শীতের ভোর ৷ বাস স্ট্যান্ডে এত ক্ষণে চায়ের দোকান বোধ হয় খুলে গেছে ৷সুনীল হন্তদন্ত পায়ে এগিয়ে চলেছে ৷ প্রথম গাড়িটা তাকে ধরতে হবে ৷এই গাড়িটা পেলে ৬.৩০টার লক্ষ্মীকান্তপুর লোকালটা আরামে ধরতে পারবে ও ৷তাতে অফিস টাইমের আগে সে নিশ্চিন্ত মনে অফিসে পৌঁছাতে পারবে ৷সুনীলের অফিসটা বালিগঞ্জ ফার্ণ রোডে ৷বালিগঞ্জ স্টেশনে নেমে রিক্সায় চাপলে টেনে টুনে বড় জোর ৫মিনিট লাগে ৷ছেলেটা ভালো শিক্ষিত,এবং ব্যবহারটা বড় মধুর ৷ওর সব চেয়ে বড় গুণ হল ও বিনয়ী আর কর্মঠ ৷এক বেসরকারি সংস্থায় মাসখানেক হল চাকরি পেয়েছে ৷গরীবের ছেলে ৷এখনো বেতন পেতে শুরু করেনি৷ও বালিগঞ্জ স্টেশন থেকে রিক্সা ধরতে পারে না ৷তাই স্টেশনে নেমে একটু পিছনে আসে ৷ও ভাঙা পাঁচিল দিয়ে মিনিট দশেক হেঁটে অফিসে পৌঁছায় ৷
তাই ভোর রাতে কাঁপতে কাঁপতে দ্রুত হেঁটে চলেছে ও ৷সাইকেলটা নিলে ভালো হত ৷ তাতে আরো ঠান্ডাটা লাগবে ৷আবার স্ট্যান্ডের ভূপাল খুড়োর গ্যারেজে রাখলে ডেইলি পাঁচ টাকা করে ভাড়া দিতে হবে ৷এখন খুড়ো পুজোর পর থেকে দু,টাকা করে বাড়িয়ে দিয়েছে ৷তাই সাইকেলের কথা মাথায় আনে না সুনীল ৷গায়ে জ্যাকেট খানা জড়িয়ে,মাফলার টা মাথায় বেঁধে জোরে হাঁটা লাগালে ঠান্ডা বেমালুম বেপাত্তা হয়ে যাবে ৷পাড়ার ভিতরে এ সময় ভয়ের কিছু নেই ৷ তবে ভোর রাতে কুকুরকে নিয়ে তার ভয় বেশি ৷ এসময় ওরা দল বেঁধে এমন ভাবে ভৌ-ভৌ করে পাড়া মাথায় করে যে ভয় না করে পারা যায় না ৷ যখন ও ইলেভেনের ছাত্র সেই সময় একবার ওকে কুকুরে কামড় দিয়েছিল তাতে নাভির কোলে চোদ্দটা ইনজেকশন নিতে গিয়ে প্রাণটা বেরিয়ে যাওয়ার জোগাড় হয়েছিল ৷
জোরে জোরে পা চালিয়েছে সুনীল ৷সুশান্তর চা দোকান থেকে গরম গরম চা টা আমেজ করে খেয়ে ও বাস ধরবে ৷পশ্চিম আকাশে ক্ষীণ চাঁদটা হালকা আলো ছড়িয়ে জেগে আছে ৷পথের ধারে সারে সারে দাঁড়িয়ে থাকা বড়ো বড়ো গাছ-গাছালি দীর্ঘ ছায়া ফেলে আলো-আঁধারি পরিবেশ তৈরি করেছে ৷ পথের ধারের ঝোপ-ঝাড় ও বড়ো অসচ্ছ ৷সুনীল একটু এগোতেই পাশের ঝোপটা হঠাৎ নড়ে ওঠে ৷গা হাত পা ওর একটু কেঁপে ওঠে ৷মুহূর্তে কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমে ওঠে ৷
ভো-উ -ভো-উ -উ-উ-
ঝোপ থেকে দৌড়ে আসে একটা কুকুর ৷ঝাঁপিয়ে পড়ে এক প্রকার সুনীলের গায়ের উপর ৷
--বাবা গো ,
সুনীল উল্টে পড়ে রাস্তার পাশে খালের দিকটা -য়৷আর একটু হলেই বরফ ঠান্ডা জলে ডুবে উঠতে হত তাকে ৷ কোন রকমে ও নিজের টাল সামলে নিল পাশের বাবলা গাছের গুঁড়ি জড়িয়ে ধরে ৷কুকুরটা তখন ও ওখানে দাঁড়িয়ে ডাকছে--- ঘেউ-ঘে-উ-উ-উ -
পুকুরের খোল থেকে উঠে আসে সুনীল ৷কুকুরটা এবার কেঁউ কেঁউ করছে ৷ ও বুঝতে পারল এটা কোন পাগল কুকুরের লক্ষণ নয় ৷এই অবলা জীবের ওই দুর্বোধ্য সংকেতের মধ্যেই কি অন্য কিছু বলতে চায় ও?
----কি বলতে চায় ও ?
কুকুরটা ওকে কামড়ায় না ৷শুধু ওর প্যান্ট টা মুখ দিয়ে টানে আর মাঝে মাঝে ঘেউ ঘেউ করে ৷
--- কিরে কিছু বলবি নাকি ?
কুকুরটা আগে আগে যায় ৷পিছনে থেকে সুনীল তাকে অনুসরণ করে ৷ঝোপ ঝাড়ের কাছে এসে পৌঁছাল ও ৷অন্ধকারে তেমন কিছু দেখা যাচ্ছে না ৷মাঝে মাঝে কিঁউ-কিঁউ আওয়াজ উঠেছে ৷
এতো সদ্যোজাত কুকুর ছানার কান্না ৷কুকুর ছানার আওয়াজ বটে ৷কিন্তু এভাবে ও আমায়
ডাকলো কেন?
- কিরে ডাকলি কেন?
পকেট থেকে মোবাইলটা বের করে সুনীল আলো জ্বালে ৷কুকুর ছানাদের উপরে টর্চের আলো ফেলা মাত্র ই বুকটা ওর ধড়াস করে ওঠে ৷চোখ থেকে ক্রমাগত জলের ধারা নামে ৷তীব্র শীতে দরদর করে তার শরীরে ঘাম নামে ৷ সুনীল টর্চের আলোয় দেখে তিনটি কুকুর ছানার অদূরে পড়ে একটি সদ্যোজাত শিশু কন্যা ৷ নাড়ির কুণ্ডলী তখন ও কাটা হয় নি ৷ এ কাদের পাপ কর্মের ফল ভোগ করছে কন্যা শিশুটি তা সে জানে না ৷মাতৃসুলভ স্নেহ ছায়ায় পালনকারী কুকুর জানে না আবার পথচারী সুনীল ও জানে না ৷এভাবে আমরা আগামী দিনের পথে এগোব ৷পবিত্র ভালোবাসা এগোবে উজ্জ্বল আলো হাতে ৷ পরকিয়া প্রেম চলবে তার পাশে
অন্ধকার পথে ৷ কুন্তীরা আজ ও কৌমার্য বিসর্জন দিয়ে লোকলজ্জা ও সমাজ সংস্কারের ভয়ে নিজের পেটের সন্তানকে নাড়ি ছিঁড়ে ছুঁড়ে দেবে আস্তা কুঁড়ের জঙ্গলে থুড়ি গঙ্গার জলে ৷
তিন ছানার সাথে এক মানুষের ছানাকে আগলে রাখতে পারে অবলা কুকুর ৷অথচ নিজের সন্তানকে আগলে রাখতে ব্যর্থ অমৃতের পুত্র মানুষ ৷চোখের জল ফেলে কথাগুলো ভাবতে ভাবতে কখন সকালের আলো ফুটে অনেক বেলা হয়ে গেল ,সেদিকে একটুও খেয়াল করেনি সুনীল ৷
-------------------------------
আর.এন.সি রোড , সুভাষগ্রাম,পো-সুভাষগ্রাম,থানা-সোনারপুর, জেলা-দক্ষিণ ২৪পরগণা