প্রচন্ড শীতের রাতে পাঁচজন মানুষ হেঁটে যাচ্ছে একটা ধূসর পথ দিয়ে। কেউই কোনো কথা বলছে না, কারণ এখানে কথা বলা বারণ। তাই, নিশ্চুপ হয়ে সবাই কেবল পথ চলছে। আশেপাশের সবকিছুও নীরব, শব্দহীন। পাঁচজনের মধ্যে প্রথম আর দ্বিতীয় জনের পরনে শীত নিবারণের জন্য যথাযথ পোশাক রয়েছে। সেগুলি আবার বেশ বিলাসবহুল। তৃতীয় ও চতুর্থ মানুষদের পরনে রয়েছে একদম সাধারণ পোশাক। যা দিয়ে খানিকটা শীত নিবারণ হচ্ছে, কিন্তু প্রয়োজনের তুলনায় হয়তো সেগুলি যথেষ্ট নয়। পঞ্চম মানুষটির পরনে শীত নিবারক প্রায় কোনকিছুই নেই। সে একজন ভিখারী। অসম্ভব শীতের মধ্যে কাঁপতে কাঁপতে সে পথ চলছে। পথটি এঁকে বেঁকে চলে গেছে বহুদূরে। মানুষগুলো জানে, পথের শেষে কোথাও একটা সাদা রঙের দরজা আছে। সেইটাই গন্তব্য। সেই দরজার সামনেই তাদের পৌঁছোতে হবে।
প্রথম রাতে, বিশ্রাম নেবার সময়, মাঝখানে একটা আগুন জ্বালিয়ে, সেটাকে ঘিরে সবাই গোল করে শুয়ে পড়লো। শেষ রাতে, আগুন যখন প্রায় নিভে গেছে, দ্বিতীয় মানুষটির ঘুম হঠাৎ ভেঙে গেলো। সে উঠে দেখলো, প্রথম মানুষটি বেশ আরামেই ঘুমিয়ে আছে। তৃতীয় ও চতুর্থ জন ও ঘুমিয়ে আছে নিজেদের যা কিছু আছে, সেসব গায়ে জড়িয়ে। কেবল পঞ্চম মানুষটি শীতের কামড়ে প্রায় কুঁকড়ে, বেঁকে শুয়ে রয়েছে আর মাঝে মাঝে "উঃ!", "আঃ" করে কষ্টদায়ক শব্দ বের করছে মুখ থেকে। দেখে দ্বিতীয় মানুষটি আর শুয়ে থাকতে পারলো না। সে নিজের ভারী, মোটা বড়ো কোটখানা গা থেকে খুলে পঞ্চম মানুষটির গায়ে ঢাকা দিয়ে দিলো। আরামে একবার "আঃ!" বলে উঠলো মানুষটি। তারপর অচিরেই ঘুমিয়ে পড়লো। দ্বিতীয় মানুষটির গায়ে তখন রইল মাত্র একখানা পাতলা কোট। প্রচন্ড শীত তাতে খুব একটা আটকাচ্ছে না। তবু মনে মনে তৃপ্তি বোধ করলো দ্বিতীয় জন। নিভন্ত আগুনটাকে একটুখানি উসকে দিয়ে পাশ ফিরে শুয়ে পড়লো।
এদিকে, অনেকক্ষণ ধরে জেগে ছিল তৃতীয় মানুষটি। শুয়ে শুয়ে চুপচাপ সবকিছু সে দেখছিলো। দ্বিতীয় মানুষটি শুয়ে পড়তেই সে চুপি চুপি উঠে পঞ্চম মানুষটির গায়ের ওপর ছড়ানো দামী কোটখানা তুলে নিয়ে নিজে পরে ফেললো। ভাবখানা এমন যে, ওই ভিখিরির আবার এইসবের কি প্রয়োজন! ঘুমের মধ্যে কিছুই টের পেলো না পঞ্চম মানুষটি।
সকাল হলে আবার শুরু হলো পথ চলা। দ্বিতীয় মানুষটি তৃতীয় জনের কাছে তার কোটটা দেখে অবাক হয়ে গেলো। কিন্তু কথা বলা যাবে না, তাই কিছুই সে বলতে পারলো না। পঞ্চম মানুষটি মনে মনে ভাবলো, ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে সে স্বপ্ন দেখেছে, একজন দেবদূত এসে তার গায়ে ভারী আরামদায়ক একটা কম্বল জড়িয়ে দিয়েছে।
রাত যত বাড়লো, ঠান্ডাও বেড়ে চললো। এতো শীত যে, পথ চলা দায়। একটা বিরাট বড়ো আগুন ধরিয়ে সবাই তার চারপাশে ঘিরে বসলো। পঞ্চম মানুষটির গায়ে কিছুই নেই। আগুনের সামনে বসেও সে থরথর করে কাঁপতে লাগলো। সবাই সেটা দেখলো। কিন্তু কারো কিছু মনে হলো না। প্রথম জন মনে মনে ভাবলো, "আমার কাছে যা আছে, তা তো আমার নিজেরই প্রয়োজন। অতিরিক্ত কিছু তো আমার নেই। তাহলে আমি কি করবো?" দ্বিতীয় মানুষটি ভাবলো, "আমার পাতলা কোটটাও ওকে দিয়ে দিলে, আমিই বা এই ঠান্ডা সহ্য করবো কি ভাবে?" তৃতীয় জন দ্বিতীয় জনের মোটা কোটটা গায়ে জড়িয়ে ভাবলো, "এটা না থাকলে এই ঠান্ডায় আমার কি হতো?" সে ভুলে গেলো, জিনিসটার ওপর তার নিজের কোনো অধিকার নেই। চতুর্থ জন ভাবলো, আমার যা আছে, তাতে তো আমারই শীত মানছে না। ওকে কি আর দেবো আমি?"
শেষ রাতে, আবার যখন আগুন প্রায় নিভে এসেছে, দ্বিতীয় মানুষটির ঘুম আবার ভেঙে গেলো। সে উঠে পড়ে দেখলো, আগের রাতের মতোই শীতের প্রকোপে কুঁকড়ে শুয়ে আছে পঞ্চম মানুষটি। উঠে দাঁড়িয়ে কাছে এসে দ্বিতীয় মানুষটি দেখলো, গা, হাত, পা ঠান্ডায় অসাড় হয়ে গেছে তার। মুখ দিয়ে কোনো শব্দও আর বের হচ্ছে না। একটা অপরাধ বোধে ভ'রে গেলো দ্বিতীয় মানুষটির মন। তাড়াতাড়ি গা থেকে পাতলা কোটখানা খুলে নিয়ে পঞ্চম মানুষটির গায়ের ওপর জড়িয়ে দিলো সে। তাতেও সাড়াশব্দ দিলো না পঞ্চম মানুষটি। ঘুমিয়ে পড়েছে ভেবে, দ্বিতীয় জন নিজের জায়গায় ফিরে এসে শুয়ে পড়লো। বেশ শীত করছে তার। তবু এখনো গায়ে তার মোটা কাপড়ের জামাটা রয়েছে, এই কথা মনে করে ঘুমিয়ে পড়বার চেষ্টা করলো সে।
এদিকে হয়েছে কি, আগের রাতের সব ঘটনা চতুর্থ মানুষটি চুপচাপ দেখেছিলো। আজ দ্বিতীয় মানুষটি শুয়ে পড়তেই, চতুর্থ জন চুপি চুপি উঠে এসে পঞ্চম মানুষটির গায়ের ওপর থেকে কোটটা তুলে নিয়ে নিজের গায়ে জড়িয়ে নিল। সকাল হলে দেখা গেলো, শীতের প্রকোপে, আগের রাতেই পঞ্চম মানুষটির মৃত্যু হয়েছে। তাকে সেখানেই ফেলে রেখে এগিয়ে যেতে হবে। এগিয়ে গেলো বাকি চারজন মানুষ। শীতের প্রকোপ ক্রমশ বেড়েই চলেছে। দিনের বেলাতেই পথ চলা কঠিন হয়ে উঠেছে এখন। তৃতীয় রাতে আরো বড়ো করে আগুন জ্বালানো হলো। এখন, দ্বিতীয় মানুষটির পরনে মাত্র একটা মোটা জামা। সেই জামার পক্ষে এই শীতের মোকাবিলা করা অসম্ভব। পঞ্চম মানুষটির মতোই শীতে কাঁপতে থাকলো সে। তারই দুই পাশে তারই শীতবস্ত্র পরে আরামে ঘুমিয়ে রয়েছে তৃতীয় আর চতুর্থ জন। অবাক হয়ে এইসব ভাবতে ভাবতে কখন একসময় ঘুমিয়ে পড়লো দ্বিতীয় মানুষটি।
**
সাদা দরজাটার সামনে পৌঁছে দ্বিতীয় মানুষটি দেখলো, পঞ্চম মানুষটি আগে থেকেই সেখানে তার জন্য অপেক্ষা করছে। রোগের নিস্প্রভতা কেটে গিয়ে দীপ্তিতে জ্বলজ্বল করছে সে। দ্বিতীয় জনকে দেখে সে তার হাত বাড়িয়ে দিলো। তখনই খুলে গেলো সাদা দরজাটা। সামনেই স্বর্গ! দ্বিতীয় মানুষটি অবাক হয়ে মনে মনে ভাবলো, মাত্র একটা শীতবস্ত্র দানের জন্য এই মানুষটি স্বর্গে পর্যন্ত প্রবেশ করেনি! তার জন্য অপেক্ষা করে আছে। এও কি সম্ভব? মনে মনে পঞ্চম মানুষটি ভাবলো, নিজের কষ্টকে তুচ্ছ করে যে অন্যকে ভালো রাখতে চায়, তার মতো মূল্যবান আর কিই বা হতে পারে! দুজনে দুজনের মনের কথা বুঝতে পারলো। পরস্পরের প্রতি বন্ধুত্বের হাসি হেসে, হাত ধ'রে দুজনে ভেতরে প্রবেশ করলো। দূর থেকে ভেসে আসা ঘন্টাধ্বনি একসাথে শুনতে পেলো তারা!
--------------------------------------------