গল্প ।। পিকনিক ২০২২ ।। স্তুতি সরকার
'হ্যাপি নিউ ইয়ার ২০২২। ' - চেঁচিয়ে উঠলো সমবেত কন্ঠে সকলে। জম্পেশ শীতের সকালে পিকনিকে চলেছে দল বেঁধে ডায়মণ্ডহারবার- ঢাকুরিয়ার পাড়ার সকলে জোট বেঁধে। পাড়াটা ঢাকুরিয়ার অভিজাত মুখার্জি পাড়া। মুখার্জি বাড়ির কাকু কাকিমা প্রতি বছরই এই পিকনিকের উদ্যোক্তা। এ বছর সকলেই ভেবেছিলো পিকনিকটা বোধহয় আর হবেনা। একে তো করোনা আতঙ্ক, তার ওপর আবার মুখার্জি কাকু মাস আস্টেক আগে মারা গেছেন সামান্য জ্বরে আক্রান্ত হয়ে ভুল ট্রীটমেনট এ। কিন্তু কাকিমাই সকলের মুখ চেয়ে পিকনিকটা বন্ধ করতে বারণ করেন। সকলেই মহা উত্সাহে প্রতিবারের মতো হইহল্লা, চিৎকার চেঁচামেচি করে পাড়া মাতিয়ে একটা ম্যাটাডোর আর একটা বাস বোঝাই করে সেই কোন ভোর থাকতে স্টার্ট করলো। হঠাৎই কিছু সময়ের মধ্যে পাড়াটা জেগে উঠেই আবার যেন গভীর ঘুমে অচেতন হয়ে পড়লো।
বাসে তখন ঘুম ভাঙ্গানো গান চলছে , আর চা বিস্কুট পরিবেশন করে চলেছেন পাড়ার বেঁচুদা। ওনাদের নাম করা ক্যাটারিং বিসনেস আছে। তবে পাড়ার পিকনিকে লাভ এর ব্যাপার নেই। শুধু আনন্দ করতেই যাওয়া।
ডায়মণ্ডহারবার পৌঁছে সকলে হই হই করে বাস থেকে নেমে পড়লো। বড়ো ছোটো সকলে সতরঞ্চিতে, কেউ বা চেয়ারে এসে বসলো। একটা বাড়ী বুক করা হয়েছিলো পিকনিকের জন্য। কেউ বাড়ীর ভিতরেও একবার ঢুঁ মেরে এলো। ঠাকুররা কড়া হাতা খুন্তি ইত্যাদি নিয়ে রান্নার জন্য নির্দিষ্ট জায়গায় চলে গেলো। এখানে রান্নার জন্য পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন ব্যবস্থা আছে। এমন কি কিছু টাকার বিনিময়ে গ্যাসএর চুলা সিলিন্ডারের ব্যবস্থাও রয়েছে।
আবার এক প্রস্থ চা সঙ্গে অল্প কিছু স্ন্যাক্স এসে পড়লো। বেয়ারা বলে গেলো লুচি ভাজা আরম্ভ হয়ে গেছে। এসে পড়লো বলে। পাশেই টলটলে জলের বড়ো পুকুর । তবে ২রা ফেব্রুয়ারি- খুব ঠাণ্ডা। হাড়ে কাঁপুনি ধরে যাচ্ছে।
জল খাবার খাবার পরে সকলেই একটু যেন ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়লো। অল্প বয়সীরা অনেক খেলার সরঞ্জাম এনেছিল। যে যার মতো খেলতে আরম্ভ করলো। বড়োরা কিছুটা তদারকি করে এসে যে যার মতো গল্প গুজবে মন দিলো। মুখার্জিদার প্রসঙ্গ ও উঠলো। সকলেই দুঃখ প্রকাশ করতে লাগলো। এই কি যাবার বয়স! মহিলাদের মধ্যে কেউ কেউ আবার উল কাঁটাও নিয়ে এসেছেন। হাত চলবার সঙ্গে সঙ্গে গল্প গুজবও চলতে থাকে। ক্রমে ক্রমে লাঞ্চ টাইম আগত। বাচ্চারা টায়ার্ড হয়ে কিছুক্ষণ আগেই সতরঞ্চিতে কুপোকাত। আরোও ছোটোদের মায়েরা খাবার খাইয়ে দিয়েছে। ছেলেদের আর মেয়েদের গ্রুপ তখন জমে গেছে। ছড়িয়ে ছিটিয়ে সকলে গল্প গুজবে মশগুল। তারই মধ্যে ২ জোড়া ছেলে মেয়ে বেশ দূরে দূরে বসে গল্প গুজবে ব্যস্ত বাকী সকলের চোখ বাঁচিয়ে!
দারুণ জমলো দুপুরের খাওয়াটা। এবার খানিকটা রেস্ট। পাড়ার নতুন বৌ কমলিকা গান ধরলো সকলের অনুরোধে। খুব সুন্দর গলাটা। গায়কীও প্রশংসা দাবী রাখে। ধীরে ধীরে উত্তুরে হাওয়া বেশ জোরে বইতে আরম্ভ করলো। জায়গাটা এখন ভাঙা হাটের অবস্থা মোটামুটি। সকলেই গরম জামা কাপড় পরে নিজের নিজের জিনিস গুছিয়ে নিতে আরম্ভ করল। চুল আঁচড়ে সেজে গুজে নিতে নিতেই আর এক প্রস্থ চা বিস্কুট দিয়ে গেলো। রান্নার জিনিস পত্র ম্যাটাডোরে ওঠানো হয়ে গেছে। এবার বাসে ওঠার পালা। বাড়ীর বড়োরা নিজের নিজের বাড়ীর সদস্যদের বাসে উঠিয়ে নিশ্চিন্ত। এবার কিন্তু বসার সীটের অদল বদল ঘটেছে। বাচ্চারা একেবারে পিছনের দিকে গিয়ে চেল্লামেল্লি, গান, কবিতা পাঠ- বড়োরা ইচ্ছা মতো ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসেছে। বাকী টীনএজ দল হইহই করতে করতে বাড়ী ফিরছে। দিনটা যেন কোথা দিয়ে পার হয়ে গেলো। চিৎকার চ্যাঁচামেচি এখন প্রশমিত। ফিসফিসিয়ে নিজেদের মধ্যে এখন দু চার কথা- বাচ্চারা ঘুমিয়ে কাত। প্রবীণ মানুষেরাও ঢুলছেন। বাসের ভিতরের লাইট নিবোনো। ফাঁকা রাস্তার মধ্যে দিয়ে বাসের ছুটে চলা- কথা ক্রমশঃ ফুরিয়ে আসছে। ক্লান্তিতে সকলেরই চোখ জুড়িয়ে আসছে..
অবশেষে পাড়ার মধ্যে গাড়ী এসে পৌঁছেছে। এখন প্রায় মধ্য রাত্রি। এখন ঘুম ভেঙে সকলের জেগে ওঠা। বাড়ি এসে গেছে সবার।
'আসছে বছর আবার হবের প্রতিশ্রুতি দিয়ে এখন যে যার ঘরে ফেরার পালা।
।।সমাপ্ত।।