ছোটগল্প ।। দৌড় ।। শ্রীজিৎ জানা
দৌড়
শ্রীজিৎ জানা
তখনো পর্যন্ত তিন-চারটে ইভেন্ট হয়ে গেছে। কোন পজিশন পায়নি ভুতুদের স্কুল। সব শিক্ষকের কপালে চিন্তার ভাঁজ। উত্তম বাবু দূরে দাঁড়িয়ে ছিলেন, দৌড়ে এসে ভুতুর কাছে বললেন
--এমন মুখ করে দাঁড়িয়ে আছিস কেন? পা দুটো একবার ঝাঁকিয়ে নে। তোকেই কিন্তু স্কুলের মান বাঁচাতে হবে। খিদে পেয়েছে? কিছু খাবি?
শুনে পাশ থেকে নন্দবাবু চেঁচিয়ে ওঠেন
-- না না খিদে পেলেও এখন কোনো খাবার নয়। পেট ভারী হলে ছুটবে কী করে? আগে ছোটা হোক তারপর ডিম- কলা - রুটি আর ফার্স্ট হতে পারলেই একখানা স্টিলের চকচকে টিফিন বক্স! স্কুলে মুড়ি নিয়ে আসবি।
ভুতুর দ্বিতীয়টার প্রতি তেমন কোনো লোভ নেই। কৌটার বদলে যদি দু'চারটে খাবারের প্যাকেট বেশি দেয় তো ভালই হয়। এসব খাবার তার ফি-দিন খাওয়া হয়না। পেট ভরে ভাতই জোটে না তাদের। ডিম-রুটির কথায় চকচক করে ওঠে ভুতুর চোখ! খুব জোরে দৌড়াতে হবে আজ তাকে।
মাইকে তখন ঘোষনা হচ্ছে-- 'চেস কার্ড নম্বর কুড়ি ১০০ মিটার দৌড়ের স্টার্টিং পয়েন্টে চলে যাও'। উত্তম বাবু দৌড়ে এসে ভুতুকে নিয়ে গিয়ে দাঁড় করিয়ে দেন ট্রাকে। তাকিয়ে থাকেন তাদের স্কুলের 'কালো ঘোড়ার'দিকে! সকলের আশা ভুতুর হাত ধরেই তাদের স্কুলের নীল কাটবে। এদিকে রেডি বলেই হুইসেলে ফুঁ দেওয়ার কয়েক মুহূর্তের মধ্যেই ফিনিশিং লাইন টপকে যায় ভুতু। ১০০ মিটার, 200 মিটার দুটোতেই প্রথম হয় সে। নন্দবাবু পকেটে হাত গুঁজে গাল ফুলিয়ে অন্য এক স্কুলের শিক্ষকের উদ্দেশ্যে খুশি ছড়িয়ে বলে উঠেন--- আমাদের ব্ল্যাক হর্স । ভুতু এসব কথার কোন মানে বোঝে না, বুঝতেও চায়না। পলিথিন প্যাকেটের ডিম কলা পাউরুটি নিতেই ব্যস্ত হয়ে ওঠে। ডিম কলাটা তো তখুনি খেয়ে পাউরুটিটা বিকেলের জন্য রেখে দেয়। সাজানো মঞ্চ থেকে তার নাম ডাকা হচ্ছে-- ভূতনাথ মুর্মূ। পিতা ধীরা মুর্মূ। হরিরাজপুর প্রাইমারি স্কুল।চেসকার্ড নম্বর কুড়ি।
হাত বাড়িয়ে পুরস্কার নেয় সে। স্টিলের চকচকে টিফিন বক্স যদিও তাতে করে কোনদিন মুড়ি যে আনা হবে না তা সে ভালো করেই জানে।
ভুতু এখন দশম শ্রেণীতে। বাড়ির যা অবস্থা তাতে এতদূর আসা সম্ভব ছিলনা তার।গ্রামের এক প্রান্তে চাষা পাড়ার মাঝে তাদের দু-তিন ঘরের বসতি। বাবা-মা মন্ডলদের জন খাটতে সেই কবে এসেছিল ঝাড়গ্রাম থেকে। তারপর শিলাবতী নদীবাঁধের ধারে ঝিটাবেড়ার ঘর সংসার পাতে। আর ফিরে যাওয়া হয়নি তাদের। চাষা পড়ার মাঝে ঘরদোর বলে কথাবার্তায় চটকরে আদিবাসী বলে ধরা যায়না। ভুতু বরাবর চুপচাপ স্বভাবের। পড়াশোনায় খুব খারাপ বলা যাবে না। আর এসব কারণেই মন্ডলপাড়ার শিবু ওকে পড়াশোনায় সব খরচ দিয়ে সাহায্য করে। তার দৌলতেই ভুতু এবছর মাধ্যমিক দেবে। শিবতোষকে খুব মেনে চলে ভুতু। মাঝেমধ্যে তাকে নিজের দাদার মতো মনে হয়। কি দারুন সব কথা বলে। কথাগুলো শুনতে শুনতে গা-হাত-পা কেমন যেন গরম হয়ে ওঠে। শিবুদার একটা কথা তার মনের মধ্যে ফাঁকা স্কুলঘরে কথা বল্লে যেমন গমগম করে,তেমন বুকের মধ্যে ধাক্কা দ্যায়-- 'লাইফ ইজ এ রেস বুঝলি ভুতু! এখানে থামা মানেই শেষ'।
কিন্তু তাকে প্রতিদিন দৌড়ে দৌড়ে স্কুলে যেতে ভালো লাগেনা। সাইকেল চালানো শিখলেও তাদের সাইকেল কেনার সামর্থ্য কোথায়? তা ছাড়া কোন উপায়ও নেই। তাদের জাতের ছেলে মেয়েদের মাধ্যমিক পড়াটাই একটা দুঃস্বপ্ন, তাও আবার সাইকেলে চড়ে…?এ যেন ছেঁড়া কাঁথায় শুয়ে লাখ টাকার স্বপ্ন দেখা! তবু মনের ভেতর ইচ্ছেরা পাখা মেলে! চোখের দরজায় স্বপ্নটা আটকে থাকে। স্বপ্ন দেখে নতুন সাইকেল চড়ে সবাইকে পিছনে ফেলে সবার আগে স্কুলে পৌঁছে গেছে সে। কিন্তু স্বপ্ন তো স্বপ্নই। স্বপ্ন ও বাস্তবের মাঝখানে বামুনকুড়ের বিশাল মাঠের মতো শূন্যতা চেপে বসে থাকে।
এরই মাঝে হঠাৎ একটা সুযোগ হাজির হয় তার কাছে। স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষে নবীন সংঘ একটা রোড রেসের আয়োজন করেছে বকুলতলা থেকে কুশপাতা। ফার্স্ট প্রাইজএকটা হারকিউলিস সাইকেল। নাম জমা নিচ্ছে তাদের স্কুলের পাশে মাদার বুক হাউস। হ্যান্ড বিলটা হাতে পাওয়া মাত্রই দৌড়ে গিয়ে নাম জমা দিয়ে আসে ভুতু। মাঝে মাত্র আর কটা দিন। ভোরে ওঠে নদীবাঁধ বরাবর দৌড়ানো প্র্যাকটিস করে সে। একটাই লক্ষ্য তার ফার্স্ট প্রাইজ হারকিউলিস সাইকেল।
ক্লাব থেকে দেওয়া সাদা গেঞ্জি আর নীল প্যান্ট পরে এক্কেবারে রেডি সে। অনেকেই স্পোর্টস সু পরে এসেছে দৌড়াতে। ভুতুর তাতে কিছু এসে যায়না। সাইকেলটাকে সে পাখির চোখ করে দৌড় শুরু করে। সবাইকে পেছনে ফেলে অনেক আগেই পৌঁছে যায় গন্তব্যে। কুশপাতা থেকে নতুন সাইকেল চালিয়ে সেদিন ঘরে ফেরে। আর দুপুরে না খেয়ে দেয়ে সারা দিনমান আনন্দে ঘুরে বেড়ায় সাইকেলে চড়ে।
যে কোন একটা কাজে ঢুকে পড়বে- মোটামুটি এরকমই একটা ঠিক করে রেখেছিল ভুতু। উচ্চমাধ্যমিকে রেজাল্ট দেখে শিবুদা ভুতুকে একরকম জোর দিয়েই বললে
--বি.এ টা করে নে তুই। এখন সরকারিভাবে তোদের অনেক সুযোগ-সুবিধা। কথায় বলে এস. টি মানে সোনার টুকরো।
শিবুদার জেদেই নাড়াজোল রাজ কলেজে বেঙ্গলী অনার্স নিয়ে ভর্তি হয়। সাথে একটা টিউশনি ধরিয়ে দেয় শিবুদা।মাইনে খারাপ নয় হাতখরচ আর টিউশন ফিসটা তাতে চলে যায়। কলেজমানে একটা নতুন জগৎ। কোনো কিছুই যেন তার সঙ্গে মেলে না। ভরপেট খেতে না পাওয়ার শুকনো চেহারা, কোটরে বসা ম্রিয়মাণ দুটো চোখ, বুকের ভিতর গনগনে ক্ষোভ - এসব নিয়ে নিজেকে সবার থেকে আলাদা করে রাখে। ক্লাস না থাকলে হোস্টেলের পশ্চিমে বট গাছের তলায় বসে থাকে একা।
কিন্তু কলেজ কাউকে একলা থাকতে দেয় না। ইচ্ছে না থাকলেও শালিক জোড়া বাঁধা হয়ে যায়। এমনই কলেজের রঙিন জীবন। মিনতিরও বেঙ্গলী অনার্স। ক্লাস চলার সময় ভুতুর চোখ আপনা থেকেই মিনতির দিকে ঘুরে যায় বারবার। যাত্রার স্টেজের লাইটগুলে থেকে থেকে যেভাবে আপনা থেকেই ঘুরে যায় ঠিক সেভাবে। কিছুতেই সরতে চায় না। মনের মধ্যে কতরকম বদল আজকাল সে অনুভব করে। আশেপাশের সবকিছুই যেন তার ভালো লাগে। ভাগ্যকে আর আগের মতো গালিগালাজ করে না। পেছনের কষ্টের দিনগুলো ভুলতে চায়। বর্ষার বুড়ি গাঙের মত মনের ভেতরে নদীর জল উপচে পড়ে। সেই জল ছুঁয়ে যায় মিনতির মনের অলিগলি। ওরা দুজনেই সানন্দে ডুবে যেতে চায় জলের অলৌকিক তরঙ্গে!
তবে অতলস্পর্শ করার আগেই মিনতির ঘরে জানাজানি হয়ে যায়। মিনতির বিয়ের জন্য ওর বাবা উঠেপড়ে লাগে। স্বজাতি হলেও ভুতুদের চেয়ে মিনতির বাড়ির অবস্থা অনেকগুণে ভালো। মিনতির দাদা প্রাইমারি টিচার। জোর করে মিনতির কলেজ আসা বন্ধ করে দেয় বাড়ির লোক। এমনকি লোকজন নিয়ে এসে মিনতির বাবা ভুতুদের বাড়িতে শাসিয়ে যায়। একলা হয়ে পড়ে ভুতু। ওদের প্রেমের কোন মূল্য নেই, না সমাজের কাছে, না বন্ধু বান্ধবদের কাছে। কেউ পাশে দাঁড়ায় না। শিবুদাও চাকরিসূত্রে অন্যত্র চলে যাওয়ায় ভুতু যেন অসহায় বোধ করে। যদিও রক্তের ভেতর জাতিগত বেপরোয়া উদ্যমতা কিন্তু যৌবনের উচ্ছ্লতাকে পশ্রয় দিতে চায় না সে।অথচ ভুলতেও পারেনা মিনতির পানপাতার মতো নরম মুখের মায়া। সব কথা গুছিয়ে বলতে না পারার মেয়ে চোখের চাহুনি, দু'চোখের তারায় জমে থাকা টলটলে সারল্য। এমন মেয়েকে তো শুধু বুকের কাছে জাপটে ধরে রাখা যায়, চোখের আড়াল হতে দেওয়া যায় না। মিনতির চিঠিগুলো সারারাত ধরে পড়ে ভুতু। আর বালিশে মুখ গুঁজে ককিয়ে ওঠে। অনুভব করে ক্ষুধার যন্ত্রণার চেয়ে প্রিয়জনকে ভুলে থাকার যন্ত্রণা অনেক গুণে বেশি।
মন শক্ত করে ভুতু। হঠাৎ একটা চিঠি তার হাতে এসে পৌঁছায় এক বিকেলে। তাতে শুধু দুটো লাইন-" তুমি আমাকে নিয়ে যেও। তোমার অপেক্ষায় থাকবো"। বারবার লাইন গুলো পড়তে থাকে। শব্দগুলোর গায়ে যেন মিনতির গায়ের গন্ধ লেগে আছে,মিনতির বিকের স্পন্দন লেগে আছে! কি করবে এখন সে? ওদের বাড়ির যোগ্য হয়ে ওঠার আগেই যদি অন্য কেউ মিনতির হাত ধরে নিয়ে যায়! সে নিজেকে ক্ষমা করতে পারবে না! ভেতরে ভেতরে দৃঢ় হয়ে উঠে ভুতু তাকে এবার সত্যি কারের ব্ল্যাক হর্স হতে হবে। দৌড়োতে হবে জীবনের নতুন একটা ট্র্যাকে। যার ফিনিশিং পয়েন্টে অপেক্ষমান একটা নরম মুখ,দুচোখের তারায় জুঁইফুল ভোর।
রেলের গ্রুপ-ডি পরীক্ষায় পাশ করার পর নিজেদের প্রেমকে পয়মন্ত মনে হয় ভুতুর। শুধুমাত্র রানটুকু কমপ্লিট করতে পারলেই ভূতনাথ মুর্মূ পূর্ব রেলের কর্মী হয়ে যাবে। পৃথ্বীরাজ এর মত সবাইয়ের চোখের সামনে দিয়ে সদর্পে সে মিনতিকে নিয়ে আসবে নিজের কাছে। ভুতুর জীবনের সবকিছু নির্ভর করছে কয়েক মিনিটের উপর। ১৬০০মিটার দৌড়াতে হবে ছয় মিনিটের মধ্যে। তাহলেই বিকেলের পিয়ন তার বাড়িতে পৌঁছে দিয়ে যাবে একটা ব্রাউন খাম। আর সেই খামের ভেতর থাকবে জীবন বদলে দেবার জাদুকাঠি।
আগের দিন ভুতু পৌঁছে যায় খড়্গপুরে। কাল শনিবার, সকাল আটটায় মাঠে রিপোর্টিং। অনেকের সঙ্গে প্ল্যাটফর্ম এ রাত কাটিয়েছে সে। কোনরকম ক্লান্তি নেই তার চোখে-মুখে। রাতে ঘুমের ভেতর বার বার ভেসে উঠেছে মিনতির নরম মুখখানা। সকালে তাড়াতাড়ি হাত মুখ ধুয়ে একটা দোকানে চা পাউরুটি খেয়ে অফিসিয়াল ফর্মালিটিস সেরে প্রস্তুত হয় সে। মনে পড়ে স্কুল বেলার খেলার মাঠটার কথা। এখানেও সেদিনকার মত কত ছেলে। তবে এখানে শুধু স্বপ্নের তরিতফাৎ। সবাই যে যার মতো করে মনের ছোট্ট কুটিরে স্বপ্নের মোমবাতিটা কে জ্বালিয়ে রেখেছে। নির্দেশ আসামাত্রই ট্রাকের স্টার্টিং পয়েন্ট দাঁড়িয়ে পড়ে ভুতু। মনে হয় এসময় উত্তম বাবু থাকলে ভালো হতো। তার কাঁধের দুপাশে হাত দিয়ে আলতো চেপে ধরে স্যার যেই বলতেন--" তুই পারবি তোকে পারতেই হবে" অম্নি শরীরে বিদ্যুৎ খেলে যেত! রেডি বলা মাত্রই চমকে ওঠে ভুতু। নিজেকে দ্রুত সামলে নিয়ে চোখ সামনের দিকে ছুঁড়ে দেয়। কানের কাছে চিঠির কথাগুলো অসহায়ের মতো চিৎকার করতে থাকে। চোয়াল শক্ত হয় তার, পায়ের পেশী গুলো টানটান হয়ে ওঠে। এখন মিনতি আর তার মধ্যে দূরত্ব মাত্র ১৬০০ মিটার! মাত্র ছয় মিনিটের দৌড়! শুধু কমান্ডিং এর অপেক্ষায়। তারপর তাকে আর কেউ আটকাতে পারবেনা।
------------------
ছবিঋণ- ইন্টারনেট।