।। ১ ।।
সবিতা গুপ্ত র ঢাকাতেই স্কুল জীবন, হায়ার সেকেন্ডারী অবধি কেটেছে।। তাদের সেই বিশাল বাড়ী, নাট মন্দির, বাগান, পুকুর সব ছেড়ে রাতারাতি এক কাপড়ে বেরিয়ে আসতে হয়েছিল। তার বয়স এখন প্রায় আশি। বিয়ের পরে ইংল্যান্ডে এসেছিল আজ থেকে পঞ্চাশ বছর আগে। সেটা এসেছিল কলকাতা থেকে। কিন্ত কলকাতাকে সে মাত্র পাঁচ বছর দেখেছে। যখন ঢাকা ছেড়ে আসতে বাধ্য হতে হল। জীবনের প্রথম পঁচিশ বছর তার কেটেছিল ঢাকা বিক্রমপুরে ! সাল ঊনিশ্শ একাত্তর, সোনার বাংলায় তখন যুদ্ধের আগুন জ্বলছে। তার বাবা ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের যোদ্ধা ছিলেন। ভালবেসে বিয়ে করেছিলেন পশ্চিম বঙ্গের একটি ব্রাহ্মণ কন্যাকে। সবিতা দের বৈদ্য পরিবারে সেই সময় এই বিয়ে নিয়ে প্রচুর জলঘোলা হয়েছিল। কিন্ত বাবার প্রেসিডেন্সী কলেজের বিপ্লবী বন্ধুদের উদ্যোগে বিয়ে টা হয়ে যায়। বাবা মার সুখী দাম্পত্য জীবন , ঘর ভরা ছেলে মেয়ে নিয়ে কেটেছিল এই বাড়ীতেই। তারা আট বোন, তিন ভাই। সবিতা সবচেয়ে বড়। সবিতার বিয়ের ঠিক ও হয়ে গিয়েছিল কিন্ত ছেলেটি মুক্তিযুদ্ধে শহীদ হয়! আদর্শ বাদী সেই তরুণের কথা আজও মনে পড়ে! যে নিজের দেশকে ভালবেসে প্রাণ দিয়েছিল!
বাবার বিপ্লবী জীবনের ছাপ পড়েছিল বড় ভাই বিজয়ের ওপরে। সে মুক্তিযুদ্ধের সক্রিয় কর্মী! বাবার ওপর চাপ আসতে লাগল ,দেশত্যাগের! বাবা মা শেষ পর্যন্ত বাধ্য হলেন, আর ভরসা করতে পারলেন না! বিজয়ের প্রাণ সংশয় দেখা দিল যখন, বাবা সপরিবার চলে এলেন কলকাতায় জ্যাঠা মশাই এর বাড়ীতে।
এখানে আসার পর থেকে শুরু হল জীবন যুদ্ধ, বেঁচে থাকার লড়াই। তাদের বাংলাদেশের জীবন যাত্রা ছিল সহজ সরল, বিলাসিতার সামর্থ্য তার বাবার ছিল না ঠিকই, পূর্ব পুরুষদের জমিদারির কিছু আয় ছিল আর বাবার শিক্ষকতার যতটুকু উপার্জন, তাতেই তাদের বেশ হেসে খেলে চলে যেত। কিন্ত কলকাতায় প্রায় কপর্দক শূণ্য অবস্হা, তারা এতজন ভাই বোন, বিজয় আর সে ছাড়া সবাই বেশ ছোট, স্কুলের গন্ডী ও পেরোয়নি তখনও।
কলকাতায় প্রথমেই তাকে বিয়ে দিয়ে দায়মুক্ত হতে চাইলেন বাবা। জেঠিমা র আত্মীয়তা র সূত্রে এই সন্বন্ধ এসেছিল। ছেলে টি লন্ডনে থাকে। তবে তার থেকে বয়সে বারো বছরের বড়। বাবার হাতে চাঁদ পাওয়ার মত অবস্হা হল। বৈদ্য বংশীয় এমন সুপাত্র তিনি হাতছাড়া করতে চাইলেন না! এদের ও বড় যৌথ পরিবার, কৃষ্ণনগরে বড় বাড়ী। সবিতার মনে অনেক স্বপ্ন ছিল, কিন্ত পরিস্থিতির চাপে সে নিজের মন তৈরী করে নিল। যেমনই হোক, এই বিয়ে তাকে করতে হবে। ছোট ছোট ভাই বোন দের শুকনো মুখ দেখতে তার ভাল লাগেনা। তার বিয়ে হয়ে গেলে বাবাকে সাহায্য করা হবে। তাই পাত্র যখন দু একজন আত্মীয়দের নিয়ে তাকে দেখতে এসে জিজ্ঞেস করল, " আপনি বিদেশে গিয়ে থাকতে পারবেন তো?" সে সটান মাথা নেড়ে বলেছিল "হ্যাঁ", মনে মনে বলেছিল, ' থাকতে আমাকে হবেই, যতই কষ্ট হোক! এই লোক টি কে সে চেনেনা, কেমন মানুষ, তাও সে জানেনা , তবে যেমনই হোক, এর সাথেই তার ভবিষ্যত তৈরী করতে হবে।' বিয়ের পর থেকে, তার এই এক বাক্যে রাজী হওয়ার ব্যাপার টা নিয়ে সবার সামনেই অবনী তাকে ঠাট্টা করত!
অবনীর ধারনা অনুযায়ী, বিদেশে যাওয়ার লোভই তার, 'হ্যাঁ' বলার কারণ ছিল।
আসল কারণ নিয়ে অবনীর কোন মাথা ব্যথা ছিল না, তার মন বোঝার ও কোনও চেষ্টা সে করেনি কখনও!
চল্লিশের পরে ,নিজের মায়ের জবরদস্তি তে বিয়েতে মত দিয়েছিল অবনী। ইংল্যান্ডের দিনগুলো তার দিব্যি কাটছিল! কলকাতার সেই সময়কার চাকরীর বাজারে সুবিধা করতে না পেরেই একটা কাগজের বিজ্ঞাপন দেখে এখানে চাকরী নিয়ে এসেছিল আজ থেকে ষাট বছর আগে! অবনী কলকাতার ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার, দশ বছর ধরে এই দেশে সে মাঝারী গোছের চাকরী করেছে, বিভিন্ন কল কারখানায়। দেশে ফিরতে তারও ইচ্ছে করত! কিন্ত এখানকার রোজগার তো কলকাতায় হবেনা! পেয়িং গেস্ট হিসেবে থাকার সুবাদে, খাওয়া থাকার অসুবিধা ও কিছু ছিল না।পাবে যেত সন্ধ্যার সময়।বহাল তবিয়তে কেটে যাচ্ছিল জীবন টা! দু একজন বান্ধবীও ছিল। একজনের সঙ্গে একটু সিরিয়াস গোছের সম্পর্ক হল। সেবার কৃষ্ণনগরের বাড়ীতে গিয়ে মা'কে, মেয়েটির কথা বলাতে, মা প্রায় অজ্ঞান হয়ে পড়ে যান, আরকি! নিজের ঘরের ঠাকুরের পা ছুঁইয়ে প্রতিজ্ঞা করালেন, গরুর মাংস খাওয়া বিদেশিনীকে বিয়ে করা চলবেনা। সেই বার ই মা র, আগে থেকেই খুঁজে রাখা সন্বন্ধ দেখতে যেতে হয়েছিল! সবিতা কে দেখে অপছন্দ হবার নয়, হয়ওনি। কিন্ত ইংল্যান্ড এর সেই বিদূষিনী র মুখ মনে পড়ছিল, যে তাকে ভালবাসার প্রথম পাঠ পড়িয়েছিল!
যাই হোক, মাকে দেওয়া কথার মর্যাদা রাখতে, অবনী সেন , সবিতা গুপ্ত কে বিয়ে করলেন। কোনরকম ঘটা পটা হলোনা। রেজিস্ট্রি হয়েছিল, আর মা বাবার ইচ্ছা অনুসারে কালিঘাটের মন্দিরে গিয়ে পূজো দেওয়া হল।
সবিতার সমস্ত ভিসা পাসপোর্টের ফরমালিটিস করতে মাস ছয়েক সময় লাগল। ততদিনে অবনী ফিরে গেছে। এতদিন সে বিভিন্ন বাড়ীতে পেয়িং গেস্ট হিসেবে, কাটিয়েছে। এবার একটা ছোট অ্যাপার্টমেন্ট ভাড়া নিলো।ওপরে থাকে বয়স্কা বাড়ীওয়ালী। সবিতা, কৃষ্ণনগরে শ্বশুরবাড়ির যৌথ সংসারের বিচিত্র অভিজ্ঞতা লাভ করল মাস ছয়েক ধরে।
শাশুড়ী বিচক্ষন মহিলা। সবিতা তেমন রান্নাবান্না পারত না। তাদের দেশের বাড়ীতে রান্নার ঠাকুর, রাত দিনের কাজের লোক বেশ দু তিন জন ছিল, তাই, কোনও কাজের অভ্যাস তার ছিল না।শাশুড়ী নিজে সব ভাল মন্দ রান্না করে, সবাই কে বলতেন সবিতা করেছে ! সেজন্য সত্যিই শাশুড়ীর প্রতি আজও কৃতজ্ঞ!
বিয়ের পাঁচ বছরের মাথায়, সেই শাশুড়ীর অসুস্থতার খবর জানিয়ে দেওর এর চিঠি এসে একদিন সকালের ডাকে পৌঁছালো। চিঠি টি ছিল দশ দিন আগের, সেই সময় এতটাই টাইম লাগত ইন্ডিয়া থেকে চিঠি আসতে! অবনী তখন অফিসে। তখন তো আর এযুগের মত মোবাইল ছিল না, এমনকি তাদের বাড়ীতে ল্যান্ডলাইন ও ছিল না, ভাড়া বাড়ীতে অতি সামান্য কাজ চালানোর মতই কিছু ছিল, বলতে গেলে একটা বেড আর রান্না খাওয়ার সরঞ্জাম ই কেনা হয়েছিল। সবিতা তখন দৌড়ে ওপরে ল্যান্ড লেডি র কাছে গেল , সেখানে অবনীর অফিসের নম্বর রাখা ছিল, অনেক বার ফোন করেও পেলনা অবনীকে। হয়তো সাইট ভিসিট ছিল। সন্ধ্যার সময় অফিস থেকে ফিরে অবনী ফ্রেশ হতে বাথরুমে গেছে, তখন, একটা টেলিগ্রাম এল ! আবার যার নামে এসেছে তার হাতে ছাড়া দেবে না, অগত্যা অবনী কে বাথরুমের দরজা দিয়ে মুখ বাড়িয়ে বলতে হল, সবিতা তার স্ত্রী, টেলিগ্রাম তাকেও দেওয়া যায়।
সবিতার বুক কাঁপছিল, নিশ্চয়ই কোনও দুসংবাদ হবে।
ঠিকই তাই ! শাশুড়ীর মৃত্যুর খবর শুনে, অবনী চিৎকার করে কেঁদে উঠল।সবিতা তখনও বলারই সময় পায়নি, সকালের চিঠির ঘটনার কথা। এবার বলল। কিন্ত তাই শুনে অবনীর বিলাপ আরও বেড়ে গেল, সে বলতে লাগল, সবিতা ইচ্ছা করেই তাকে খবর টা ঠিক সময়ে দ্যায়নি।
কিন্ত দশ দিন আগের লেখা চিঠির আজ সকালে এসে পোঁছানোর মধ্যে সবিতার কোনও হাত নেই। তাও খবর টা অবনীকে জানানোর চেষ্টায় সে কোনও ত্রুটী করেনি ! অসুস্থ শাশুড়ীর মারা যাবার টেলিগ্রাম যে আজই আসবে একথাও তার জানার কথা নয়।
সেই অভিযোগ তার প্রতি আজও পুষে রেখেছে সে।সবিতা তাকে বলে বোঝাতে পারেনি, যে এই কাজ সে সত্যি সত্যিই করেনি আর কেনই বা সে করবে? শাশুড়ীর প্রতি কোন বিরূপ মনোভাব তার ছিল না বরং শ্রদ্ধা মিশ্রিত সমীহই ছিল।
।। ২ ।।
অবনী বাচ্চা চায়নি। বিয়ের পর প্রথম চার বছর তাকে ওষুধ খেতে দিত, যাতে বাচ্চা না হয়। সবিতা জানে, বিয়ে হলে বাচ্চা হবে, একটা স্বাভাবিক ঘটনার মতোই। সে আর পাঁচটা সাধারণ মেয়ের মতই, চেয়েছিল পরিপাটি একটা সংসার, যে সংসার সে খুব গুছিয়ে করবে, সেখানে একজন স্বামী থাকবে, যে তাকে ভালবাসবে খুব আর থাকবে তাদের সন্তান! এই রোমান্টিক ভাবনা গুলো তার বেশ এলোমেলো হয়ে গেল, যখন সে প্রথম বিদেশের মাটি তে পা রাখল।
অবনী নিপাট ভদ্রলোক, স্ত্রী কে কখনও অসম্মান করেনি, তার চরিত্র দোষ ও নেই ! তবে মাঝে মাঝেই সে লিজার গল্প করত তাকে, সে কত সুন্দরী ছিল, কত স্মার্ট ছিল, এসব কথা বলার সময় তার চোখ মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠত, আর সবিতা তখন অবাক চোখে চুপচাপ শুনে যেত! অবনী যে স্ত্রী কে ভালবাসে, এমন কথা তার হাবেভাবে, কথায়, আচরণে কোনও দিন বোঝা যায়নি। বরং সব সময়ই একটা তাচ্ছিল্য সুলভ মনোভাব প্রকাশ পেয়েছে। সবিতার বাঙাল ভাষায় কথা বলাটা যে কতখানি কুৎসিত লাগে, একথা প্রথম থেকেই বলত,সে।! সবিতার সঙ্গে সাংসারিক, কথা ছাড়া তার কখনও বসে গল্প হয়েছে বলে মনে পড়েনা। সবিতা ইংরিজী টা ঠিক করে বলতে পারেনা, লেখা তো দূরের কথা! কারণ তার পড়াশুনো হয়েছে বাংলা মিডিয়াম স্কুলে এবং সেখানে সে বরাবর ভাল ছাত্রী ছিল। কিন্ত অবনীর কাছে তার কোন মূল্য নেই। সবিতা নিজের চেষ্টায়, দোকানে গিয়ে দোকানীর সঙ্গে ,বাড়ীওয়ালীর সঙ্গে কথা বলে বলে, ঠোক্কর খেতে খেতে মোটামুটী কাজ চালানোর মত ইংলিশ শিখে ফেলেছে। অবনীর কোন সাহায্য ব্যতিরেকে। বাঙাল ভাষা ছেড়ে এখন শুদ্ধ বাংলায় কথা বলে। কিছু বাঙালির সঙ্গে পরিচয়, বন্ধুত্বে পরিনত হয়েছে!
চার বছর ধরে শুধু রান্না করেছে, সংসারের সমস্ত কাজ করেছে। মেশিনের সাহায্য পেয়েছে কিছুটা, তবে আজও তার ডিশ ওয়াশার নেই। অবনীর নাকি ডিশ ওয়াশারে মাজা বাসনে খেতে ঘেন্না লাগে! আজও সেই সব একই কাজ করে চলেছে। এখন অবশ্য তার মেয়ে পিয়া তাকে সব কাজে সাহায্য করে।এদেশে কাজের লোক বা চাকর বাকর রাখার চল নেই, খুব পয়সা ওয়ালা স্থানীয় বা বড় চাকুরেয়ালা দেশীয়রাই একমাত্র সে ক্ষমতা রাখে। পঞ্চম বছরে সে যখন আকস্মিক ভাবে প্রেগন্যান্ট হল, তখন খুশির সীমা রইল না তার! সবিতার এই খুশির খবর শুনে, আরও গম্ভীর হল অবনী। নির্ভার জীবনে যেন বাড়তি ঝামেলা এসে পড়ল, " এখানে কে তোমার দেখাশোনা করবে? দ্যাখো, যদি দেশে চলে যেতে চাও, আমি নাহয় ব্যাবস্থা করে দিচ্ছি। "
সবিতা জানে, দেশে যাওয়া তার পক্ষে সম্ভব নয়,কারণ সেখানে তার বাবা মা, ভাইবোনেরা, নিজেরাই কষ্ট করে, দু কামরার বাড়ীতে আছে। তবে বাবার দুশ্চিন্তার একটু লাঘব হয়েছে তার বিয়ে হওয়াতে আর গতবছর বিজয় নিজের চেষ্টায় কানাডা য় চাকরী নিয়ে চলে যাওয়াতে।। আর তার পরের বোন শিবানী নিজেই পছন্দ করে পাড়ারই একটি ছেলে কে বিয়ে করেছে। শুনেছে তার বিয়ে সুখের হয়েছে। তার বরের সামান্য মুদির দোকান আছে কিন্ত ছেলেটি শিবানী আর তার বাড়ীর সবাই কে নাকি খুব ভালবাসে!সেজ বোন শর্মিলা পড়াশুনায় খুব ভাল, সে গ্র্যাজুয়েশনের পর বি,এড পড়ছে, শিগগিরই হয়তো ভালো শিক্ষকতার চাকরী পাবে। বিজয়ের পরের ভাই অজয়ের জন্য ই সবচেয়ে চিন্তা হয় তার, ছোটবেলায় বড়দিদির কাছেই তার যত আবদার ছিল, মাঝে মাঝে সেই ট্রাঙ্কল করে তার খবর নেয়, কিন্ত ইদানীং নকশাল আন্দোলন এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে, প্রেসিডেন্সি কলেজের ফার্স্ট ইয়ারেই! এখন সে বাড়ীতেও সবসময় থাকেনা। দূরে কোথায় কোথায় চলে যায় তাদের পার্টির কাজে।
কাজেই কলকাতায় যাবার প্রশ্নই নেই। এখন লন্ডন ই তার ঘরবাড়ী। যা হবে, সব এখানেই হবে। নিজেকে সে সামলাতে পারবে, সেই মনের জোর তার আছে। আছে বলেই, একজন প্রায় অচেনা পুরুষের ঘর করতে সে বিদেশে এসেছিল। অবনী,যেমনই হোক, তার প্রতি ও একটা মায়া অনুভব করে সে। সে যদি চলে যায়, তাহলে এই লোকটা তো আবার সেই বাইরে বাইরে খাবে! মধ্য চল্লিশেই তার হাই প্রেসার , আর গ্যাসট্রিক আলসারেও কষ্ট পায় খুব।
বাচ্চা হওয়ার সময় এগিয়ে এসেছে। অবনী কোনও দিন জিজ্ঞেস করেনি, তার শরীর কেমন আছে বা তার এখন কি খেতে ভাল লাগে ইত্যাদি! সে নিজের অফিসের কাজ, সন্ধ্যায় পাবে যাওয়া, আর পরিপাটি খাওয়া, ঘুম নিয়েই ব্যস্ত থাকে!
হঠাৎই একদিন সবিতার প্রসব যন্ত্রনার লক্ষন প্রকাশ পায়। নিজেই কষ্ট করে ওপরে বাড়ীওয়ালীর ঘরে যায়। বুড়ি তাকে মেয়ের মতই ভালবাসত! যতটুকু আদর যত্ন সবিতা পেয়েছিল, সেই সময়, তা এই মানুষ টার কাছেই! মিস ডেভিড প্রথমে অবনীর অফিসের ফোন ট্রাই করলেন, রিং হয়ে যেতে লাগল, পাঁচ ছ বার ট্রাই করেও যখন অবনী কে পাওয়া গেল না তখন অ্যাম্বুল্যান্স কে খবর দিলেন। সবিতার তখন জল ভাঙতে শুরু করেছে। বিকেলের দিকে হসপিটাল বেডে শুয়ে আছে। পাশের ছোট বেবি কটে শুয়ে থাকা শিশুকন্যার মুখের দিকে তাকিয়ে আর আশ মেটেনা! এত ফুটফুটে শিশুকন্যা তার নিজের, বিশ্বাস ই হয় না যেন!অবনীর জন্য অপেক্ষা করে করে রাত হয়ে যায়, সে আসেনা। পরদিন বিকেলের ভিসিটিং আওয়ার্সে সে আসে, হাতে ফুলের বুকে নিয়ে। ইংলিশ আদব কায়দা তার বিশেষ পছন্দের। মেয়ে কে দেখে হাসে একটু, খুশী হয় কিনা বোঝা যায়না। নির্বিঘ্নে একটি সুস্থ শিশুর জন্মদান করে সবিতা এখন গর্বিতা মা! সে শিশুটিকে একটা সার্থক জীবন দেবে বলে, নিজের কাছেই অঙ্গীকার করে। দুদিন পরেই সে হসপিটাল থেকে বাড়ীতে আসে। মিস ডেভিড মেন গেট এ দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছিলেন। অবনী অফিস ফেরত মা, মেয়ে কে নিয়ে এসেছে। মিস ডেভিড, এমনিতে অবনীকে খুব ভালবাসত, বিয়ের পরে সে যখন নতুন, তখন, অবনীর পছন্দের খাবার গুলো সবিতা কে জানিয়ে বলত, " লিসন, মাই ডিয়ার, " 'সেন ' লাইকস, স্যালমন ফিশ ভেরি মাচ, অ্যান্ড গ্রিলড চিকেন অলসো, সো ইউ ট্রাই টু মেক দোজ আইটেমস! " কিন্ত অবনীর, সবিতার প্রতি অবহেলা তার নজর এড়ায়নি। তিনি দেখেছেন এই আনকোড়া মেয়েটি কিভাবে সমস্ত কিছু কত দ্রুত শিখে নিয়েছে। কি নিষ্ঠার সঙ্গে অবনীর যত্ন করেছে। তাই আজকাল অবনীর থেকে সবিতার প্রতি তার পক্ষপাতিত্ব বেশী। সেই মিস ডেভিড বেশ কিছু বছর আগেই মারা গেলেন। তার আগেই অবশ্য তারা এই বাড়ী কিনে উঠে এসেছিল। যদিও মিস ডেভিডের শেষ দিন পর্যন্ত দেখাশোনা করেছে তারাই।
আজ যখন অবনী নব্বই পেরিয়েছে তখন, তাদের মেয়ে প্রতিতী র বয়স ও প্রায় পঁয়তাল্লিশ, সেও আজ নিজের প্রফেশনাল লাইফে সুপ্রতিষ্ঠিত একজন অবিবাহিত নারী, যে বাবা, মা র সঙ্গেই থাকার কথা ভেবেছে, হয়ত সারাজীবন! আজ অবনী, নিজের মেয়ে কে নিয়ে কত গর্বিত বাবা! দেশে র আত্মীয়দের মুখ বন্ধ করে দেয়, যখন তারা মেয়ের বিয়ের বয়স নিয়ে চিন্তার ভান করে!! সবিতা আড়াল থেকে শোনে, " আজকের দিনে, এটা কোন ব্যাপার ই নয়! মেয়ে আমার বড় চাকরী করে, তার যখন ইচ্ছা বা সময় হবে, তখন বিয়ে করবে।"
সবিতার ভাবলে হাসি পায়, মেয়ের বড় হওয়ার সময়ে কোনও দিন, ফিরে ও তাকায়নি অবনী। রবীন্দ্রনাথের একনিষ্ঠ অনুরাগী , সবিতা, মেয়ের নামকরণ থেকে শুরু করে বাংলা শেখানোর চেষ্টায় ত্রুটি না হওয়া, স্কুলের পড়াশোনার দিকে খেয়াল রাখা, ভারতনাট্টমের ক্লাসে ঢিলে না দেওয়া, মেয়ের স্বাস্থ্যের প্রতি কড়া নজর রাখা সমস্ত কিছুই একা হাতে সামলেছে।
মেয়ে কে সে নিজের হাতে গড়েছে তার মনের মত করে। অবনীর কাছে সে ব্যাপারে কিছুমাত্র সাহায্য না পেলেও, কোনটাতে বাধাও দেয়নি বা নিজের নাক ও গলায়নি। শুধুমাত্র এই জন্য সে কৃতজ্ঞ অবনীর কাছে। মেয়ের পাঁচ বছর বয়স থেকে সে নিজেও চাকরী শুরু করেছে।মেয়ের স্কুলেই ন্যানী র চাকরী, সেজন্য তাকে কষ্ট করে ট্রেনিং নিতে হয়েছে। সংসার খরচ বাড়ছে বলে, দিনের বেলায় স্কুলের চাকরির পরে মেয়েকে বাড়ী তে নিয়ে এসে, ঘরের সব কাজ নিপুণ ভাবে করে আবার সন্ধ্যার সময় একটা পোস্ট অফিসের চাকরি নিয়েছে। তবে সেটা সপ্তাহের তিন দিন ছিল। কিন্ত গাড়ী চালানোটা আর শেষ পর্যন্ত শিখে উঠতে পারেনি। এখানে ভীষন কড়াকড়ি এই ব্যাপারে। অনেক বার ফেল করেও যখন হলনা তখন ক্ষান্ত দিল। সেসব খরচা, নিজের রোজগার থেকেই করেছে।
সবিতা ও মেয়ের বিয়ে নিয়ে চিন্তা করে ! এখন সে ও সমস্ত বাইরের কাজ থেকে অবসর নিয়েছে। ঘরের কাজে তো মেয়েদের অবসর হয়না ! অবনী অনেক আগেই রিটায়ারড!সে খেয়ে, ঘুমিয়ে, হেঁটে অবসর জীবন যাপন করছে।তারা তিন জন এখন ভালই আছে। অবনীর চাকরীর ভাল পেনশন আছে। মেয়ে নিজের জন্য কিছুটা রেখে তার মাইনে, মাকে ই দিয়ে দেয়। সুন্দরী প্রতীতি সেন আজ সফল ব্যাঙ্কার, কাজের জগতে সে ব্যস্ত হলেও , লন্ডনের রবীন্দ্র হেরিটেজ সোসাইটির মেম্বার, সেখানে বিভিন্ন অনুষ্ঠান করে সবার সঙ্গে , যোগা ক্লাস থাকে রোজ, বাড়ীতে আবার অনলাইন ক্লাস করছে পেন্টিং এর , মাঝে মধ্যে ছোটবেলায় শেখা ভায়োলিন বাজায় বসে, শ্রোতা একমাত্র বাবা মা ! তার জন্ম ,ছেলেবেলার সব কিছুই লন্ডনের এই শহরতলীতে ! সে ব্রিটিশ নাগরিক হলেও, নিজের ভারতীয় সত্তা কে অটুট রেখেছে। ঝরঝর করে বাংলা বলে বাড়ীতে, বা কলকাতায় গেলে আত্মীয়দের সঙ্গে।
সবিতার যত্নে, অবনী সেন কে দশ বছর কম বয়সী দেখায় এখনো। তবে আজও কোন রকম প্রশংসা বা স্বীকৃতির দাবিদার হতে পারেনি সে। অন্তত অবনী সেন এর কাছে ! বরং একটি রিফিউজি হয়ে আসা পরিবারের মেয়েকে বিয়ে করে উদ্ধার করার মত মহান কাজ করেছে বলে, এখনও অবনী, সেই আত্মশ্লাঘায় ভোগে !
সবিতার রান্নার হাত অসাধারণ, রকমারী রান্নায় সে এক্সপার্ট ! এদেশের বেকিং ও শিখে নিয়েছে , চমৎকার কেক বানায় !এতদিনের প্রবাসের সব বন্ধুদের কাছে তার জনপ্রিয়তাও প্রচুর! সবাইকে বাড়ীতে ডেকে নিমন্ত্রণ করে খাওয়াতে সে খুব ভালবাসে। তারা লন্ডনের এই শহরতলিতে ছোট একটি দোতলা বাড়ী কিনে, সেখানে, গত তিরিশ বছর ধরে আছে। সে মনের মত করে বাড়ী ও সাজিয়েছে। যদিও অবনীর পছন্দ হয়না কিছুই, বিরক্তির সুরে বলে, " বস্তি বাড়ী করে তুলেছো , বাড়ীটাকে!" সবিতা আজকাল আর এসব নিয়ে মন খারাপ করেনা, মাথাও ঘামায়না। এখন মেয়ে তার অনেক ইচ্ছা পূরণ করে।
জীবনের শেষ পর্যায়ে এসে সবিতা নিজেকে নিয়ে তৃপ্ত! তার যা করার ছিল, সব কিছুতেই সে সফল হয়েছে। জীবনের অজস্র ঘাত প্রতিঘাত পেরিয়ে আজ সে বিজয়িনী।
================