ভ্রমণকাহিনি ।। ওঙ্কারেশ্বর জ্যোতির্লিঙ্গ ।। দেবী প্রসাদ ত্রিপাঠী
ওঙ্কারেশ্বর জ্যোতির্লিঙ্গ
দেবী প্রসাদ ত্রিপাঠী
২০১৭ সালের নভেম্বর মাসের প্রায় মাঝামাঝি সময়ে আমি ও আমার স্ত্রী উজ্জয়িনীর মহাকালেশ্বর জ্যোতির্লিঙ্গ দর্শন করে প্রায় দুপুর একটা বেজে তিরিশ মিনিটের সময় উজ্জয়িনী রেল স্টেশন থেকে একটি গাড়ি নিয়ে দ্বাদশ জ্যোতির্লিঙ্গের চতুর্থ জ্যোতির্লিঙ্গ ওংকারেশ্বরের পথে চললাম। উজ্জয়িনী থেকে ইন্দোরকে বাঁদিকে রেখে হাইওয়ে দিয়ে ঘাট পথ পেরিয়ে ওঙ্কারেশ্বর যাব- দূরত্ব প্রায় ১৩৮ কিলোমিটার। গাড়ির ড্রাইভার বলল সময় লাগবে প্রায় চার ঘণ্টা। ইন্দোরের পরে বালওয়ারা থেকে ঘাট পথের শুরু। মোরটক্কার থেকে ডানদিকে ওঙ্কারেশ্বর - মোরটক্কা - মান্ডি রোড হয়ে ওঙ্কারেশ্বর পৌছালাম প্রায় সাড়ে পাঁচটার সময়। শীতের দিন, সুতরাং আগে মাথা গোঁজার ঠাঁই করতে হবে। ট্যাক্সি স্ট্যান্ডের কাছে প্রায় প্রত্যেকটি হোটেল এবং ধর্মশালাতে চেষ্টা করলাম কিন্তু কোথাও জায়গা পেলাম না। অবশেষে প্রায় দেড়শ মিটার দূরে বাজারের শেষ প্রান্তে একটি নির্মীয়মাণ হোটেলে(হোটেল ঐশ্বর্য) জায়গা পেলাম। হোটেলটি নিরিবিলি, ফাঁকা জায়গায় এবং মোটামুটি ভাবে থাকা যায়। আমরা যেহেতু কার্তিক পূর্ণিমার ৪/৫ দিন আগে এসেছি সেই জন্য এখানকার হোটেল বা ধর্মশালা গুলি দর্শনার্থীতে পরিপূর্ণ। ওঙ্কারেশ্বর ধামে কার্তিক পূর্ণিমাতে বিরাট মেলা হয়। ভোর রাত্রি থেকে উজ্জয়িনীতে মহাকালেশ্বর মন্দিরে ভস্মারতি দেখে হরসিদ্ধি মাতার মন্দির দর্শন করে চার ঘন্টা যাবৎ ট্যাক্সিতে এসে খুব ক্লান্ত লাগছিল। স্থির করলাম আজ আর কোথাও যাবো না। পরেরদিন সকাল থেকে পূজা, দর্শন এবং পরিক্রমা করব। আগামী পরশু দিন এখান থেকে আমরা ফিরে যাব।
পরের দিন সকাল আটটার মধ্যে স্নান করে নর্মদার উপর সেতু পেরিয়ে পুণ্যতোয়া নর্মদার উত্তর তীরে ওঙ্কারেশ্বর ধামে গেলাম। সরিত শ্রেষ্ঠা নর্মদাকে দেখে অনেক কথাই মনে এসে গেল। সর্ব পাপহারিনী নর্মদাকে সকল দেবতা, গন্ধর্ব এবং ঋষিগণই পূজা করেন না দেবাদিদেব মহাদেবেরও তিনি পরম স্নেহের পাত্রী। নর্মদার উৎসস্থল অমরকন্টকের চূড়ায় ধ্যানমগ্ন ছিলেন ধূর্জটি। সহসা নীলকন্ঠের কণ্ঠ থেকে আবির্ভূত হলেন নর্মদা। নির্গতা হয়েই তিনি মহাদেবের দক্ষিণ চরণের উপর দাঁড়িয়ে শিব তপস্যাতে রত হলেন। কতকাল যে কেটে গেল তার ইয়ত্তা নেই। মহাদেবের যখন ধ্যান ভাঙলো তখন তিনি দেখলেন এই অপরূপা পিঙ্গল বর্ণের জটাধারী কন্যাকে যার অঙ্গের ঊর্জস্বল দীপ্তির ছটায় চারিদিক বিকীর্ণ হচ্ছে। যার বাম হস্তের সুডৌল কব্জিতে একটি কমণ্ডলু এবং দক্ষিণ হস্তের একটি আঙ্গুলে একটি অক্ষমালা দুলছে ঠিক যেন একটি নিবাত নিষ্কম্প দীপশিখা। যোগীবর তখন কন্যার তপস্যাতে তুষ্ট হয়ে জিজ্ঞেস করলেন -" কে তুমি মা? তোমার তপস্যাতে আমি সন্তুষ্ট হয়েছি - তুমি যা বর প্রার্থনা করবে তাই পূরণ হবে।" সেই কন্যা তখন উত্তর দিলেন- "আমি আপনার নীলকন্ঠ নিসৃতা, চিরকাল যেন এই ভাবে আপনার সাথে নিত্য যুক্তা হয়ে থাকতে পারি।" মহাদেব তাকে আশীর্বাদ করে বললেন - "তুমি শুধু আমার সাথে নিত্য যুক্তা হয়েই থাকবে না উপরন্তু তুমি একাধারে মোক্ষদাত্রী এবং সর্ব সিদ্ধি প্রদায়িনী হবে।" শিবের বরে সন্তুষ্ট হয়ে সেই কন্যা পুনরায় তপস্যা আরম্ভ করলেন। তার তপস্যায় বিচলিত হয়ে স্বর্গের দেবতারা ভাবলেন এই কন্যা নিশ্চয় স্বর্গ অধিকার করবেন। তখন দেবতারা নয়ন মনোহর রূপ ধারণ করে সেই কন্যাকে বিবাহের জন্য অনেক প্রলোভন দেখালেন, কিন্তু তিনি বিচলিত হলেন না। তখন দেবতারা স্থির করলেন জোরকরে কন্যাকে অধিকার করবেন। কন্যা তখন দেবতাদের অভিসন্ধি বুঝতে পেরে সহসা নদীর রূপ ধারণ করে অমরকন্টক থেকে পাহাড়-জঙ্গল গিরিকন্দরের ভিতর দিয়ে প্রবাহিত হয়ে চললেন যাতে দেবতারা তার আর কোন হদিস না পান। দেবতারা তখন পরাজয় স্বীকার করে ফিরে গেলেন। মহাদেব অলক্ষ্য থেকে সব দেখতে পেয়ে কন্যার সামনে আবির্ভূত হয়ে তার কান্ড দেখে প্রীত হয়ে তাকে আশীর্বাদ করে বললেন - "আজ থেকে তুমি শুধু আমার সাথে নিত্য যুক্তাই হবে না উপরন্তু আমার আনন্দ বিলাসের ক্ষেত্র হলে। তোমার নাম হবে নর্মদা। নর্ম অর্থাৎ পরম পরিতৃপ্ত বিধায়িনী পরম সুখ ও আনন্দদায়িনী মহাকুমারী শক্তির প্রতীক তুমি।" তিনি আরো বললেন - "আজ থেকে তুমি আমার জলময় রূপ হলে, তোমার কোলে তোমার পুত্র হয়ে নিত্যকাল বিরাজ করব চিন্ময় শক্তি সম্পন্ন শিব লিঙ্গ রূপে।" অমরকন্টক থেকে নির্গত হয়ে বিন্ধ্য ও সাতপুরা পর্বতমালার মধ্য দিয়ে প্রায় ১৩৫০ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে গুজরাটের ভারোচে যেয়ে আরব সাগরে মাতা নর্মদা লীন হয়েছেন।
আবার হিন্দু শাস্ত্র মতে কোন দেবদেবীর পুজো করতে হলে সর্বাগ্রে জলশুদ্ধি করতে হয়। জলশুদ্ধি এই মন্ত্রে করা হয় - "ওং গঙ্গে চ যমুনা চৈব গোদাবরী সরস্বতী নর্মদা সিন্ধু কাবেরী জলেস্মিন সন্নিধিং কুরু। কুরুক্ষেত্র গয়া গঙ্গা প্রভাস পুষ্করানীচ এতানি পুণ্য তীর্থানি সংকল্প কালে ভবন্তিহ।।" এই সাতটি নদীকে ভারতবর্ষের সবচেয়ে পবিত্রতম নদী বলে মান্য করা হয়। সরস্বতী নদী বর্তমানে অবলুপ্ত । অবশিষ্ট ষষ্ঠ নদীর অন্যতমা পুণ্য সলিলা নর্মদা। গঙ্গার অপার মহিমার কথা স্মরণে রেখেও প্রাচীন যুগের মহর্ষি ভৃগু, কর্দম, কপিল, দুর্বাসা, অনীমাণ্ডব্য প্রভৃতি বৈদিক ঋষিরা ঘোষণা করে গেছেন " নর্মদা সরিৎশ্রেষ্ঠা রুদ্র তেজা বিনিঃসৃতা। তারয়েৎ সর্ব ভূতানি স্থাবরানি চরানি চ।।" অর্থাৎ নর্মদা সমস্ত নদী সমূহের মধ্যে শ্রেষ্ঠা, রুদ্রের তেজ হতে সমুৎপন্না, স্থাবর,জঙ্গম সমস্ত কিছুকেই তিনি ত্রাণ করেন। মহাভারত রচয়িতা বেদব্যাস মহাভারতের বনপর্বে বলেছেন – "নর্মদান্তু সমাসাদ্য নদীং ত্রৈলোক্যবিশ্রুতাম্। তপয়িত্বা পিতন দেবান্ অগ্নিষ্টোমফলং লভেৎ।।" অর্থাৎ নর্মদা ত্রিলোক বিশ্রুতা, নর্মদা তীরে পিতৃপুরুষ এবং দেবতাদের পূজা তর্পণ করলে অগ্নিষ্টোম যজ্ঞানুষ্ঠানের ফল লাভ হয়। বেশিদিনের কথা নয়, বর্তমান যুগের লোকনাথ ব্রহ্মচারী বলেছেন - তিনি যখন নর্মদা পরিক্রমা করছিলেন তখন তিনি দেখেছিলেন একটি কৃষ্ণা রঙের গাভী সূর্যাস্তের পূর্বে নর্মদার একটি বিশেষ ঘাটে নেমে ডুব দিয়ে স্নান করার পরে শ্বেতবর্ণ হয়ে ফিরে যায়। এর রহস্য জানার জন্য তিনি ধ্যানস্থ হয়ে জানতে পারেন যে ওই কৃষ্ণা গাভী স্বয়ং গঙ্গা মাতা। সারাদিনে গঙ্গাতে যে অসংখ্য পাপী, তাপী লোক স্নান করে গঙ্গাকে কলুষিত করছে তার থেকে মুক্তি পাবার জন্য মা গঙ্গা নর্মদাতে ডুব দিয়ে তার পাপস্খালন করেন। নর্মদা শব্দটি মূর্তিমতী গায়ত্রীর মত ত্র্যক্ষরা। নর্মন দদাতি অর্থাৎ আনন্দ বিলাস যিনি দান করেন। আনন্দ ব্রম্ভের অলৌকিক আনন্দ বিলাস দেখবার, বুঝবার এবং অনুভব করার ক্ষমতা যিনি দান করেন তিনি নর্মদা। শাস্ত্র মতে নর্মদা পরিক্রমা প্রাচীন যুগ থেকে বর্তমান যুগ পর্যন্ত মুনিঋষিরা করেছেন শুধুমাত্র নর্মদা মাতার আশীর্বাদ পেয়ে সিদ্ধিলাভ করার জন্য। বর্তমান যুগের সাধারণ মানুষরা যেভাবে হুজুগে নর্মদা নদীকে মোটর গাড়িতে করে প্রদক্ষিণ করেন সেটি কিন্তু শাস্ত্র মতে নর্মদা পরিক্রমা নয়। শাস্ত্র মতে নর্মদা পরিক্রমার নিয়ম হলো নগ্নপদে অথবা খড়ম পরে দিনান্তে একবার স্বহস্ত নির্মিত আহার করে অথবা আকাশ বৃত্তি অবলম্বন করে নর্মদা মাতাকে সদা সর্বদা দৃষ্টির মধ্যে রেখে কোনরূপ যানবাহন অবলম্বন না করে নদীকে উল্লঙ্ঘন না করে উত্তর তট অথবা দক্ষিণ তট বরাবর অথবা উভয় তট ধরে পদব্রজে নর্মদা পরিক্রমা করতে হয়। এই রূপ পরিক্রমাতে পরিক্রমাকারীর সর্ব সিদ্ধি করায়ত্ত হয় এবং ঈশ্বর বিশ্বাস দৃঢ় হয়। এই রূপ পরিক্রমার সময় নর্মদা মাতাকে সর্বদা স্মরণে রাখলে তিনি পরিক্রমা কারীকে সর্ববিধ বিপদ থেকে রক্ষা করেন এবং অভীষ্ট ফল দান করেন । এখানে উল্লেখ করা যায় যে নর্মদা তীরের একমাত্র জ্যোতির্লিঙ্গ হলেন ওঙ্কারেশ্বর মহাদেব।
নর্মদার সেতু পেরিয়ে ওঙ্কার দ্বীপে পা রাখলাম। দ্বীপটির গঠন বৈচিত্র এমনভাবে অর্থাৎ নর্মদা ও কাবেরীর জলধারা দ্বীপকে এমন ভাবে বেষ্টিত করেছে মনে হয় যেন ওঁ অক্ষরের আকারে এবং জলের প্রবাহ সেইভাবেই এঁকে বেঁকে গেছে। দ্বীপটি পূর্ব পশ্চিমে প্রায় সাড়ে পাঁচ কিলোমিটার লম্বা এবং উত্তর-দক্ষিণে প্রায় তিন কিলোমিটার লম্বা। পূর্ব দিকে নদীর তীর থেকে প্রায় চার পাঁচশ ফুট উঁচু পাহাড় এবং ধীরে ধীরে পাহাড়টি ঢালু হয়ে পশ্চিমে নর্মদা ও কাবেরীর সঙ্গমস্থল এর কাছে সমতল ভূমিতে মিশেছে। দ্বীপের মধ্যবর্তী এই পাহাড়টি একটি উপত্যকা দ্বারা দু'ভাবে বিভক্ত। ওঁ অক্ষরটির মাহাত্ম্য ব্যাপক। প্রকৃতি থেকে উৎপন্ন সংসার রূপ মহাসাগরের নাম হল 'প্র' । প্রণব হল এই মহাসাগর থেকে পার করার জন্য নৌকা। প্রণব কথাটির প্রত্যেকটি অক্ষরের অর্থ ভিন্ন। প্র মাণে প্রপঞ্চ,ন মানে নেই এবং ব মানে তোমাদের জন্য। জ্ঞানী ব্যক্তিরা ওঁ কে প্রণব নামে জানেন, অর্থাৎ জ্ঞানী বা তপস্বীর কাছে প্রপঞ্চ বা মায়া নেই। ওঁ মন্ত্র জপকারী যোগীদের বা উপাসকদের দিব্য নূতন জ্ঞান প্রদান করে। মায়া রহিত পরমাত্মা, শুদ্ধস্বরপ মহেশ্বরকেই প্রণব বলা হয়। শিব পুরানের বিশ্বেশ্বর সংহিতাতে মহাদেব বলেছেন – "সর্বপ্রথম মহাদেবের মুখ থেকে ওঙ্কার উদগত হয় যা তার স্বরূপ বোধক। মহাদেবের উত্তর দিকের মুখ থেকে অ-কার, পশ্চিম মুখ থেকে উ-কার, দক্ষিণ মুখ থেকে ম-কার, পূর্ব মুখ থেকে বিন্দু এবং মধ্যের মুখ থেকে নাদ উচ্চারিত হয়েছিল। এইভাবে পাঁচ অবয়ব দ্বারা যুক্ত ওঁ কার বিস্তারিত হয়েছে। এইসব অবয়ব একত্রিত হয়ে প্রণব 'ওঁ' নামের এক অক্ষর হয়েছে। ওঁ কার-ই সমস্ত জগৎ পরিব্যাপ্ত। শিব ও শক্তির বোধক এই ওঁ মন্ত্র। ওঁ থেকে 'ওঁ নমঃ শিবায়' পঞ্চাক্ষর মন্ত্রের উদ্ভব। পঞ্চাক্ষর মন্ত্র থেকে গায়ত্রী এবং গায়ত্রী থেকে বেদ সমূহের সৃষ্টি। বেদের থেকে সমস্ত দেব দেবীর আবাহন, ধ্যান, বীজ, প্রণাম ও বিসর্জনের মন্ত্রের সৃষ্টি।" প্রণবের দুটি ভাগ - স্থূল এবং সূক্ষ্ম। এক অক্ষর বিশিষ্ট ওঁ সূক্ষ্ম রূপ এবং' নমঃ শিবায়' পঞ্চাক্ষর যুক্ত মন্ত্র স্থূল রূপ। সূক্ষ্ম প্রণবের হ্রস্ব ও দীর্ঘ দুটি ভেদের কথা জানা উচিত। অ-কার, উ-কার, ম-কার, বিন্দু, নাদ, শব্দ, কাল এবং কলা - এর দ্বারা যুক্ত যে প্রনব তাকে বলা হয় দীর্ঘ প্রণব। তা' কেবলমাত্র যোগীর হৃদয়েই স্থিত হয়। ম-কার পর্যন্ত যে ওঁ তা' অ, উঃ,ম্ - এই তিন তত্ত্ব দ্বারা যুক্ত। একে হ্রস্ব প্রণব বলা হয়। অ-শিব, উ-শক্তি এবং ম হল দুই এর ঐক্য সম্পাদনকারী। এটি ত্রিতত্ত্বরূপ এরূপ মনে করে এই হ্রস্ব প্রণব জপ করা উচিত। প্রবৃত্তিমার্গী পুরুষের হ্রস্ব প্রণব এবং নিবৃত্তিমার্গী পুরুষের দীর্ঘ প্রণব জপ করা উচিত। অন্য মন্ত্রের শুরুতে হ্রস্ব প্রণব উচ্চারণ করা হয়ে থাকে।
আবার তারকব্রহ্ম নাম রাম এবং ওঙ্কার একই জিনিস। রাম শব্দ বিশ্লেষণ করলে দেখতে পাই - র্+ আ+ ম্+ অ = র্+ অ+ অ+ম্ +অ । স্বরবর্ণ মাত্রই পুংলিঙ্গ এবং স্বাধীন। আর ব্যঞ্জনবর্ণ মাত্রই স্ত্রীলিঙ্গ বা পরাধীন। পাণিনির আদ্যন্ত বিপর্যয় সূত্র অনুসারে বিশ্লেষিত রাম শব্দের অ সামনে এল। তাহলে - অ+ র্ +অ +অ +ম। ব্যাকরণের নিয়ম অনুসারে যদি কোন শব্দের 'র' বর্ণের পূর্বভাগে এবং উত্তর ভাগে 'অ' বসে তবে তার 'র' বর্ণ 'উ' বর্ণে পরিণত হয়। ফলে অ +র্ +অ = উ । এবারে উ+ অ = 'ও' হবে। তাহলে ও + ম= ওম্ বা ওঁ হয়ে গেল। এইভাবে রাম শব্দের মধ্যে ওঁ লুকিয়ে আছে। ঋষিদের উপলব্ধি ওঁ কার তত্ত্ব মনন করলে যেমন কোন বস্তুই অপ্রাপ্ত থাকে না অনুরূপভাবে রাম শব্দ মনন করলেও কোন বস্তুই অপ্রাপ্ত থাকেনা। ওঙ্কার যেমন মোক্ষ দান করে রাম এই সিদ্ধ শব্দও মোক্ষ দান করে। তাই রাম মন্ত্র কে বলা হয় তারকব্রহ্ম নাম।
মন্দিরে আমরা ওঙ্কারেশ্বর জ্যোতির্লিঙ্গের পূজো দিতে গেলাম। একজন পান্ডা আমাদের মন্দিরের ভিতরে নিয়ে গেলেন। ওঁকারেশ্বর মন্দির পাঁচতলা বিশিষ্ট পশ্চিম মুখী মন্দির। বিশাল বিশাল লাল পাথরের স্তম্ভ বৈদুর্য পর্বত গাত্রে এই মহাদেব মন্দিরকে সুউচ্চ ভিত্তির উপর খাড়া করে রেখেছে। প্রত্যেকটি স্তম্ভ ১৪ ফুট উঁচু এবং মুখ্য মণ্ডপে মোট ষাটটি স্তম্ভ আছে। স্তম্ভ গুলি সূক্ষ্ম কারুকার্যমন্ডিত। নাটমন্দিরের কক্ষতলে সাদা ও কালো রংয়ের চতুষ্কোণ বিশিষ্ট পাথর বসানো আছে । নাটমন্দিরের প্রান্তে মন্দিরের গর্ভগৃহ তার দরজা উত্তরমুখী এবং ওঁকারেশ্বর জ্যোতির্লিঙ্গ স্বমহিমায় বিরাজিত। উজ্জয়িনীর মহাকালেশ্বর মন্দিরে যেরকম দর্শনার্থীর ভিড় দেখেছিলাম এবং মন্দিরের পাহারাদাররা যেভাবে এক ঝলক দর্শনের পরে দর্শনার্থীদের সরিয়ে দিচ্ছিল, আমরা ভেবেছিলাম এখানেও সেইরকম ঘটনার মুখোমুখি হতে হবে। কিন্তু ওঁকারেশ্বর বাবার অসীম কৃপায় আমরা মন্দিরে যখন প্রবেশ করলাম তখন নামমাত্র দশ থেকে বারোজন দর্শনার্থী ছিল। সুতরাং আমরা জ্যোতির্লিঙ্গের সামনে প্রাণভরে দর্শন করতে পারলাম ও প্রণাম করলাম। অন্তর অনির্বচনীয় আনন্দে ভরে গেল। প্রণাম করে দুচোখ ভরে দেখতে লাগলাম অমল ধবল ওঙ্কারেশ্বর জ্যোতির্লিঙ্গকে। লিঙ্গ মুলে নর্মদার সাথে যোগ আছে তাই নিত্য জলপূর্ণ চতুষ্কোণ ক্ষেত্রের মতো একটি কুণ্ডের মধ্যস্থলে জেগে আছেন ওঙ্কারেশ্বর জ্যোতির্লিঙ্গ।ডানদিকে জ্বলছে অনির্বাণ ঘিয়ের প্রদীপ যা কখনও নিভে না। শিবলিঙ্গের পিছনে মা পার্বতীর শ্বেতপাথরের বিগ্রহ। অন্যান্য শিবলিঙ্গের মত ওঙ্কারেশ্বরে কোন যোনিপীঠ নেই বা গৌরীপট্ট নেই, কারন প্রকৃত জ্যোতির্লিঙ্গে কোন যোনিপীঠ থাকেনা। জ্যোতির্লিঙ্গের ডানদিকে পূজারী বসে আছেন। ফুলের আলপনা, মাঝখানে জ্যোতির্লিঙ্গ বিরাজিত। আমাদের কাছে যে ফুল বেলপাতা ছিল তার অর্ধেক পূজারীকে দিতে তিনি ওঙ্কারেশ্বরের পূজা করে দিলেন। এখানে উল্লেখ্য যে ওঙ্কারেশ্বর মন্দিরের প্রাতঃকালীন পূজা করেন ওঙ্কারেশ্বর মন্দির ট্রাস্টের নির্বাচিত পূজারীরা, মধ্যাহ্নের পূজা করেন গোয়ালিয়রের সিন্ধিয়া রাজবংশের নির্দিষ্ট পুজারীরা এবং সান্ধ্যকালীন পূজা করেন ইন্দোরের হোলকার রাজবংশের নির্দিষ্ট করা পূজারীরা। এরপরে তীর্থ পান্ডার সাথে নাটমন্দিরে এলাম। তীর্থপাণ্ডা সেখানে আমাদের দুজনকে পার্থিব শিবলিঙ্গের সামনে বসিয়ে যথোচিত নিয়ম মেনে পূজা করালেন। এরপরে তীর্থ পান্ডা আমাদের স্কন্দপুরাণ পুঁথি খুলে মহামুনি মার্কণ্ডেয় কথিত ওঙ্কারেশ্বরের মহিমা পড়ে শোনালেন। সেখানে স্বয়ং বিশ্বেশ্বর মহাদেব পার্বতী দেবীকে বলছেন - 'হে দেবী জগতে যিনি ওঙ্কারেশ্বর নামে প্রসিদ্ধ আমি তার মাহাত্ম্য বলছি তুমি শোনো। আমি পূর্বে প্রাকৃত কল্পে আমার মুখ হতে এক কপিলাকৃতি পুরুষকে সৃষ্টি করে তাকে বলি তুমি নিজের আত্মাকে বিভক্ত কর। কিভাবে নিজের আত্মাকে বিভক্ত করবে সেই চিন্তায় যখন সেই পুরুষ ধ্যানে আবিষ্ট সেই সময় আমার প্রসাদে তার দেহ ভেদ করে ত্রিবর্ণ স্বররূপী চতুর্বর্গ ফলপ্রদ ঋক্, যজুঃ, সাম্ নামে ব্রহ্মা বিষ্ণু শিবাত্মক ওঁকার স্বীয় প্রভাবে অখিললোক পরিব্যাপ্ত করে আবির্ভূত হলেন। এই সময় আমার আশীর্বাদে ওঁকারের হৃদয় হতে বষট্- কার ধ্বনি উত্থিত হল, আর ছন্দঃশ্রেষ্ঠা চতুর্বিংশতি অক্ষরবিশিষ্ট পঞ্চশীর্ষা মধুরভাষিণী দেবী গায়ত্রীও তারই পাশে প্রকাশিত হলেন। এই গায়ত্রী দেবীই সাবিত্রী নামে জগতে প্রসিদ্ধ। বিশ্বেশ্বর শিব তখন গায়ত্রী অনুসৃত্র ওঁকার কে বললেন – “ তোমরা উভয়ে বিচিত্র সৃষ্টির সূচনা কর"। মহাদেবের কথা শুনে হিরণ্ময় ত্রিশিখ ওঁকার তাঁর জ্যোতি থেকে প্রথমে বেদ সৃষ্টি করলেন, পরে ক্রমে ক্রমে তেত্রিশ জন বৈদিক দেবতা,কয়েকজন ঋষি এবং মানুষের সৃষ্টি হল। এই ওঙ্কার থেকেই বেদ, যজ্ঞ, জ্ঞান ও তপস্যার উৎপত্তি ঘটেছে। সমস্ত সৃষ্টি কার্য শেষ হলে এই ওঙ্কার ভগবান মহাদেবের কাছে তার স্থিতি যোগ্য পবিত্র স্থান নির্দিষ্ট করে দিতে বললেন। তার উত্তরে মহাদেব শুলপানি ঝাড়ি বা জঙ্গলের পূর্ব দিকে মহাকাল বনের এই স্থানটিকে তার আবাসস্থল হিসাবে নির্দিষ্ট করে দিলেন এবং বললেন যে এই মহাকাল বনে ত্রিকল্প কাল ব্যাপী যে লিঙ্গ বিদ্যমান আছেন সেই লিঙ্গ এই ওঁকার-এর নামে ওঁকারেশ্বর জ্যোতির্লিঙ্গরূপে প্রসিদ্ধিলাভ করবেন। মহাদেবের এই কথা শুনে ওঁকার হৃষ্ট চিত্তে সেই লিঙ্গকে দর্শণ করে তাতেই লয় প্রাপ্ত হন। চতুর্বেদ অধ্যয়ন করলে যে পূণ্য হয় ওঁকারেশ্বর জ্যোতির্লিঙ্গ দর্শন করলে সেই পূণ্য লাভ হয়ে থাকে। তীর্থ পান্ডার মুখে ওঙ্কারেশ্বর সম্বন্ধে স্কন্দপুরাণের এই ভাষ্যটি শুনে আমাদের হৃদয় রোমাঞ্চিত হয়ে উঠল। মনে ভাবলাম এর থেকে আর কোনও পুণ্যতম স্থান পৃথিবীতে নাই। আমার স্ত্রী তীর্থ পান্ডাকে এই ওংকারেশ্বর সম্বন্ধে আর কোন কাহিনী তার জানা থাকলে বলার জন্য অনুরোধ করলেন। তীর্থ পান্ডা তখন আরও একটি কাহিনী বললেন।
শিব পুরাণের কোটিরুদ্র সংহিতা খণ্ড অনুযায়ী ব্রহ্মার মানসপুত্র নারদ ঋষি একবার বিন্ধ্য পর্বতে যেয়ে ভগবান মহাদেবের তপস্যা করতে শুরু করলেন। তাকে তপস্যা করতে দেখে বিন্ধ্য খুব খুশি হলেন। বিন্ধ্য নারদের কাছে যেয়ে তাঁর যথোচিত সম্মান দিয়ে তাঁকে বললেন - " মুনিবর আপনি যখন আমাকে তপস্যার উপযুক্ত স্থান হিসাবে নির্বাচন করেছেন তাহলে পৃথিবীর সমস্ত পর্বত থেকে আমিই শ্রেষ্ঠ।" বিন্ধ্যের কথা শুনে নারদ মুনি দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন - "তপস্যার উপযুক্ত স্থান হিসাবে তোমার এখানে সবকিছুই আছে সত্য, তবে সুমেরু পর্বত তোমার থেকেও বড় এবং শ্রেষ্ঠ কারণ সেই সুমেরু পর্বত দেবাদিদেব মহাদেব ও মা পার্বতীর আবাসস্থল। সুমেরু শ্রেষ্ঠ না হলে তাঁরা তাঁদের আবাসস্থল হিসাবে সুমেরুকে নির্বাচিত করতেন না।" আমি সুমেরু থেকেই তোমার এখানে এসেছিলাম। সুমেরুর শিখর ভাগ দেবলোকে পৌঁছে গেছে। এই বলে নারদ মুনি চলে গেলেন। স্তব্ধ ভগ্ন হৃদয় বিন্ধ্য মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইলেন মনের দুঃখে। বিন্ধ্য মনে মনে প্রতিজ্ঞা করলেন যে তাকে সুমেরুর থেকে শ্রেষ্ঠ হতে হবে, সময় নষ্ট না করে বিন্ধ্য যেখানে সাক্ষাৎ ওঙ্কার-এর সৃষ্টি সেই বৈদূর্য পর্বতে যেয়ে দেবাদিদেব মহাদেবের পার্থিব লিঙ্গ তৈরি করে তপস্যা শুরু করলেন। বছরের পর বছর কেটে যায় বিন্ধ্য তার তপস্যায় অটল। তার তপস্যাতে তুষ্ট হয়ে একদিন মহাদেব বিন্ধ্যের কাছে আবির্ভূত হয়ে তাকে বর দিতে চাইলেন। বিন্ধ্য বললেন- "হে ভক্তবৎসল আশুতোষ, আপনি যদি সত্যই আমার তপস্যাতে সন্তুষ্ট হয়ে থাকেন তাহলে আপনি আমাকে পবিত্র করুন এবং তাবৎ পর্বত কুলের মধ্যে আমাকে সর্বোচ্চ করে দেন। এই স্থানে আপনি চিরকাল স্থিতি লাভ করুন এবং পূণ্যবান মানুষেরা যেন এখানে এসে তাদের প্রার্থিত সাধনাতে সিদ্ধিলাভ করেন।" মহাদেব বিন্ধ্যের প্রার্থনা পূরণ করে বললেন - " তোমার এই স্থানে এসে মুনি-ঋষিরা তাদের তপস্যায় সিদ্ধিলাভ করবেন এবং তুমি পর্বত কুলের মধ্যে সর্বোচ্চ হবে, যদি না তুমি ভবিষ্যতে জগতের পক্ষে কোন বাধার সৃষ্টি কর।" শিবের আশীর্বাদে বিন্ধ্য খুব খুশী হলেন। এরপরে মহাদেবের সতর্কবাণী ভুলে বিন্ধ্য নিজেকে ক্রমশ উন্নত করতে লাগলেন। তার এই উন্নত শির পৃথিবীতে সূর্য ও চন্দ্রের কিরনের আসা যাওয়ার পথে বাধা সৃষ্টি করতে লাগল। দেবতারা এই দেখে প্রমাদ গুনলেন, কারণ পৃথিবী অন্ধকারাচ্ছন্ন হওয়ার ফলে তাবৎ জীবকুলের জীবন দুর্বিষহ হয়ে উঠল। তখন তারা বিন্ধ্যের গুরুদেব অগস্ত্য মহা মুনিকে এই ঘটনা বললেন এবং তাকে অনুরোধ করলেন এই অবস্থা থেকে পরিত্রান করার জন্য। অগস্ত্য মুনি এবং তার স্ত্রী লোপামুদ্রা তখন বিন্ধ্যের কাছে এলেন। বিন্ধ্য তার গুরুদেব এবং গুরুমাকে যথোচিত পাদ্য অর্ঘ্য দিয়ে বন্দনা করে দণ্ডবৎ হয় প্রণাম করলেন। বিন্ধ্যের প্রণাম অবস্থাতে অগস্ত্য মহামুনি বললেন - " তোমার আতিথ্যে আমরা খুব প্রীত হয়েছি। আমরা যতদিন না এই পথে পুনরায় ফিরে আসছি ততদিন তুমি এই অবস্থাতে থাকবে।" গুরুদেবের আদেশ নতমস্তকে মেনে নিয়ে বিন্ধ্য বললেন - "তাই হবে প্রভু।" অগস্ত্য মহামুনি এবং তার স্ত্রী লোপামুদ্রা বিন্ধ্যর কাছ থেকে বিদায় নিয়ে দক্ষিনে ক্রৌঞ্চ পর্বতে (শ্রীশৈলম পর্বত) যেয়ে সেখানে রয়ে গেলেন আর ফিরলেন না। তারা না ফেরার জন্য বিন্ধ্যের উদ্ধত শির চিরকালের জন্য নত হয়ে থাকল।
এই জ্যোতির্লিঙ্গ সম্বন্ধে আরো দুটি কাহিনী আছে। ত্রেতাযুগে ইক্ষাকু বংশের নৃপতি মান্ধাতা শিবের তপস্যা শুরু করেছিলেন। তার তপস্যাতে দেবাদিদেব সন্তুষ্ট হয়ে তাঁর সম্মুখে আবির্ভূত হলেন বিরাট এক জ্যোতির কলেবরে। সেই জ্যোতিঃপুঞ্জের দিকে মান্ধাতা তাকাতেই তার দৃষ্টিশক্তি নষ্ট হয়ে গেল । তখন তিনি মহাদেব কে বললেন - "প্রভু যদি সত্যিই আপনি আমার তপস্যাতে প্রীত হয়ে থাকেন তাহলে আপনার এই জ্যোতির তেজ হ্রাস করে এখানে আপনি এমন ভাবে বিরাজ করুন যাতে মানবকুল আপনার দর্শন লাভে প্রীত হয়।" সেই জ্যোতিঃপুঞ্জ তখন লিঙ্গ রূপ ধারণ করে মামলেশ্বর নামে নর্মদা তীরের দক্ষিণ দিকে স্থিত হলেন। মহাদেবের আশীর্বাদে রাজা মান্ধাতা তার দৃষ্টিশক্তি ফিরে পেলেন। পরে রাজা মান্ধাতার পুত্র মুচুকুন্দ সেই জ্যোতির্লিঙ্গের উপর মন্দির নির্মাণ করে দেন। দ্বিতীয় কাহিনীটি হল রাজা মান্ধাতা নর্মদা পরিক্রমা করতে বেরিয়েছিলেন। ওঙ্কার পর্বতে এসে তিনি মনস্থির করলেন রুদ্র যজ্ঞ করার। যজ্ঞ শুরু করার পরে সেই যজ্ঞের লেলিহান অগ্নিশিখা আকাশ ছুঁই ছুঁই। অগ্নির তেজে ওঙ্কার পর্বতের বৃক্ষরাজি, পশু, পাখিদের ত্রাহি ত্রাহি অবস্থা। মহাদেব তখন ব্যাধের রূপ ধারণ করে মান্ধাতার যজ্ঞস্থলীতে এসে বললেন - "তুমি আগুন জেলে আমার শিকার সব নষ্ট করছ, জন্তু-জানোয়াররা আগুনের তাপে জঙ্গল ছেড়ে পালিয়ে যাচ্ছে, তুমি যজ্ঞ বন্ধ কর।" মান্ধাতা বললেন- "আমি শিবের আরাধনার জন্য এই যজ্ঞ করছি, এই যজ্ঞ বন্ধ করা আমার পক্ষে সম্ভব নয়, তুমি বরং অন্য জঙ্গলে যেয়ে শিকার কর।" কিরাতরূপী শিব ও রাজা মান্ধাতা দুজনেই নিজের নিজের কথাতে অনঢ়। অগত্যা দুজনের মধ্যে শুরু হলো মল্লযুদ্ধ। মল্লযুদ্ধের সময়ে রাজা মান্ধাতা মহাদেবকে স্মরন করে ওঙ্কার নাদ করে উঠলেন। ওঙ্কার নাদ শুনে শিব আর নিজেকে প্রচ্ছন্ন রাখতে পারলেন না. কিরাতরূপ ত্যাগ করে ভক্তের সামনে আবির্ভূত হলেন। মহাদেবের চরনে ভূপতিত হয়ে রাজা মান্ধাতা তখন প্রার্থনা করলেন -" প্রভু, আপনি যদি আমার উপর সন্তুষ্ট হয়ে' আবির্ভূত হলেন, তাহলে এখানে আপনি চিরকাল বিরাজ করুন।" শিব বললেন - তথাস্তু। এই বলে তিনি অন্তর্হিত হলেন। শিব রাজা মান্ধাতার সাথে মল্লযুদ্ধ করেছিলেন বলে জ্যোতির্লিঙ্গের নাম হল মল্লেশ্বর বা মামলেশ্বর। মামলেশ্বর জ্যোতির্লিঙ্গ নর্মদার দক্ষিণ তটে ব্রহ্মাপুরী এবং বিষ্ণুপুরীর মধ্যস্থলে। মান্ধাতার পুত্র মুচুকুন্দ ওঙ্কার দ্বীপের উত্তর-পশ্চিম দিকে এক বিরাট প্রাসাদ তৈরি করেছিলেন। অশ্বমেধ যজ্ঞের অনুষ্ঠান এবং বেদ মন্ত্রের ধ্বনিতে এই প্রাসাদ সব সময় মুখরিত থাকত। কালক্রমে হৈহয় বংশের রাজা মহিষ্মৎ এই নগরী জয় করেন এবং তার নামানুসারে নগরীর নাম হয় মাহিষ্মতী। এই হৈহয় বংশের শ্রেষ্ঠ নৃপতি ছিলেন কার্তবীর্যার্জুন। তার আমলে আসমুদ্র হিমাচল তার সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত হয়। লঙ্কার রাক্ষসরাজ রাবণকে তিনি পরাজিত করে কারাগারে বন্দী করে রেখেছিলেন। পরে পুলস্ত্য মুনির অনুরোধে রাবনকে কারাগার থেকে মুক্ত করেন। মহাক্ষত্রপ রুদ্রদামন-এর জুনাগড় শিলালিপিতে কার্তবীর্যার্জুনকে 'অনুপনিবৃৎ' অর্থাৎ আসমুদ্র হিমাচলের রাজা বলে উল্লেখ আছে।
এছাড়াও মহাকবি কালিদাসের রঘুবংশ কাব্য গ্রন্থ থেকে জানা যায় যে নর্মদা বা রেবা নদীর তীরে বহু প্রাসাদ শোভিত মাহিষ্মতী একটি সমৃদ্ধশালী নগরী ছিল। রঘুবংশ কাব্য গ্রন্থে রাজকন্যা ইন্দুমতীর স্বয়ংবর সভাতে উপস্থিত কার্তবীর্যার্জুনের বংশধর মহারাজ প্রতীপের কাছে এসে তার পরিচয় রাজপ্রাসাদের প্রধান দ্বারপালিকার মুখ দিয়ে মহাকবি এইভাবে বলেছেন - "অস্যাঙ্কলক্ষীর্ভব দীর্ঘবাহোমাহিষ্মতীব প্রণিতম্বকাঞ্চীম্। প্রাসাদজালের্জলবেনিরম্যাম্, রেবাং যদি প্রেক্ষিতুমস্তি কামঃ।" (রঘুবংশ ষষ্ঠ সর্গ পৃষ্ঠা ৪৩) অর্থাৎ মহারাজ কার্তবীর্যার্জুনের বংশধর প্রতীপের রাজধানী মাহিষ্মতী নগরীর প্রাকার রূপ নিতম্বে রেবা নদী মেখলার ন্যায় শোভা পাচ্ছে । সেই প্রাসাদের গবাক্ষ হতে যদি রেবা নদীর রমণীয় জলপ্রবাহ তোমার দর্শন করার ইচ্ছা হয়, তবে তুমি এই দীর্ঘ বাহু নরপতির অঙ্কলক্ষী হও। সাঁচীর অনুশাসন লিপিতেও মাহিষ্মতী নগরীর উল্লেখ আছে। পারমার বংশের রাজা দেবপালের মান্ধাতা অনুশাসন লিপি হতে জানা যায় খ্রিস্টীয় ত্রয়োদশ শতাব্দীতে মাহিষ্মতী নগরীতে অবস্থানকালীন রাজা দেবপাল ওঙ্কার পর্বতে বহু শিব মন্দির নির্মাণ ও সংস্কার করেন। বর্তমানে সেই প্রাসাদের ধ্বংসাবশেষ হিসাবে বিরাট চওড়া পাথরের প্রাচীর গাত্র, কোথাও বা তোরণের ধ্বংসাবশেষ দেখা যায়। বর্তমানের ধ্বংসাবশেষ দেখে কল্পনাও করা যাবে না যে একদিন এখানের রাজপ্রাসাদ বা দুর্গ কিরকম বিশাল ও ঐশ্বর্য আড়ম্বরে পরিপূর্ণ ছিল। এরপরের ইতিহাস হল ভীল দস্যুরা এই মান্ধাতার রাজা হয়। মান্ধাতার রাজাকে বলা হত ভীলালা। এই রাজারা চৌহান রাজপুত ভরত সিংহের বংশধর ছিল। ধারের পারমার, মালওয়ারের সুলতান এবং সর্বশেষে গোয়ালিয়রের সিন্ধিয়াদের অধীনে তারা এখানে রাজত্ব করত । ১১৬৫ খ্রীষ্টাব্দে মন্দিরের পুরোহিত দরিদ্র নাথ গোঁসাইয়ের আমন্ত্রণে চৌহান রাজ ভরত সিংহ এসে ভীল সর্দার মাথু ভীলকে হত্যা করে তার কন্যাকে বিবাহ করে এখানকার অধিকার আয়ত্ত্ব করে। ভীলরা ছিল পার্বত্য জাতি। রাজপুত বংশের সাথে ভীলদের বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হওয়ার ফলে যে মিশ্র জাতির উদ্ভব হল তারাই ভীলালা নামে পরিচিত। বর্তমানে ওঙ্কারেশ্বর মন্দিরের পুরোহিতরা পূর্বতন দরিদ্র নাথ গোঁসাইয়ের বংশধর। এখানে উল্লেখ্য যে ব্রিটিশ শাসনের পূর্বে ওঙ্কারেশ্বরের বীরখালা পাহাড়ের ভৈরবশিরাতে বীভৎস নরবলি হত প্রতি বৎসর কার্তিক মাসের প্রথম ভাগে। নরবলি অনুষ্ঠানের সাথে চার দিন ব্যাপী বিরাট মেলা বসত। সেই সময় মেলাতে প্রায় পঁচিশ থেকে তিরিশ হাজার লোকের জমায়েত হত। তারা যা প্রণামী দিত তা লুটপাট করত দুর্ধর্ষ ভীল দস্যুরা। সেই জন্য রাজার সৈন্যদের সাথে ভীলদের প্রকাশ্য যুদ্ধ হত। এরপরে ১৮২৪ খ্রীষ্টাব্দে ব্রিটিশের শাসনাধীনে ওঙ্কারদ্বীপ আসে এবং এই রাজারা ব্রিটিশের জায়গীরদার হয়।
তীর্থপান্ডা আরো বললেন দৈত্যরাজ পরম শিবভক্ত বান রাজার রাজধানী এখানেই ছিল। এখানেই বানকন্যা ঊষার সাথে শ্রীকৃষ্ণের পৌত্র অনিরুদ্ধের প্রণয় হয়েছিল। বান রাজা অনিরুদ্ধকে বন্দী করে রাখার পরে শ্রীকৃষ্ণ পুত্র প্রদ্যুম্নকে নিয়ে বান রাজার সাথে যুদ্ধ করতে আসেন এবং বানরাজাকে পরাজিত করেন এবং তার পৌত্র অনিরুদ্ধ এবং উষাকে উদ্ধার করে দ্বারকাতে নিয়ে চলে যান। অবশ্য কোন কোন ঐতিহাসিক বলেন বান রাজার রাজধানী ছিল বর্তমান আসাম রাজ্যের শোণিতপুর। তীর্থ পান্ডার কাছে এই সমস্ত পৌরাণিক এবং ঐতিহাসিক ঘটনা জানতে পেরে আমরা দুজনেই ঋদ্ধ হলাম। ওঙ্কারেশ্বর মন্দিরের প্রথম তলে ওঙ্কারেশ্বর মহাদেব, দ্বিতীয় তলে মহাকালেশ্বর, তৃতীয় তলে সিদ্ধনাথ মহাদেব, চতুর্থ তলে গুপ্তেশ্বর মহাদেব এবং শীর্ষদেশে ধ্বজাধারী মহাদেব বিরাজিত। ধ্বজাধারী মহাদেবের কোন লিঙ্গ রূপ নেই। কেবলমাত্র ঘরটির মাঝখানে সিঁদুর মাখানো একখানি ত্রিশূল এবং ত্রিশূল এর গায়ে রক্ত পতাকা। তীর্থ পান্ডাকে উপরের তল গুলিতে নিয়ে যেতে বললাম। নাটমন্দিরের এক কোণে উপরে যাবার সিঁড়ি দেখিয়ে তিনি বললেন বর্তমানে সরকার থেকে উপরের তলগুলিতে যাওয়া বন্ধ করে দিয়েছে। এই বলে তিনি আমাদের দেখালেন সিঁড়ির মুখে উপরের তলগুলিতে যাবার দরজাটি তালাবন্ধ। নাটমন্দিরে আদি শঙ্করাচার্যের মূর্তিকে প্রণাম করলাম। অষ্টম শতাব্দীতে সুদূর দাক্ষিণাত্যের কেরল প্রদেশের কালাডি গ্রাম থেকে পদব্রজে গুরু গোবিন্দ পাদের আকর্ষণে বিন্ধ্য পর্বতের নর্মদা বক্ষের ওঙ্কার দ্বীপে ছুটে এসেছিলেন এবং এখানেই তাঁর দীক্ষা হয়েছিল। সিদ্ধ মহাগুরু গোবিন্দপাদ তাঁর জৈব আবরণের দৃশ্যপট উন্মোচন করে তাঁর মধ্যে শিব চেতনার উত্তরণ ঘটিয়েছিলেন। শিবকল্প সিদ্ধ মহাযোগী গুরুর দিব্যস্পর্শ ও শক্তি পেয়ে আচার্য শংকরও শিবকল্প মহাযোগী যুগন্ধর পুরুষরূপে আত্মপ্রকাশ করেছিলেন। এই সমস্ত অতীতের ঘটনাবলী চিন্তা করতে করতে মনের মধ্যে এক অপূর্ব শিহরন জাগল। ভাবছিলাম যে আজ থেকে প্রায় বারোশো বছরেরও বেশি আগে কিভাবে আচার্য শংকর সুদূর দাক্ষিণাত্য থেকে নদ-নদী, পাহাড়, পর্বত অতিক্রম করে ঈশ্বরের আকর্ষণে পদব্রজে এখানে এসেছিলেন। তাঁরা শিবকল্প মহাযোগী পুরুষ হবেন না তো বর্তমানের তথাকথিত প্রচার মাধ্যমে মুখ দেখানো -ওয়ালা লুন্ঠনানন্দ, রমণানন্দ, রজনীশ, রমনীশ বা বটকেষ্ট মার্কা অভিসন্ধি- পরায়ন সাধুরা সিদ্ধ পুরুষ হবেন, যাদের কাছে তপস্যার থেকে অর্থকরী ও যৌনচিন্তা বেশি। তীর্থ পান্ডাকে যথোচিত দক্ষিণা দিয়ে আমরা তার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে কোটি তীর্থের ঘাটে গেলাম এবং মা নর্মদাকে স্পর্শ করল।
পুনরায় নর্মদা সেতু পেরিয়ে দক্ষিণ তটে এসে ব্রম্ভাপুরী এবং বিষ্ণুপুরীর মধ্যস্থলে মামলেশ্বর বা অমরেশ্বর জ্যোতির্লিঙ্গ দর্শনে গেলাম। ইন্দোরের ধর্মপ্রাণা মহীয়সী মহারানী অহল্যাবাঈ নির্মিত বর্তমানের এই মন্দির। মন্দিরের কারুকার্য গুলি চোখ চেয়ে দেখার মত, দেওয়ালে শিবের মহিম্ন স্তোত্র উৎকীর্ণ। প্রায় তিনশ বছরের প্রাচীন এই মন্দির বর্তমানে ভারতীয় পুরাতত্ত্ব বিভাগ রক্ষণাবেক্ষণ করে। মন্দিরে গর্ভগৃহের মেঝে সাদা ও কালো রঙের পাথরে নির্মিত। বিশাল গৌরীপট্টের উপরে কালো রংয়ের বিশাল শিবলিঙ্গ। শিবলিঙ্গের মস্তকে নাগরাজ, তার ওপরে পিতলের কলসের ভিতরে দিয়ে সর্বক্ষণ বিন্দু বিন্দু জল শিবলিঙ্গের উপর পড়ছে। শিবলিঙ্গের পিছনে মা পার্বতী ও গণেশের মূর্তি, শিবলিঙ্গের চারিধার রেলিং দিয়ে ঘেরা। মন্দিরে ভিড় কম ছিল, পূজারীর হাতে ফুল বেলপাতা ও পূজার উপাচার দিতে তিনি নিষ্ঠা সহকারে আমাদের পূজা করে দিলেন। পূর্বে এখানে হোলকার রাজাদের রাজত্বকালে বাইশ জন ব্রাহ্মণ দৈনিক তিরিশ হাজার পার্থিব শিবলিঙ্গ তৈরি করে সেই পার্থিব লিঙ্গগুলি পূজার পরে নর্মদার জলে বিসর্জন দিতেন । বর্তমানে এই ব্রাহ্মণের সংখ্যা মাত্র পাঁচজন। তারাই পার্থিব শিবলিঙ্গ তৈরি করে তার মাথায় একদানা করে চাল দিয়ে যোনিপীঠ সমন্বিত বড় বড় কাঠের চৌকিতে স্থাপন করে পূজা করেন এবং পূজার পরে সেগুলি পূর্বের প্রথা মত নর্মদার জলে বিসর্জন দেন।মামলেশ্বর মন্দির প্রাঙ্গণে প্রাচীন বিষ্ণু মন্দির ছাড়াও মামলেশ্বর মন্দিরগাত্রে হর পার্বতী, চতুর্ভুজ নারায়ণের পাথরের খোদাই করা মূর্তি আছে। এইগুলি প্রত্যহ পূজিত হন প্রমাণস্বরূপ দেখলাম মূর্তির পদতলে ফুল বেলপাতা পড়ে আছে। এখানে সবকিছু দর্শন করে আমরা আমাদের সাময়িক আশ্রয়স্থলে ফিরে চললাম।
ফিরে গিয়ে স্থির করলাম ওঙ্কার পর্বত পরিক্রমা করব। ওঙ্কারেশ্বর জ্যোতির্লিঙ্গ দর্শনের মত এটিও একটি পবিত্র কাজ। স্ত্রীকে আমার মনের কথা বলতে তিনি তার পায়ের এবং হাঁটুর ব্যথার জন্য যেতে পারবেননা বললেন। তখন আমি একাকীই ওঙ্কারেশ্বর জ্যোতির্লিঙ্গকে স্মরণ করে বেরিয়ে পড়লাম। নর্মদা সেতু পেরিয়ে ওঙ্কারেশ্বর মন্দিরে প্রণাম করে কোটিতীর্থের ঘাটে এলাম। দৈর্ঘ্য-প্রস্থে কোটিতীর্থের ঘাট অতি বিশাল। বৈদূর্য পর্বতের ঢাল ঘিরে অর্ধচন্দ্রাকার এই ঘাট। পর্বতের ঢালু দেশ সোজা বাঁধানো ঘাটের উপর নেমে এসেছে। কাশী দশাশ্বমেধ ঘাটে যেমন ছায়া ঢাকা চৌকি স্নানার্থীদের জন্য পাতা থাকে এখানেও সেই রকম চৌকি পাতা আছে। চৌকি গুলিতে তীর্থ পুরোহিতরা পূণ্যার্থীদেরকে মা নর্মদার পূজা, পূর্বপুরুষের তর্পণ ও পিন্ডদান প্রভৃতি আচার-অনুষ্ঠান করাচ্ছেন। ফুল বেলপাতা ইত্যাদি ঘাটের সিঁড়িতে বিক্রি হচ্ছে। মনে পড়ে গেল মহাভারতের বনপর্বের কথা যেখানে মহামুনি বেদব্যাস বলেছেন - "দেবনামেতি কৌন্তেয়। তথা রাজ্ঞাং সলোকতাম্ বৈদূর্যপর্বতম্ দৃষ্টবা নর্মদামবতীর্থ চ।। সন্ধিরেষ নরশ্রেষ্ঠ! ত্রেতায়া দ্বাপরস্য চ। এতমাসাদ্য কৌন্তেয়! সর্বপাপেঃ প্রমুচ্যতে।।" লোমশ মুনি তীর্থ ভ্রমণ রত যুধিষ্ঠিরকে বলছেন - " হে কুন্তী নন্দন, ঐ দেখ সামনে বৈদুর্য পর্বত দেখা যাচ্ছে। এখানে নর্মদা নদীতে স্নান করলে দেবলোক ও রাজলোক প্রাপ্ত হওয়া যায়। এই বৈদুর্য পর্বত ত্রেতা ও দ্বাপর যুগের সন্ধিক্ষণে জন্মেছিল। এখানে আগমন করলে মানুষ সর্বপ্রকার পাপ থেকে মুক্ত হয়।" এখান থেকে পদব্রজে পরিক্রমা শুরু করলাম। বর্তমানে পরিক্রমার পথটি গীতা পরিক্রমা পথ নামে পরিচিত। পথের ধারে ধারে গীতার শ্লোক লেখা আছে। এক একটি গীতার শ্লোক পড়ছি আর মনে উৎসাহ পাচ্ছি এগিয়ে যাওয়ার। পরিক্রমা পথটি অর্থাৎ ওঙ্কারেশ্বর মন্দির থেকে পরিক্রমা শুরু করে পুনরায় ওঙ্কারেশ্বর মন্দির পর্যন্ত সাত কিলোমিটার। পরিক্রমা পথের বেশ কিছুটা রাস্তা সিমেন্ট দিয়ে বাঁধানো। প্রথমে এলাম রাস্তার বাঁদিকে নর্মদা তীরে সীতারামদাস ওঙ্কার নাথ আশ্রমে, মন্দিরে অখন্ড রাম নাম হচ্ছে। রাস্তা থেকে সিঁড়ি দিয়ে নেমে মন্দির দর্শন ও প্রণাম করে পুনরায় পায়ে চলা রাস্তাতে এলাম। এরপরে বাঁদিকে খেড়াপতি হনুমানজীর মন্দিরে। মন্দিরে সিঁদুরে রাঙানো মূর্তি, মন্দিরের শীর্ষদেশে গেরুয়া রঙের পতাকা উড়ছে। মন্দিরে প্রণাম করে এলাম কেদারেশ্বর শিবের মন্দিরে। হিমালয়ের কেদারনাথ এবং কাশীর কেদারেশ্বর মন্দিরের অনুরূপ এখানেও শিবলিঙ্গ ওল্টানো ধামার মত দেখতে। প্রণাম করে এলাম রামকৃষ্ণ মিশন সাধনা কুটিরে। মন্দিরের ভিতরে ঠাকুর শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণ দেবের মূর্তিতে প্রণাম করে সামান্য দূরে আনন্দময়ী মায়ের আশ্রম পৌছালাম। এখানে আনন্দময়ী মায়ের তৈলচিত্র আছে। আনন্দময়ী মায়ের আশ্রমের পরে গায়ত্রী মাতার মন্দির। সমস্ত মন্দির গুলি রাস্তার বাম দিকে। এরপরে পরিক্রমা পথ থেকে কিছুটা নেমে বরফানী দাদাজীর আশ্রম। এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে যে বরফানী দাদাজী মহারাজ কায়কল্প যোগে এখনো জীবিত আছেন, বর্তমানে তাঁর বয়স ২২৫ বৎসরের অধিক। তাঁর মূল আশ্রম অমরকন্টকে নর্মদা উদ্গম স্থলে মা নর্মদার মন্দিরের পূর্ব দিকে। দু'বছর আগে যখন অমরকন্টক গেছলাম তখন দাদাজী মহারাজের আশ্রম দেখার সৌভাগ্য হয়েছিল। এরপরে ডানদিকে গোরক্ষনাথ মন্দির। পরিক্রমা পথ যেখানে ডান দিকে বাঁক নিয়ে বৈদুর্য পাহাড়ের উত্তর-পূর্ব দিকে যাচ্ছে সেখানে নর্মদা ও কাবেরীর সঙ্গম। কাবেরীর উত্তর দিকে গভীর জঙ্গল। পরিক্রমা পথ থেকে বাম দিকে নেমে সঙ্গমের জলস্পর্শ করে এলাম। এখানে এরন্ডী মাতার মন্দির আছে, যার জন্য এই সঙ্গমকে এরণ্ডী সঙ্গম বলা হয়। যক্ষ অধিপতি কুবের এখানে শিবের উপাসনা করে মন্মথেশ শিবলিঙ্গ স্থাপন করেছিলেন। বহু লোক বিশেষতঃ বিবাহিত মহিলারা এখানে স্নান করে এরণ্ডী মাতার পূজা দিচ্ছেন। মন্দিরে মহা বৈষ্ণবী শক্তি এরণ্ডী মাতা পূজিত হচ্ছেন। রাস্তার উপরে ধর্মরাজ দ্বারের নিকটে মকর বাহিনী মা নর্মদার মূর্তি। এরপরে রাস্তার ডান দিকে একাদশ শতাব্দীর গৌরী সোমনাথ মন্দিরে পৌছালাম। তিন তলা বিশিষ্ট মন্দিরটি বালি পাথরের লালচে আভা যুক্ত গৈরিক বর্ণের পাথরে নির্মিত। মন্দিরের সামনে ভগবান শিবের বিশাল একটি মূর্তি। প্রবেশপথে নন্দীকেশ্বর ভৈরব,হনুমানজী, গণেশ, রাম- সীতা প্রভৃতির মূর্তি। মন্দিরে কৃষ্ণবর্ণের ছয় ফুটের বিশাল শিবলিঙ্গ। আয়তনে এত বিশাল যে দুজন মানুষ হাত ধরাধরি করে শিবলিঙ্গকে বেষ্টন করতে পারবেনা। এখানে জানতে পারলাম আদিতে স্ফটিকের শিবলিঙ্গ ছিল, পুণ্যার্থী বা দর্শনার্থী পরজন্মে কি হবে এই প্রার্থনা নিয়ে স্ফটিক শিবলিঙ্গের কাছে দাঁড়ালে তার ভবিষ্যতের ছবি ভেসে উঠত। মুঘল সম্রাট ঔরঙ্গজেব এই প্রবাদের কথা মনে রেখে তার মনের ইচ্ছা নিয়ে শিবলিঙ্গের সামনে দাঁড়াতে দেখতে পেলেন এক শুকরের মূর্তি ভেসে উঠেছে। হিন্দু বিদ্বেষী সম্রাট ক্রোধে শিবলিঙ্গে অগ্নিসংযোগ করেন এবং তারপর থেকে শিবলিঙ্গ ঘোর কৃষ্ণবর্ণে পরিণত হয়েছেন। পারমার বংশের প্রতিষ্টিত একাদশ শতাব্দীর এই মন্দিরটি পঞ্চরথ রীতিতে নির্মিত। মন্দির চত্বরে নন্দী মূর্তি, দ্বিতীয় তলাতে রাম সীতা, হনুমানজী এবং গৌরীকেদারের মূর্তি এবং তৃতীয় তলায় কেদারেশ্বর লিঙ্গ, লিঙ্গের মস্তকে তামার বিশাল নাগরাজ। মন্দিরে প্রণাম করে রাস্তার বিপরীতে রাম মন্দিরে এলাম। মন্দিরে রাম সীতা হনুমানজীর মূর্তি পূজিত হচ্ছে। মন্দির দর্শন ও প্রণাম করে এখানে পূজারীর সাথে মন্দির সম্বন্ধে কিছুক্ষণ কথাবার্তা বলে পুনরায় পরিক্রমা পথে এগিয়ে চললাম। গৌরী সোমনাথ মন্দিরের পরেই রাস্তার ডান দিকে লেটে হনুমান বা পাতালী হনুমান মন্দির। মন্দিরে হনুমানজির ২১ ফুট লম্বা এবং ৫ ফুট চওড়া শায়িত মূর্তি, যেরকম প্রয়াগরাজে অক্ষয় বটের নিকট আছে। সাধারণত এরূপ মূর্তি দেখা যায় না। মন্দিরে প্রণাম করে এরপর বেশ কিছুটা পথ অতিক্রম করে এলাম ত্রয়োদশ শতাব্দীর বারদুয়ারী সিদ্ধনাথ মন্দিরে। সিদ্ধনাথ মন্দির বর্তমানে ভারতীয় প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের দ্বারা সংরক্ষিত এবং তারাই এই মন্দিরের রক্ষণাবেক্ষণ ও সংস্কারের যাবতীয় কাজ করে। প্রাচীনকালে ওঁকার দ্বীপের এই মন্দির ছিল সর্বশ্রেষ্ঠ। প্রাচীন মুনিঋষিগণ এবং বর্তমান কালের যারা সিদ্ধ তপস্বী তাঁরা তাঁদের ধ্যান দৃষ্টিতে দেখেছেন যে সিদ্ধনাথই আদি ওঙ্কার নাথ। মার্কন্ডেয় মুনি লিখেছেন ওঙ্কারেশ্বর পর্বতের পূর্ব কিনারে ওঙ্কারেশ্বর লিঙ্গই আদি লিঙ্গ, অর্থাৎ এই সিদ্ধনাথ শিবলিঙ্গ। পাথরের সিঁড়ি দিয়ে আট ফুট উঁচু মন্দির চত্বরে উঠে এলাম। মন্দির চত্বর থেকে অগ্নিকোনে নর্মদা নদীর উপর ওঙ্কারেশ্বর ব্যারেজের সুনীল জলরাশি দৃশ্যমান, দক্ষিণে সবুজ বনানী। মন্দির চত্বর বিশাল, বালি ও পাথরে নির্মিত নিখুঁত জ্যামিতিক নিয়ম মেনে একটি আয়তক্ষেত্র। বিশাল বিশাল পাথরের স্তম্ভ। পূর্বে ২৮টি স্তম্ভ ছিল উচ্চতায় ১৪ ফুট, উপরে ছাদ ছিল, কিন্তু কাল স্রোতে সব ভেঙ্গে গেছে। কয়েকটি স্তম্ভ এখনো অক্ষত আছে। মন্দিরের পাঁচটি শিখর ছিল এবং বারটি দরজা ছিল। প্রতিটি কোনে একটি করে চারটি, মন্দিরের বাইরের দেওয়ালে চারটি এবং গর্ভগৃহে চারটি অর্থাৎ মোট বারোটি দরজা ছিল। বাইরের শিখর এবং মন্দির প্রাঙ্গন সব ভেঙে পড়েছে। বর্তমানে শুধু গর্ভগৃহে ভগবান সিদ্ধনাথের আদি ওঙ্কারেশ্বর লিঙ্গ বিদ্যমান। মন্দিরের বাইরে ধ্বংসাবশেষ চারিদিকে ছড়িয়ে আছে। যে স্তম্ভ গুলি কালের স্রোতে এখনো টিকে আছে সেগুলিতে এবং মন্দিরের গাত্রে পাথর খোদাই করে হস্তী মূর্তি এবং অন্যান্য কারুকার্য করা আছে। এই সমস্ত শিল্পকর্মগুলি দেখে মনে হচ্ছিল যে অতীতের শিল্পীরা কি অতুল প্রতিভার অধিকারী ছিলেন। বর্তমানে মন্দিরটি জরাজীর্ণ হয়ে গেছে। প্রতিটি স্তম্ভের মাথায় পাথরের মোটা মোটা খিলান। পাথরের ভারী ভারী কড়ি দুটি খিলানকে সংযুক্ত করেছে। কড়ির উপরে যে ছাদ ছিল সেটি ধ্বংস হয়ে গেছে, মূর্তিগুলিও অনেক নষ্ট হয়ে গেছে। পরে জানতে পেরেছি কয়েকটি মূর্তি নাগপুরের মিউজিয়ামে রাখা আছে। মন্দিরে যখন পৌঁছেছি তখন প্রায় দেড়টা বাজে, মাথার ওপরে ঠা ঠা রোদ্দুর। দুপুরবেলা বলে মন্দির বন্ধ ছিল। লোহার রেলিংয়ের দরজার বাইরে থেকে সিদ্ধনাথ মহাদেবকে প্রণাম জানালাম মনে এক অনির্বচনীয় আনন্দ নিয়ে। যোনিপীঠ হতে প্রায় এক ফুট উঁচু মধু পিঙ্গল বর্ণের আদি ওঙ্কারেশ্বর বা সিদ্ধনাথ লিঙ্গ। পরে আরো জানতে পেরেছিলাম এই পর্বতগাত্রে অনেক গোপন গুহা আছে যেখান থেকে সিদ্ধ মহাত্মারা গভীর রাত্রে এখানে এসে সিদ্ধনাথকে পূজা করেন। আমার দুর্ভাগ্য যে এরকম কোন সিদ্ধ মহাত্মার দর্শন পাইনি। যাইহোক এখান থেকে এবার ফিরে চললাম। পথে ভীমার্জুন দরজা এবং আদিবাসীদের দু-একটি ছোট ছোট গ্রাম দেখলাম যেখানে বর্তমান আধুনিক সভ্যতার উপকরণগুলি পৌঁছে গেছে। আধঘন্টা হাঁটার পরে ওঙ্কারেশ্বর জ্যোতির্লিঙ্গ মন্দিরে এসে পৌছালাম এবং পরিক্রমা শেষ হল। নর্মদা সেতু পেরিয়ে যখন আমাদের সাময়িক আশ্রয় স্থলে পৌছালাম তখন প্রায় তিনটে বাজে। স্ত্রীকে সাথে নিয়ে খেতে গেলাম । একটি হোটেল খোলা ছিল যেখানে ভাত ডাল ও একটি তরকারি দিয়ে কোন রকমে পেট ভরালাম।
বিকেলে পুনরায় বেরোলাম। গোমুখ ঘাটের ডানদিকে প্রাচীন শক্তিপীঠ ব্রম্ভেশ্বর মহাদেবের মন্দির। পুরাণে আছে স্বয়ম্ভূব মনুর সময়ে দানবদের ভয়ে দেবতারা এই তীর্থে এসে ব্রম্ভার শরণাপন্ন হন। তখন ব্রম্ভা নিজেই দানবদের ভয়ে তটস্থ, দিশাহারা, তার সমস্ত বেদমন্ত্রের বিস্মরণ ঘটেছে। এমতাবস্থায় ব্রম্ভা সহ সমস্ত দেবতারা এখানে ব্রহ্মেশ্বর মহাদেবের পূজা করে তাঁর করুণা প্রার্থনা করলেন। ভগবান শিবের প্রচণ্ড হুংকারে পাতাল থেকে এই শিবলিঙ্গের উদ্ভব হয় এবং তার আশীর্বাদে ব্রম্ভার সমস্ত বেদ মন্ত্র স্মরণে আসে। বেদমন্ত্রের প্রভায় দেবতারা দানবদের ধ্বংস করেন। ব্রম্ভেশ্বর মহাদেবকে প্রণাম করে বাজারের ভিতরে দিয়ে এলাম বিষ্ণুপুরীতে। রাস্তা থেকে সামান্য উচ্চতায় বিষ্ণু ভগবানের শ্বেতশুভ্র মন্দির। মন্দির প্রাঙ্গণ বেশ বড়। মন্দিরে বিষ্ণু ভগবান এবং লক্ষী মাতা বিরাজিত, পাশে গণেশের শ্বেত পাথরের মূর্তি। মহানির্বাণী আখড়া পরিচালিত এই মন্দিরে নিত্য ভগবান বিষ্ণু, লক্ষীমাতা ও অন্যান্য দেব দেবীর পূজা করা হয়। মন্দিরে প্রণাম করে বেরিয়ে আসার সময় পূজারী আমাদের হাতে প্রসাদী বাতাসা দিলেন। মন্দির প্রাঙ্গণে হনুমানজীর পাথরের মূর্তি। মন্দিরে প্রায় সন্ধ্যে হয়ে গেল, উত্তর দিকে তাকিয়ে দেখি ওঁকারেশ্বর মন্দিরের চূড়া থেকে আলোর বন্যা বইছে। বৈদ্যুতিক আলোর প্রভায় শ্বেতশুভ্র মন্দিরকে অপরূপ দেখাচ্ছে। কোটিতীর্থের ঘাটেও আলো দিয়ে সাজানো। বিষ্ণুপুরীর মন্দির থেকে বেরিয়ে পুনরায় ওঁকারেশ্বর মন্দিরের উদ্দেশ্যে গেলাম সান্ধ্য আরতি দর্শনের অভিপ্রায়ে। রাত্রি সাড়ে আটটা থেকে আরতি শুরু হবে। আরতির প্রায় মিনিট পনেরো আগে আমরা মন্দিরে পৌঁছে গেলাম। মন্দিরের সমস্ত প্রকোষ্ঠ আলোকমালাতে সজ্জিত। ওঙ্কারেশ্বর জ্যোতির্লিঙ্গের সামনে জ্বলছে ঘিয়ের প্রদীপ, অনির্বাণ দীপশিখা। জ্যোতির্লিঙ্গের পিছনে বিশ্বার্তিহারিনী মা পার্বতী। প্রায় তিরিশ মিনিট ধরে আরতি করলেন মন্দিরের প্রধান পুরোহিত। গৃহী, সাধু মিলিয়ে প্রায় জনা পঞ্চাশেক লোক। আরতির পরে ভগবান ওঙ্কারেশ্বরের শয়ান। রূপক হিসাবে পূজারীরা রূপোর দোলা খাটালেন ওঁকারেশ্বরের বিশ্রামের জন্য। ভগবান এর পরে বিশ্রাম নিবেন। মনে মনে ভাবলাম ভগবানের আবার বিশ্রাম কি ? ভগবানের বিশ্রাম মানে তো নিরন্তর সৃষ্টি কার্যের সাময়িক ছেদ, তাহলেই তো পৃথিবী ধ্বংস হয়ে যাবে। আসলে ভক্তরা অন্তরের অনুরাগ মিশিয়ে এইভাবে ভগবানের সেবার অভিনয় করেন। মন্দির থেকে সাড়ে নটার পরে বেরোলাম। হেমন্তের রাত্রি, চারিদিক নিস্তব্ধ। নর্মদার উপরে ঝুলা ব্রিজ পেরিয়ে দক্ষিণ তীরে এলাম। দক্ষিণ তীরে বাজার, হোটেল সবই তখনও খোলা আছে। সাধারণতঃ যাত্রীরা বেশিরভাগই থাকেন দক্ষিণ তীরে। দক্ষিণ তীরে ধর্মশালা, থাকার হোটেল, খাবার হোটেল, বাজার, ব্যাংক সবকিছুই আছে। আমরা খাবার খেয়ে আমাদের সাময়িক আশ্রয়স্থল 'হোটেল ঐশ্বর্যতে' যখন ফিরে এলাম ঘড়ির কাঁটা তখন ১০-৩০ পেরিয়ে গেছে। পরের দিন সকালে স্নান করে পুনরায় সাড়ে সাতটার মধ্যে ওঙ্কারেশ্বর মন্দিরে গেলাম। আজই ফিরে যাব তাই যাবার আগে আর একবার জ্যোতির্লিঙ্গ দর্শন করতে ইচ্ছে হল। যতবারই দর্শন করি না কেন মনের যেন আর সাধ মিটে না। মনে হচ্ছে এখানে যদি পাকাপাকিভাবে থাকতে পারতাম তাহলে সারাদিন এই ওঁকারেশ্বর মন্দিরের কাছে ঘুরে বেড়াতে পারতাম। ফুলে ফুলে সুশোভিত, মৌন নির্জন পর্বতে পাখীর কূজন, সবুজ বনানী, দর্শক কোলাহলহীন তীর্থ, আর্থিক চাহিদা হীন মার্জিত পূজারী, এত সুন্দর দেব দর্শন অমরনাথ ব্যাতীত আর কোথাও হয়নি। যেতে হবে বলে মনটা খুব ভারী হয়ে উঠলো। জ্যোতির্লিঙ্গকে শেষবারের মতো প্রণাম করে ফিরে চললাম, জানিনা আর কোনদিন পুনরায় এখানে আসতে পারবো কি না। মন্দিরের পূর্বমুখী দর্শন পথের দুপাশে দোকান। ফেরার পথে আমার স্ত্রী একটি বড় ডিম্বাকৃতি আকারের নর্মদা উদ্ভূত শিবলিঙ্গ কিনলেন। লিঙ্গের নিম্নাংশ ঈষৎ ছাই রঙের এবং উর্ধ্বাংশ মধু পিঙ্গলবর্ণের। উর্ধ্বাংশে ত্রিপুণ্ডকের ন্যায় তিনটি সাদা রেখা। নিচের রেখাটি দীর্ঘ উপরের গুলির তুলনায়। জানিনা শাস্ত্রে এই প্রকার শিবলিঙ্গকে কি নামে অভিহিত করা হয়, তবে এটি যে বাণলিঙ্গ সে বিষয়ে নিশ্চিত। মন্দির থেকে ফেরার পথে একটি গাড়ীর সাথে কথা হল যে আমাদের এখান থেকে মহেশ্বর নিয়ে যাবে, সেখানে দর্শনীয় স্থান ও মন্দির দর্শন করে আমাদের ইন্দোর রেলস্টেশনের নিকটে পৌঁছে দেবে। আমরা জলখাবার খেয়ে মালপত্র নিয়ে গাড়ীতে চাপলাম সকাল দশটা নাগাদ। পরের গন্তব্য স্থল অষ্টাদশ শতাব্দীর পুণ্যশীলা, মহীয়সী রানী অহল্যাবাঈ ।
=================
লেখকের নাম - দেবী প্রসাদ ত্রিপাঠী।
ঠিকানা- মাইকো লেন, ক্ষুদিরাম নগর, মেদিনীপুর-৭২১১০১।
লেখকের সংক্ষিপ্ত পরিচিতি- কর্মজীবনে ভারতীয় স্টেট ব্যাংকের আধিকারিক ছিলেন। ২০১১ সালে চাকুরী থেকে অবসর গ্রহণ করেছেন। ২০০২সালে ভারত সরকারের পরিচালনায় কৈলাস ও মানস সরোবর ঘুরে এসেছেন। 'শিব ঠাকুরের আবাসভূমি', 'ভারতের পুণ্যাত্মা' ও মহাতীর্থের পথে পথে (প্রথম খন্ড ও দ্বিতীয় খন্ড) নামে চারটি বই প্রকাশিত হয়েছে। এছাড়াও রামকৃষ্ণ মঠ ও মিশন কর্তৃক প্রকাশিত উদ্বোধন পত্রিকার ১৪২৮ বঙ্গাব্দের ভাদ্র সংখ্যায় 'নীলকন্ঠ মহাদেব ও চন্দ্রবদনী মন্দির দর্শন' লেখাটি প্রকাশিত হয়েছে।
অলঙ্কারের মহেশ্বর। ওঙ্কারেশ্বর জ্যোতির্লিঙ্গ থেকে বিখ্যাত শৈবতীর্থ মহেশ্বর। বিদায় ওঙ্কারেশ্বর ।