লখনউ শহরের ইতিহাসের হাতছানি টা এতটাই প্রবল যে অস্বীকার করা যায়না, কাবাবের ম্যাজিক কেও আপনি ইগনোর করবেন এমন জিভের পাটা আপনার নেই নিশ্চিৎ। কিন্তু লখনউ এর অলি গলিতে ঘুরতে ঘুরতে নবাবি খান-পানের প্রলোভনটা আপনি ডাইজিন সহযোগে সামলে নিয়েছেন ভেবে খুশি হচ্ছেন কি ,দাড়ান কত্তা !! পিকচার অভি ভি বাকি আছে বন্ধু ।
লখনউ মানেই যে শুধু লাজওয়াব কাবাব আর লাজীজ বিরিয়ানি, তা কিন্তু নয়। কিছু লোক নিশ্চই নাক কুঁচকে বলছেন ," গলোটি কাবাব কে টক্কর দেবে কে শুনি?" ।
উত্তরে যদি কোনো veg আইটেম শোনেন, তাহলে নিশ্চয়ই আপনার মুখ থেকে যদি একটা বিরক্তি সূচক হুঁ বেরিয়ে আসে তাহলে আপনার দোষ নেই কোনো। কিন্তু লখনউ আপনাকে প্রতি পদে সারপ্রাইজ করতে তৈরি বন্ধু। লখনউ এর তেহজিবের কথা জানেন আপনি মশাই , ওই যে জনাব পেহেলে আপ!!
হজরতগঞ্জের বাজারে আপনি ঘুরছেন হঠাৎ দেখতে পেলেন দিলবাগ কুলফিওয়ালা। কুলফির হাঁড়ির সামনে দাড়িয়ে বেশ সুরিলা গলায় ডাকছেন বৃধ্য ভদ্রলোক।
" জনাব কুলফী লে লিজিয়ে,বেচারি আপকে ইয়াদ মে পিঘলি যা রাহী হে!!"
ভাবতে পারেন আপনাকে ডাকার কি মিষ্টি কায়দা। পান, কুলফির ডাক কে স্ট্যান্ড বাইতে রেখে আমরা যে দোকান টা তে পৌছালাম তার নাম "দা রয়েল ক্যাফে!" দোকানের মালিক শ্রী হারদায়াল মরিয়া। নামটা মনে রাখবেন,remember the name!!
একটু ফাস্ট ফরওয়ার্ড করছি পরে আবার ফিরে আসবো। চাট বলতেই আপনার কি মাথায় আসে? পাপড়ি চাট, ভেলপুরি, রাজ কচুরি? কিন্তু বাস্কেট চাটের নাম শুনেছেন কি? আলু ভাজা দিয়ে তৈরি একটি খাস্তা মুচ মুচে বাস্কেট এর মধ্যে এক রহস্যময় ফিলিং। তার মধ্যে থাকছে আলু টিক্কি,দই বড়া,পাপড়ি, ফুচকা, মোটর, ছোলা। বেশ কিছু মসলা তার সাথে মিশে আরো ঘনীভূত হচ্ছে রহস্য। এবার শুরু হচ্ছে সবচেয়ে মজার খেলা। টক দই কে এত মিহি আর মসৃণ ভাবে যে ফাটানো যায় আমি তো জানতাম না। আর সেই মিহি করে ফ্যাটানো টক দই এর সাথে মিশে যাচ্ছে গুঁড়ো করা চিনি ও বিটনুন । বাস্কেট এখন দই তে ভাসছে। পাপড়ি, আলু টিক্বী,বড়া সবাই এখন দই এর মজায় মজেছে। তেতুলের টক মিষ্টি আচার মিশ্রিত তরল এবার ঝাঁপিয়ে পড়লো দই এর বুকে। বাস্কেট এখন টই টুম্বর!এবার পালা টপিং এর খেলা শুরুর। পেঁয়াজ কুঁচি, দালমুট, সেউ, ভুজিয়া, ডালিমের দানা, বাদাম, আমের কুচি,ধনে পাতা কুচি আরো কত কি ছিল সেটা খোঁজার মত ধৈর্য আপনার থাকবে না বিশ্বাস করুন। কিছু খাবার থাকে যেগুলো দেখে আপনার মুখে জল আসতে বাধ্য সে আপনি যত বড় তিস মার খান হন না কেন। মানে আপনার পাড়ার খিটখিটে মেসোমশাই হন না কেন বা আপনার স্কুলের রাগী দিদিমণি, এই যে দারুণ একটা সুস্বাদু বাস্কেট তৈরি হলো সেটা কিন্তু তারাও রেসিস্ট করতে পারতেন না বিশ্বাস করুন। চামচ দিয়ে হালকা চাপ আর বাস্কেটের একটা কোনা টুক করে ভেঙ্গে যাবে। তাড়াহুড়ো করে মুখে পুরে দেবেন না যেনো কারণ এখানে কিন্তু খেলা আছে। গুছিয়ে চামচে তুলবেন কিন্তু বাস্কেটের টুকরো, স্টাফিংস, আর দই আর চাটনির মিশ্রিত তরল আর শুকনো ভূজিয়া। এবার আরাম করে মুখে চালান করুন। লখনউ আফটার অল! থোড়া তকুল্লুফ ফর্মাইয়ে দোস্ত! চাট যে কি অসাধারণ খেতে আপনি সেটা বুঝতে ও পারবেন না যদি আপনি এই রহস্যময় চাট টি না খেয়ে থাকেন।প্রতি কামড়ে একটা নতুন থ্রিল অনুভব করবেন আপনি। পদে পদে রহস্যভেদ! কখনো মুচমুচে পাপড়ি, কখনো টক,ঝাল মিষ্টি দই, কখনো ডালিম দানা, আলু টিক্কির চটক! নতুন স্বাদের হাতছানি প্রতি কামড়ে।
যাক নামটা ভোলেন নি তো? হরদায়াল মৌর্য । ১৯৯২ সালে ভদ্রলোক নাকি ভুল বসত একটু আলুর বাস্কেট বানিয়ে ফেলেছিলেন । না মানে এটা উনি নিজেই বললেন। তবে লখনউ বলে কথা, যা বিনয়ী এখানকার জনতা। ভদ্রলোক যে বিশেষ চাট আবিষ্কার করলেন টা অল্প দিনেই সারা ভারতে ছড়িয়ে পড়লো। হারদায়ল জি শুরু করলেন শেখানো। না উনি আপনার স্কুলের সেই ফাস্ট বয় নন যে নিজের লেখা নোট কাউকে দিতো না। আর জানেন তার ফল কি হলো। আজ 78 টা দেশে ওনার চাট ছড়িয়ে গেছে, সারা ভারতে তো বটেই। Youtube সার্চ করে দেখুন মশাই চাট কিং অফ Lucknow দেখে চমকে উঠবেন ওনাকে দেখে প্রায় 2.5 কোটি মানুষ। Insta ও ফেসবুকএও ফলোয়ার দের ছড়াছড়ি। নিজে কানে শুনলাম অনন্যা পান্ডে, রাজপাল যাদব, বরুণ ধাওয়ান আসবে রাতের দিকে আগে থেকে বলে রাখছে ফোন করে যাতে মবড না হতে হয়। তবে তাও কি অদ্ভুত নম্র,ভদ্র,grounded ভদ্রলোক। হাঁসি মুখে সেলফি তুলে যাচ্ছেন লোকের সাথে। সম্বোধন করছেন জনাব, বেটা, বেটি বলে। যেচে বলছেন এক্সট্রা দই আর চাটনি দিতে। সত্যি এই তেহজিব লখনউ ছাড়া অসম্ভব।
ইতিমধ্যে কিন্তু আমার মুখের ভীতর একটা পলাশির যুদ্ধ শুরু হয় গিয়েছে। টক, ঝাল, মিষ্টি বিপরীতধর্মী স্বদেরা একে অপরের সাথে যুদ্ধ লাগিয়ে দিয়েছে নিজেদের supremecy প্রমাণ করবে বলে। কেউ এক চিলতে জায়গা ছাড়তে নারাজ। কখনো চাটনি মাখা পাপড়ি আক্রমণ করছে তো ঠাণ্ডা দই এর বন্যা তাদের কে প্রশমিত করছে। আর সেই বন্যার মাঝে ডালিম কনারা নিজের অস্তিত্বের প্রমাণ দিচ্ছেন নিপুণ ভবে। অবশেষে যুদ্ধ শেষে জিতলেন আপনি আর আপনার স্বাদ করোক রা। আপনি খেয়ে ক্লান্ত , পেট ভারাক্রান্ত,কিন্তু মনের মধ্যে এক অদ্ভুত মুগ্ধতা। অনেক টা " যুদা হকে ভি তু মুজমে কাহি বাকি হ্যাই"।
এমন সময় আপনি দেখবেন বিজয়ী হাঁসি হেসে সামনে দাড়িয়ে লখনউ এর বেতাজ বাদশাহ চাট কিং হরদয়াল মৌর্য। নবাবরা কি আর লখনউ তে থাকেন না? কে বলেছে? আমার সামনেই একজন নবাব দাড়িয়ে যিনি তার চাট সেনার মাধ্যমে অসমুদ্র হিমাচল ই নয় বরং ৭৮ টা দেশে স্বাদের শাসন বিস্তার করেছেন। এটাই ম্যাজিক জনাব। এটাই লখনউ।
এই জন্যেই বলা হয়ে ," মুস্কুরাইয়ে আপ লখনউ মে হো"
=====================
ধন্যবাদান্তে,
পথিক মিত্র
পুনে