আলাদিনের প্রদীপ
সোমা চক্রবর্তী
গলির মুখে আশ্চর্য প্রদীপটা হাতে নিয়ে আলাদিনের সেই প্রদীপের দৈত্যটা দাঁড়িয়ে থাকে, এ কথা এখন সবাই জানে। কিন্তু সকলেরই বিবেচনাবোধ বদলে গেছে একালে। তাই কেউ আর প্রদীপখানা সাধ করে নিজের ঘরে নিয়ে যেতে চায় না। ফলে প্রদীপের দৈত্যের সময় এখন ভালো যাচ্ছে না। সবাই জানে, রূপকথার গল্পের শেষটা কখনো বলা হয় না। আলাদিনের সব সমস্যার সমাধান করে দিয়েছিলো ওই আশ্চর্য প্রদীপটা। কিন্তু তারপর? তারপর কি হলো, তা আর কোথাও বলা হয়নি। রূপকথার গল্পে সব সমস্যার সমাধান হয়ে গেলেও, মানুষের জীবন রূপকথার গল্প নয়। সেখানে সমস্ত জীবনটাই মানুষকে যাপন করতে হয়। তাই সমাধান হয়ে যাওয়া সমস্যাগুলো আবার ফিরে আসে। আবার নতুন সমস্যার সম্মুখীন হতে হয় মানুষকে ধারাবাহিক ভাবে। তাই বলছিলাম, রূপকথার গল্পের শেষটা কখনো বলা হয় না।
সে যাই হোক, প্রদীপের দৈত্যের সময় এখন ভালো যাচ্ছে না। এই তো সেদিন, বাজার করতে গিয়ে চোখে পড়লো, আমাদের পাড়ার রামকমল জেঠু মাছওয়ালা নিমাইয়ের অমন রূপোর মতো চকচকে বড়ো বড়ো ইলিশগুলো আড়চোখে দেখতে দেখতে, আচমকা মুখ ঘুরিয়ে জগন্নাথের কাছে গিয়ে, খান চারেক তেলাপিয়া মাছ কিনে বেজার মুখে থলেতে ভরে ফেললো। প্রদীপের দৈত্য যে সেখানেই ঘুরঘুর করছিলো, আগে আমার নজরে পড়েনি। হঠাৎ দেখি, সে রামকমল জেঠুর কানে কানে ফিসফিস করে বলছে,
- জেঠু, আপনি একবার বললেই কিন্তু আসল পদ্মার ইলিশ আপনার বাড়িতে একেবারে রান্নাঘরে সেঁধিয়ে যাবে। তাও ডিমভরা। ভেবে দেখুন।
রামকমল জেঠু তাড়াতাড়ি তেলাপিয়া মাছ ভরা বাজারের থলেটা বগলদাবা করে ধরে, নাক সিঁটকে বলে উঠলেন,
- আরে ছোঃ। আমার আর গিন্নীর দুজনেরই বড্ড আমাশার ধাত। বুঝলে কিনা? ইলিশ মাছ আমাদের কাছে যাকে বলে কিনা বিষ।
বলেই আর কোনো দিকে না তাকিয়ে, হনহন করে হেঁটে বাড়ির দিকে চলে গেলেন।
আমাদের পাড়ার রাস্তায় ছোলা, মুড়ি আর বাদাম শুকনো খোলায় ভেজে বিক্রি করে যে ভজনদা, সেই ভজনদা নাকি একবার দৈত্যের কথা শুনে লোভে পড়ে প্রদীপটা বাড়িতে নিয়ে গিয়েছিলো। কিন্তু মাত্র এক সপ্তাহের মধ্যেই তার একেবারে পরিত্রাহি অবস্থা। দেখা গেলো, হন্যে হয়ে ভজনদা দিনরাত কেবল দৈত্যকে খুঁজে চলেছে। এদিকে দৈত্য মহাশয়ের দেখা নেই। যেন হাওয়ায় মিলিয়ে গেছে একেবারে। ভজনদার তো যাকে বলে একবারে পাগলের মতো অবস্থা। পাড়ার সবাই মিলে ভজনদাকে নানারকম ভাবে জিজ্ঞাসাবাদ করে অবশেষে জানা গেলো, প্রদীপ নিয়ে বাড়ি যাবার পর থেকে ভজনদার সুখশান্তি সব ভোজবাজির মতো উধাও হয়ে গেছে। এতদিন ধরে ওদের অভাবের সংসারে বউকে নিয়ে আর দুই ছেলেমেয়েকে নিয়ে বেশ সুখেই ছিল ভজনদা। সেই কোন ছোটবেলায় বিয়ে হয়েছিলো ওদের। এতো কষ্ট, টাকাপয়সার এতো টানাটানি, তবু ভাব-ভালোবাসার অভাব ছিল না এতটুকুও। অথচ, প্রদীপের দৌলতে অভাব-অনটন দূর হতে না হতেই, ভজনদার মাথায় নাকি দুর্মতি জাগতে শুরু করেছে। এখন তার সেই চিরদিনের 'খোকার মা' তার কাছে পুরনো আর বুড়ি বলে মনে হচ্ছে। বাইরের দিকে নজর চলে যাচ্ছে তার। আর খোকার মাও উঠতে বসতে ভজনদাকে সন্দেহের চোখে দেখছে। আর সন্দেহের চোখে দেখবে নাই বা কেন? ভজনদার যে কুনজর পড়ছে যার তার ওপর। কিন্তু, এতকাল অভাব-অনটনের মধ্যে তো এইসব উপদ্রব ছিল না! তাই ভজনদা প্রদীপটা ফেরত দিয়ে দিতে চায়। বড়লোক হতে চায় না ভজনদা। শুধু তার আধবুড়ি বউ আর ছেলেমেয়েদের নিয়ে আগের মতো সুখে থাকতে চায়।
কিন্তু বললে কি হবে? যার প্রদীপ, তার তো দেখা নেই। ফেরত দেবে কাকে? শেষ পর্যন্ত অনেক কষ্ট করে, পাড়ার ডাক সাইটে উকিল মধুসূদন নন্দীর বুদ্ধি কাজে লাগিয়ে, অনেক ফন্দি ফিকির খাটিয়ে দৈত্যকে খুঁজে এনে, তাকে প্রদীপটা ফেরত দিয়ে, তবে ভজনদার শান্তি হলো। মধুসূদন দাদাকে দু'হাত তুলে আশীর্বাদ করতে করতে হাসি মুখে বাড়ি ফিরে গেলো ভজনদা। সেই থেকে প্রদীপের দৈত্যের অবস্থা আরো চরমে পৌঁছে গেছে। আগে যাও বা দুয়েকজন দুয়েকটা কথা বলতো ওর সঙ্গে, এখন তো দেখা হলেই সবাই মুখ ঘুরিয়ে তাড়াতাড়ি করে চলে যায়। ফলে প্রদীপের দৈত্যের অবস্থা এখন আরো মন্দা হয়েছে।
**
আমি ছোটখাটো একটা অফিসে চাকরি করি। একটা বহুতল বাড়ির দোতলায় একটেরে একখানা ঘরে মা-মেয়ে থাকি। আমার একমাত্র লক্ষ্য আমার মেয়েকে লেখাপড়া শেখানো, ভালোভাবে মানুষ করে তোলা। বড়লোক হতে আমার মোটেও ইচ্ছে করে না। তাই প্রদীপের দৈত্যকে দেখে আমার ভয়ও করে না। দোকান বাজার বা অফিস যাতায়াতের পথে লোকটাকে আমিও দেখি। গলির মুখটায় কাঁদো কাঁদো মুখ করে দাঁড়িয়ে থাকে।
দুদিনের বৃষ্টির পর সেদিনও আকাশ যথেষ্ট মেঘলা। ঝোড়ো হাওয়ার সাথে গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি পড়েই চলেছে। রাস্তাঘাটে লোকজন বেশী নেই। বাসে ট্রামে ভিড়ও নেই তেমন। অফিস যাবার সময় একটা সরকারী বাসে উঠে দেখি, বাসটা প্রায় ফাঁকা। জানলার পাশের একটা সিটে বসে, ব্যাগ থেকে এ মাসের 'কবিতাপত্র' পত্রিকাখানা বের করে আনমনে পাতা ওল্টাচ্ছি, শুনলাম পাশ থেকে কে যেন বললো,
- আজকাল সাহিত্য, সিনেমার মান অনেক নেমে গেছে, তাই না?
অবাক হয়ে তাকিয়ে দেখি, আমার পাশের সিটেই দৈত্য বসে আছে আর আমার দিকে তাকিয়ে মৃদু হাসছে। তাড়াতাড়ি মনে মনে অনেক কিছু ভেবে নিলাম। মনে মনে একটু কৌতূহলও হলো। লোকটা তো নিতান্তই পরাবাস্তব। শিল্প-সংস্কৃতি আর আধুনিক সাহিত্যের কথা কতটুকু জানে? আর জানলোই বা কিভাবে? তাছাড়া আমি তো ওর কাছ থেকে কোনো সুযোগ নেবো না। কারণ, টাকাপয়সার প্রতি আমার কোনো লোভ নেই। হঠাৎ করে বড়লোক হতে চাই না আমি। তাহলে সামান্য কথা বলতে দোষ কি? দেখাই যাক না, শেষ পর্যন্ত কি বলে! তাই মনে মনে খুব সাবধান হয়ে, ওপরে শান্ত ভাব বজায় রেখে ওকে জিজ্ঞেস করলাম,
- আপনি এখনকার দিনের শিল্প, সাহিত্যের কথা জানলেন কি করে?
লোকটা মুখ ভার করে উত্তর দিলো,
- না জেনে উপায় কি, বলুন? দেখছেন তো আমার অবস্থা। কেউ ঠেকেও কথা বলে না আমার সঙ্গে। কথা বলা তো দূরে থাক, সবাই আমাকে দেখলেই ছুটে পালাতে চায় ভয়ে। এরকম চলতে থাকলে আমার অস্তিত্বই একদিন বিপন্ন হয়ে উঠবে। দৈত্যগিরি তো খোয়াতেই বসেছি প্রায়।
তা বটে! যার যা কাজ, তা খোয়ানো বড় বেদনার। দেখলাম লোকটা খবর রাখে অনেক কিছুরই। কোথায় কার লেখা কবে বেরিয়েছে, কোন সিনেমার কিরকম জনপ্রিয়তা- সব নিয়ে বেশ গুছিয়ে আলোচনা করছে। একসময় লোকটা বললো,
- আচ্ছা, অন্যের এইসব লেখা না পড়ে, ইচ্ছে করে না আপনার নিজের লেখাগুলো প্রকাশ করতে?
চমকে উঠলাম। আমার লেখার কথা এ জানলো কেমন করে? বরাবর মনে মনে ভেবেছি, আমি সাহিত্যিক হবো। কবি হবো। আমার লেখার মধ্যে দিয়ে সমাজের বিবেক জাগ্রত হবে। বলা বাহুল্য আমার একটা কবিতাও কখনো কোথাও ছাপা হয়নি। তবে, আমার লেখার সবচেয়ে বড় পাঠক হলো আমার কন্যা। নামী কলেজে ইংরেজীতে অনার্স নিয়ে ভর্তি হয়েছে আমার মেয়ে। সাহিত্যে অনুরাগ আমার থেকে ওর বেশী ছাড়া কম নয়। ওই তো আমাকে উৎসাহ দেয়। সবসময় বলে, "মা, তুমি খুব ভালো লেখো। তোমার লেখাই আমার সবথেকে বেশী ভালো লাগে। দেখো, একদিন তোমার সব লেখা ছাপা হবে।"
চুপ করে আছি দেখে দৈত্য আবার বললো,
- আচ্ছা, আপনি চান না, আপনার নিজের লেখাগুলো এই পত্রিকার পাতায় প্রকাশিত হোক? সবাই আপনার নাম জানুক। আপনাকে চিনুক?
মনে মনে চিৎকার করে বললাম, "চাই, চাই। অন্তত একবার হলেও চাই আমার লেখা কবিতা নামী পত্রিকার পাতায় প্রকাশিত হোক।"
দৈত্য আবার বললো,
- আপনি চাইলেই কিন্তু আপনার সব স্বপ্ন সত্যি হতে পারে। এই পত্রিকার আগামী মাসের সংখ্যাতেই প্রকাশিত হতে পারে আপনার লেখা। একবার ভেবে দেখুন।
ভেবে দেখে, সিদ্ধান্ত নিতে তিনদিন লাগলো। দৈত্যকে বললাম,
- লেখার বিষয় ছাড়া আর কোনো বিষয়ে কিন্তু আপনার সাহায্য নেবো না আমি।
- সেটা আপনার বিবেচনা। প্রদীপ যতক্ষণ আপনার কাছে থাকবে, আপনার সব ইচ্ছে পূরণ করতে বাধ্য থাকবো আমি।
প্রদীপটা সাবধানে আমার অফিসের আলমারিতে রেখে দিলাম। এই কথা আর কেউ জানলো না। এমনকি আমার মেয়েও না। পরের মাসে আমার লেখা কবিতা নামী পত্রিকার পাতায় প্রকাশিত হলো। তারপর আর একটা। আরো একটা। আমার সব পুরনো লেখা প্রকাশিত হয়ে গেছে নানা পত্রপত্রিকায়। বেশ কিছু উপন্যাস বই হিসেবে বেরিয়েছে। এখন আমি লেখক হিসেবে যথেষ্ট পরিচিত একজন মানুষ। পত্রিকার পাতায় লেখা প্রকাশিত হওয়া এখন আর আমার কাছে নতুন কিছু নয়। এখন আমি যথেষ্ট রকম আত্মবিশ্বাসী, অহঙ্কারী আর আঁতেল হয়ে উঠেছি। এখন আমার 'লেখার মাধ্যমে সমাজের বিবেক জাগ্রত করা'র সেই মহৎ উদ্দেশ্য আর মনে পড়ে না। এখন আমি খ্যাতি আর উচ্চাশার স্বপ্নে সবসময় বিভোর হয়ে থাকি। আগে কতো সময় ধরে যত্ন করে, পড়াশোনা করে, অনেক প্রস্তুতি নিয়ে এক একটা লেখা লিখতাম। এখন আর অতো সময় কোথায়? এখন প্রচুর লেখার চাহিদা। তাই যতো তাড়াতাড়ি সম্ভব, লিখে ফেলি। তাছাড়া, এখন আমি বিখ্যাত। যা লিখবো, তাই ছাপা হবে।
এখন আমার ইচ্ছে হয়েছে কিছু পুরস্কার অর্জন করার। সেই কথাই দৈত্যকে জানালাম একদিন। মাঝারি মানের কয়েকটা পুরস্কার এসে গেলো। একটা বেশ বড়ো পুরস্কারও পেলো আমার একটা উপন্যাস। এবার আমার সবচেয়ে বড়ো পুরস্কারটা চাই, চাই-ই।
পুরস্কার ঘোষণার দিন সকালে ঘুম থেকে উঠেই খবরের কাগজের খোঁজ করতে লাগলাম। এতক্ষণে তো ফোনের ঘন্টায় সারাবাড়ির জেগে ওঠার কথা! অভিনন্দন জানিয়ে ভক্তদের পাঠানো ফুলের তোড়ায় ভরে ওঠার কথা আমার এই ছোট্ট ফ্ল্যাট! কিন্তু সবকিছু এতো চুপচাপ কেন তাহলে? ফ্ল্যাটের বাইরের দরজার হাতলে সেদিনের দৈনিক পত্রিকাটা আটকানো ছিল। হাতে নিয়েই প্রথম পাতাটা খুলে দেখলাম। পুরস্কার প্রাপকদের নাম প্রকাশ করা হয়েছে। সেখানে আমার নাম নেই। প্রচন্ড রাগে সর্বাঙ্গ জ্বলে উঠলো। গরম হয়ে গেলো মাথা। চিৎকার করে মেয়েকে ডাকলাম। আমাদের ফ্ল্যাটের চিলতে বারান্দাটায় বসে পড়াশোনা করছিলো মেয়ে। আমার ডাকাডাকিতে ভেতরে চলে এলো। ওকে বললাম কি অবিচার করা হয়েছে আমার প্রতি। পুরস্কারটা দেওয়া হয়নি আমায়। সব কথা শুনে শান্ত গলায় মেয়ে বললো,
- পুরস্কারটা তুমি পেলেই আমি অবাক হতাম, মা।
- কি বলছিস এসব তুই?
- ঠিকই বলছি। কখনো নিজে পড়ে দেখেছো, আজকাল কি সব লেখো তুমি?
- কিন্তু গত মাসেই তো অতবড়ো একটা পুরস্কার পেলাম আমি।
- ওটা তোমার আগেকার লেখা, মা। এখন কি আর ওইরকম লেখা লিখতে পারো তুমি?
কথাগুলো বলে নিজের ঘরে চলে গেলো মেয়ে। ওকে কলেজে যাবার জন্য তৈরী হতে হবে। স্তব্ধ হয়ে সেখানেই বসে রইলাম আমি। একসঙ্গে অনেক কিছু পাবার আশায় যে আমার একমাত্র পাঠক, যে আমার লেখার সত্যিকারের ভক্ত, আমার মেয়ে, তাকেই আজ হারিয়ে ফেলেছি আমি। এতকাল ধরে প্রদীপের দৈত্য অন্য সকলের যে ক্ষতি করেছে, শেষ পর্যন্ত আমারও সেই ক্ষতিটাই করে ফেললো!
-------------------------