Click the image to explore all Offers

ধারাবাহিক উপন্যাস । । পরজীবী ( পর্ব - ৭) ।। অভিষেক ঘোষ

 


 

পরজীবী  (পর্ব - ৭) 

অভিষেক ঘোষ 

২০০৩

একটা অন্ধকার ঘরে একটা দৃষ্টিহীন মানুষ পড়ে থাকলে, কারো তেমন যায় আসে না মানুষটারও তেমনই অভ্যাস হয়ে যায় ঘরের প্রতিটি কোণ, আসবাব থেকে আসবাবের দূরত্ব, দৈর্ঘ্য-প্রস্থের অনুপাত সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এই অভিযোজন অবশ্যম্ভাবী কিন্তু যে দুঃখগুলো জমে, তা কাউকে বোঝানো সম্ভব নয় মেজো ছেলেতাঁর ন্যাওটা ছিল, কিন্তু তার সেজো ভাইটা অকালে চলে যাওয়ার জন্য কি সে মা-কে দায়ী করলো ? সূর্য সরে গেলে চাঁদের উদয় হয় কিন্তু তাই কি হলো ? সেজো ছেলে মণিকান্তর মৃত্যু মাধুরী দেবীর কাছ থেকে দূরে সরিয়ে দিল মেজো ছেলে সূর্যকান্তকে এমনিতেই বড্ড ভুগতো জন্ম থেকেই একে পোলিও, তার ওপরে পক্স, ফোঁড়াএসব লেগেই থাকতো তার উপর সেবারে সাতদিনের ভোগান্তি, জ্বর-সর্দি-কাশি, আর এই বাজে জায়গাটা, সুন্দরপুর ডাক্তার নেই, বদ্যি নেই, সূর্যকান্ত সেসময় কম্পিউটার শিখতে বেরিয়ে যেত সেই সকালে কম্পিউটার শিখে, কলেজ সেরে, বাড়ি ফিরতে ফিরতে সূর্যর রাত হয়ে যেত কৃষ্ণকান্ত মিত্র সেসময় খুবই ব্যস্ত ছেলেরা বড়ো হচ্ছে কিন্তু রাধাকান্ত বড়ো ছেলে হয়েও কোনো দায়িত্বই বুঝতে চাইছে না ওর শুধু শরীরের খিদে রাধাকান্তর কথা শুনেই ওই মেয়েটাকে, মাধবীকে তিনি মিত্তির বাড়িতে এনে রেখেছিলেন বড়ো ছেলে, অথচ কখনও মায়ের কাছে সেভাবে কিছু চায় নি, ওই প্রথম চাইলো, “ওই মেয়েটাকে তোমার কাছে রাখবে ? হাতে হাতে কাজের একটা মেয়েও পাবে তিনি রেখেছিলেন যদিও অনুরোধের আড়ালে অন্য কিছু আছে, তিনি আঁচ করেছিলেননয়তো কখনও তো সে মায়ের কথা ভাবে না স্বভাবটা যে কৃষ্ণকান্তর মতোই ছিলো ! আর মেয়েটাকেও তাঁর তেমন দরকার ছিলো না, আর সকলের মতোই সেও ঝাউখালির দক্ষিণের চরে অনায়াসে ফিরে যেতে পারতোকেবল কৃষ্ণকান্ত চাইলেই তাহলে রাতের অন্ধকারে আরো অনেকের মতো সেও পুড়ে মরে যেতে পারতো সেই আগুনে-রাতে, আর কোনো ল্যাঠা থাকতো না কিন্তু রাধাকান্ত কি কিছু আঁচ করেছিলো ? নাকি সত্যিই সে ওই চরের মেয়েটাকে ভালোবেসে ফেলেছিলো ? নাকি কৃষ্ণকান্তই কিছু ভেবে রেখেছিলো ? তাঁর প্রথম সন্তান রাধাকান্ত, তবু মাধুরী দেবীর সংশয় হয়, রাধাকান্তর মধ্যে সেই প্রেম জিনিসটাই নেই, ভালোবাসতে শেখেইনি, রাধাকান্ত অবশ্য তিনি ভুলও হতে পারেন কতটাই বা চেনেন তিনি ছেলেকে ? বাবার ছায়াতেই সে মানুষ দাদাকে যে বাবা অনেক বেশি ভালোবাসে, এই বোধ থেকেই, কোনো নিরাপত্তাহীনতা থেকেই হয়তো সূর্যকান্ত মায়ের সাথে অনেকটা সময় কাটাতো অনেক কথা বলতোও যেমন সূর্যকান্তই তাঁকে প্রথম বলেছিল, চর থেকে অনেক লোক এসেছে, তাদের নাকি ভূতের মতো দেখতে সূর্য, মণি আর চন্দ্রকান্ত একসাথে শুতো দোতলার মাঝের ঘরে ওদের জানালায় ওই মেয়েটা সেই ঝড়-বৃষ্টির রাতে ঢিল মেরেছিলো ! ভাবা যায় ! কী সাহস ! আচ্ছা একটা ঝড় কি মানুষের বুকে এরকম একটা দমকা সাহস দিয়ে যায় ? নাকি মেয়েটা এই জোর খুঁজে পেয়েছিলো কোনো গোপন সত্যি থেকে ! তিনি অনুমান করতে পারতেন, কৃষ্ণকান্তের কোনো রক্ষিতা আছে এবং সে আদৌ চরের মানুষ নয় কিন্তু তাই বলে চরে ? সেই অত দূরে মেয়েটা আর তার মাকে লুকিয়ে রাখা, সকলের দৃষ্টির আড়ালে ! কাজ কৃষ্ণকান্তই পারে



স্ত্রীর চিকিৎসা হচ্ছে কিনা, ছেলেটাকে ডাক্তার দেখানো দরকার কিনা, সব সদানন্দর দায়িত্ব ! এদিকে সদানন্দ আবার আপনভোলা মানুষ, তেল রং, জল রং নিয়ে পড়ে থাকেন নিজের ভাবনায় এত আত্মমগ্ন মানুষকে কীকরে কেউ কারো আপন লোকেদের দায়িত্ব দেয় ? তাও কৃষ্ণকান্তর মতো বিষয়বুদ্ধিসম্পন্ন লোক হয়ে ! তারপর তো ভাইটাকে তাড়িয়েই দিলো কৃষ্ণকান্ত, বদরাগী ছেলের কথায় তিনি চেষ্টা করেও কিছুই আটকাতে পারলেন না, কোনোদিনই পারেন নি স্বামীকে আটকাতে মাধুরী দেবী কোনোদিন কৃষ্ণকান্তকে ক্ষমা করতে পারবেন না, কারণ তাঁদের বিয়েটা জোর করে হয়েছিলো এবং কৃষ্ণকান্তর বাবা শশীকান্তর কাছে মাধুরীর বাবার অজস্র ঋণ, এর জন্য দায়ী কিন্তু মাধুরী তখন একজনকে ভালোবাসতেন তাঁর অতীনকে মরতে হলো শুধু কৃষ্ণকান্তর শয়তানিতে বাবার সেই রক্ত রাধাকান্তরও শরীরে বইছে সেইজন্যই কি ? কিন্তু তিনি কোনটায় বিশ্বাস করবেন ? ভালোবাসায় না রক্তে ? অতীনকে যেভাবে লোক লাগিয়ে খুন করেছিলো পথের কাঁটা সরাতে, সেভাবেই ছেলেকেও মারতে লোক লাগালো ? বাবা হয়ে পারলো কী করে ? নাকি কৃষ্ণকান্ত তার আসল বাবা নয় ? - মাধুরী দেবী নিশ্চিত নন অতীনের সঙ্গে তাঁর মাত্র একবারইবিয়ের ঠিক আগে নাকি কৃষ্ণকান্তর কাছে এই পিতৃপরিচয়ের থেকে গুরুত্বপূর্ণ আরো বড়ো আরেকটা পরিচয় ? নিজেরই প্রতিবিম্ব তিনি দেখতেন রাধার মধ্যে


তবে কে বা কারা রাধাকান্তকে মেরেছিলো, সেসব মাধুরী দেবীর জানার কথা নয়, কিন্তু সূর্যই তাঁর কানে খবরগুলো পৌঁছে দিতো ঊননব্বইয়ের ২২শে জানুয়ারির ভোর রাতে সব দায় ঝেড়ে ফেলতে, দক্ষিণের চরের ঝুপড়িতে অগ্নি সংযোগ, সাবিত্রী-সহ চরবাসীদের পুড়ে মরা, এরপর সব গোপন রেখে মাধবীকে এখানকার স্কুলে ভরতি করা, নার্সিং ট্রেনিং দেওয়া, তার জন্য সুন্দরপুরের একমাত্র বালিকা বিদ্যালয়ের হেডম্যামকে বা, হসপিটালে ঘুষ দেওয়া - এইসব আপাতভাবে পরস্পরবিপরীত ঘটনাগুলোর খবর তাঁকে এনে দিত সূর্যকান্ত, তাঁর প্রিয় মেজো কিন্তু যেদিন তার দাদার উপর আক্রমণ হচ্ছে দেখেও মা-কে নিস্ক্রিয় থাকতে দেখলো, সে আগেভাগে সন্দেহের কথা জানানো সত্ত্বেও মাধুরী দেবী কিছুই করতে পারলেন না, তখনই হয়তো তার মায়ের প্রতি ভরসা চলে গেলো যেটুকু ছিলো, তাও গেলো মণিকান্তর মৃত্যুতে লোকে বলে ম্যালেরিয়া, ডাক্তারকাকাও তাই বলেছিলেন, কিন্তু তাঁর কেমন সন্দেহ হয় ! ডাক্তারকাকা ঘুঘু লোক কিন্তু কাকে সন্দেহ করবেন তিনি ? মাধুরীকে ? কিন্তু তিনি তো মেয়েটাকে স্নেহ করতেন ! তাঁকে অনেকটা জায়গা দিয়েছিলেন বাড়িতে ! তাহলে ? মণিকান্ত বরাবরই অসুস্থ হয়ে পড়তো অল্পেই, খুব রুগ্ন ছিলো ভালো করে হেঁটে-চলে বেড়াতেও পরতো না তবে তাকে কেউ মারতে যাবে কেন ? নাকি মারতে চেয়েছিলো অন্য কাউকে ? মেজো-কে কি ? তিনি সঠিক জানেন না, তবে হতে পারে কলেজ থেকে ফিরে এসে ওই খাবারটাই মেজোর সেদিন খাবার কথা ছিলো কিন্তু রুগ্ন ছেলেটা সেদিন লোভে পড়ে... ! মাধুরী দেবীর চোখদুটো জলে ভরে আসে



এরপর চন্দ্রকান্তকে অবলম্বন করবেন তিনি, এই ছিলো তাঁর একান্ত বাসনা কিন্তু অন্ধ মা-কে ছেড়ে ছেলেরা সকলেই দূরে সরে গেলো ! ওপেন অ্যাঙ্গেল গ্লুকোমা ধীরে ধীরে হয়, ফলে চোখে সেভাবে ব্যথা অনুভূত হয় না সেই শুরুর দিকে কৃষ্ণকান্ত কলকাতায় নিয়ে গিয়ে ডাক্তার দেখিয়েছিলো, তারপর লোকটাই ক্রমশঃ কেমন যেন বদলে গেলো ! সেসময় ডাক্তার বলেছিলো, যে নার্ভগুলো চোখ আর মাথার মধ্যে আছে, সেগুলো নষ্ট হয়ে যাচ্ছে নিয়মিত ট্রিটমেন্ট প্রয়োজন কিন্তু কৃষ্ণকান্ত তখন খুব ব্যস্ত, গা করেনি করবেই বা কেন ? বউ তার কোন্ কাজে লাগবে ? বাইরে বেরোনো প্রায় নিষিদ্ধ বাপের বাড়ি তাকে যেতেই দেওয়া হয় না সেই গিয়েছিলো শেষবার রাধাকান্ত যখন পেটে এখন তাঁর আপন বলতে ছেলে রয়েছে দু'টি, যদিও থাকার কথা ছিলো চারজনের তবু আছে তো ! দু'জনকেই মায়ের থেকে দূরে সরিয়ে নিতে সফল হয়েছেন কৃষ্ণকান্ত কৃষ্ণকান্তর মাধুরীকে আর প্রয়োজন নেই যে নারাজ তাকে জোর করে কেড়ে আনে কৃষ্ণকান্ত-রাধাকান্তরা, দরকারে যে অনিচ্ছুক, তাকে ভেঙে ফেলবে, তবু দখল করবেই কিন্তু যেই দায়িত্ব নেওয়ার সময় আসে, অমনি ঝেড়ে ফ্যালে, ওই চরের মানুষদের মতো, অথবা ওই রজতের মতো ! হাঁ ছেলেটা ফিরে এসেছে, সূর্য তাঁকে বলেছে, এই ছেলে মাধবীর ছেলে সূর্য এখন তাঁর চোখের একমাত্র আলো কালেভদ্রে মায়ের কাছে আসে রজতের মাতৃপরিচয় সে দিয়েছে, কিন্তু যেটা বলেনি, সেটা অনুমান করতে পারেন মাধুরী দেবী ওরা হয়তো অভিশপ্ত, একথা ভেবে তিনি আঁতকে ওঠেন তাঁর মনে পড়ে যায় মাধবীকে, বছর কুড়ি বয়স তখন মুখে একটা আলগা টান, সে টান অবধারিতভাবে পুরুষদের জন্য তখনও তিনি যথেষ্ট দেখতে পেতেন, সেসব তিনি ভোলেন নি তখনই তাঁর মনে হতো, এই মেয়ের জলদি বিয়ে না দিলে, মুশকিল আছে



মাধুরী দেবীর শাশুড়ি তখনও বেঁচে সুরবালা দেবী যেভাবে প্রাণে বেঁচে গিয়েছিলেন, সে প্রায় অকল্পনীয় ১৯৮৬ সালের ১০ই মার্চ বিহারে, অমৃতসর-টাটা এক্সপ্রেসের সাথে একটা মালগাড়ির সংঘর্ষে কোয়েল নদীর কাছে একটা নালায় ট্রেনের কয়েকটা বগি পড়ে যায় মাধুরী দেবীর শ্বশুর-শাশুড়ি দু'জনেই ছিলেন তাতে প্রায় পঞ্চাশ জনের মৃত্যু হয় তাঁর শ্বশুর শশীকান্ত মিত্র মারা গেলেও, সুরবালা দেবী প্রায় অক্ষত অবস্থায় ফিরে আসেন দিন তিনেক হসপিটালে থেকে, বাড়ি ফেরার পর তিনি সবাইকে ওই ঘটনার জন্য দোষারোপ করতে থাকেন বড্ড খিটখিটে হয়ে যান নানারকম শুচিবাই হয় তাঁর যার কিছু কিছু সম্প্রতি কৃষ্ণকান্তর মধ্যেও দেখা দিচ্ছে নিয়মিত স্নান করেন না, বারবার জল আছে কিনা, খোঁজ নেন, সবসময় যেন ব্যস্ত আর খিটখিটে হয়তো এঁরা নিজেদেরই দোষী বলে মনে করেন, ‘গ্লানি থেকেই হানি হয়’ - মাধুরীর বাবা স্বর্গতঃ অলোকনাথ মুখার্জি বলতেন তাই হবে... অপরাধ রে আর অপরাধবোধে ভোগে এরা শাশুড়ির সমস্যা কী ছিল, মাধুরী সঠিক জানে না চাপা মানুষ ছিলেন খুব কখনও ডাক্তার দেখাতেন না কিন্তু মাধুরীর স্বামীকে সম্প্রতি একবার ডাক্তার দেখানো হয়েছে কৃষ্ণেন্দু সবে পাস করে বেরিয়েছে, তাঁর বোনের ছেলে কৃষ্ণেন্দু ওর এক স্যারকে গত মাসেই নিয়ে এসেছিলো সুন্দরপুরে, মনোরোগ-বিশেষজ্ঞ ডাক্তারবাবুর মতে, কৃষ্ণকান্তর নাকি 'অবসেসিভ কম্পালসিভ ডিসঅর্ডার' ! সেটা যে কী বস্তু কে জানে ? আর ডিসঅর্ডার ! সেজো ছেলের মৃত্যুর পর থেকেই তাঁদের সম্পর্কে আর কোনোঅর্ডারনেইতাঁরা পৃথক থাকেন, বহুকাল হলো রাধাকান্ত উধাও হওয়ার পর স্বামীর অসহ্য গোপনীয়তায় বিরক্ত হয়ে, তিনি বাক্যালাপও বন্ধ করে দিয়েছেন ঘর থেকেও আর বেরোন না তবে এটুকু তিনি নিশ্চিত, তাঁর স্বামী দীর্ঘদিন বাঁচবেন কিন্তু তিনিই হয়তো থাকবেন না মাধুরী দেবীর আয়ু ফুরিয়ে আসছে কৃষ্ণেন্দুই আমতা আমতা বলেছে তাঁকে, তাঁর শরীরে রক্তাল্পতা আছে হতেই পারে, শাক-সবজি তিনি বরাবরই কম খেতেন আগে যখন এক টেবিলে বসে শাশুড়ি আর স্বামীর সাথে দুপুরেরে খাবার খেতেন, সুরবালা তাঁকে খাদ্যাভ্যাস নিয়ে কম খোঁটা দিতেন না কৃষ্ণকান্তও তেমন, কোনোদিন হয়তো খাবার ইচ্ছে নেই বলে ফুলকপিটা খেলেন না পরের দিন ফুলকপির কোনো রান্নার বাটিতে হাত বাড়ালেই, কৃষ্ণকান্ত বলে উঠতেন, “তোমার জন্য বানাবে না আর, ভক্তির মা-কে বারণ করে দিয়েছি মানে একদিন নারাজ হলে, কোনোদিন আর পাবে না এভাবে মা-ছেলেতে মিলে কম জ্বালিয়েছে তাঁকে ! মাধুরী দেবীর মনে পড়ে যায়, মাধবীকে ছেলের কথায় ভিতর বাড়িতে সিঁড়ির তলার ঘরে আশ্রয় দেবার পর সুরবালা দেবী বলেছিলেন, "ছারখার হয়ে যাবে সব, খুব ভুল করছো, সব অধঃপাতে যাবে " তিনি শোনেন নি, এখন বুঝতে পারেন, ভুল করেছিলেন আগুনকে চরের আগুনে পুড়তে দিলেই ভালো হতো, বড়োদের কথা শুনতে হয় ময়নার মা, অর্থাৎ ভক্তিদি যেদিন মাধবী-কে তাঁর ঘরে নিয়ে এসেছিলো, সেদিন সেই মুহূর্তেই তাঁর মনে হয়েছিলো, এই মেয়েকে নিয়ে মুশকিল আছে কী চোখ রে বাবা ! এই মুশকিলটা তাঁর নিজের ক্ষেত্রেও যৌবনে হয়েছিল কিনা, তাই তাঁর ভালোমতোই জানা আছে মেয়েটার চোখে যে আগুনটা তিনি দরজা দিয়ে ঢোকার সময়ে দেখতে পেয়েছিলেন, সেটা কিন্তু ঘরে ঢোকার পর দু-মিনিটেই বদলে গেল, বদলে জাগলো বিস্ময় আর প্রশ্ন




"ওটা কী গো ? জানালার সামনে টুলের ওপর একটা পাথরের ছাইদানির পাশে রাখা পিতলের যাঁতি দেখিয়ে প্রশ্ন করেছিলো বিহ্বল মাধবী মাধুরী দেবী বিবাহের সময় যে কয়টি জিনিস যৌতুক হিসেবে পেয়েছিলেন, ঐটি তার মধ্যে অন্যতম ব্যবসার কাজে বেনারসে গিয়ে তাঁর বাবা অলোকনাথ মুখার্জি ভারী পিতলের ওই চমৎকার যাঁতিখানা কিনে এনেছিলেন সুপারি কাটার কাজে লাগে, তবে পান খাওয়ার অভ্যাস তেমন নেই তাঁর, অবরে-সবরে খান তবে অদ্ভুত ভালোলাগে ওটা হাতে নিয়ে নাড়াচাড়া করতে ময়নার মা-কে তিনি ওইটিতে হাত পর্যন্ত দিতে দেন না অথচ ময়নার মা তাঁকে সেই বিয়ের পর থেকে চেনে বাড়ির পুরোনো কাজের লোক সে কিন্তু ওই মেয়ে কোনো অনুমতির তোয়াক্কা না করেই, তুলে নিয়েছিলো যাঁতিখানা যাঁতিটাতে ছুটন্ত ঘোড়ার পিঠে জীনের উপর, লাগাম ধরে বসা, এক মাথায় পাগড়ি-আঁটা ঘোড়সওয়ার অপূর্ব কাজ ! ওই জিনিস আর পাওয়া যায় না তাঁরও আর নেই চুরি হয়েছিল কে নিয়েছে, তিনি জানেন না কাকে দোষ দেবেন ?



পিতলের ওই যাঁতিটা হাতে নিলে মনে হতো ঘোড়সওয়ার তাঁকেই দেখছে সেদিন ভালো করে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে যাঁতিটা পরখ করেছিলো মেয়েটা, তারপর বললো, "মাইরি হেবি জিনিস !" কথাটা মনে পড়তেই মাধুরী দেবীর ঠোঁটের কোণে হাসি খেলে গেলো তারপর মাধবীর চোখ পড়লো দোয়াতে, তারপর একখানি কাজললতায় প্রত্যেকটাই হাতে নিয়ে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখে, তবে সে নিশ্চিন্ত হলো সেদিন মাধুরী দেবী সম্ভবতঃ আশ্বস্ত হয়েছিলেন এই ভেবে যে, এই মেয়েটিকে একটু গড়ে-পিটে নিতে পারলে কথা বলার একটা লোক পাওয়া যাবে তখনও তিনি মাধবীর আসল পরিচয় বিস্তারিত জানতেন না কিন্তু মেয়েটার চোখে-মুখে ছিলো বুদ্ধির ঝিলিক যেটা ময়নার মা ভক্তিদি বা, তার ছেলে নিতাই, কাপড় কাচার লোক ছন্দাদি বা, এরকম আর পাঁচজনের চোখে-মুখে দেখা যায় না ! ভালো লেগেছিলো, সেটাই হয়তো ভরসাও দিয়েছিলো কোথাও... ভুলই হয়েছিলো...



তিনিই তখন অন্দরমহল দেখাশোনা করতেন এখনকার মতো দৃষ্টিহীন অবস্থা তো ছিলো না, তবে চোখে একটা সমস্যা হতোই ছোটোবেলায় বাড়িতে অল্প আলোয় পড়াশোনা থেকেই যার শুরু তাঁর বাবার ব্যবসা কখনও ভালো, কখনও বেজায় মন্দা হ্যারিকেনের আলো থেকে তিনি হ্যাজাকে এসে পৌঁছোলেন বিয়ের পর কারেন্ট তো সুন্দরপুরেও খুবই যায় ঝড়-বৃষ্টি হলে তিন-চার দিন কারেন্ট থাকে না তবে বাড়ির মোটা মোটা দেওয়াল বলে একতলাটা ঠান্ডাই থাকে তবে দু'তলায় গরমকালে খুব কষ্ট হয় ছেলেরা ওই গরমেই থাকে ওদের সয়ে গিয়েছে তাঁর ঘরের ঠান্ডা মেঝেতে বসে মেয়েটা কতো প্রশ্ন যে করতো ! প্রশ্নের শেষ ছিলো না তার মোরব্বা সে কোনোদিন চাখে নি মাধুরী দেবী তাকে সিউড়ির বিখ্যাত মোরব্বা খাওয়ালেন শক্তিগড়ের ল্যাংচা, বর্ধমানের মিহিদানা আর সীতাভোগ কিংবা কৃষ্ণনগরের সরভাজার মতো সিউড়ির সঙ্গেও দীর্ঘ সময় ধরে জুড়ে রয়েছে মোরব্বার নাম বীরভূম জেলার সদর শহরে গেলে, অনেকেই তাই আম, বেল, শতমূল, পেঁপে, ন্যাসপাতি, আপেল, হরিতকী, আমলকী-সহ নানা বর্ণের সুস্বাদু মোরব্বা বাড়ির জন্য নিয়ে যেতে চান, অথবা একবার চেখে দেখতে চান তাঁদের বাড়িতে ওসব ভেট হিসেবে আসতো তখন, সদানন্দর বাবা- তো আদালতের মুহুরী ছিলেন, লোকে খাতির করতো এখন আর আসে না সে পাট কবেই চুকেছে তিনি মাধবীকে খাইয়েছিলেন চিনির কড়া রসে ডুবিয়ে বানানো রাজকীয় স্বাদের আম, চালকুমড়ো আর আমলকীর মোরব্বা ওগুলোই বেশি আসতো কিনা তখন ! তবে একবার শতমূলী মোরব্বা খেয়ে দু'জনেরই মনে হয়েছিলো, এর জবাব নেই সূর্য আবার রাগ করতো কাজের মেয়ের সাথে তাঁর এত ভাব দেখে বলতো, "ওকে ভালো ভালো জিনিস খাওয়াও কেন ? ফালতু মেয়ে একটা " কেন রে বাপু ! তুই মায়ের কাছে আসার সময় পাস না ! পড়াশোনা ছাড়াও খেলাধুলো, ছিপ ফেলা, মাছ ধরা, আড্ডা নিয়ে মেতে থাকিস ! এদিকে মা কী করে একা একা ? তারও তো একটা কথা বলার লোক চাই ! রান্নাঘরেও তাঁকে ঢুকতে দেওয়া হয় না ওসব ময়নার মা সামলাতো তখন

এরপর মনে পড়ে, বাঁকুড়ার রামপুরে তৈরি কাঠের ঘোড়া দেখে মাধবীর চমকানোর পালা পাঁচমুড়ার টেরাকোটার ধাঁচে ঘোড়ার কানগুলো বর্শার মতো খাড়া হয়ে উপরে উঠে আছে, নিখুঁত কাজ ! কাঠের গণ্ডার দেখে তো তার বিস্ময় ধরে না ! তারপর সে বোলপুরের কাঁথাস্টিচের ব্যাগ দেখে মোহিত হলো শ্রীনিকেতন, জামবুনি, বাহারি, বৈদ্যনাথপুর, বল্লভপুরের মেয়েরা ওসব ব্যাগ বানায় - মাধুরী শুনেছিলেন তমলুকের গহনা বড়ি, যা নাকি শুধু দেখবার, খাওয়ার জন্য নয়; সেও মেয়েরাই সূক্ষ্মহাতে বানায়, তাই দেখেও মাধবী মুগ্ধ হয়েছিলো সবুজ, কালো ব্যাগের উপর কতো চমৎকার কাজ ! যে পৃথিবীটা এতদিন মাধবীর অধরা ছিলো, সেটাকে সে তখন জাপটে ধরতে চাইছিলো ক্ষোভও হতো নিশ্চয়, কেন এতদিন তাকে এসব থেকে বঞ্চিত থাকতে হলো ! ক্ষোভ হবারই কথা মুর্শিদাবাদের দুটো পাটের পুতুল তিনি উপহার দিয়েছিলেন মাধবীকে খুব খুশি হয়েছিলো সেই পুতুলদুটো পেয়ে উজ্জ্বল মুখে বলেছিলো, "দ্যাকো দ্যাকো, কেমন মুকটা সাদা রেকেচে ! দেহটাকে লাল আর নীল করে দিয়েচে ! চোখ আর মুকে আবার কি সোন্দর রং, ঠোঁটের কাছটায় শুধু কালো ! মাথায় আবার রং মিল করে ঝুঁটি ! আমি কোনোদিন হারাবো না !" হায় ! তুই নিজেই হারিয়ে গেলি ?



মাধুরীও শিখেছিলেন, মাধবীর থেকে কীভাবে ওরা ব্যাঙের ছাতা আর কোরক অর্থাৎ মাশরুমের মধ্যে তফাৎ করে, কীভাবে তা রান্না করে, বকফুলের বড়া কীভাবে হয়, সেসব শুধু মুখে বলা নয়, ময়নার মা-কে ম্যানেজ করে রান্না করেও খাইয়েছিলো সে তারপর শাশুড়ি গত হলেন, সেসব শেখা তাঁর কাজেও লেগেছিলো তিনি নিজে কখনও ঘুঁটে দেন নি, গোবর ঘাঁটেন নি, তাই মাধবী তাঁকে একবার হাতে-কলমে ওসব নাড়াঘাঁটার সুযোগ করে দিয়েছিলো সবার অলক্ষে, ভীষণ চালু মেয়ে ছিলো কিন্তু সে কী গন্ধ ! বাপরে ! রাতে কৃষ্ণকান্ত পর্যন্ত গন্ধ টের পেয়ে বলেছিলেন, "গোবর নিয়ে কী করেছো ? পদ্মফুলের সাধনা ?" তিনি সজনে ফুল দিয়ে আলু ভাজা খেতে ভালোবাসতেন, মাধবী কতবার সেসব রেঁধে দিয়েছেডুমুর খাইয়েছে ময়নার মা-কে সে ম্যানেজ করেছিলো নিতাইকে হাত করে নিতাইয়ের তখন কিছু টাকার দরকার, সবে বিয়ে করেছিলো সে নিতাইয়ের ক্ষমতা ছিল না কৃষ্ণকান্তকে নিজের মুখে কিছু বলে তার মায়েরও সাহস ছিলো না তখন কিন্তু মাধবী বললো রাধাকান্তকে কীভাবে বলেছিলো, মাধুরী জানেন না কিন্তু সূর্যকান্ত একদিন তাঁকে কানে কানে জানিয়ে গেলো, "জানো মা, ওই মেয়েটাকে না দাদা মাঝে মাঝে টাকা দেয় " মাধুরী তখন বিশ্বাস করেন নি, উল্টে তাকেই বকেছিলেন, "তুমি কি সারাদিন মাধবীর ওপর নজরদারি করছো নাকি ? অন্য কোনো কাজ নেই তোমার ? কী ব্যাপারটা কী ?" মেজোর চোখে তখন অবিশ্বাস, "বা রে ! তুমি আমায় বকছো কেন ? মেয়েটার জন্য সবার খুব দরদতাই না ? চরের নোংরা মেয়ে একটা নামের আবার কত কেতা - মাধবী !" - বিদ্রূপ করতে ছাড়ে নি সূর্যকান্ত এখন মনে হয়, সেজো মণিকান্তর ভাগ্যে যে বিষ জুটেছিলো বলে তার বা, আরো অনেকের সন্দেহ, সেই বিষ সূর্যকান্তর জন্যই বরাদ্দ ছিলো প্রথমতঃ সূর্যকান্ত তার ওপর বড্ড নজর রাখতো, তার গতিবিধি এতে ব্যাহত হতো এছাড়া কৃষ্ণকান্তর উপরেও সে একটা শোধ নিতে চেয়েছিলো, কারণ সে খবর পেয়েছিলো দক্ষিণের চরে তার পরিচিতদের ঘরে আগুন লাগানো হয়েছে এবং কে সেই আগুন লাগিয়েছে ! সাবিত্রীর মৃত্যু তার পক্ষে মেনে নেওয়া কঠিন ছিলো দুঃখের বিষয় এর পিছনেও সূর্যকান্ত, সেই ওই অগ্নিকান্ডর খবরটা মাধবীর কানে তুলেছিলো সে কেন কে জানে, মাধবীকে দু-চক্ষে দেখতে পারতো না তার ছোটো ভাইকেও সে প্রভাবিত করেছিলো সূর্য মাধবীকে রাগিয়ে দিতেই একদিন বলে ফেলেছিলো, বোঝেনি কোথাকার জল কোথায় গড়াবে - বড্ড ওপরচালাক ছেলেটা তাঁর, ভীষণ বোকা বলা উচিত - অপরিণামদর্শী ভাগ্যিস্ ছোটোটা ওরকম নয়, সে একেবারেই অন্যরকম হয়েছে

ওই গান ভেসে আসছে... "রোমিও নাম মেরা.. চোরি হ্যায় কাম মেরা.." ! নিশ্চই পূবের ঘরে আসর বসেছে আসলে নবকান্ত দাদারা এসেছেন, ওনারা আজকাল মাঝেসাঝে বাড়িতে এসে থাকেন স্বামী-স্ত্রীতে বড্ড ভালো দুজনেই ছেলেদুটো মানে সূর্য আর চাঁদ তো সেভাবে কেউই দায়িত্ব নিতে শিখলো না অগত্যা নবকান্তদাদাকে বলে-কয়ে এনে রাখে কৃষ্ণকান্ত, একরকম বাধ্য হয়েই ভদ্রলোক গ্রামের একমাত্র লাইব্রেরির লাইব্রেরিয়ান অবসরের বয়সও প্রায় হয়ে এলো ! ওই স্কুলছুটির সময়টুকু বাদে লাইব্রেরি ফাঁকা-ফাঁকাই থাকে, বেশি বড়োও তো নয় জানালা দিয়ে কেমন ওপারে বেশ বিরাট পুকুরটা দেখা যায়, জলে কেমন ঝাউ, ইউক্যালিপটাস আর কদম গাছের ছায়া পড়ে ! চমৎকার ! মনে পড়তেই মাধুরী দেবীর মুখে অমলিন হাসি খেলে যায় ওখানে জানালার পাশটিতে চেয়ারে বসে শব্দছক মেলাতেন নবকান্তদাদা, তাঁর মনে পড়ে যায় জমি-জমার ব্যাপারেও তিনি এক্সপার্ট লোক, অনেক খবর রাখেন, আদালতের মুহুরীদেরও ভালোই চেনেন মৌজার হিসাব বোঝেন মাধুরীর খুড়শ্বশুরের কাছেই শেখা কৃষ্ণকান্তর দরকার না থাকলে সে কখনোই তার পিসতুতো দাদাটিকে এতো গুরুত্ব দিতো না ওনাদেরই ঘরে মালতী বৌদি মানে ওনার স্ত্রী, পাড়ার ঝি-চাকরদের নিয়ে বসে মাঝেসাঝেই এই সময়টা হিন্দি বা, বাংলা ছবি দেখেন ! কী নাকি কেবল্ লাইন হয়েছে আজকাল ! তিনি তো আর ওসব দেখার সুযোগ পেলেন না কালো চশমা এখন চোখে বেশি আলোতে কষ্ট হয় তাঁর কিন্তু সিনেমার টুকরো কথা বা, গুলি-গোলা চলার শব্দ তিনি এই ঘরে বসেই পান পাশের বাড়ির কাজের মেয়ে স্বপ্না সিনেমা দেখতে বসে প্রায়ই কাঁদেন, সে খবরও পৌঁছেছে তাঁর কানে তাঁর মনে পড়ে যায়, মাধবী একবার রাধাকান্তর সাথে সিনেমা দেখতে যেতে চেয়েছিলো, অবশ্যই সকলকে লুকিয়ে, কিন্তু তাঁর স্পাই সূর্য ঠিক খবরটা মায়ের কানে তুলে দিয়েছিলো কিন্তু সেদিন ছিলো বিবিমা পুজো তিনি তখনও বেরোতেন অল্পস্বল্প, এই আচার-অনুষ্ঠানগুলো ছিলো সেই সুযোগ লোকের ধারণা, তিনি বাড়ি থেকে বেরোন না তাঁকে যে সেভাবে কোনোদিনই বেরোতে দেওয়া হয় নি, সেটা খুব কম লোকেই জানে



বিবিমা বা ওলাবিবি এক লৌকিক দেবী; কলেরা, ডায়েরিয়া, পায়খানা, বমি অর্থাৎ ওলাওঠার মতো রোগ থেকে পরিত্রাণ পাবার আশায় মানুষ এই দেবীর পুজো দিয়ে আসছে বহুযুগ ধরে সুন্দরপুরে সাধারণত পৌষ, মাঘ, ফাল্গুনের শনি বা মঙ্গলবার দল বেঁধে দূর দূরান্ত থেকে গ্রামের মহিলারা উপোস করে এই পুজো দিতে আসেন গলায় খড়ের মালা বা বদি পরেন তাঁরা তার আগে মহিলারা বাড়ি বাড়ি মাঙ্গন অর্থাৎ ভিক্ষা সংগ্রহ করেন পয়সা চাল সংগ্রহের প্রথা পালন করে, তারপর পুজো দিতে যাওয়া হয় এই পুজোয় -টি আস্ত ফল দেওয়ার রীতি আছে বর্ণভেদ নেই দেবীর ভক্তদের মধ্যে, তবে নিম্নবর্ণের মানুষ বেশি যান বিবিমাতলায় দেবীর থানে গোড়া থেকেই একজন মুসলমান মহিলা, পুরোহিতের কাজ করেন বর্তমানে তিনি প্রৌঢ়া হিন্দু যেসব মহিলারা পুজো দিতে আসেন, তাঁরা সবাই তাঁকে মা বলে সম্বোধন করেন তিনবার থান পরিক্রমা করে ভক্তগণ পুজো দেন। ভক্তদের বিশ্বাস, তাঁদের আনা দুধ বিবিমার কাছে উৎসর্গ করলে, পরে প্রসাদী সেই দুধ খেয়ে পেটের রোগ সেরে যায় ভক্তগণ আস্ত নানান ফল, মোয়া, পাটালি, বাতাসা, ধূপ, মোমবাতি ইত্যাদি পূজারীর হাতে তুলে দেন বিবিমাকে উৎসর্গ করার জন্য পুজো শেষে ভক্তগণ তাঁদের সঙ্গে আনা মুড়ি-তরকারি বা, ওই জাতীয় কিছু নিয়ে আশেপাশে মাঠে বা গড়ের পাড় ধর এগিয়ে এসে গোষ্ঠতলার চাতালে বসে বনভোজনের প্রথা সারেন প্রথা অনুযায়ী, চাঁদ দেখার আগে বাড়িতে প্রবেশ করা যায় না তিনি অবশ্য মালতী বৌদিদির সাথে সোজা ভিতরপুকুরে গিয়ে চান করে, বরাবর ঘরে চলে আসতেন বেশিক্ষণ বাইরে থাকা, ছোটোলোকেদের সাথে বসাতে কর্তার বারণ ছিলো সেবার মাধবী সঙ্গে গেছিলো বাধ্য হয়ে তবে সকালে যে দোকান এসেছিলো ঝাঁকা নিয়ে, যারা ওই পুজোর দিন এসে থাকে আর কি, তাদের ঝাঁকা থেকে বাদামের ছাপা, চিঁড়ের ছাপা, কড়াইয়ের ছাপা, মুড়কি, বাতাসা, মিছিরি, পাটালিএই সবগুলোই মাধবী বাড়িতে থেকে যাওয়ার দরুণ অল্পস্বল্প চেখে দেখার সুযোগ পেয়েছিলো অবশ্য দোলের সময়েও সে ফেনি বাতাসা আর লাল-সাদা-সবুজ রঙের মঠগুলো মজা করেই চেখেছিলো নোলা ছিলো বটে মেয়েটার সেবার রাধার সাথে সিনেমা দেখার দুধের সাধ ওইভাবেই ঘোলে মেটাতে হয়েছিলো তাকে

কিন্তু এই পৌষ পার্বণের শুভ সময়টাতে এই ছেলেটা এসে উদয় হলো কেন ? কোথা থেকে ? যতটুকু সূর্য তাকে বলেছে, কৃষ্ণকান্ত নাকি সবই জানতো তিনিই কেবল জানতেন না নন্দদাদা ওদের মা-ব্যাটাকে আশ্রয় দিয়েছিলো, কোন্ চুলোয় কে জানে ! সে নাকি এতদিন অনাদরে ছিলো কৃষ্ণকান্ত দিন তিনেক হলো রজতকে এই বাড়িতে এনে তুলেছেন, মানুষ করবেন বলে তার মা মাধবী নাকি এখন কলকাতায় কোথায় আয়ার কাজ করে ! ভাবা যায় ! নন্দদাদাই ওকে দেখতো তার মানে ! নন্দদাদার মৃত্যুর পরে ওকে এখন দেখার কেউ নেই রজত এখন এই বাড়িতেই সিঁড়ির নীচের ঘরে থাকবে, যে ঘরে একসময় মাধবী থাকতো কিন্তু কান টানলে মাথা আসে অনুশোচনা থেকেই হোক্ বা, কোনো মতলবেই হোক্, তাঁর কর্ত্তা যে ফের মাধবীকে এই বাড়িতে টেনে আনতে চলেছে, বিষয়ে নিশ্চিত মাধুরী দেবী লোকটা আর কিছুতেই শিখলো না

(ক্রমশ...)


Post a Comment

1 Comments
* Please Don't Spam Here. All the Comments are Reviewed by Admin.
  1. খুব ভালো। এভাবেই এগিয়ে চলুক কাহিনি।

    ReplyDelete