Click the image to explore all Offers

ধারাবাহিক বড়গল্প ।। প্রবাসিনী ।। কাকলী দেব

 

ছবিঋণ- ইন্টারনেট 
 

 

প্রবাসিনী

কাকলী দেব

 

 প্রথম পরিচ্ছেদ

সবিতা গুপ্ত ঢাকাতেই  স্কুল জীবন, হায়ার সেকেন্ডারী অবধি কেটেছে।  তাদের সেই বিশাল বাড়ী, নাট মন্দির, বাগান, পুকুর সব  ছেড়ে  রাতারাতি এক কাপড়ে বেরিয়ে আসতে হয়েছিল।  তা বয়স এখন পঁচাত্তর। বিয়ের পরে ইংল্যান্ডে এসেছিল আজ থেকে পঞ্চাশ বছর আগে। সেটা এসেছিল কলকাতা থেকে। কিন্ত কলকাতাকে সে মাত্র পাঁচ বছর দেখেছে। যখন ঢাকা ছেড়ে আসতে বাধ্য হতে হল। জীবনের প্রথম কুড়ি বছর তার কেটেছিল ঢাকা বিক্রমপুরে ! সাল ঊনিশ্শ একাত্তর, সোনার বাংলায় তখন যুদ্ধের আগুন জ্বলছে। তার বাবা ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের যোদ্ধা ছিলেন। ভালবেসে বিয়ে করেছিলেন পশ্চিম বঙ্গের একটি ব্রাহ্মণ কন্যাকে। সবিতাদের বৈদ্য পরিবারে সেই সময় এই বিয়ে নিয়ে প্রচুর জলঘোলা হয়েছিল। কিন্ত বাবার প্রেসিডেন্সী কলেজের বিপ্লবী বন্ধুদের উদ্যোগে বিয়েটা হয়ে যায়। বাবা মার সুখী দাম্পত্য জীবন , ঘর ভরা ছেলে  মেয়ে নিয়ে কেটেছিল  এই বাড়ীতেই। তারা আট বোন, তিন ভাই। সবিতা সবচেয়ে বড়।

প্রত্যেকটি বোন সুন্দর দেখতে। বাবার বিপ্লবী জীবনের ছাপ পড়েছিল বড় ভাই বিজয়ের ওপরে। সে মুক্তিযুদ্ধের সক্রিয় কর্মী!  বাবার ওপর চাপ আসতে লাগল ,দেশত্যাগের! বাবা মা শেষ পর্যন্ত বাধ্য হলেন,  আর ভরসা করতে পারলেন না! বিজয়ের প্রাণ সংশয় দেখা দিল যখন, বাবা সপরিবার চলে এলেন কলকাতায় জ্যাঠা মশাই এর বাড়ীতে।

এখানে আসার পর থেকে শুরু হল জীবন যুদ্ধ, বেঁচে থাকার লড়াই। তাদের বাংলাদেশের জীবন যাত্রা ছিল সহজ সরল, বিলাসিতার সামর্থ্য তার বাবার ছিল না ঠিকই, পূর্ব পুরুষদের জমিদারির কিছু আয় ছিল আর বাবার শিক্ষকতার যতটুকু উপার্জন, তাতেই তাদের বেশ হেসে খেলে চলে যেত। কিন্তু কলকাতায় প্রায় কপর্দক শূণ্য অবস্থা, তারা এতজন ভাই বোন, বিজয় আর সে ছাড়া সবাই বেশ ছোট, স্কুলের গন্ডী পেরোয়নি তখনও।  

তাকে বিয়ে দিয়ে দায়মুক্ত হতে চাইলেন বাবা। জেঠিমা আত্মীয়তা সূত্রে এই সন্বন্ধ এসেছিল। ছেলেটি লন্ডনে থাকে। তবে তার থেকে বয়সে বারো বছরের বড়। বাবার হাতে চাঁদ পাওয়ার মত অবস্থা হল। বৈদ্য বংশীয় এমন সুপাত্র তিনি হাতছাড়া করতে চাইলেন না! এদের বড় যৌথ পরিবার,  কৃষ্ণনগরে বড় বাড়ী। সবিতার মনে অনেক স্বপ্ন ছিল, কিন্তু পরিস্থিতির চাপে সে নিজের মন তৈরী করে নিল। যেমনই হোক, এই বিয়ে তাকে করতে হবে।   ছোট ছোট ভাই বোন দের শুকনো মুখ  দেখতে তার ভাল লাগেনা।  তার বিয়ে হয়ে গেলে বাবাকে সাহায্য করা হবে। তাই পাত্র যখন দু একজন আত্মীয়দের নিয়ে তাকে দেখতে এসে  জিজ্ঞেস করল, " আপনি বিদেশে গিয়ে থাকতে পারবেন তো?" সে সটান মাথা নেড়ে বলেছিল "হ্যাঁ", মনে মনে বলেছিল, ' থাকতে আমাকে হবেই, যতই কষ্ট হোক! এই লোক টি কে সে চেনেনা, কেমন মানুষ, তাও সে জানেনা , তবে যেমনই হোক, এর সাথেই তার ভবিষ্যত তৈরী করতে হবে।' বিয়ের পর থেকে, তার এই এক বাক্যে রাজী হওয়ার ব্যাপার টা নিয়ে সবার সামনেই অবনী তাকে ঠাট্টা করত! এর পেছনের কারণ নিয়ে অবনীর কোন মাথা ব্যথা ছিল না, তার মন বোঝার কোনও চেষ্টা সে করেনি কখনও!

প্রায় চল্লিশে এসে,নিজের মায়ের জবরদস্তি তে বিয়েতে মত দিয়েছিল। ইংল্যান্ডের দিনগুলো তার দিব্যি কাটছিল! কলকাতার সেই সময়কার চাকরীর বাজারে সুবিধা করতে না পেরেই একটা কাগজের বিজ্ঞাপন দেখে এখানে চাকরী নিয়ে এসেছিল!  অবনী কলকাতার ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার, দশ বছর ধরে এই দেশে সে মাঝারী গোছের চাকরী করেছে,  বিভিন্ন কল কারখানায়। দেশে ফিরতে তারও ইচ্ছে করত! কিন্ত এখানকার রোজগার তো কলকাতায় হবেনা! পেয়িং গেস্ট হিসেবে থাকার সুবাদে, খাওয়া থাকার অসুবিধা কিছু ছিল না।পাবে যেত সন্ধ্যার সময়।বহাল তবিয়তে কেটে যাচ্ছিল জীবন টা! দু একজন বান্ধবীও ছিল। একজনের সঙ্গে একটু সিরিয়াস গোছের সম্পর্ক হল। সেবার কৃষ্ণনগরের বাড়ীতে গিয়ে মা'কে, মেয়েটির কথা বলাতে, মা প্রায় অজ্ঞান হয়ে পড়ে যান, আরকি! নিজের ঘরের ঠাকুরের পা ছুঁইয়ে প্রতিজ্ঞা করালেন, বিদেশিনী কে বিয়ে করা চলবেনা। সেই বার মা , আগে থেকেই খুঁজে রাখা সন্বন্ধ দেখতে যেতে হয়েছিল! সবিতা কে দেখে অপছন্দ হবার নয়, হয়ওনি। কিন্ত ইংল্যান্ড এর সেই বিদূষিনী মুখ মনে পড়ছিল,  যে তাকে ভালবাসার প্রথম পাঠ পড়িয়েছিল!

যাই হোক, মাকে দেওয়া কথার মর্যাদা রাখতে, অবনী সেন , সবিতা গুপ্ত কে বিয়ে করলেন। কোনরকম ঘটা পটা হলোনা। রেজিস্ট্রি হয়েছিল, আর মা বাবার ইচ্ছা অনুসারে কালিঘাটের মন্দিরে গিয়ে পূজো দেওয়া হল।

সবিতার সমস্ত ভিসা পাসপোর্টের ফরমালিটিস করতে মাস ছয়েক সময় লাগল। ততদিনে অবনী ফিরে গেছে। এতদিন সে বিভিন্ন বাড়ীতে পেয়িং গেস্ট হিসেবে, কাটিয়েছে। এবার একটা ছোট অ্যাপার্টমেন্ট ভাড়া নিলো।ওপরে থাকে বয়স্কা বাড়ীওয়ালী। সবিতা, কৃষ্ণনগরে শ্বশুরবাড়ির যৌথ সংসারের বিচিত্র অভিজ্ঞতা লাভ করল মাস ছয়েক ধরে।

শাশুড়ী বিচক্ষন মহিলা। সবিতা তেমন রান্নাবান্না পারত না। তাদের দেশের বাড়ীতে রান্নার ঠাকুর, রাত দিনের কাজের লোক বেশ দু তিন জন ছিল, তাই, কোনও কাজের অভ্যাস তার ছিল না।শাশুড়ী নিজে সব ভাল মন্দ রান্না করে,  সবাই কে বলতেন সবিতা করেছে ! সেজন্য সত্যিই শাশুড়ীর প্রতি আজও কৃতজ্ঞ!

বিয়ের পাঁচ বছরের মাথায়, সেই শাশুড়ীর অসুস্থতার খবর জানিয়ে দেওর এর চিঠি এসে একদিন সকালের ডাকে পৌঁছালো। অবনী তখন অফিসে। তখন তো আর এযুগের মত মোবাইল ছিল না, এমনকি তাদের বাড়ীতে ল্যান্ডলাইন ছিল না, ভাড়া বাড়ীতে অতি সামান্য কাজ চালানোর মতই কিছু ছিল, বলতে গেলে একটা বেড আর রান্না খাওয়ার সরঞ্জাম কেনা হয়েছিল। সবিতা তখন দৌড়ে ওপরে ল্যান্ড লেডি কাছে গেল  সেখানে অবনীর অফিসের নম্বর রাখা ছিল,  অনেক বার ফোন করেও পেলনা অবনীকে। হয়তো সাইট ভিসিট ছিল। সন্ধ্যার সময় অফিস থেকে ফিরে অবনী ফ্রেশ হতে বাথরুমে গেছে, তখন, একটা টেলিগ্রাম এল,আবার যার নামে এসেছে তার হাতে ছাড়া দেবে না, অগত্যা অবনী কে বাথরুমের দরজা দিয়ে মুখ বাড়িয়ে বলতে হল, সবিতা তার স্ত্রী, টেলিগ্রাম তাকেও দেওয়া যায়।

সবিতার বুক কাঁপছিল, নিশ্চয়ই কোনও দুসংবাদ হবে।

ঠিকই তাই! শাশুড়ীর মৃত্যুর খবর শুনে, অবনী চিৎকার করে  কেঁদে উঠল।সবিতা তখনও বলারই সময় পায়নি, সকালের চিঠির ঘটনার কথা। এবার বলল। কিন্ত তাই শুনে অবনীর বিলাপ আরও বেড়ে গেল, সে বলতে লাগল, সবিতা ইচ্ছা করেই তাকে খবর টা ঠিক সময়ে দ্যায়নি।

সেই অভিযোগ তার প্রতি আজও পুষে রেখেছে সে।সবিতা তাকে বলে বোঝাতে পারেনি, যে এই কাজ সে সত্যি সত্যিই করেনি আর কেনই বা সে করবে? শাশুড়ীর প্রতি কোন বিরূপ মনোভাব তার ছিল না বরং শ্রদ্ধা মিশ্রিত সমীহই ছিল।

ক্রমশঃ--------- 

 

কাকলী দেব

কলকাতা

 

 

 

Post a Comment

0 Comments
* Please Don't Spam Here. All the Comments are Reviewed by Admin.