গল্প ।। অভদ্র!! ।। সান্ত্বনা ব্যানার্জী
অভদ্র!!
সান্ত্বনা ব্যানার্জী
কি বাজে জায়গায় বাড়িটা নেওয়া হয়েছে বাবা! ঘরে বসে থেকেই যত সব বাজে লোকের মুখ খারাপ শুনতে হয়!.....খুব বিরক্ত গলায় বলে রিমি।অফিস যাওয়া আসার পথে বাবা মাকে দেখাশোনার সুবিধের জন্যই এখানে বাড়িটা নেওয়া হয়েছে সেটা ভুলে যায়।আর অবাক হয়ে দেখে যে লোকটার বিরুদ্ধে ওর এতো অভিযোগ সেই লোকটাই তরতর করে বাবার ঘরে ঢুকে এলো!.....এই জাম কয়টা রাখেন কাকা, এই মাত্র বাজারে দেখতি পেয়ে কিনে নিলাম।সেদিন খুঁজছিলেন না!বহুত ভালো জেতের জাম গুলো,খুব মিষ্টি!....বলেই জামের ঠোঙা টা বাবার সামনে নামিয়ে দিয়ে আবার তেমনই তরবর করে চলে গেলো। রাস্তার উল্টো দিকেই ওর মনোহারী জিনিসের দোকান।বাবা আমতা আমতা করে বলে......নারে,একটু মুখ খারাপ করে বটে,তবে মনটা ভালো,খুব উপকার করে,খোঁজ খবর নেয়।এটা ওটা বাজার থেকে এনে দেয়।.....আরও রেগে যায় রিমি......তবু একটা ক্লাস নেই!ওই ধরনের লোক যখন তখন বাড়ির মধ্যে চলে আসবে!..... গজ গজ করতে থাকে রিমি।বাবা ওকে থামানোর চেষ্টা করে.....যাক গে, ছাড়, চা খাবি তো?তোর মা চা করছে। বিস্কুটের কৌটো টা বাড়িয়ে ধরে সামনে। আপাতত থেমে যায় রিমি,কিন্তু মন থেকে সরাতে পারেনা একটা চাপা অস্বস্তি।তারা শিক্ষিত পরিবার,এখানে সবাই তাদের চেনে,কত নামী দামী মানুষ বাবার কাছে আসে,গল্প করে,গান শোনে।মাঝে মাঝেই গানের আসর বসে বাড়ীতে। এর মাঝে ওই লোকটা বড়ো বেমানান! কথায় কথায় ব কারান্ত, শ কারান্ত ওর চলতেই থাকে। কোনদিন বাড়ীর মধ্যেই বলে দেবে তার ঠিক নেই।না,না,একটু আধটু উপকার করে বলে এই সব লোককে বাড়ীতে আসতে দেওয়া মোটেই ঠিক নয়।....নে চা খা,কি।ভাবছিস এত?.....মায়ের কথায় চমক ভাঙে রিমির।চা খেতে খেতে বলে.....না গো,ওই দোকানের লোকটা ,কি মুখ খারাপ করে কথা বলে,তাকে তোমরা এত পাত্তা দাও কেন বুঝিনা!মা বলে.....ও অজিত? তা কি করবো বল,সামনেই থাকে,দোকান ফাঁকা থাকলে আসে,একটু চা খায়,তোর বাবার কিছু দরকার পড়লে এনে দেয়,বাড়ী থেকেও এটা ওটা এনে খাওয়ায়।এখানে কোনো খারাপ কথা বলেনা,তবে দোকানে বলে, শুনতে পাওয়া যায়।......তবে আর কি!শোনো বসে বসে।....গজ গজ করতে করতে ব্যাগ কাঁধে তুলে বেরিয়ে পড়ে রিমি।স্টেশনের পথে হাঁটতে থাকে। বড়ো অসহায় লাগে। নিজের বাড়িতে এনে রাখার উপায় নেই, একখানা ঘর,আর এক চিলতে বারান্দা ঘিরে ওদের দুজনের মত ছোটো করে সাজানো সংসার ওখানে......।আবার ওই পরিবেশে বাবা মাকে রাখতেও বড়ো খারাপ লাগে,অকালে চলে যাওয়া ভাইয়ের কথা বড্ড মনে পড়ে! ও বেঁচে থাকলে বাবা মা কে এভাবে ভেসে ভেসে বেড়াতে হতো না।তবুও এই ব্যবস্থা করা ছাড়া আর কোন উপায় নেই।বাড়িটার পজিশন খুব ভাল,স্টেশন, ব্যাংক,পোস্ট অফিস ডাক্তার ,সব কাছাকাছি। আর অফিস যাতায়াতের পথে দেখাশোনা ও করা যায় সাধ্য মত।ওদের বাড়ির পজিশন সে দিক থেকে মোটেও সুবিধের নয়।সব কিছুই দূরে দূরে,মোটর সাইকেলে যেতে হয়।তাই বাইরের সব কাজই করতে হয় অনিন্দ্য কে।এমন কি রিমিকে স্টেশনে দিয়ে আসা,নিয়ে আসা পর্য্যন্ত।আজ অনিন্দ্য না থাকায় ওকে স্টেশন থেকে হেঁটে হেঁটে-ই আসতে হলো।ঘরে ঢুকে টেবিল থেকে জলের বোতলটা নিয়ে ঢক ঢক করে অনেক টা জল খেয়ে ফেলে রিমি। তার পরই শুরু হয়ে যায় কাজ।ব্যাগ থেকে টিফিন কৌটো নামিয়ে রাখে সিংকে,এখুনি বন্দনা এসে পড়বে আর ঝড় এর বেগে কাজ শুরু করে দেবে।কাপড় ছেড়ে ফ্রেশ হয়ে টিভিটা খুলে একটু গা এলিয়ে দিয়ে বসে ডিভান টায়। অনিন্দ্য ফিরে এসে ফ্রেশ হয়ে বসে ওর পাশে।দুজনকে দু কাপ চা দিয়ে যায় বন্দনা।এই সময় টুকু বিশ্রাম নিতে নিতে একটু টিভি দেখে দুজনে।কিন্তু দেখবেই বা কি!একটা ভালো কোনো প্রোগ্রাম আছে! সিরিয়াল গুলো তো.... শুধু দল বাঁধা বাঁধি,চক্রান্ত,সম্পত্তি নিয়ে বিবাদ,বিষ খাওয়ানো, এই সব। একটু যা ভালো লাগে রাসমণি ,বড়ো
ভালো করছে রাসমণি আর রামকৃষ্ণ! আর সকালের গানের অনুষ্ঠান।তাও বিজ্ঞাপনের ঘটা!ক,টা গান ই বা শোনা হয়!আট টা তেই রান্নাঘরে ঢুকে পড়ে রিমি। রাতের রুটি আর তরকারি করে নেয়।তারপর সকালের রান্নার যোগাড় করে রাখে।ক,দিন থেকেই বাবা মায়ের জন্য একটু রাইস আর পনীর করে নিয়ে যাওয়ার কথা ভাবছে, হয়ে আর উটছে না।কালকে সকাল সকাল উঠে করতেই হবে।কিচেনে দেরাদুন রাইস, কাজু,কিসমিস, ঘী,গরম মশলা সব গুছিয়ে রাখে। বিনস,গাজর সরু সরু করে কেটে ট্যাপার এ ভরে ফ্রিজে ভরে রাখে। পনীর সবজি হালকা করে ভেজে রেখে দেয়,সকালে সুবিধে হবে।রাতের খাবার টেবিলে নিয়ে খেতে বসে দুজনে।আরও সব টুকি টাকি কাজ সেরে হাত মুখ ধুয়ে টানটান করে চুল বেঁধে মুখে ক্রিম ঘষতে থাকে রিমি।এই টুকু বিলাসিতা না করে ও ঘুমোতে পারে না।আর সারাদিনের পর নরম পাফ দিয়ে ওর পিঠে পাউডার মাখিয়ে দেয় অনিন্দ্য।এই আদর টুকু বড়ো উপভোগ করে রিমি,সারাদিনের সব ক্লান্তি যেন.......,ঘুমের অতলে তলিয়ে যায় নিশ্চিন্তে!
সকালেই আবার কাজ শুরু। নিজেদের জন্য মাছের ঝোল ভাত করে নিয়ে বাবা মায়ের জন্য রান্না করতে লেগে যায় দ্রুত হাতে। হট পটে ভরে নেয়,রাইস,পনীর। আগের দিন করে রাখা পায়েস আর চাটনী টাও ভরে নেয় ব্যাগে।..... কি গো তাড়া তাড়াতাড়ি করো, ট্রেন পাবে না কিন্তু।.....মোটর সাইকেল বার করতে করতে বলে অনিন্দ্য। সব গুছিয়ে গেট এ চাবি দিয়ে বেরিয়ে আসে রিমি,মোটর সাইকেলের পিছনে বসতে বসতে বলে...... দেখো,আবার সে বারের মত আমাকে না নিয়েই স্টেশনে চলে যেও না।....
মুচকি হেসে গাড়িতে স্টার্ট দেয় অনিন্দ্য।বাড়তি ব্যাগটা নিয়ে ট্রেনের দরজার কাছে দাঁড়িয়ে পড়ে
রিমি,দুটো তো মাত্র স্টেশন।প্ল্যাটফর্ম থেকে নেমে পাশের সরু গলি পথ টা ধরে হাঁটতে শুরু করে ও।গরম গরম রাইস আর পনীর পেয়ে বাবার মুখটা কেমন খুশিতে ভরে উঠবে এটা ভেবেই বড়ো আনন্দ হয় রিমির।গলির শেষ প্রান্তে এসে থমকে দাঁড়িয়ে পড়ে রিমি!ওকি!বাবার বাড়ির সামনে অত চিৎকার করছে কে!দ্রুত পা চালিয়ে এগিয়ে যায় রিমি। দেখে পাশের বাড়ির অরুণ বাবু চিৎকার করে বাবাকে কি যেন বলছে!
বাবা কেমন অসহায় ভাবে দাঁড়িয়ে আছে।মা ভয়ে ভয়ে বলল....দেখনা,ওই ডাবের খোলা গুলো কারা অরুণ দের নাচে ফেলে গেছে আর ও তোর বাবাকে দোষারোপ করে শুধু শুধু অপমান করছে। চারি দিকে তাকিয়ে কেমন হতবাক হয়ে যায় রিমি!রাস্তার দু ধারে মানুষ জন দাঁড়িয়ে আছে পুতুলের মত!একজন প্রবীণ মানুষকে এভাবে অপমান করছে কারও কোনো প্রতিবাদ নেই!হটাৎ সবাই অবাক হয়ে দেখে মনোহারী দোকানের সেই মুখ খারাপ করা অজিত বীর বিক্রমে এগিয়ে আসছে!কিছু বুঝে ওঠার আগেই বাবাকে ঘরে ঢুকিয়ে খাটের ওপর বসিয়ে দিয়ে তার স্বভাব সিদ্ধ ভঙ্গিমায় অরুনের ঘাড় ধরে ওরই দরজায় চেপে ধরে আর চিৎকার করতে থাকে......আর একবার ওই বুড়ো মানুষটার ওপর হম্বি তম্বী করে দেখ,তোকে কিকরি আমি!ভেবেছিস পিতিবাদ করার কেউ নেই!শা.........।কোনো কথা না বলেই ঘরে ঢুকে যায় অরুণ।আর হতবাক রিমিকে হাত নেড়ে বলে অজিত......আপনি যান দিদি অপিস পানে, নিছিন্তে,আমি আচি,কুনো ভয় নাইকো। ও কাকীমা দুকাপ চা করি দ্যান দিকি,আমি আর কাকা খাই।......আবার গলা উচিয়ে বলে.....আর এদিক পানে এলি ঠ্যাং খোঁড়া করি দিবো!ভেবেছো বুড়ো মানুষ কে যা খুশি বলা যায় লয়!
.....এতক্ষনে সম্বিত ফিরল রিমির। মায়ের হাতে খাবার দাবারের ব্যাগটা দিয়ে অস্ফুটে বলে.... সব গরম আছে,এখনই খেয়ে নাও,আর অজিত দাদাকে দিও!
--------------------
সান্ত্বনা ব্যানার্জী,