গল্প ।। শুরুর সেদিন ভয়ংকর ।। অরবিন্দ পুরকাইত
– দাও।
তারপর হঠাৎ এক নিদারুণ নৈঃশব্দ্য! স্তব্ধ সংসার, নৈশ চরাচর। উত্তর ছিল ভিন্ন ভুবনাগত। অতি পরিচিত কণ্ঠস্বরে।
সেই অতি সংক্ষিপ্ত প্রশ্নোত্তর এবং তজ্জনিত হঠাৎ-স্তব্ধতার পর কিয়ৎক্ষণ। তারপর চেনা লম্ফর দীর্ঘ পরিচিত স্বল্প আলোকে সন্তর্পণে কেবল এগিয়ে আসে একই চালের চামচভরা ভাত। উভয় সীমান্তেই।
গদা যকোন নিজে চাইত, বলত 'একটু'। আগে বলত 'এট্টু', যেমন বৃন্দা বলে আজও। তকোন তো ও এট্টুখানি ছেল। যকোন কোলবর গেল দাদার সোঙ্গে, কত আর বয়েস ছেল! – বড়জোর বচোর-বারো-তেরো। টুম্পা আর তপন ওরই পিটোপিটি পরপর। তা শাউড়ি-বউয়ে আন্নাবান্না, খেতি দাওয়া। বিশেষ করে সন্দেয়। কেন-না বলতি গেলি সন্দেতেই সবাই একসোঙ্গে খাওয়া। সকালে পান্তা যে যকোন পারে খায়, যে-যার বেড়ে নেয়। ইস্কুলির দিনি বা ছুটির-দিনি খেলাধুলোর ঝাঁজে থাকা ছাবালপোনেদের, বিকেলে বাড়িই ফিরে খাওয়া আকা-ভাত বেড়ে নে। তো যকোন বিন্দার হাতে খাওয়া, বৈদি, এট্টু ভাত। 'দে' বলত না অবশ্য, 'দাও'। তা সেই এট্টু ককন এট্টু এট্টু করে 'একটু' হয়ে গেল! চোকির সামনে এট্টু এট্টু করে ককোন বড় হয়ে গেল গদা! নেকাপড়া শিকে চাগরি-বাগরিনা পেয়ে গদাধর এট্টা ভুসিমালের দোকান দেল। বাড়ির গায়। মা-বাবা, ভাইবোনের সোঙ্গে সোঙ্গে বৈদিকেও পুজোয় শাড়ি। পরে সেটা সরে এল বোশেকের পয়লায়। ভাইপো-ভাইজিদের কিন্তু বড় পুজোতেই। তাদের নে পড়াতি বসা। তোমরা বলো, কান করবেনে কতায়; আর কাকা বলুক, নেইপে নেইপে ছুডবে বইপত্তর নে! তা ছোটখাটো বেবাদ-বেসংবাদ কি আর ছেলনি! – সে আর কোন সোংসারে না থাকে! তার বাইরি কে বলবে সৎ শাউড়ি – দেওর-ননদের সোঙ্গে সোংসার বিন্দার! পাড়ার নোকে বরং তাদের দেইকে বলত, তোরা এগ্ মার পেটের ভাইবোন এরম কত্তিচিস আর দেগগে্ দেন ওরা সদ্ ভাইবোনেরা কেরোম কুলুচ্চে! শুনে কি কোম ভাল নাগত! দোকান নেহাত খারাপ চলতেছেনে, বচোর-দশেক পর বে করল গদাধর। বচোর-তিন-চার না যেতি যেতি কী যে হল সব! এগ,দিনি কি আর সব হয়, আগে থেকেই উকু হয়ে ছেল। তাও ওই চলতেছেল কোনও অকমে। যাক, সেসব কতা বলে আর কী হবে, কোন সোংসারে আর জানতি বাকি আচে! সবচেয়ে খারাপ নেগেছেল ঝকোন বলল সব, আমরা নাকি গুইচে নাওয়ার জন্যি এক সোংসারে আচি! মেয়ের বে দিতি হবে। তা গুইচে তোরা নিসনি! নেকাপড়া সোংসারে থেকে হয়নে! দোকান কত্তি পাত্তিস! দাদা সোংসারে ওরম না খাডলি নিশ্চিন্তে নেকাপড়া কত্তি পাত্তিস! তাহলি!
যেমন সন্তর্পণে এগিয়েছিল, তেমনই সন্তর্পণে পশ্চাদপসরণ করে চামচ। হাতের নঞর্থক ইশারায়। উভয় চামচই। ঢুকে যায় পরিচিত ছোট দুই হাঁড়িতে। পাশাপাশি প্রশ্ন উঠতে চায় দু-দিকে – বৃন্দা ও তার শাশুড়ি সুবর্ণর গলায়, কেন নিবিনি! দু-দিকেই কেঁপে যায় কণ্ঠ। উত্তর কি অজানা! অশীতিপর কর্তা ভবানী ভাতই খায় রাতে, আজ খিদে নেই। গেল না রান্নাঘরে। ভাত খাবে না, বৃন্দা জোর করে একটু মুড়ি দিয়ে এল দাবায়। সেক'টি নিয়ে নাড়াচাড়া – অথচ মাথা গোঁজা কেবল মুড়ির বাটিরই দিকে! একবার কি দীর্ঘশ্বাসের সঙ্গে ফোঁপানি বেরিয়ে এল একটু! অন্যদিকে, কাকলির বেড়ে-দেওয়া ভাতের বেশির ভাগটা তুলে দিয়ে, ক'টা ভাত নিয়ে সুবর্ণর চাকুর-মাকুর; কয়েক বার চোখে শাড়ির খুঁট উঠতে উঠতে – শেষে নিজেই উঠে যাওয়া! ছোট-বড় আজ যেন সবাই খাওয়ায় খুবই মগ্ন, অথচ এমন মগ্নতা সত্ত্বেও এ কেমন আধাখেঁচড়া ভোজন! যাদের হাতে ভর করে ভরা-ভাত চামচরা এগিয়ে এসেছিল সন্তর্পণে, ভালই হল – সেই বৃন্দা ও কাকলির শেষে আর খেতে বসতে হয় না! সবাই জানে, বলে কোনো লাভ নেই। নিজেদের দৃষ্টান্তে বলার আর মুখ নেই কারো। হাঁড়িতে জলঢালা সাঙ্গ হলে, এঁটোকাঁটা-সহ বাসনকোসন নিয়ে লম্ফ-হাতে খানিক আগে-পরে উভয়েই রওনা দেয় ঘরের পুকুরের উদ্দেশে।
একটি আলোর উঠে আসার আভাস পেয়ে অন্য আলোটি এগোয় পুকুরের দিকে। প্রথম আলোটি দ্বিতীয় আলোকে পাশ কাটিয়ে যাওয়ার সময় উপর থেকে গোটাতিনেক বাটি-গেলাস মাটিতে পড়ে যায়। একটু পেছিয়ে ঘাটের কাঠের উপর থালাবাসনগুলো রেখে, পড়ে-যাওয়া বাটি-গেলাস ক'টি ধুয়ে নিতে হয়। চারিদিকের বাঁশ-তেঁতুল-আম-আশস্যাওড়া ইত্যাদির মধ্যেকার জমাট অন্ধকারের পটভূমিতে দুটি মানুষের ছায়া-ছায়া মূর্তির দুই বিপরীত দিকে কম্পমান ক্ষীণ দুটি আলো। কত গল্প ছিল এই ঘাটের, আজ নীরব! প্রথম আলোটি উঠে যাচ্ছে। ফাগুন বাতাসের কী ছিল মনে – হঠাৎ সে খানিক জোরজবরদস্তি করে পুকুরে নেমে নিভিয়ে দেয় ক্ষীণ লম্ফালোক। উপরে উঠতে-থাকা আলোটি থমকে যায়। একটু ইতস্তত ভাব। হাতের বাটি-গেলাস ক'টি স্থাপিত হয় থালাবাসনের উপর। তারপর উপরের আলোটির হঠাৎ ধীরে ধীরে নিচের দিকে নেমে আসতে দেখা যায়! নিভে-যাওয়া পলতেকে যখন প্রজ্জ্বলিত পলতেটি স্পর্শ করতে যাচ্ছে, নিচের মানুষটির হাত শাড়ি ছুঁয়ে তড়িঘড়ি আর একটু বাড়িয়ে দেয় পলতেটি। এগিয়ে-আসা আলোটি স্পর্শে জ্বালিয়ে দেয় দ্বিতীয়টিকে। দ্রুততায় কাজ সেরে এক ঝটকায় সোজা হতে গিয়ে হঠাৎ প্রথম আলোটিও যায় নিভে! আর দেরি না করে, প্রথম আলো দ্বিতীয়কে স্পর্শ করে প্রজ্জ্বলিত হয়ে, ধাপে ধাপে উঠে যায় গৃহাভিমুখী।
* * *