানন্দ কি বলবে না বলবে বুঝতে না পেরে বললো, তবে থাক পাঁচ টাকার কয়েন চোরের পিছনে ঘুরে মূল্যবান সময় নষ্ট করার দরকার নেই। চোরকে অভিশাপ দিয়ে মাফ করে দিলাম।
আনন্দী বললো, ক্ষমার সাগর! খেতে পাও না, ক্ষমা করে বেড়াচ্ছো।
পরের দিন আনন্দী কাঁথা সেলাই করছে আর পঁচানন্দ রান্না করছে। তখন এক ভিখারিনী এলো। ভিখারিনী ভিক্ষা চাওয়ার আগেই বললো, আপনার স্বামীকে দিয়ে রান্না করাচ্ছেন?
আনন্দী বললো, আমার চেয়ে উনি জ্বালানি কম খরচ করে রান্না করতে পারেন। তাই উনাকে দিয়ে রান্না করাই। তাছাড়া উনি বহুমূখী প্রতিভার অধিকারী। ঘর ঝাড়ু দিতে জানেন, ঘর লেপনেও দক্ষ। কাপড় কাঁচতে পারেন। সাবান বাদেই উনি কাপড় কাঁচতে পারেন। তাছাড়া উনি আমাকে বড্ড ভালোবাসেন, কোনো কাজে হাত দিতে দেন না। সব কাজ একাই করেন। ভিখারিনী বললো, ও। তা কাঁথা সেলাই এত ফাঁকা ফাঁকা করে দিচ্ছেন কেনো?
আনন্দী বললো, সুতা কম খরচ করবো বলে ফাঁকা ফাঁকা করে সেলাই দিচ্ছি। সব কিছু হিসাব করে করতে হয়। বেহিসেবিরা শেষ বয়সে না খেয়ে মরে।
ভিখারিনী বললো, এবার আমাকে ভিক্ষা দিয়ে বিদায় করেন।
আনন্দী বললো, আপনাকে ভিক্ষা দিলে আমার স্বামী আমাকে ছেড়ে দেবেন? সংসার ছাড়া নারী বাঁচে না। আপনাকে ভিক্ষা দিয়ে আমি আমার সংসার হারাতে পারবো না।
তখন পঁচানন্দ রান্না ঘর থেকে বললো, বৌ, শাক-সবজিগুলো আলাদা করে না রান্না করে ভাতের মধ্যে দিয়ে দেবো? ভাতের সাথেই তো সবজি খাবো। আলাদা রান্না করে লাভ কি?
আনন্দী বললো, কি? তুমি এখনো ভাতই রান্না করছো? জ্বালানি সব শেষ করে ফেলছো?
পঁচানন্দ বললো, এতগুলো জ্বালানি পুঁড়িয়ে ভাত রান্না করবো? তাই ভাবতে ভাবতে অনেক পরেই রান্না শুরু করেছি।
আনন্দী বললো, দ্রুত রান্না শেষ করে ঘর ঝাড়ু দেবে।
ভিখারিনী বললো, আমি খুব বুঝেছি আপনার স্বামী আপনাকে, নাকি আপনি আপনার স্বামীকে নিয়ন্ত্রণ করেন। আমি তবে যাই।
আনন্দী বললো, যান। আপনি হাটতে থাকলেই চাউল বাড়বে। আমাদের উনাকে যেতে বলি, উনি বলেন, সম্মানে বাঁধে৷ লজ্জা করলে কি আর টাকা পয়সার মুখ দেখা যায়?
ভিখারিনী বললো, আপনি আপনার স্বামীকে ভিক্ষা করতে পাঠাতে চান?
আনন্দী বললো, ভিক্ষা করা কি খারাপ? আপনার পেশাতে নতুন কেউ আসুক চান না, না? একচেটিয়া ভিক্ষা করতে চান?
ভিখারিনী আর কথা না বাড়িয়ে চলে গেলো। আনন্দী কাঁথা সেলাই রেখে স্বামীর কাছে গেলো। পঁচানন্দ চুলাতে কাঠ দিতে লাগলো আর বললো, বৌ, আমাদের এই বাজারে আগে সপ্তাহে দুই দিন হাট বসতো। পরদিন ভোরে বাজারে গেলে অনেক কয়েন পাওয়া যেত।
আনন্দী বললো, এখন কি আর পাওয়া যাবে? মানুষ সব সচেতন হয়ে গেছে।
পঁচানন্দ বললো, জানো বৌ, দিনের বেলা তো সব পরিষ্কার, রাস্তা-ঘাটে টাকা পড়ে থাকে না। তাই রাতে পথ চলার সময় পথ আমি খুব দেখে দেখে চলি যদি দুই এক টাকার পয়সা পড়ে পাই, কিন্তু পাই না।
আনন্দী বললো, তবুও পথ-ঘাট দেখে চলবে। এখন এক দুই টাকার কয়েন পাওয়া না গেলেও অনেক টাকার বান্ডেল পাওয়াও যেতে পারে। কখন কার পকেট থেকে পড়ে যায় বলা তো যায় না। আর টাকা পয়সা পেলে এনে আমাকে দেবে, তোমার কাছে থাকলে হারিয়ে যাবে।
পঁচানন্দ বললো, ঠিক আছে। আহা, আগে মাটির নিচে গুপ্তধন পাওয়া যেত। সোনার মোহর পাওয়া যেত। আর এখন কিছু পাওয়া যায় না। ভুল সময়ে জন্মেছি।
পরদিন পঁচানন্দ সত্যি সত্যি পাঁচশত টাকার একটা নোট রাস্তায় পড়ে থাকতে দেখলো। চারপাশে চেয়ে দেখলো কেউ নেই। টুপ করে টাকাটা পকেটে নিয়ে নিলো। বাড়ি গিয়ে বৌকে টাকাটা দিয়ে সে তাক লাগিয়ে দেবে। বাড়ির পথে রওনা দিলো। পথে এক বন্ধু অনুকূলের সাথে দেখা। খুশিতে পঁচানন্দ বলেই ফেললো, বন্ধু, পাঁশশো টাকা পেয়েছি।
অনুকূল খুশি হয়ে বললো, তাই? মিষ্টি খাওয়া।
অনিচ্ছা সত্ত্বেও অনুকূলকে মিষ্টি খাওয়ালো পঁচানন্দ। তারপর আরো এক বন্ধু সুবলের সাথে। সোল্লাসে তাকেও বলে ফেললো, বন্ধু, পাঁচশো টাকা পেয়েছি।
সুবলও মিষ্টি খেতে চাইলে বাধ্য হয়ে তাকেও মিষ্টি খাওয়ালো। অনুকূল আর সুবল মিলে আরো তিন চারকে বিষয়টা জানালো। তারাও এসে মিষ্টি খেয়ে পাঁচশত টাকার পুরোটা শেষ করে ফেললো। একথা বাড়ি এসে বৌকে বললে বৌ যাচ্ছেতাই করবে তাই মাকে বললো, মা, পাঁচশো টাকা পেয়েছি।
মা মন্দ্রা বললেন, পাওয়া টাকা নিতে নেই। মন্দিরে দিয়ে আস।
মা এ বলে ঘরে চলে গেলেন। কিছুক্ষণ পর এক বৃদ্ধ লোক এসে বললেন, পঁচা, পাঁশশো টাকা পেয়েছিস নাকি, ও টাকাটা আমার। দিয়ে দে।
তা দেখে মন্দ্র বললেন, ছেলে তো টাকাটা মন্দিরে দিয়ে এসেছে। মন্দিরে দেয়া টাকা তো ফেরত নেয়া ঠিক হবে না। দাঁড়াও, আমি ঘর থেকে এনে দিচ্ছি।
মন্দ্রা ঘর থেকে পাঁচশত টাকা এনে বৃদ্ধ লোকটিকে দিয়ে দিলেন। এ ঘটনা আনন্দী টের পেয়ে পঁচানন্দকে ঘরে ডেকে নিয়ে বললো, টাকা পেয়েছো, ভালো কথা। মায়ের কথা শুনে মন্দিরে দিয়েছো কেনো? আমার কাছে দিতে পারোনি? হাঁদারাম মিনশে।
পঁচানন্দ বিস্তারিত জানালো না। জানালে বৌ তাকে শেষ করে দেবে। শুধু আফসোস করে ভাবতে থাকলো, টাকা পেয়ে হায় হায় কত টাকা ক্ষতি হলো?
আনন্দী বললো, টাকা পাওয়ার ভাগ্য সবার নেই। সেই ভাগ্য তোমার হয়েছিলো। তুমি গোপন রাখতে পারোনি। গোপনীয়তা না রাখতে পারার কারণে ধনদেব কুবের তোমার ভাগ্যে আর কোনো টাকা পাওয়ার সুযোগ রাখলো না। হাঁদারাম।
পঁচানন্দ বললো, সত্যিই বৌ, আমার অনেক ভুল হয়েছে৷ টাকা পাওয়া মাত্র শুরু হয়েছিলো, এভাবে পথে পথে হেটে হেটে যদি টাকা পেতেই থাকতাম তবে রাতারাতি সম্পদশালী হয়ে যেতাম।
আনন্দী বললো, চোখের সামনে থেকে যাও, তোমাকে দেখলেই রাগ হচ্ছে, হাঁদারাম।
পঁচানন্দ চলে গেলে আনন্দী বিলাপ করতে থাকলো, পাঁচশো টাকা, এত বড় একটা টাকার নোট, হাঁদারাম মিনশে পেয়েও হারালো। টাকাটা আমাকে দিলে কত যত্ন করে শাড়ির ভাজে রেখে বাক্সে রেখে দিতাম। টাকার প্রতি কোনো মায়া নেই। এভাবে কজন পায় টাকা? ও কি বোঝে না? টাকা এত মূল্যবান আর সেই টাকা পেয়েও যদি মূল্য না বোঝে তবে গাছের তলে ফল-মূল পড়ে পেলে ও তো হাতেও তুলবে না। কি হাঁদারাম স্বামী পেলাম আমি, হে ঈশ্বর!
স্কুল থেকে ভজানন্দ বাড়ি এসেছে। দাদু গজানন্দের পাশে বসে বললো, দাদু, স্যার আজ আমাদের সৌজন্যতা কি শিখিয়েছেন।
গজানন্দ আশ্চর্য হয়ে বললরন, বল্ তো, সৌজন্যতা কি?
ভজানন্দ বললো, ধরো, রিক্সায় চড়ে কোথাও দুইজন যাচ্ছি যিনি জ্যেষ্ঠ তিনি ভাড়া দেবেন। হোটেল বা রেস্তোরাঁয় যদি খেতে যাওয়া হয় যিনি জ্যেষ্ঠ তিনি বিলটা দেবেন, এ হলো সৌজন্যতা।
গজানন্দ বললেন, স্যার তো ঠিকই পড়িয়েছেন।
ভজানন্দ বললো, এজন্যই তো আমি বড়দের সাথে মিশি। বন্ধুরা বলে বড়দের সাথে মিশি, আমি নাকি পেকে গেছি।
গজানন্দ বললেন, বড়দের সাথে মেশা খারাপ না, শেখার আগেও অনেক শেখা যায়। তবে প্রত্যেকদিন বড়রা যদি বিল দিয়ে দেয় আর ছোটরা যদি শুধু খায়-ই তাও কিন্তু সৌজন্যতা নয়।
ভজানন্দ তৎক্ষণাৎ উত্তরে বললো, তবে যা শিখেছি আর না। বড়দের সাথে আর ঘুরবো না। পকেটের টাকা খরচ করে সৌজন্যতা রক্ষা করার দরকার নেই। বাবা বলেছে, টাকা গাছের পাতা নয়, যে ছিঁড়বে আর খরচ করবে। মা বলেছে, টাকা কুঁড়িয়ে পাওয়া যায় না যে, কুঁড়িয়ে নেবো আর পকেটে ভরবো। টাকা সব সময় ছুটে চলে যেতে চায়, টাকা আটকে রাখতে হয়।
গজানন্দ আশ্চর্য হয়ে বললেন, এই বয়সে কত কিছু জেনেছিস, তবে পরীক্ষায় ফেল করিস কেন্?
ভজানন্দ বললো, আমার হাতের লেখা একটু অপরিষ্কার, মনে হয়- না পড়েই স্যার কেটে দেন। বাড়ি নিজের খাতায় কম লিখলেও পরীক্ষার খাতায় অনেক লিখি। বাবা বলেছে, বেশি বেশি লিখে পরীক্ষার ফিসের টাকা উঠিয়ে ছাড়বি। বানিয়ে লেখা একটা গুণ স্যারেরা তা তো বোঝেন না। যত্তসব!
গজানন্দ বললেন, বাড়ি বই পড়িস না কেরোসিন পুড়বে বলে, লিখিস না খাতা ফুরাবে বলে, কলম ফুরাবে বলে। ঠিকমত স্কুলে যাস না জুতা ছিঁড়বে বলে। বাবা মায়ের চেয়ে তো কম কৃপণ না তুই! মনে রাখবি কৃপণের ধন পরমানুষে খায়।
আনন্দী একথা শুনতে পেয়ে বললো, ছেলেটাকে কি শিখাচ্ছেন? টাকা-পয়সা হিসাব করে খরচ করলে কি মানুষ কৃপণ হয়? আপনি যা তাকে শেখাচ্ছেন তা হলো অপচয়। অপচয়কারী কোনোকালেই উন্নতি করতে পারে না। আমার ছেলেকে অপচয় করতে শেখাবেন না। নিজের ছেলেকে তো অপচয় করার লাইসেন্স দিয়ে মানুষ করেছেন।
গজানন্দ বললেন, যতটুকু খরচ করা উচিত ততটুকু খরচ করলে মানুষ ঠকে না, বৌমা। তোমরা যা করছো তাতে মানুষ হাসাহাসি শুরু করেছে। মানুষ ঠাট্টা-তামাশা করছে।
আনন্দী বললো, কারো মুখ আটকে রাখার দায়িত্ব বা ক্ষমতা আমার নেই। মানুষ যদি রঙ্গ-তামাশা করে মজা পায়, করুক। তাই বলে মানুষের মন রক্ষা করতে গিয়ে কি আমি বেহিসেবি হবো?
এমন সময় পটল হাতে পঁচানন্দ বাড়ি ফিরলো, দেখে আনন্দী বললো, পটল কিনেছো? ঠিকমত কিনতে পেরেছো তো? মাপে কম দেইনি তো, হাঁদারাম!
পঁচানন্দ বললো, একপোয়া পটল কিনেছি। দোকানদার বলছিলো আড়াইশগ্রাম দশ টাকা, আমি বলেছি একপোয়া বিশ টাকা হলে দেন। দিয়ে দিলো।
একথা শুনে আনন্দী কান্না জুড়ে দিলো, এই হাঁদারাম স্বামী নিয়ে আমি বাঁচবো কি করে? ওরে হাঁদারাম, একপোয়া আর আড়াইশগ্রাম এক কথা। কি গর্দভ ছেলে পেলেছেন, শ্বশুর বাবা! দেখুন দেখুন।
পঁচানন্দ সেই পটল নিয়ে ঐ দোকানে যাচ্ছে ফেরত দেবে। মনে মনে ভাবতে ভাবতে যাচ্ছে, আমাকে ঠিকিয়েছিস বদমাস দোকানদার? স্ত্রী-সন্তানের সামনে ছোট করেছিস, হারামি? তোকে আজ শায়েস্তা করবো।
দোকানে যেতেই দোকানদার ঠোঁটে হেসে কোনো বাড়তি কথা না বলে দশ টাকা ফেরত দিয়ে দিলো। পঁচানন্দ দোকান থেকে সরলো না, মনে মনে বললো, আড়াইশ কি মাপ, আজ শিখেছি। দোকানদার, তোকে আজ উচিত শিক্ষা দেবো।
মনে মনে একথা বলা শেষে মুখে উচ্চারণ করে বললো, আড়াইশ পিঁয়াজ কত?
দোকানদার বললো, দশ টাকা।
দোকানদারের কাছ থেকে একটা পলি ব্যাগ নিলো। নিয়ে ভালো ভালো পেয়াজ বাছতে লাগলো। পঁচানন্দের পেয়াজ বাছা দেখে দোকানদার বললো, আড়াইশ পিঁয়াজ নেবেন না?
পঁচানন্দ হ্যাঁ-সূচক মাথা ঝাঁকালো, তারপর আবার বাছতে লাগলো। বাছাই শেষ ব্যাগ নিয়ে সে চলে যেতে লাগলে দোকানদার থামালো, আর বললো, না মেপেই পিঁয়াজ নিয়ে চলে যাচ্ছেন কেনো?
পঁচানন্দ বললো, আড়াইশ পিঁয়াজই তো নিয়েছি। গুণে গুণে ঠিকঠাক আড়াইশ পিঁয়াজই নিয়েছি।
দোকানদার দৌঁড়ে পঁচানন্দের কাছ থেকে পিঁয়াজের প্যাকেট কেড়ে নিলো ধস্তাধস্তি করে। বাজারের দুই চার জন এ কাণ্ড দেখলো, জানার পরে হাসলো সবাই। দোকানদার বললো, কোথাকার হাঁদারাম এ লোক! বাজারে ছাড়লো কে তাকে?
পরের দিনের ঘটনা। পঁচানন্দ একটা পেন্সিল আর একটা কলম কিনে বাড়ি এলো। তা দেখে ভজানন্দ বকা শুরু করলো, বাবা, পেন্সিল কিনেছো, আবার কলমও কিনেছো। দুটোর তো একই কাজ। এত টাকা নষ্ট করো কেনো?
আনন্দী দেখে কান্না জুড়ে দিলো, ঘরের টাকা সব পরের দিলো আমার এই হাঁদারাম স্বামী।
পঁচানন্দ বললো, আহ্ বৌ কান্না করিস না। আমি তো বুদ্ধি করে পেন্সিল আর কলম কিনেছি। প্রথমে ভজা পেন্সিল দিয়ে লিখবে তারপর তার উপর দিয়ে কলম দিয়ে লিখবে। খাতা কম খরচ হবে।
বুদ্ধিটা শুনে আনন্দী কান্না থামালো। ভজানন্দ বললো, বাবা, তোমার দেখি অনেক বুদ্ধি। বাবা, তুমি পেন্সিলটা অর্ধেক কেটে রেখে দাও, বাকি অর্ধেকেই আমার এ বছর চলে যাবে।
পঁচানন্দ বললো, বাহ্ বাহ্, খুব ভালো কথা। বাবা, এখন কি অংক করবি?
ভজানন্দ বললো, হ্যাঁ, স্যার দশটি অংক করতে দিয়েছেন। স্যার এত অংক যে করতে কেনো দেন? সব খাতা, কলম শেষ হয়ে গেলো।
পঁচানন্দ বললো, দশটি অংক তিন পৃষ্ঠায় করে শেষ করবি।
আনন্দী বললো, তিন পৃষ্ঠা না, দশটি অংক দুই পৃষ্ঠাতেই করে শেষ করবি।
ভজানন্দ বললো, মা, চিন্তা করো না, দশটি অংক আমি এক পৃষ্ঠাতেই করে শেষ করবো।
রাতে স্বামী-স্ত্রী দুই জন আলাপ করছে। আনন্দী বললো, আমাদের একটাই সন্তান। ওর একটা সুন্দর দেখে জামা গড়ে দিতে হবে।
স্ত্রী কথায় পঁচানন্দের রাজি না হওয়ার কারণ নেই। পরদিন ছেলেকে নিয়ে পঁচানন্দ বাজারে গেলো। দর্জিওয়ালাকে বললো, আগেকার সেই কাপড় আর নেই। আমার এই জামাটা ষোল বছর আগে বানানো। শুধু কলার আর বগল ছিঁড়ে গেছে। বৌ সেলাই করে দেয়। আর এই যে পরনের লুঙ্গিটা, তাও সাত বছর হলো। শুধু মাঝে মধ্যে ছিঁড়লে বৌ একটু সেলাই করে দেয়।
দর্জিওয়ালা বললো, আগেকার জামা-কাপড়ের পিস অনেক মানসম্মত ছিলো। আগের জিনিসের সাথে এখনকার জিনিসের কি তুলনা চলে?
পঁচানন্দ বললো, মানুষ আগের থেকে তো এখন অধিক জ্ঞানী ও বিজ্ঞ। তবে জামা-কাপড়ের পিসের মান নেমে যাচ্ছে কেনো? আসলে এখনকার মানুষ ঠকানোর দিক দিয়ে প্রচণ্ড জ্ঞানী ও বিজ্ঞ হয়েছে। মন চায়, ধরে ধরে আছাড় মারি। আচ্ছা, আমার ছেলের মাপ নেন। সব মাপ বড় বড় করে নেবেন। যেন আমার ছেলে বিএ পাশ করা পর্যন্ত পরতে পারে।
দর্জিওয়ালা বড় বড় করে মাপ নিলো। পঁচানন্দ বললো, ভাই, সেলাই বেশি বেশি করে দেবেন। প্রয়োজনীয় সেলাই ছাড়াও অপ্রয়োজনীয় সেলাইও দেবেন। যেন দুই যুগেও না ছেঁড়ে।
দর্জিওয়ালা হাসলেন আর হ্যাঁ-সূচক মাথা ঝাঁকালেন। কাপড় আর মজুরি মিলে পাঁচশত টাকা। পঁচানন্দ চোখ মোটামোটা করে বললো, পাঁচশো? টাকার কি কোনো মূল্য নেই? টাকা কি রোজগার বাদে আসে?
দর্জিওয়ালা বললেন, দাদা, কাপড়ের দাম বেড়েছে, মজুরির দামও চড়া।
পঁচানন্দ বললো, আমিও তো মাঠে কাজ করি, আমার মজুরি তো বাড়েনি। কাপড়ের দাম বাড়ে কেনো? আন্দোলন করতে পারেন না? মজুরির দাম বাড়ে কেনো? এসব সেলাইম্যান রাখেন কেনো? আপনাদের অত্যাচারে আমরা কি জামা-কাপড় বাদে থাকবো?
দর্জিওয়ালা বললেন, তাদেরও চলতে হবে তো নাকি? তাদেরও তো সংসার আছে। চাল-ডালের বাজার উর্ধ্বমুখী।
পঁচানন্দ বললো, ও তারাও সংসার করে? তাদের সংসার করার কি দরকার?
দর্জিওয়ালা আশ্চর্য হলেন আর বললেন, সেলাইম্যানরা মজুরি খাটে বলে তারা মানুষ না? সংসার করবে না?
পঁচানন্দ বললো, সংসার করবে করুক, তাই বলে সেলাই কাজে এসে সেলাইয়ের দাম বাড়াবে কেনো? এসব শ্রমিকের অন্য কাজে পাঠিয়ে দেন, যারা মজুরি কম নেবে তাদের আনেন। আমার বৌও তো আমার জামা সপ্তাহে দুই দিন সেলাই করে দেয়, তাকে কি টাকা দেয়া লাগে? যারা এমনিতেই সেলাই করে দেবে তাদের সেলাই করতে দেবেন। এ্যাঁ, সুই আর সুতা দিয়ে একটু কাজ করবে তার জন্য এত এত টাকা দিতে হবে? এটা কি মগের মুল্লুক? দক্ষ কারিগর রাখবেনই না, তাদের বেশি মজুরি দিতে হয়।
দর্জিওয়ালা বললো, ঠিক আছে। আচ্ছা দাদা, আপনি পঞ্চাশ টাকা কম দেন।
পঁচানন্দ বললো, ছেলেটাকে এই প্রথম বাজারে এনেছি, ওকে মিষ্টি কিনে না দিলে হবে? দাদা, আর দশটা টাকা কম নেন।
দর্জিওয়ালা তাই করলেন। কিন্তু পঁচানন্দ ছেলেকে মিষ্টি কিনে দিলো না, বললো, মিষ্টি খেলে মিষ্টি মিষ্টি গন্ধ করবে। তাছাড়া মিষ্টি খেলে দাঁতে পোকা লাগবে। দাঁতে পোকা লাগলে মাংস খাবি কি করে। চল্, বাদাম কিনে দিচ্ছি।
কিন্তু কি মনে হলো, বাদামও কিনে দিলো না। বললো, অন্যদিন বাদাম খাস্। এই টাকাটা অনেক নতুন, চকচকে। এত চকচকে টাকা খরচ করতে মায়া লাগছে।
ভজানন্দ বললো, যেদিন ছেঁড়া টাকা পাবে সেদিন বাদাম কিনে দেবে তো, বাবা? বিশ্বাস করো, বাদাম আমি একদিনে খেয়ে ফেলবো না।
পঁচানন্দ বললো, সেদিন ভাববো, শুধু খাই খাই করে বেহিসেবি ছেলে আমার। কত কথা বলে বলে ষাট টাকা বাচালাম। বাদাম খাওয়ার জন্য? চল্।
পরেরদিন সকালে পঁচানন্দ সারা ঘর তন্যতন্য করে আয়না খুঁজলো, কিন্তু খুঁজে পেলো না। ভারাক্রান্ত মনে স্ত্রীকে বললো, আয়না কি হারিয়ে গেছে, বৌ?
আনন্দী বললো, না। আমি তুলে রেখেছি। কাচের জিনিস কখন পড়ে ভেঙে যায় ঠিক নেই। তোমার তো আবার পা পিছলে পড়ার অভ্যাস আছে। আবার যেখানে সেখানে যখন তখন ঠুল খাও।
পঁচানন্দের মুখে এতক্ষণে হাসি ফুটলো, বললো, তোমার এত বুদ্ধি? তুলে রেখেছো ভালো করেছো। পুজোর সময় বের করবে, তখন একটু সাজলেই হবে।
আনন্দী বললো, বুদ্ধি না থাকলে কি সংসার টিকানো যায়? তাও তোমার মত হাঁদারামের সংসার!
পঁচানন্দ বোকার মত হেসে বললো, সকাল থেকে তুমি জুতো পায়ে দিয়েছো, এবার আমাকে দাও, আমি পায়ে দেবো।
আনন্দী বললো, একজোড়া জুতাতে আমাদের দুই জনের হয়ে যাচ্ছে, আমরা দুই জোড়া জুতো কিনবো কেনো তবে?
পঁচানন্দ জুতো পায়ে দিয়ে পায়খানা ঘরে যাচ্ছে পায়খানা করতে। কিন্তু পায়খানা ঘরে ঢুকছে না। আনন্দী বললো, পায়খানা ঘরে না যেয়ে কি ভাবছো?
পঁচানন্দ বললো, ভাবছি, পায়খানা করবো, কি করবো না। পায়খানা করলে পায়খানা ঘর ভরাট তো হবেই আবার পেটও খালি হবে।
আনন্দী বললো, পায়খানা পেটে চেপে রেখো না। পেটে গণ্ডগোল হলে ডাক্তার গলা কেটে টাকা নেবে।
পঁচানন্দ ফিরে এসে বললো, পায়খানা চাপ চলে গেছে।
আনন্দী বললো, তবে এবার কাজে যাও।
সবাই চায়ের দোকান থেকে চা-বিস্কুট খেয়ে কাজে চলে যাচ্ছে। পঁচানন্দ চা খেলো না, জিভ পুড়ে যাবে বলে, বিস্কুট খেলো না, বিস্কুট দাঁতে লেগে থাকবে বলে। কলাও খেলো না, কলা খেলে গলা বসে যাবে বলে। তখন দোকানদার বললো, তবে একটা বিড়ি নে, টাকা দিতে হবে না।
পঁচানন্দ ক্ষেপে বললো, আমাকে মেরে ফেলার জন্য নেশা ধরাতে চাচ্ছিস, তাই না?
দোকানে বসে থাকলো একা একা। কাজ জুটলো না তার। তারপর মাঠের দিকে গেলো, কেউ যদি ডেকে নেয় তাই। বিশাল মাঠ। কাজের সময় চলছে। কেউ না কেউ তাকে ডেকে নেবেই। হঠাৎ এক ভদ্রগোছের লোক পঁচানন্দকে বললো, একা বসে আছেন কেনো?
পঁচানন্দ বললো, কাজ পাইনি আজ।
ভদ্রগোছের লোকটি পঁচানন্দকে ডেকে নিয়ে গেলো কাজ দেবে বলে। ঘাসে ভরা এক ক্ষেতে পঁচানন্দকে লাগিয়ে দিয়ে বললো, এটা আমার ক্ষেত। আপনাকে একায় দিলাম। যতদিন লাগে আপনিই কাজ করবেন। আশা করি, আগামি এক সপ্তাহ আপনার কাজের অভাব হবে না।
এই বলে ভদ্রগোছের লোকটি বাড়ি চলে গেলো। পঁচানন্দ কাজ পেয়েছে এতেই খুশি, কাজ মনোযোগ দিয়ে সে করতে লাগলো সারাদিন। সন্ধ্যা হয়ে গেলো, তবুও সে কাজ করছে। আনন্দী স্বামীকে সারাদিন খুঁজে না পেয়ে মাঠে এসে দেখলো কাজ করছে। আনন্দী বললো, সকাল থেকে টানা কাজ করছো কেনো?কাজটা কি একা ধরেছো? কার ক্ষেত?
পঁচানন্দ চিন্তায় পড়লো, তাই তো! কার ক্ষেত? লোকটার বাড়ি কোন্ গ্রামে? আমি তো চিনি না।
পাশের থেকে আর এক কৃষক বললো, এ ক্ষেত তো মদন মণ্ডলের। তিনি মারা গেছেন। এ ক্ষেত তো কেউ চাষ করেন না, আর তাই এত ঘাস জন্মেছে।
আনন্দী কান্না জুড়ে বললো, হাঁদারাম মিনশে, কার ক্ষেতে কাজ ধরেছে তাও ঠিক জানে না। ভূতের ব্যাগার খাটছে। নির্বোধ পেয়ে তোমাকে এই ক্ষেতে কাজে লাগিয়ে দিয়ে ভেগেছে কোনো লোক। এই হাঁদারাম মিনশেকে নিয়ে আমি করবো টা কি?
পঁচানন্দ আশ্চর্য হয়ে বললো, সারাটা দিন কাজ করলাম, একটি বারও মনে প্রশ্ন জাগেনি- যে আমাকে কাজে লাগিয়েছে তাকে চিনি না। সে চলে গেছে আর আসেনি। কি বোকার বোকারে আমি।
আনন্দী এমন গরম দিলো, কোনো কথা না বলে পঁচানন্দ টানা মাটির দিকে নজর ফেলে হেটে বাড়ি চলে এলো। বাড়ি আসতেই ভজানন্দ বললো, বাবা, একটা সাইকেল কিনে দাও।
পঁচানন্দ বললো, সাইকেল চালালে ঘন ঘন ক্ষুধা লাগবে।
ভজানন্দ এবার বললো, তবে বাবা একটা ঘড়ি কিনে দাও।
পঁচানন্দের উত্তর দেয়ার আগেই আনন্দী বললো, নতুন ঘড়ির দিকে মানুষের নজর পড়বে। চোর পিছনে লাগবে।
ভজানন্দ এবার বললো, তবে আমাকে দশটা টাকা দাও। একটা আপেল কিনে খাবো।
আনন্দী বললো, আপেল বড় লোকের বাচ্চারা খায়, বাবা।
ভজানন্দ আশাহত হয়ে বললো, তবে থাক। আমি খেলতে গেলাম।
পঁচানন্দ বললো, ধুলা-কাদা মাখবি না। পুজোর আগে তোর মা যে সাবান কিনেছিলো পুজোর দিন ব্যবহার করে পছন্দ না হওয়ায় পুজোর পর তা ফেরত দিয়েছে কিন্তু।
ছেলে চলে গেলে আনন্দী বললো, আজ সারাদিন কার ক্ষেতে কাজ করেছো জানতে না, তাও কাজ করে গেছো। তিনশো টাকা আয় থেকে বঞ্চিত হয়েছো আজ। তোমার বুদ্ধি কি হাঁটুর নিচে?
পঁচানন্দ বললো, বৌ, আমার যাতে বুদ্ধি বাড়ে তার জন্য আমাকে দীক্ষা দিবি?
আনন্দী বললো, তোমার বুদ্ধি বৃদ্ধির আর দরকার নেই। তোমার থেকে ফলাফল আর পাওয়া সম্ভব না। এঁড়ে গরুকে যতই খেতে দিইনা কেনো, এক ফোঁটাও দুধ দেবে না।
পঁচানন্দ আবারও বললো, না, বৌ রাগ করিস না। আমাকে জ্ঞানী হওয়ার দীক্ষা দে।
আনন্দী রেগে বললো, তোমার মাথা গোবরে ভরা, ও মাথায় জ্ঞান ঢুকার আর জায়গা নেই। তোমার মত হাঁদারাম দ্বিতীয়টি আর নেই। তুমি হলে এক নম্বর গোবর-গণেশ।
পরের দিনের ঘটনা। পঁচানন্দকে তার মা মন্দ্রা বললেন, মাখন তোর কাছে টাকা পায়, শচীন্দ্র তোর কাছে টাকা পায়। শোধ দিস না কেন্? কারো কাছে ঋণী থাকতে নেই।
ধার দেনা করে মায়ের কাছে এভাবে ধরা পড়াতে পঁচানন্দ থতমত খেলো৷ তাই নিজেকে বাঁচানোর জন্য মিথ্যা বললো, মা, দুই জন না হয় আমার কাছে টাকা পায়, আমিও তো দুই জনের কাছে টাকা পাই। আমি কালীরামের কাছে দুশো, আর অরিন্দমের কাছে তিনশো টাকা পাই।
শেষের কথাটি আনন্দী শুনে ফেলেছে, বললো, তুমি মানুষকে টাকা ধার দিয়ে বেড়াও।
এ বলেই আনন্দী কান্না জুড়ে দিলো, আর বললো, মা, আপনার এই হাঁদারাম ছেলে নিজের ভালো বোঝে না। সংসারটাকে ধ্বংস করে দেবে।
পঁচানন্দ স্ত্রীর এমন কাণ্ডে অপ্রস্তুত হয়ে গেলো। মিথ্যা বলে ও ফাঁদে পড়েছে। এমন সময় মাখন এলো আর বললো, তোকে অনেক দিন পর ধরতে পেরেছি। কত দিন তোর কাছে টাকা ফেলে রাখবো, আমার টাকা ফেরত দে।
এ কথা শুনে আনন্দী আবার কান্না জুড়ে দিলো, আর বললো, দেখেছেন মা, আপনার ছেলে টাকা ধার যেমন দেয়, টাকা ঋণও করে। এই টাকা দিয়ে সে কি করেছে? আরো একটা বিয়ে করেছে নাকি? আপনার ছেলে ঘরে কত সাধু, বাইরে কি সব করে বেড়ায়, এতো হাঁদারাম না। এ যে একেবারে পাকারাম।
পঁচানন্দ আরো অপ্রস্তুত হয়ে গেলো। কি বলবে বুঝতে পারলো না। আনন্দী বললো, যাও কালীরাম আর অরিন্দমের কাছে। পাওনা টাকা আদায় করে এনে দেনা শোধ করে ঘরে উঠবে।
পঁচানন্দ দিকভ্রান্ত হয়ে পালালো। বাড়িতে ঝঞ্ঝাট দেখে মাখনও চলে গেলো। মন্দ্রা আত্মবিশ্বাসের সাথে বললো, আমার ছেলে অমূল্যধন, ঋণ করতেই পারে, কিন্তু কাউকে ধার দেবে আমার তা বিশ্বাস হয় না। তুমি তাকে যে কৃপণ বানিয়েছো?
আনন্দী কেঁদে কেঁদে বললো, কই আর কৃপণ বানাতে পারলাম, বেহিসেবি একটা। টাকা ছয় নয় করে। ঘরের টাকা কেউ পরকে দেয় বুদ্ধি থাকলে৷ বুদ্ধি থাকলে পরের টাকা ঘরে আনতো।
সন্ধ্যা বেলা ভয়ার্ত হৃদয়ে পঁচানন্দ বাড়ি ফিরে এলো, কিন্তু ঘরে ঢুকছে না। আনন্দী বললো, ঘরে এসো৷ হাঁদারাম হলেও তো তুমি আমার স্বামী। তোমাকে কি ফেলে দিতে পারবো? তোমাকে শিখিয়ে নিয়েই আমাকে সংসার করতে হবে।
পঁচানন্দ বললো, বিশ্বাস কর্ বৌ, আমি কারো কাছে টাকা পাই না। ভাব নিয়ে বলে ফেলেছিলাম যে, কালীরাম আর অরিন্দমের কাছে টাকা পাই। আর কিছুদিন আগে মোট দুই দিন কাজ পাইনি। তুই তো বলেছিস দিনের শেষে কাজের টাকা তোকে দিতে হবে। দুই দিনে কাজ না থাকায় ইনকাম করতে পারিনি। তাই মাখন আর শচীন্দ্রের কাছ থেকে টাকা ধার করে এনে তোকে দিয়েছিলাম।
আনন্দী একটু হেসে বললো, তাই বুঝি! সত্যিই তুমি আমার স্বামী হওয়ার যোগ্য। এমন হাঁদারাম স্বামীই আমার আকাঙ্ক্ষার ছিলো।
ভাত খেতে বসলো ওরা। ডাটা শাক দিয়ে ভাত খাচ্ছে। আর গল্প করছে মাংসের। পঁচানন্দ বললো, আচ্ছা বৌ, বিস্কুট খেলে দাঁতে আটকে গেলে আঙুল দিয়ে বের করে খেয়ে ফেলি। তবে দাঁতে মাংস আটকে গেলে আঙুল বা কাটি দিয়ে বের করে ফেলে দিই কেন্?
আনন্দী বললো, দাঁতে আটকে যাওয়া মাংস আমি তো বের করে খেয়ে ফেলি, তুমি ফেলে দাও কেনো? মাংস দামি খাদ্য। ওভাবে ফেলতে নেই।
গজানন্দ পাশ থেকে বললেন, এক বছর হতে চললো বাড়িতে মাংস আসেনি। এত মাংস খাওয়ার গল্প কোথা থেকে আসছে শুনি!
মন্দ্রা বললো, যে বৌমা ঘরে এনেছি এ বাড়ি মাংস ভবিষ্যতে উঠবে বলে মনে হয় না। আমাদের কথা বাদ দিলাম নিজেদের ছেলের জন্য হলেও তো এক ছটাক মাংস কিনতে পারিস! পুষ্টিকর খাবার না খেলে ছেলের বৃদ্ধি হবে?
আনন্দী ক্ষেপে উঠে বললো, আপনারা আপনাদের ছেলেকে পুষ্টিকর খাবার তো খুব খেতে দিয়েছিলেন, আস্ত একটা হাঁদারাম হলো কি করে সে!
পঁচানন্দ রেগে গেলো, বললো, বৌ, আমাকে হাঁদারাম হাঁদারাম বলবি না।
আনন্দী বললো, তোমার যে জ্ঞান-প্রজ্ঞা তাতে হাঁদারামের চেয়ে আর তো যথাপোযুক্ত শব্দ পৃথিবীতে আছে বলে আমার মনে হয় না।
গজানন্দ বললো, বৌমা, তোমার দেয়া হাঁদারাম শব্দটাই ওর জন্য উপযুক্ত। পঁচা, কাল মাংস কিনে আন্, দেখি পারিস কিনা! বুঝবো তবে তুই হাঁদারাম না।
পঁচানন্দ চুপ করে থাকলো। আনন্দী বললো, ধাড়ি ছাগলের মাংস খাসির মাংস বলে বিক্রি করে। তাছাড়া সবজি খেতে খেতে অভ্যাস হয়ে গেছে হঠাৎ মাংস খেলে বমি হবে। তাছাড়া মাংস খেলে পেটের পীড়া হবে। তাছাড়া ছেলের দাঁতের ফাঁকে মাংসের টুকরো বেঁধে থাকলে ছেলের দাঁতে পোকা লাগবে।
ওদিন রাতে ভজানন্দের জ্বর এলো। মন্দ্রা এসে বললেন, বাবা, ডাক্তার ডেকে নিয়ে আয়।
পঁচানন্দকে থামিয়ে আনন্দী বললো, রোগ হলেই ওষুধ খাওয়া ঠিক না, টেলিভিশনে বলেছে, নিজ কানে শুনেছি।
গজানন্দ বললেন, দিনকাল ভালো না। রোগ-বালাই হলে গাফিলতি করা ঠিক না, বৌমা।
আনন্দী বললো, রোগ হলেই ওষুধ খেলে দেহের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যায়।
পঁচানন্দ ডাক্তার আনতে যেতে পারলো না বৌর বাঁধায়। সারারাত বিভোরে পড়ে থাকলো ভজানন্দ। সকালে পঁচানন্দ বললো, বৌ, ডাক্তার ডাকবো?
আনন্দী বললো, ডাক্তার তো না, সব কসাই। এসেই একগাদা টাকা নেবে। ডাকতে হবে না। কত ব্যামোই তো ওষুধ বাদে সেরে গেলো।
জ্বরের মাত্রা বেড়ে যাওয়াতে কাঁতরাতে লাগলো ভজানন্দ। পঁচানন্দ বাধ্য হয়ে বললো, জ্বর যে বাড়ছে, ডাক্তার আনতে গেলাম।
আনন্দী আবারও বাঁধা দিলো আর বললো, দুপুর পর্যন্ত দেখি সারে কিনা। তারপর না হয় ডাক্তার ডাকা যাবে।
ভজানন্দের অবস্থা বেগতিক। পঁচানন্দ বৌর বাঁধা অগ্রাহ্য করে ডাক্তার ডাকতে চলে গেলো, আনন্দী বললো, কিছু হলেই ডাক্তার ডাকা এ যে কি খারাপ অভ্যাস!
ডাক্তার এসেই কিছু ওষুধ লিখে বললেন, পঁচা দা, এই ওষুধগুলো দ্রুত নিয়ে আসো।
আনন্দী পঁচানন্দকে বাঁধা দিলো, থামো। এত ওষুধ লাগবে না। ডাক্তার দাদা, ওষুধ আরো কম করে লেখেন।
ডাক্তার একটু হেসে বললো, অনেক সম্পদ গড়েছো, ছেলের কিছু হলে কি করবে এসব দিয়ে? নিজেরা না হয় না খেয়ে থাকো, ছেলেটাকেও কিছু খেতে দাও না। বাবা মা না খেয়ে থেকেও তো সন্তানকে খাওয়ায়। পুষ্টির অভাবে ছেলেটার কি অবস্থা! ওষুধের পাশাপাশি কিছু ফলমূলও কিনে আনবে, পঁচা দা।
আনন্দী বললো, ওষুধ খেলে জ্বর সারবে যখন ফল কেনার কি দরকার?
ডাক্তার আশ্চর্য হয়ে শুনলো কথাগুলো। আর ভাবলো, কৃপণ শুধু টাকায় চেনে, সন্তানকেও চেনে না।
ডাক্তারের সাথে সাথে পঁচানন্দও বের হয়ে গেলো ওষুধ কিনতে। ডাক্তার পাঁচ দিনের ওষুধ দিলেও পঁচানন্দ তিন দিনের ওষুধ কিনে আনলো। ওষুধ খেয়ে ভজানন্দ চোখ মেলল। ওষুধপত্র দেখে ভজানন্দ বললো, ডাক্তার ডেকেছিলে তোমরা? দুই দিনের মধ্যেই তো সুস্থ হয়ে যেতাম। টাকা থাকলে যেমনে ইচ্ছা তেমনে খরচ করবে? থাকতাম না হয় শুয়ে, সেরে যেত রোগ। আমার তো স্কুল আরো তিনদিন ছুটি।