গল্প ।। খোয়াবনামা ।। দেবলীনা দাস
খোয়াবনামা
দেবলীনা দাস
শীতের সকাল। এই বেলা দশটা- সাড়ে দশটা খানেক হবে। দুশো বছরের পুরোনো কেরী সাহেবের এই শ্রীরামপুর কলেজ কমপ্লেক্সের মাঝখানের সবুজ ঘাসের উপর থেকে শিশির এখনও একেবারে মুছে যায় নি। রোদ্দুরের তেজ নেই, ভারী মায়াবি একটা আদুরে রোদ্দুর। সেই রোদেরই এক ফালি এসে পড়েছে জানলা দিয়ে ক্লাসরুমের মধ্যে। থার্ড বেঞ্চের কোনা থেকে অমল মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে আছে সেদিকে। ক্লাস নিচ্ছেন ছাত্রমহলে বদরাগী বলে সুপরিচিত SKC মানে সুদর্শন কুমার চৌধুরী। তিনি ঠিক সুদর্শন কিনা এ বিষয়ে সন্দেহ থাকলেও, বদরাগের বিষয়খানা স্বয়ংসিদ্ধ। অথচ অমলের আজ বিন্দুমাত্র ভ্রুক্ষেপ নেই সেদিকে। সে সাক্ষাৎ ডাকঘরের অমলের মতোই জানলার দিকে হাঁ করে চেয়ে। একটু খুঁটিয়ে লক্ষ্য করলে দেখা যাবে, অমল ঠিক একেবারে জানলার দিকে চেয়ে নেই। বরং চেয়ে আছে জানলা গড়িয়ে যে একফালি রোদ্দুর এসে পড়েছে দুধে আলতা রঙের কপালের উপর নজর না লাগা কালো তিলটা আর তার চারপাশে একগুচ্ছ উড়ন্ত অবাধ্য চুল সেই দিকে। আর তারই ঠিক নিচে ডাগর ডাগর দুখানা নীল চোখের দিকে।
এইখানে হোঁচট খেলেন তো? হ্যাঁ, ঠিকই পড়েছেন- নীল চোখ। কিন্তু বঙ্গললনা, দুধে আলতা, তার উপরে নীলাঞ্জনা - ঠিক হজম হচ্ছে না তো? আরে মশাই - এই শহরটার নাম যে শ্রীরামপুর। এই যে আপনারা পাঁচজন জ্ঞানী গুণী মানুষ রয়েছেন- আপনারা যারা হিস্টিরি জেওগ্রাপী সম্বন্দে এট্টু ওয়াকিবহাল, তারা সক্কলেই জানেন- আমাদের কলকেতাতে কোম্পানী আমল চালু হবার আগেই সাহেবসুবোদের চরণ মানে বুটের ধূলি পড়েছিল এই শহরে। তাই সেই ইউরোপীয়ন বৈশিষ্ট্য এর এক দু - পিস হলোগ্রাম মাঝেসাঝে এখনও দিব্বি দেখা যায় এ শহরে। আরে মশাই, এ হলো জেনেটিক্স! সে যে চার পাঁচ পুরুষ (অথবা নারী) ডিঙিয়ে কোন জনে কি ট্রিক্স করবে, তা দেবা না জানন্তি। আর এখন এই যে ফিজিওলজির ক্লাসখানা তো চলছে- সেও তো জেনেটিক্সেরই। আর তারই মাঝে আমাদের হিরো - অমল বাবাজি বিশ্ব সংসার ভুলে এক্কেরে হাঁ করে তাকিয়ে আছে তার সুধা থুড়ি মধুরিমার দিকে।
হঠাৎ করে ক্লাসখানা যেন একটু বেশিই নিস্তব্ধ। আলপিন পড়লেও শোনা যাবে। ছন্দপতনটা আবছা টের পেয়ে ডুবজল থেকে সাঁতরে বাস্তবে ফিরতেই দেখতে পেল- পড়া থামিয়ে থমথমে মুখে ওর দিকে সটান তাকিয়ে skc আর তার সঙ্গে গোটা ক্লাসও। "ব্লাকবোর্ডটা কিন্তু জানলার দিকে নয়-" ভারী গলার কথাগুলো ভেসে আসতেই ক্লাসরুম জুড়ে হাসির ঢেউ। - "আহঃ, সাইলেন্স সাইলেন্স" -SKC র বকুনি আর বেঞ্চের তলায় আদরের লাথি উপেক্ষা করে- অপ্রস্তুত মুখে মাথার পিছনে হাত বুলাতে বুলাতে অমলের চোখে পড়ল- থার্ড বেঞ্চের কোণেও লাজুক হাসির রেশ। আরে, হাসলে গালে একটা মারাত্মক টোল পড়ে তো! অমলের মনে হল- এতক্ষণের নরম রোদ্দুরটা, হঠাৎ জানলা গলে যেন থাউজেন্ড ওয়াটের আলো নিয়ে আসছে।
ফাইনাল ইয়ারের excursion trip। ফিজিওলজির HOD দীপক রঞ্জন বোস বা DRB, যিনি ডার্বি বলেই পরিচিত, তেনার আবার Off bit এর ঝোঁক। ফর্মাল ট্রাউজারের সঙ্গে florescent sports shoe আর ব্লেজারের সঙ্গে বেগনি মাফলার দেখে দেখে সবাই এতই অভ্যস্ত যে, যখন দীঘা, মুর্শিদাবাদ কিংবা মুকুটমণিপুরের বদলে ডার্বি বললেন- ডুয়ার্স। তখন একটু হোঁচট খেলেও, কেউ প্রতিবাদ খুব একটা করলো না। Afterall ডার্বিই তো! ৪ দিন, ৩ রাত ট্যুর। রাতের বেলায় হোটেলে ষ্টে, দিনভর বাসে দল বেঁধে হৈচৈ, অন্তাক্ষসারি আর তারই মাঝেমাঝে ভোরের আলো মাখা জলঢাকা নদীর তীর, কালিজানি নদীর চড়ায় সূর্যাস্ত, কুয়াশা মাখা জায়গাঁ ভ্যালি ছুঁয়ে অবশেষে ভুটান বর্ডারের থিম্পু।
ট্রিপ শুরুর দিন AC ট্যুরিস্ট বাসের বদলে - রঙের চকলা ওঠা লড়ঝড়ে মিনিবাসখানা দেখে সবার মাথাগরম। সামনের ভালো সিটগুলো মেয়েদের দিয়ে পিছনের স্প্রিংকাটা সিটে বসে ছেলেরা যখন ডার্বির উর্দ্ধতন চোদ্দপুরুষের আদ্যশ্রাদ্ধ করছে, সেই সময় একজনেরই শুধু মুখে কুলুপ। মানে একেবারে স্পিকটি নট- সে আমাদের অমল। আচ্ছা বলুন দিকি - পুরো বাসটাই যদি ঝাঁ চকচকে হতো, তাহলে কি আর মেঘরঙর সালোয়ারের পাশের জানলাটা ওমন বেখাপ্পা আটকে থাকত? আর সেটা খোলার জন্যে বেছে বেছে অমলেরই ডাক পড়তে হতো? এখন যে ওই মেঘরাঙা রঙের ছোঁয়া সবার নজর এড়িয়ে এখনও লেগে রয়েছে অমলের হাতে- এসব আপনার AC বাস হলে হতো?
কথায় বলে প্রেম আর হাম নাকি বেশিক্ষন চেপে রাখা মুশকিল বিশেষত- বন্ধুর কাছে। অমলের এই মুগ্ধ দৃষ্টি, আড় চোখে তাকানো, ঠোঁটে এঁটুলির মতো লেগে থাকা ভিজে হাসি ধরা পড়ে গেল। জায়গাঁ থেকে থিম্পু যাবার ঘন সবুজ ঢাকা রাস্তায় কৌশিক একেবারে পেড়ে ফেলল অমলকে। কিছু কিছু লোক থাকে - একেবারে নিঃস্বার্থ ভাবে, ফ্রী অফ চার্জে জ্ঞান দিতে পারে ঘন্টার পর ঘন্টা। অমলের বন্ধু কৌশিক সেই দলের। উপর্যুপরি দু অক্ষর, চার অক্ষরের স্রোতে অমলকে হাবুডুবু খাওয়াতে খাওয়াতে কৌশিক অতি প্রাঞ্জল ভাষায় মোদ্দা যে উপদেশটি ঝাড়লো- তা হল pratical আর নোটস নিয়ে তো অনেক তো পাঁপড় বেলা হয়ে গেছে গত তিন বছরে- এইবারে হয় এস্পার না হয় ওস্পার করে এগুনো উচিত। সে তো অমলও বুঝছে - কিন্তু....
মাথাপিছু মুন্ডু ট্যাক্স দিয়ে, থিম্পুর মার্কেটে পৌঁছাতে না পৌঁছাতেই সকলে হামলে পড়ে শপিং করতে লেগে পড়ল। যেন আজই পৃথিবী ধ্বংস হতে চলেছে, তার আগেই ভুটান বাজার থেকে ঝটপট কিনে ফেলতে হবে সস্তার পারফিউম, ফোল্ডিং ছাতা, উলের সোয়েটার, ছোটোখাটো ইলেক্ট্রনিক্স। টুকরো টুকরো দলে ভাগ হয়ে সকলে এ দোকান, সে দোকানে ব্যস্ত। খুঁজতে খুঁজতে অমল দেখতে পেলো একখানা পাঁচমেশালি দোকানে ইয়ারিং বাচছে মধুরিমা। গলার কাছটা একটু শুকনো শুকনো ঠেকলেও- দুকানে ভরে ছিল কৌশিকের মধুর বচন। তাই এগিয়ে গিয়ে যথাসাধ্য স্মার্টনেস বজায় রেখে বলল- না, না, ওই ঝুমকোটাই বেশি মানাচ্ছিল তো।
অমলের গলার আওয়াজে একটু চমকে উঠলেও, তৎক্ষনাৎ স্মিতমুখে সামান্য সরে গিয়ে দাঁড়ানোর জায়গা করে দিলো মধুরিমা। আর ঠিক তখনই অমলের চোখে পড়ল ওটা। দোকানের একেবারে শেষের সারিতে উপরের তাকে রাখা......দুধে আলতা রং, নীল চোখ, গোলগাল চেহারা- টুকটুকে একখানা পুতুল। গাল ভরা আভিধানিক নাম নেস্টিং ডল। আরে মশাই, আপনিও দেখে থাকবেন অমন পুতুল। ওই যে সেরামিক দিয়ে তৈরি, পেটের কাছটা খুলে ফেললে ভেতরে একখানা ছোটমাপের পুতুল,তার ভিতরে আরও একখানা। দোকানের তাকে ওমনিধারা পুতুলখানাকে দেখে অমল ভাবল- আরে এ তো অবিকল মধুরিমার পুতুল অবতার, দারুন ব্যাপার। হঠাৎ করে কি মনে করে ঝটপট দাম দিয়ে অমল প্যাক করিয়ে ফেললো পুতুলখানাকে......আর দোকান থেকে বেরোনোর আগে হতভম্ভ মধুরিমার হাতে গুঁজে দিয়ে- "তোর জন্যে" বলেই চম্পট। বাপ্ রে, আজকের জন্যে অনেক কথা বলা হয়ে গেছে তো।
একটা গুমটি দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে, এক কাপ ধোঁয়া ওঠা চায়ে অমল সবে একখানা চুমুক দিয়েছে কি দেয় নি, এমন সময় দেখতে পেল ওদের দাঁড়িয়ে থাকা বাসটার জানলা থেকে মধুরিমা হাত নেড়ে ওকে ডাকছে। থতমত অমল বাসে উঠে দেখে মাথায় গামছা মুড়ি দিয়ে শুয়ে থাকা এক খালাসি বাদে বাকি সবাই তখনও শপিং এ। পাশের খালি সিট খানা দেখিয়ে অমলকে বসতে বলল মধুরিমা। ওর হাতে এখনও সেই পুতুলের প্যাকেট..নেপালি খবরের কাগজে মোড়া সে দিকে ইঙ্গিত করে মধুরিমা বললো- "থাঙ্কস। ছোটবেলায় আমার এই রকমের একটা পুতুল ছিল"। কিছু একটা বলার উচিত এটা বুঝতে পারলেও কি বলবে ঠিক করতে না পেরে অমল বলে বসল - "ভালোই তো, এখন দুটো হলো"। বলেই মনে মনে জিভ কাটলো....."ইশ, এটা একটা কথা হল? এতো unsmart!" নিজের উপর নিজেরই রাগ ধরে।
একটু হেসে মধুরিমা বললো - "তোকে একটা কথা বলার ছিল জানিস, আমার দাদার এক বন্ধু আছে- সোহম। গুরগাঁও তে থাকে, একটা IT কোম্পানিতে আছে। ওরা আমাদের ফ্যামিলি ফ্রেন্ড। আমাদের বাড়ি থেকে arranged, পরের মাসে, মানে পার্ট ২ এর পরীক্ষাটা হয়ে গেলেই সোহম আর আমার ......"
বেশ কয়েক মুহূর্ত সময় লাগল অমলের হৃদয়ঙ্গম হতে, মানে কি বলছে মধুরিমা তা বুঝতে। তারপর জোর করে মুখে একটা হাসি এনে বলল- "বাহ্, এতো খুব ভালো খবর, congratulation. বিয়েতে ডাকিস কিন্তু। নেমন্তন্ন খেতে আমি খুব ভালোবাসি" এই বলে জোর করে সিট থেকে উঠে পড়ল অমল। এর পরে কিই বা আর বলার থাকতে পারে? শুধু একটা তীব্র চিনচিনে ব্যাথা হচ্ছে বাঁ দিকে আর চোখে সব ধোঁয়াধোঁয়া ? এর পরের excursion টুকু আর তার পরের ফাইনাল exam পানসে মানে বেশ নিস্তরঙ্গ ভাবেই কেটে গেলো। ফাইনাল পরীক্ষার পরেপরেই বেশ ধুমধাম করে বিয়ে হয়ে গেলো মধুরিমার। ক্লাস শুদ্ধ সবার নেমন্তন্ন ছিল। অমলেরও ছিল। শুনেছে মধুরিমার বাবা খাইয়েছিল নাকি অঢেল। শুধু কি না সেইদিন অমলের ভীষণ রহস্যময় এক পেট ব্যাথা করছিল বলে বিয়েবাড়িতে যাওয়া হয় নি ওর।
এরপর মাঝে কেটে গেছে অনেক কটা বছর। শ্রীরামপুরের হুগলি নদীতে বয়ে গেছে অনেক জল, বন্ধ হয়ে গেছে বহু জুট মিল। আর টুকটুক করে মাস্টার্স ডিগ্র্রী শেষ করে অমল পাড়ি দিয়েছে বিদেশে, University of Florida তে PHD করতে। অমলের জীবন বয়ে গেছে ক্যারিয়ার এর স্রোতে। মাঝে মধ্যে ফ্লোরিডার সমুদ্র সৈকতে সমুদ্রের রঙের কোনো নীলনয়নাকে রোদ্দুরে শরীর ডুবিয়ে চান করতে দেখে যে মধুরিমার কথা এক আধবার যে মনে পড়েনি তা নয়। পড়েছে....কিন্তু ওই পর্যন্তই। দু একবার ছুটি ছাটায় বাড়ি এলে শুনেছে স্বামী আর বছর চারেকের ফুটফুটে ছেলে নিয়ে মধুরিমার ভরভরন্ত সংসার। ভালো আছে সে।
পিএইচডি টা শেষ করে University of Florida র ই Nano oncology department এ চাকরিটা পাওয়ার পর থেকেই মা একেবারে উঠে পড়ে লাগলেন তড়িঘড়ি অমলকে কন্যাস্থ করার জন্যে। কথায় বলে খুঁজলে ভগবানও পাওয়া যায়। মায়ের আন্তরিক চেষ্টায় অমলের কপালেও জুটে গেল সুছন্দা। রায়পুরের প্রবাসী বাঙালি, বিয়ের আগে বেসরকারি ব্যাংকে চাকরিরত সুছন্দা একেবারে perfectly no nonsence। শুধু মায়ের দুঃখ রয়ে গেলো -রায়পুরের বিয়ের অনুষ্ঠানটার পরেপরেই ভীষণ জরুরি এক কাজে ফ্লোরিডা ফিরে যেতে হওয়ায় বৌভাতের রিসেপশনটা করার সুযোগ হলো না ওদের। সামনের পুজোতে অতি অবশ্যই বাড়ি আসবে মাকে এই ভরসা দিয়ে সুছন্দাকে নিয়ে পাড়ি দিল অমল। নতুন সংসার, আর নতুন চাকরির টানাপোড়েনে মন্দ কাটছিলো না দিনগুলো। দেখতে দেখতে বছর ঘুরে পুজো প্রায় আসে আসে। বাড়ি ফেরার ফ্লাইটের টিকিট দেখা শুরু করেছে.....এমনি একদিন মাঝরাতে মেসেঞ্জার এ বার্তা- "বিয়েতে নেমন্তন্ন করলি না তো। আমিও তো নেমন্তন্ন খেতে খুব ভালোবাসি। তুই ডাকলে - আমার কিন্তু পেট ব্যাথা করত না।" এত বছর পর মধুরিমার কাছ থেকে এমন অদ্ভুত একটা মেসেজ। এর উত্তর কি বা হাত পারে? একটু ভেবে অমল লিখল - "পুজোতে বাড়ি যাচ্ছি। তোরা free থাকলে সবাই মিলে একটা get-together করা যেতে পারে। যা খেতে চাইবি - রেঁধে খাওয়াবো। রান্নাটা ভালোই শিখে ফেলেছি এই কবছরে । "। বেশ কয়েক মিনিট চুপচাপ- তারপর msg " বাড়ি আয়, ভীষণ জরুরি কথা আছে"। ব্যাস, আর কিচ্ছুটি নয় ....logged off।
ফ্লোরিডা থেকে নিউইয়র্ক হয়ে কলকাতা...pakka ২৩ ঘন্টার ফ্লাইট ঠেঙিয়ে, শ্রীরামপুরের বাড়িতে পৌঁছতে ওদের প্রায় মাঝরাত। পরদিন মহালয়া। ঘুম ভাঙলো বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের গলায়, আকাশে সদ্য আলো ফুটছে, বাতাসে ঠান্ডা ঠান্ডা আমেজ, জানলা দিয়ে ভেসে আসছে শিউলি ফুলের গন্ধ। এমন ভোরে ভালোবাসা পাবে এত খুবই স্বাভাবিক। পাশেই ঘুমিয়ে কাদা সুচন্দা। সবে ওকে ডেকে তুলতে যাবে এমন সময় চোখে পড়ল, দেরাজের মাথায় রাখা পুতুলটা। অবিকল সেই নেস্টিং ডলটার মতো দেখতে। তেমনি দুধে আলতা রং, তেমনি নীল চোখ। দেখে ভীষণ অবাক লাগলো। নিশ্চয়ই বোন কোথাও থেকে কিনে এনেছে। অমল বিদেশে যাবার পর থেকে এই ঘরটা বোনেরই তত্বাবধানে থাকে। একটু পরে বেলা বাড়লে জলখাবার সেরে আবার শোয়ার ঘরে ফিরে এসে কিন্তু পুতুলটা আর খুঁজে পাওয়া গেল না। সুছন্দা তো খেয়ালই করেনি। কোথায় বা যেতে পারে এইটুকু সময়ের মধ্যে? খোঁজ নিয়ে জানা গেল ঠিকে ঝি -মালতি মাসি ঘর ঝাঁটিয়ে মুছে দিয়ে গেছে এর মধ্যে। এক যদি সে ঘর পরিষ্কার করতে গিয়ে ভেঙে ফেলে থাকে। মালতি মাসি গোটা পাড়ায় ৮ খানা বাড়িতে টর্নেডোর মতো ঘুরে ঘুরে কাজ করে। বক্রেশ্বরের মানতের চুল কাটার মতো এ বাড়িতে বাসন, তো ওবাড়িতে ঝাঁট, সে বাড়িতে জল ধরা......এমনি তার কাজ। এবাড়িতে সে একরাউন্ড কাজ সেরে দিয়ে গেছে। Next round আবার ঘন্টা দুই পরে। "মালতি মাসি এলে আমায় ফোন করে দিও। আমি নিজে কথা বলব" এই বলে আদ্দির পাঞ্জাবিটা মাথা দিয়ে গলাতে গলাতে অমল বাইরে বেরোল। বাড়ি থেকে দু এক পা যেতেই কৌশিকের সঙ্গে দেখা। এককালের সেই হান্ডসাম কৌশিক এই দশ বছরে অন্তত কুড়ি বছর বয়স বাড়িয়ে ফেলেছে। মাথায় টাক, ইয়া এক ভুঁড়ি, হন্তদন্ত হয়ে কোথায় চলেছে। ওকে দেখে থমকে দাঁড়ালো। "কেমন আছিস?" "কবে এলি" ইত্যাদি প্রাথমিক কুশল মঙ্গল শেষ করার পরেই কৌশিক কথাটা তুলল।
-"খবরটা পেয়েছিস তো?"
- " কোন খবর?"
- ওই মধুরিমার ব্যাপারটা"
- আসার দিন পনেরো আগে কথা হয়েছিল। আর তো কোনও ব্যাপার ঠিক।......
কৌশিক এবার কাঁচুমাঁচু ভঙ্গিতে কিন্তু কিন্তু করে বলল- " ইয়ে, মানে জানি না ঠিক, তুই কেমন ভাবে নিবি কথাটা....মানে একটা সময় তো তুই...."
- "এত ধানাই পানাই করছিস কেন? ঝেড়ে কাশ......"
- "মানে, মধুরিমা কালকে রাত্রে মারা গেছে..."
নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারছিল না অমল......চোখেও ঝাপসা দেখছে যেন সব।
কোন মতে অস্ফুটে বলতে পারল......"কী বলছিস তুই? কী করে?"
- মানে গত বেশ কিছু মাস ধরেই তো ভুগছিল ও। বাইক একসিডেন্টে সোহম চলে যাওয়ার পরেপরেই তো মধুরিমার ক্যান্সারটা ধরা পড়লো। chemo ও চলছিল......আর বোধহয় নিতে পারল না জানিস। আমি তো ওখানেই যাচ্ছি। তুই যাবি? চল না একসঙ্গে যাই।"
কোনোমতে ঘাড় নেড়ে না বলে অমল বাড়ির দিকে ফিরতি পা বাড়াল -
এই তো সেদিন চ্যাট এ কথা হলো......তখনও তো ঘুনাক্ষরেও! একটিবার গিয়ে কি?
ভাবনাটা মাথায় আসতেই নিজের মনে শিউরে উঠল অমল। না না, তা হয় না - সে যে অসম্ভব!......হ্যাঁ সে স্বার্থপর, সে দেখতে চায় না, chemo তে জ্বলে যাওয়া চামড়া, ঝরে পড়ে যাওয়া চুল, রাতের থেকে ফুলে ওঠা মৃতদেহ। বরং স্মৃতিতে রয়ে যাক সেই অপ্সরার মতো নীল চোখ, দুধে আলতা কপালে উড়ন্ত কুচি কুচি চুল.....
প্রায় টলতে টলতে বাইরের গেট খুলে বাড়ি ঢুকল অমল। শরীরটা ভীষণ খারাপ লাগছে.....
মা রান্নাঘর থেকে চেঁচিয়ে জিজ্ঞেস করল- "কিরে ফিরে এলি? মালতি মাসি এসেছে, পাঠাবো? তোর কি খুঁজে পাচ্ছিস না যে কই?
সিঁড়ি দিয়ে দোতালায় উঠতে উঠতে অমল জবাব দিল- "না, তার আর দরকার নেই ....."
মধুরিমা তার "ভীষণ জরুরি কথাটা" আজ ভোরেই বলে গেছে।
---------------------------
ছবিঋণ- ইন্টারনেট।
দেবলীনা দাস
EV 103, Bijananpura Campus, IISc, New BEL Road, RMV-2, Bangalore- 560094