প্রবন্ধ।। সাহিত্যে রম্যরচনা ।। রণেশ রায়
আজের শিক্ষিত সমাজে বলা হয় যে বাংলা সাহিত্যে 'রম্য রচনা'র সূত্রপাত ঘটে ইংরেজি Belles letters শব্দ ধরে। ফরাসি ভাষায় রম্য রচনার প্রতিশব্দ Belles lettres । এর ইংরেজি মানে হল fine letters । বাংলা করলে দাঁড়ায় সুন্দর অক্ষর সমাবেশ। তবে আমরা মনে করি যে কোন ভাষাভাষী মানুষের মধ্যে পরস্পর ভাব বিনিময়ে যে সহজ সরল কৌতুক বোধ ব্যঙ্গ হাস্য রস তার চরিত্রে অঙ্গাঙ্গীভাবে যুক্ত থাকে তার থেকেই সূত্রপাত ঘটে রম্য রচনার।এমন কি আনুষ্ঠানিক লিপি আবিষ্কারের আগেও কথপকথনে মুখে মুখে যে সাহিত্য চালু ছিল ছড়া করে সুর করে গানের মাধ্যমে তার মধ্যেই রম্যরচনার সূত্র খুঁজে পাওয়া যায়। আনুষ্ঠানিকভাবে এটা স্বীকৃত লিপিবদ্ধ সাহিত্যে রূপ পায় পরে যার উদ্ভবের সূত্র Belles letters বলে মনে করা হয়। কার্যত লোক সাহিত্যের মধ্যেই সাহিত্যের অংশ হিসেবে রম্য রচনার সূত্র পাওয়া যায় সুপ্রাচীন কাল থেকে । আমরা আজও প্রত্যন্ত অঞ্চলে মুখে মুখে যে লোকগাঁথা শুনি তার মধ্যে অফুরন্ত রম্য রচনার মৌলিক উপাদান পাই।
ফরাসি সাহিত্যিক মোতেনকে ইংরেজিতে Belles lettres এর পথিকৃত বলে মনে করা হয়। একই কারনে আধুনিক বাংলা সাহিত্যে কালীপ্রসন্ন সিংহকে তাঁর অনবদ্য লেখা 'হুতোম প্যাঁচার নক্সা' রচনার জন্য বাংলা সাহিত্যে রম্যরচনার পথিকৃৎ বলা চলে। আবার অনেকে সঞ্জীব চন্দ্র চট্টোপাধ্যায়কে তাঁর 'পালামৌ' ভ্রমণ সাহিত্যের জন্য এ সম্মানে ভূষিত করার পক্ষপাতি। বঙ্কিমচন্দ্র লিখিত 'কমলাকান্তের' দপ্তর এ ধরনেরই একটি উপহার বাংলা সাহিত্যে। এছাড়া বাংলা সাহিত্যে যে সমস্ত লেখক রম্যরচনা লেখায় বিশেষ কৃতিত্বের অধিকারী তাঁদের মধ্যে অগ্রগণ্য হলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, বলেন্দ্রনাথ ঠাকুর, বীরবল, যাযাবর, বিরুপাক্ষ, সৈয়দ মুজতবা আলি, সুনন্দ, বুদ্ধদেব বসু, রূপদর্শী প্রমুখ ।
কোন সাহিত্যিক তাঁর সাহিত্যকর্মকে রমনীয়তা, খেয়ালি কল্পনা আর কৌতুক পূর্ণ হাস্যরসের দ্বারা সমৃদ্ধ করে তোলেন তাঁর রম্যরচনায়। তা গল্পের মাধ্যমে কবিতার মাধ্যমে বা ছড়ার মাধ্যমে হতে পারে। এটা কোন বিষয় সম্পর্কে সাহিত্যিকের মননের এক বিশেষ ধরনের পরিবেশন, শিল্প নৈপূণ্যে সৃষ্টি যা হাস্যরসে রসসিক্ত। রম্য কথাটি ধরে তার মানে ধরে স্থূল অর্থে বলা হয় সাহিত্যে কোন রচনা সামগ্রিক বিচারে রমণীয়ভাবে পরিবেশন করলে তাকে রম্যরচনা বলা যেতে পারে। কোন বিষয়কে সাহিত্যিকের ব্যক্তিগত মননের সাহায্যে হাস্যরসে সমৃদ্ধ করে পরিবেশন করা হয় রম্য রচনার মাধ্যমে। সেই দিক থেকে একে সাহিত্যিকের ব্যক্তিগত রচনা বলে অনেকে মনে করেন । যে রচনা সর্বাত্মক বিচারে রমণীয় বা মনোরম, তাকে ব্যাপক অর্থে রম্যরচনা নামে অভিহিত করা হয়।তবে রম্য সাহিত্যকে নেহাত ব্যক্তিরচনা ভাবলে ভুল হয়।রম্য রচনায় বস্তুজগতের ঘটনাকে কেন্দ্র করে লেখক তার মননের রঙে রাঙিয়ে তাকে হাস্যরস কৌতুক রসে সিক্ত করে গল্প কবিতা ছড়া বা প্রবন্ধের মাধ্যমে উপস্থিত করেন শিল্প গুণের সমাবেশ ঘটিয়ে ।
সাহিত্যে রম্য রচনা
সাহিত্যে রম্যরচনার ভূমিকা বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ।এ ধরনের রচনা যেমন কৌতুকপূর্ণ হতে পারে তেমনি এ ধরনের রচনায় সাহিত্যিকের গভীর জীবন বোধ সূক্ষ শৈল্পিক নৈপুণ্যে আপাত লঘু আবহে পরিবেশিত হতে পারে। রম্য রচনা সাহিত্যের ভান্ডারকে বাড়িয়ে তোলে, সাহিত্যশিল্পকে এক অভাবনীয় উচ্চতায় পৌঁছে দেয়। সাহিত্যিক আর পাঠকের মধ্যে এক অভাবনীয় মেলবন্ধন সৃষ্টি করে।
মজলিসের মেজাজে সাহিত্যিক ও পাঠকের মধ্যে খোলামেলা নিবিড় বন্ধুত্বের সম্পর্ক বজায় রেখে আপাত লঘু সরস উপস্থাপনের মাধ্যমে সাহিত্যের আঙিনায় কিছু রচিত হলে তাকে রম্য রচনা বলা হয়। অনেকে মনে করেন গভীর ভাবনা বর্জিত অনানুষ্ঠানিক ঘরোয়া মেজাজে লঘু হাস্যরসাত্মক বন্ধনমুক্ত পরিবেশনই রম্যরচনার প্রধান বৈশিষ্ট্য। এ ধরনের রচনায় কোন গভীর তত্ত্ব কথা প্রকাশের প্রয়াস থাকে না বলে অনেকে মনে করেন। পাণ্ডিত্য প্রদর্শনের তাগিদ দেখা যায় না বলে মনে করা হয়।দৈনন্দিন জীবনের সহজ ও মজাদার বিষয়কে কৌতুক ছলে প্রকাশ করা হয় রম্য রচনায়।সাহিত্যের অঙ্গনে তার বিভিন্ন অঙ্গ তথা গল্প কবিতা ছড়া প্রবন্ধের মধ্যে দিয়ে রম্য রচনা রচিত হতে পারে। স্যামুএল জনসন বলেন,
'Loose Sally of mind which is an irregular undigested piece and not regular or orderly composition.'
আমরা স্যামিউয়েল এর মতের সঙ্গে একমত নই। সে ব্যাপারে পরে আসছি।
অনেকে ব্যক্তিগত প্রবন্ধ আর রম্যরচনার মধ্যে পার্থক্য নির্দেশ করে একটাকে আরেকটা থেকে পারস্পরিক বিচ্ছিন্ন দুই বিপরীত মেরুর বিষয় বলে মনে করেন।তাঁদের মতে ব্যক্তিগত প্রবন্ধে সাহিত্যিকের নিজের মননের চাষ বিশেষভাবে গুরুত্ব পায়।সেখানে সাহিত্যিকের হৃদয়বেগ বড় কিন্তু তাঁর ভাবনাকে যুক্তি ভাবনার এক সুশৃঙ্খল মননশীলতার আয়নায় তুলে ধরা হয়। এই ভাবনা অনুযায়ী রম্যরচনার এমন কোন দায় থাকে না। তা অনেক বেশি মুক্ত পরিবেশে কৌতুকপূর্ণ ভাবে এমনকি প্রগলভ পথে প্রকাশ করা হয়। তবে আমরা ব্যক্তিগত রচনা আর রম্যরচনার মধ্যে এ ধরনের আনুষ্ঠানিক বিভাজনে বিশ্বাসী নই বরং মনে করি মানুষের জীবন বোধ তাকে যুক্তি বর্জিত না রেখে সুচারুরূপে মজায় মজলিসের আবহে তুলে ধরা, উভয়ের মধ্যে মেল বন্ধন ঘটানো সাহিত্যিকের এক অসাধারণ শিল্প কর্ম।
রম্য রচনার ইতিকথা আলোচনা প্রসঙ্গে শ্রীশ চন্দ্র দাসের নাম উঠে আসে তাঁর ১৯৪০ সালে লেখা 'আমার বই' নামক বইটির জন্য যেটা সম্পর্কে ড: শ্রীকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় লেখেন,
''মানুষের মন অনেক সময় গুরুভার সমস্যা ও অবশ্য পালনীয় কর্ম্ম পদ্ধতির চাপ হইতে মুক্ত হইয়া কল্পনা বিলাস ও দিবা স্বপ্নে বিভোর হইতে চাহে। শরতের আকাশে যেমন লঘু মেঘখণ্ডগুলি উদ্দেশ্যহীনভাবে মন্থর গতিতে চলাফেরা করিতে থাকে সেইরূপ আমাদের চিত্তাকাশেও অনেক লঘু চিন্তা ও রঙিন রস-কল্পনার উদ্ভব হয়—প্রবন্ধকার সেগুলিকেই ভাবসূত্রগত ঐক্য দান করিয়া মানুষের বিশিষ্ট মনোভাবের সহিত গ্রথিত করিয়া তাহাদিগকে রস-সাহিত্যের বিষয়ীভূত করেন। অধ্যাপক শ্রীশচন্দ্রের রচনাগুলি এই শ্রেণির–তিনি তাঁহার প্রবন্ধগুলিকে বুদ্ধিগত আলোচনার বিষয় না করিয়া তাহাদের মধ্যে কল্পনার লঘু প্রবাহ ও মৌলিক দৃষ্টিভঙ্গি সঞ্চারিত করিয়া সন্ধর্ভগুলিকে বিশেষ উপভোগ্য করিয়াছেন।"
বাংলা সাহিত্যের এই বিশেষ অঙ্গ রম্যরচনা তার গভীরতা ও প্রসারে যে ব্যাপ্তি লাভ করেছে তা বোঝা সম্ভব নয় রম্যরচনা সম্পর্কে সঠিক দৃষ্টিভঙ্গি না থাকলে। সাহিত্যের নিজস্ব আঙ্গিকে রম্যরচনা তার নিজস্ব ভংগিতে আজ বহমান। সাহিত্যের আঙিনায় হাস্য কৌতুক আর চেতনার গভীরতা যে একটা মোহনায় সঙ্গমে লিপ্ত হতে পারে সেটা আজকে রম্যরচনা প্রমাণ করেছে।তাই একে নেহাত স্থূল হাস্যরসে কৌতুকে আর ভারামিতে সিক্ত তা ভাবার কারণ নেই। এ যেন এক স্রোতস্বিনী নদী নিজস্ব সাবলীল ভঙ্গিতে বয়ে চলে। সাহিত্যের পুষ্প স্তবকে একটা বিশেষ ফুলের সৌরভ ছড়ায় যা সাহিত্যকে নতুন মাত্রা দেয়।
যদিও রবীন্দ্রনাথ স্বয়ং কিছু ভালো রম্য রচনা সৃষ্টি করেন রম্য রচনার সম্পর্কে তাঁর দৃষ্টি ভঙ্গির মধ্যে একটা ঋণাত্বক দৃষ্টিভঙ্গি ধরা পড়ে। তাঁর মতে রম্য রচনার বড় গুন তার ভাব শূন্যতা।তাঁর মতে ছোট গল্পের মত রম্য রচনাতেও শেষ হয়ে না হইল শেষ ধরনের একটা রেশ পড়ার পর থেকে গেলেও তা যেন অন্তর্সার শূন্য বাজে বকা। যেমন স্যামুয়েল বলেন।অর্থাৎ হালকা মেজাজে মজলিসের আবহে ভাবনার গভীরতা প্রকাশ করা যায় না। তিনি তাঁর 'বাজে কথা' প্রসঙ্গে আলোচনায় এটা তুলে ধরে কার্যত রম্য রচনাকে পরোক্ষে হলেও সাহিত্যের নিকৃষ্ট ধরন বলে মত পোষণ করেন।আধুনিক বাংলা সাহিত্যে রম্য রচনা যে গভীরতা ও ব্যাপ্তি পেয়েছে তার সঠিক মূল্যায়ণ সম্ভব নয় রম্য রচনা সম্পর্কে এই ঋণাত্বক দৃষ্টিভঙ্গি থাকলে। সাহিত্য হাস্য রস আর রমনীয়তায় সিক্ত না হতে পারলে তা সম্পূর্ণতা লাভ করতে পারে না। জীবন যুদ্ধে লিপ্ত মানুষ ক্লান্তি আর যান্ত্রিক জীবনের একঘেমিয়তার মধ্যে একটু বৈচিত্র চায় যা আপাত লঘু হাস্যরসে সিক্ত অথচ তা ভাবনার গভীরতায় শিকড় ছড়াতে পারে। সেটা দেয় আজকের যুগের রম্য রচনা যা নেহাত বাজে কত্থা অন্তর্সার শূন্য নয়।
আমরা রম্য রচনা সম্পর্কে উক্ত ঋণাত্বক দৃষ্টি ভঙ্গির সঙ্গে একমত হতে পারি না। এ ব্যাপারে আমি সংক্ষেপে আমার মত তুলে ধরছি।
(Ref: © 2022 ‧ Million Content. All Rights Reserved)
Read at: https://bongo-lyric-shayari.blogspot.com/2020/05/blog-post_25.html?m=1
Copyright ©
মনে রাখা উচিত আপাতভাবে রম্য রচনা হালকা মজাদার ভারমুক্ত তত্ত্ব নিরপেক্ষ বলা হলেও খুব শৈল্পিক নৈপুণ্যে হালকা মজার আড়ালে গভীর কথা বলা হয় অনেক রম্য রচনায়। রচনায় আপাত হাসি তামাশার আড়ালে কান্নার রোল এক গভীর বিরহ বেদনা শোষনের মর্মর ধ্বনি ধ্বনিত হতে পারে। তাই তাকে নেহাত ভাবনা মুক্ত কৌতুক হাস্যরসে সিক্ত ভাবার কারণ নেই।অনেক গভীর ভাবনা তত্ত্বকথা পরিবেশিত হতে পারে আপাত লঘু কৌতুক ছলে। পশ্চিমী শিল্প জগতে চার্লি চ্যাপলিন তাঁর অভিনয়ে রম্য রচনা জগতের এক অবিস্মরণীয় নাম। তাঁর প্রতিটি অভিনীত চরিত্রে রম্য রচনাকে তুলে ধরা হয়েছে হাস্য কৌতুকের মাধ্যমে। আর সত্যজিৎ রায় স্বমহিমায় বাংলা বাংলা শিল্প সাহিত্য চলচ্চিত্র জগতে রম্যরচনা রূপকার। সমাজের গভীর সমস্যা উঠে এসেছে তাঁর অভিনয় শৈলীতে। আর সাধারণত গল্পের প্রসাধনে রম্যরচনা সজ্জিত বলে মনে করা হলেও কবিতা ছড়া প্রবন্ধের মাধ্যমে খুব সুক্ষভাবে রম্যরচনা পরিবেশিত হতে পারে। তাছাড়া নাটক চলচ্চিত্র রম্য রচনা পরিবেশনের উচ্চ মার্গের মঞ্চ। সৈয়দ মুজতবা আলী শিবরাম চক্রবর্ত্তী সঞ্জীব চ্যাটার্জী এমনকি রবীন্দ্রনাথের এমন অনেক লেখার মধ্যে আমরা এই ধরনের রম্যরচনা পেয়ে থাকি। আমি নিচে আমার একটা কবিতায় রম্যরচনায় ভাবের গভীরতাকে হালকা মজলিসের ছলে বুনে তোলার চেষ্টা করেছি:
যদি তোমার সঙ্গে চলি
সবাই বলে, চললি কোথা !
ওটা যে কানা গলি।
যদি তোমায় কিছু বলি
সবাই বলে, বললি কাকে !
ওটা যে কালা কলি।
যদি তোমার হাত ধরি
সবাই বলে, ধরলি কাকে ?
ওটা যে বদের ধাড়ি ।
যদি তোমার প্রেমে মজি
সবাই বলে, মজলি কোথায় !
ওকেই তো সবাই খুঁজি।
যদি তোমায় দিই মান
সবাই বলে, দিলি কাকে !
ওটা যে অপাত্রে দান ।
যদি তোমায় ডাকি কাছে
সবাই বলে, ডাকিসনারে
যদি কামড়ে দেয় পাছে।
যদি তোমায় বরি গোড়ের মালায়
তৎক্ষণাৎ তা শুকিয়ে যায়
গড়াই আমি ধুলায়।
তবু আমি তোমায় বলে যাই
যে যাই বলুক
আমি তোমার সাথেই বাই
শুকোক না সে মালা
আমার তোমার সঙ্গেই ঠাঁই।
নিচে আমি আমার লেখা একটা ছোট গল্প তুলে ধরছি রম্য রচনা হিসেবে।
ঘ্রাণেন অর্ধ ভোজন
পরিচয়হীন নাম না জানা এক অখ্যাত মানষু । কখন ময়দানে ষ্টেডিয়ামের বাইরে থেকে রেম্পাডে দাঁড়িয়ে খেলা দেখে বা কখনো রেড রোড ধরে হেঁটে চলতে দেখা যায়।। আবার কখনও তাকে দখা যায় ভিক্টরিয়া মেমরিয়াল হলের উঠোনে। সে চরকির মত ঘুরে বড়ায়। তাকে যমন কেউ চেনে না সেও কাউেক চেনে না। যেন এক মুসাফির। থাকা খাওয়া পোশাক কিছুরই ঠিক নেই। বিশেষ কেউ জানে না তার বাড়ী কোথায়, সে কেন এ ভাবে ঘুরে বড়ায়। আর সবাই যারা রাস্তায় বার হয় তাদের কাজ আছে, আছে বাড়ী ফেরার তাগিদা। প্রতিটি মুহূর্ত তাদের কাছে দামী। তবে এই চরকিবাবুর অবাধ সময় তাই তার কাছে সময়ের দাম শূন্য । নেই কিছুর জন্য ভাবনা তাই ব্যস্ততাও নেই। তাও তার তাড়া। কোন এক জায়গায় বেশিক্ষণ থাকা নয়। এক জায়গায় পৗছেই অন্য কোথাও যাবার তাগিদ। তবে কোথায় কেন সে জানে না।
একিদন তাকে দখা যায় এসপ্লেনেডে একটা নামকরা খাবারের দাকানের সামনে উবু হয়ে বসে থাকতে। যেন কোন কারনে সে কষ্ট পাচ্ছে। আজ তার এখান থেকে সরার লক্ষণ নেই। এখানেই যেন তার স্থায়ী আশ্ৰয় সে খুঁজে পেয়েছে। সারা জীবন ঘুরে ঘুরে একটা আশ্রয় পেয়েছে। রাস্তার ওপর ওরই মত কোন আশ্রয় ছাড়া নেহাৎ অবেহলায় বেড়ে উেঠেছে বটগাছটা। সে এখানে গত একেশা বছেরর অসংখ্য ঘটনার সাক্ষী। সেই ইংরেজ আমল থেকে।দেশের স্বাধীনতার জন্য কত মানুষের কত আত্মত্যাগ । তারপর পালাবদল। সাদা মানষুরা দেশ ছেড়ে চলে গেছে। কালা মানেুষের এখন চলাফেরা। তাদের সঙ্গেই এখন ভাব। আর ঘরছাড়া এই চরকি বাবুদের ছায়া বিছিয়ে দেওয়াই তার কাজ। তাদের আশ্ৰয় এই বুড়ো বটগাছ। তারাই যে একান্ত আত্মীয়। আমি যে মানষুটার কথা বলিছলাম যে আমার আজের গল্পের নায়ক সে এই বটতলায় উবু হয়ে বসে আছে। কোন দিকে ভ্রুক্ষেপ নই তার।
হন হন করে এক ভদ্রলোক হেঁটে যাচ্ছেন । চোখ পড়ে উবু হয়ে বসে থাকা লোকটার ওপর। মনে হচ্ছে পরিচিত। যেন রোজই দেখেন, ভীষণ চেনা। আপাত দৃষ্টিতে ভদ্রলোকের কোনদিকে দৃষ্টি নেই মনে হলেও তার প্ৰখর দৃষ্টি । চরকি বাবুকে আমি ছাড়া আর কেউ না হলেও উনি দেখছেন। উনার বসে থাকা নামগোত্রহীন মানষুটার দিকে নজর পড়ে। কাছে গিয়ে বলেন এ কি হাল আপনার? আপনি যে এ ভাবে বসে? কি ভাবছেন? চরকি বাবু বোবা চোখে তাকিয়ে। তাকে দেখে ভাবে এমন মানষু পৃথিবীতে আছে নাকি ! এত আন্তরিকতার সঙ্গে কউ তো তাকে কেমন আছ বলে জানতা চায় না। সে একটু অস্বস্তি বাধ করে। ভদ্রলোক কাছে এসে হাত বাড়িয় বলেন, " উঠে আসুন। চলনু "। চরকিবাবু যেন নির্বাক, বাক হারা। কোন কথা না বলে উনার হাত ধরে উঠে দাঁড়ান। ভদ্রলোক উনাকে ধরে হাঁটতে হাঁটতে এগিয় যান। চরকিবাবু উনার কাঁধে ভর করে হাঁটা শুরু করেন । কিসের ঘোরে যেন চরিকবাবু আপ্লুত। বেশ কিছুক্ষণ হেঁটে তিনি ভদ্রলোকের সঙ্গে একটা অফিস ঘরে ঢোকেন। উনাকে সামনে বসিয়ে ভদ্রলোক বেয়ারাকে জল আনতে বলেন । তারপর দুজনের আলাপ চারিতা।
চরকি বাবু অবাক হয়ে বেলন, " আপনি কি আমাকে চেনেন? আমি ঠিক ঠাওর করেত পারছি না। তবে মনে হয় কোথায় যেন আমিও আপনাক দেখিছ।''
''আরে এই এলাকায় যাতায়াত করে এমন লোক আছে যে আপনাকে চেনে না? মনে করে দেখুন বেশ কয়েক বছর আগে খেলার মাঠে একটা গোলমাল হয়।মাউন্ট পুলিশের তাড়া খেয়ে আপিন দৌড়তে শুরু কেরন। আমিও। এই ময়দান মার্কেটের সামনে এসে আপিন পড়ে যান। ওখানে দাকানদাররা যারা আপনার সঙ্গে রংগরসিকতা করত তারা আপনাকে তুলে বাসায়। আমি আপনাকে নিয়ে গিয়ে মানিকতলার বাড়ীতি পৌঁছে দিই। কি মনে পড়ে আজ ?''
আলাপ পরিচয়ের মধ্যে আগুন্তুক ভদ্রলোক বলেন: " আপিন কি অসুস্থ? আমি সকালে অফিসে আসার সময় আপনাকে ওখানে দেখি। এখনও একই ভাবে বসে।
চরকিবাবু অবাক হন।বলেন, " অসুস্থ হব কেন? বরং আমি তো ভাবিছলাম আপনিই অসুস্থ। তা নইলে আমার খবর নেবেন কেন? আমার খবর নেওয়া তো কোন সুস্থ মানুষের কাজ না।" বলে চরকি বাবুর হাসি। ভেদ্রলোক তখন বলেন " আচ্ছা চরকি বাবু, আপনি ওভাবে উপুড় হয়ে বেসেছিলেন কেন? আমি তো জানি আপিন হেঁটে বেড়ান, ঘুরে বড়াতেই পছন্দ করেন।" চরকিবাবু বাঝেন ধরা পড়ে গেছেন । উনি বলেন " সত্যিটা শোন তবে তোমাকে বলি। ওই খাবার দোকানের খাবারের গন্ধ আমাকে মাতাল করে দেয়। গন্ধের আবেশে আমি বসে পড়ি।উঠতে পারি না। দোকানের ভেতরে গিয়ে আশা মেটাব তার মুরোদ আমার নেই। তাই এভাবে বসে প্রাণ ভোরে গন্ধ নিই। জান তো ঘ্রানেন অর্ধ ভোজন। আর অর্ধভোজন বলে পেট ভরতে সময় লাগছিল। এই যা।"
আগন্তুক বাবুর এবার হিসাবের পালা। উনি চরকিবাবুর হাত ধরে বাইরে এসে বলেন, " আপনার কাছ থেকে যা পাবার পাওয়া হয়ে গেছে। কাল কাগজটা পাঠিয়ে দেব। কলকাতা করচার কলমটা দেখে নেবেন। আর এই আপনার সামান্য পাওনা কাল যাতে গন্ধে অর্ধ ভোজন করতে না হয়। খরচ করে পূর্ণ ভোজন করবেন।''
নিচে অনু গল্প হিসেবে আমার একটা গল্প পরিবেশন করলাম:
অণুগল্প
সেই কলেজ জীবনের দুই বন্ধু। একজন ঘষে মেজেও পাশ করে না আরেকজন তুখোড় বুদ্ধিতে বাজি মাত। কলেজ জীবনের পর একজনের মেহনতি জীবন আর আরেকজন সমাজে সন্মানজনক ব্যক্তিত্ব। বুদ্ধি বেঁচে খাওয়া পরা। দুজন দুই মেরুতে। বহুদিন দেখা হয় না। এখন বার্ধক্যে দুজনের আবার মিলন। দেখা সাক্ষাৎ আড্ডা। পূরণ প্রেমটা জিগিয়ে উঠেছে। একদিন বুদ্ধির কারবারি মেহনতিকে বলে:
আচ্ছা তোকে এক কালে সবাই গাধা বলত। আজ কি হল সবাই গরু বলে কেন?
মেহনতি বন্ধুর উত্তর :
তখন গতর ছিল বইতে পারতাম। এখন বয়েস হয়েছে পারি না। ঘাস খেয়ে বেড়াই তাই।
এবার মেহনতি বুদ্ধিমান বন্ধুকে প্রশ্ন করে:
একদা তোকে সবাই খচ্চর বলত আজ ঘোড়া বলে কেন?
বন্ধু ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে বলে:
বলত নাকি? জানি না কেন ?
মেহনতি বন্ধু বলে:
পারলি না তো বলতে। তবে শোন। তুই আগে টিকিটিকির মত সবার পেছনে থাকতি আর আজ সবাইকে পেছনে ফেলে জোরে দৌড়ে পালাস তাই।
দুজনে হেসে ওঠে।
-----------------------------------
( সম্পাদিত, ০৪/০৪/২০২২)