Click the image to explore all Offers

গল্প।। মুক্তি ।। আব্দুস সাত্তার বিশ্বাস

 



বোঝাই সাইকেল টানতে হাঁপিয়ে গেল মদন। আর তার মুখ দিয়ে তাই বেরিয়ে গেল,' উফ্, কী রোদ আর গরম!'
মদনের সাইকেলে এখন শপ, মশারি, বিছানার চাদর রয়েছে। গ্রামে হাঁক দিয়ে দিয়ে বিক্রি করে। সকাল বেলায় বেরিয়ে যায় আর সন্ধ্যা বেলায় ফেরে। কোন কোন দিন আবার ফিরতে রাত হয়ে যায়। যেদিন দূর গ্রামে যায়। প্রচুর মেহনত হয় মদনের। না থাকে খাওয়ার ঠিক, না থাকে ঘুমানোর ঠিক।

শুধু রোদ গরমের কারণেই নয়, মদন আজ হাঁপিয়ে গেল অন্য কারণে। সেই সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত ঘুরেও তার বউনি হয়নি। শুধু আজ নয়, এর আগেও কয়েক দিন বউনি হয়নি। বিশ দিন হল সে বাড়ি থেকে এসেছে। রোজগার হয়েছে মাত্র বারোশো টাকা। তাও আবার খোরাকে আর পকেট খরচে চলে গেছে। পকেটে এখন পড়ে রয়েছে মাত্র পঞ্চাশ টাকা। ওদিকে আবার বাড়িতে টাকার দরকার। কাল বাদ পরশু কিস্তি আছে। কাল দু' হাজার টাকা পাঠাতে হবে। তার দু' দিন বাদে আবার দু' হাজার টাকা লাগবে। সে টাকাটাও তাকে পাঠাতে হবে। আর একটা কিস্তি আছে। খেতে না পেয়ে মুখ দিয়ে রক্ত উঠে মরলেও কিস্তির টাকা মাফ নেই, দিতেই হবে। না হলে যে বাড়ি বয়ে এসে তারা ঝামেলা করবে। কোন কথা শুনবে না। যে কারণে কিস্তির টাকা যেখান থেকে যেভাবে হোক জোগাড় করতেই হবে। তার হাঁপিয়ে যাওয়ার এটাই হল সবচেয়ে বড় কারণ।

ভীষণ চিন্তা ক্লিষ্ট হয়ে মদন রাস্তার ধারে একটা নিম গাছতলায় দাঁড়াল। নিম গাছের ছায়া ঠাণ্ডা বলে। ও সাইকেলটা গাছে হেলান দিয়ে হাউমাউ করে কাঁদতে লাগল,' প্রভু, ও প্রভু, তুমি আর কত পরীক্ষা নেবে আমার? আমি যে আর পারছি না। আমি যে ক্লান্ত। তার চেয়ে তুমি আমার মরণ করো। এত দুঃখ, এত কষ্ট, এত চিন্তা আমি আর বইতে পারছি না। তুমি আমার মরণ করো।....'
ভীষণ জোরে জোরে কথা গুলো বলতে বলতে মদন মাটিতে বসে পড়ল। তার শরীর এখন খুব ক্লান্ত; মাথা ঝিমঝিম করছে; ঘুম পাচ্ছে; অতএব মাথা থেকে গামছাটা খুলে ঘাসের উপর সাট করে পাড়ল। এক ঘুম পেড়ে উঠে গ্রামে যাবে। কিন্তু শোওয়ার পরে ঘুম এল না। ঘুমানোর অনেক চেষ্টা করল তবুও না। নানান ধরনের চিন্তা তাকে গ্রাস করে ফেলল। কিন্তু চোখ সে খুলল না, বন্ধ করেই রাখল। পরে যদি----

'কে শুয়ে ওখানে, মদনদা নাকি?'
মদন উত্তর দিল,' হ‍্যাঁ।' ও সে চোখ খুলে তাকিয়ে দেখে গামছার উপর উঠে বসল,' বিনয়! এসো, এসো...'
বিনয় সাইকেল স্ট‍্যান্ড করে মদনের কাছে আসলো। এই বিনয়ের বাড়ি হল, জিয়াগঞ্জ। সেও গ্রামে হাঁক দিয়ে দিয়ে শপ, মশারি, বিছানার চাদর বেচে। দু' জনে একই মহাজনের মাল বেচে, গৌতম বাবুর।
মদন জিজ্ঞেস করল,' কেমন আছো?'
বিনয় বলল,' ভালো আছি দাদা, আপনি কেমন আছেন?'
'আমার আর ভালো থাকা! যাইহোক, ব‍্যবসা কেমন হল?'
'ব‍্যবসা ভালো হয়েছে দাদা, হাজার খানেক টাকা লাভ হবে।'
'খুবই ভালো ব‍্যবসা হয়েছে তাহলে। এক দিনে হাজার টাকা লাভ মানে বিরাট।'
'আপনার কেমন হল?'
'আমার হয়নি।'

এরপর বিনয় উঠে গেলে পরে মদনের আপনি কান্না চলে এল। সকলের ভালো ব‍্যবসা হয়, শুধু তারই হয়না। তার ভাগ‍্যটাই যে খারাপ। না হলে কোম্পানির কাজ করতে যায়? কোম্পানির কাজ করতে গিয়েই তো সে----  ঘরবাড়ি ছেড়ে কুলিতে (এটা রাঢ় অঞ্চলের একটা জায়গার নাম, কান্দি মহকুমার অন্তর্গত। বাগড়ির অনেক মানুষ এখানে থেকে হকারি করে।) পালিয়ে এল।
না এলে যে আমানতকারীরা তাকে ধরে টানাহেঁচড়া করত, টাকা চাইত। টাকা সে দেবে কোত্থেকে? তাছাড়া টাকা তো সে খায়নি, কোম্পানির খাতায় জমা করেছে। এখন কোম্পানি যদি পালিয়ে যায় তো সে কী করবে? কিন্তু মানুষ সেটা শুনতে চায়না। তারা নাকি কোম্পানি চেনে না, তাকে চেনে। তাকে দেখে টাকা দিয়েছে। সুতরাং, তার কাছে টাকা নেবে। না হলে বাড়ি থেকে উঠিয়ে নিয়ে গিয়ে---- বাবার টাকা নাকি! 
উফ্, ওই নোংরা জলে কেন যে সে নেমেছিল? কী ভুল যে করেছে! লোকের কাছে মুখ দেখাতে পারে না।

রোদ এখন একটু কমেছে। আগের সেই তীব্রতা আর নেই। অতএব মদন গ্রামে গেল। গ্রামের অলিগলি সব ঘুরল। শুধু ঘুরল না, হাঁকের পরে হাঁক দিল,' নেন গো শপ, মশারি, বিছানার চাদর....' এবং গ্রামেই তার সন্ধ্যা হয়ে গেল। আর রোডে উঠতে উঠতে অন্ধকার। না, তবু বউনি হয়নি। কাল যে দু' হাজার টাকা তাকে পাঠাতে হবে সেটা সে পাবে কোথায়? পাঠাবে কী করে?...ভাবতে ভাবতে মদন রোডের উপর হুড়মুড় করে পড়ে গেল, হুড়মুড় করে...

হ‍্যাঁ, মদনের এখন খুব খিদে পেয়েছে। সেই সকাল বেলায় একটু পান্তা ভাত খেয়ে বেরিয়েছে। তারপর আর সারাদিন কিছু খায়নি। যদিওবা একবার মিষ্টির দোকানে ঢুকে দুটো মিষ্টি, একটা পাউরুটি কিনে খাওয়ার কথা ভেবেছিল। তাহলে শরীর একটু বল পাবে। কিন্তু পয়সার কথা ভাবতে গিয়ে আর খায়নি। ফলে বোঝাই সাইকেল টানতে তার এখন খুব কষ্ট হচ্ছে, খিদের জ্বালায় পেট চিঁ চিঁ করছে।

রোজ সে রুমে গিয়ে চান করে তবে রান্না চাপায়। আজ সে চান করার আগেই রান্না চাপাবে। না হলে খিদের যন্ত্রণায় মাথা ঘুরে পড়ে গিয়ে মারা যেতে পারে।.... ভাবতে ভাবতে মদন 'খুক' করে একবার কাশল। তারপর তার ফোনটা হঠাৎ বেজে উঠলে মদন ফোনটা ধরল,' হ‍্যালো! কে?'
'আমি গো, প্রভা!'
প্রভা, মদনের স্ত্রী। ফলে মদন তাকে বলল,' এখন ফোন রাখ, রোডের উপর আছি, সাইকেল চালাচ্ছি; রুমে গিয়ে ফোন করব। সামনে দুটো লরি আসছে। লাইটে তাকাতে পারছি না।'
প্রভা শুনল না। সে বলল,' পরশু কিস্তি আছে, মনে আছে তো?'
'না, মনে নেই। ফোন রাখতে বললে শুনতে পাস না!'
'কাল দু-হাজার টাকা পাঠিয়ে দিও, মনে করিয়ে দিলাম।'
মদনের মুখ থেকে এবার বেরিয়ে গেল,' টাকা পাঠাতে পারব না, আমার কাছে টাকা নেই। শালিকে ফোন রাখতে বললে শুনতে পায় না!'
'বললেই হল না!'
'হ‍্যাঁ হ‍্যাঁ, বললেই হল।' মদন মেজাজ করে বলল কথা গুলো।
'আমি তাহলে স‍্যারকে বিয়ে করব।'
বনাত করে অমনি মাথাটা ঘুরে গিয়ে মদন পড়ে গেল।.....লরি দুটো চলে গেল।
কিস্তি নিতে আসে যে ছেলেটা, গ্রুপের মেয়েরা তাকে স‍্যার বলে।
মদনের এখন আর কিস্তির টাকা বলে চিন্তা করতে হবে না, আমানতকারীদের ভয় তাকে আর তাড়া করবে না। এখন স্বর্গে বসে সে সুখময় ফল খাবে; লাল টুকটুকে পাকা আপেল ফল। আর সুন্দরী অপ্সরীদের সঙ্গে---
জলঙ্গি থানার সাহেবরামপুর গ্রামে তার যে বাড়ি ছিল সেটা সে ভুলে যাবে।
                         --------------
 
ঠিকানা:-আব্দুস সাত্তার বিশ্বাস
গ্রাম+পোস্ট:-সারাংপুর খাসপাড়া,
থানা-ডোমকল,
জেলা-মুর্শিদাবাদ। পশ্চিম বঙ্গ,ভারত। পিন-৭৪২৩০৪।



Post a Comment

0 Comments
* Please Don't Spam Here. All the Comments are Reviewed by Admin.