পাহাড়ি পথ এমনই।পাক খেয়ে খেয়ে ওঠা। গাড়ির সামনে বসেছিল বলে সন্দীপ পুরো যাত্রাপথটার চাপ এবং উত্তেজনা শিরা-ধমনীতে ক্ষণে ক্ষণে টের পাচ্ছিল। ড্রাইভার নেহাতই পোড় খাওয়া তাই বেশ নিশ্চিন্তে বাংলা ব্যান্ডের গান শুনতে শুনতে গাড়ি চালাচ্ছিল।সন্দীপের হবু বউ নিশার বন্ধু।দাদাতোত বন্ধু।কলেজের সিনিয়র।সেই দাদাতোত বন্ধুর নাম প্রিয়ম।সঙ্গে আরো দেড় জন আছে।প্রিয়মের বউ শ্রীময়ী আর তাদের বছর পাঁচেকের ছেলে প্রয়াস। আকাশ যতক্ষণ পরিষ্কার ছিল ততক্ষণ প্রিয়ম বেশ জুৎসই করে নিশাকে নৈসর্গ দেখাতে দেখাতে গাড়ি চালাচ্ছিল সন্দীপের গুরুতর আপত্তি সত্বেও।
কলেজে দু'জনের যা থাকার থাক এখন কিসের এত মাখামাখি? গোড়া থেকেই এই ট্যুরে সন্দীপের আপত্তি ছিল স্রেফ এই কারণে।ট্রেনের টিকিট হয়নি যখন তখনই ও নিশাকে বলেছিল, পাহাড়ের প্ল্যান বদলে অন্য কোথাও যেতে।কোথা থেকে যে নিশা এই মক্কেলকে পেল!শুধু তাই নয় মোড়লিপনা করে এই প্রিয়মই তার বউ শ্রীময়ীকে লেলিয়ে দিয়েছে নিশার ওপর স্পাইগিরি করার জন্য। রাতে নিশার সাথে শ্রীময়ী আর সন্দীপের সাথে প্রিয়ম থাকবে।কেন ভাই? নিশা সন্দীপতো তো এর আগেও একসাথে ট্যুর করেছে। প্রিয়মের খবরদারিটা নিশার তালিবানি মনে হয়নি? প্রিয়ম নাকি ট্রাভেল ট্যুরিজমের এজেন্সি চালায়। বলেই দিয়েছে খরচাপাতি সব ওর। নিশার কথানুযায়ী নিশা নয়, প্রিয়মই নাকি নিশার সাথে যোগাযোগ করেছে। এই গায়ে পড়া ব্যাপারগুলো সন্দীপ একদম পছন্দ করেনা। নিশা ওকে কিন্তু সেকেলে, তালিবান, ফ্যাসিস্ট আরো কতকি বলবেই...তাই সন্দীপ মুখ শুধু বন্ধই রাখেনি ভানও করে গেছে পাহাড়ে এসে সে যে কত খুশি সেটা দেখানোর। তবে যেটা ওকে আরো বেশি অবাক করেছে সেটা হল শ্রীময়ীদিও এই ব্যাপারে একদম চুপ। কে জানে এটাকেই বোধ হয় বলে বোঝাপড়া।
ওদের বিয়ের বয়স তাও এগারো বছর হল। ওদের ছোট্ট ছেলেটা মাঝে মাঝে বোকা বোকা প্রশ্ন করছিল বলে শ্রীময়ীদির অংশগ্রহণের কিছুটা আভাস পাওয়া যাচ্ছিল নইলে পুরোটাই হচ্ছিল প্রিয়মের ওয়ানম্যান শো। আর হ্যাঁ সঙ্গে মাঝে মাঝে নিশার বিস্ময়মূলক অভিব্যক্তিস্বরুপ 'ওয়াও,' 'তাই নাকি' 'অউসাম' শোনা যাচ্ছিল।প্রিয়ম মাঝে মাঝে গাড়ি থামিয়ে সবাইকে পায়ে হেঁটেও পাহাড়ি শোভা উপভোগ করার সুযোগ করে দিয়েছিল।হঠাৎ মেঘটেঘ নেমে এসে বৃষ্টি নামায় যেযার মত ছুটে গাড়িতে বসলো। সন্দীপ খানিকটা বিরক্ত হয়েই গাড়ির পেছনে চলে এল যাতে নিশা প্রিয়মের পাশে বসতে পারে। বাইরে সামনে বাঁক নেওয়া রাস্তার পাঁচ ফুট দুরেও সব ঝাপসা। প্রিয়মও যেন একটু সতর্ক।নিশাও গেছে ঘাবড়ে। বাপরে এই রাস্তায় যাওয়া কি রিস্কি! ওরা পৌঁছতে পারবে তো?
নীরবতা ওদের দু'জনের কেউই বিশেষ পছন্দ করে না। কিন্তু প্রকৃতির কাছে মানুষ নিরুপায়।গাড়িটাকে যে একটা ধারে দাঁড় করাবে সেটারও ঝুঁকি নিয়ে উঠতে পারছে না প্রিয়ম।গাড়িকে ওপর থেকে কোনো গাড়ি যদি এসে মেরে দেয়!কিস্যু দেখা যাচ্ছে না যে! আবহাওয়ার এমন গোমড়াপনায় প্রয়াস বোর হয়ে ঘ্যানোড় ঘ্যানোড় করতে শুরু করলে শ্রীময়ী একটা গল্প শুরু করে যার মাথা মুন্ডু কিস্যু নেই। যেখানে তার তাল কেটে যায় সেখানেই বেশ দক্ষতার সাথে আখ্যানটিকে এগিয়ে নিয়ে যায় সন্দীপ।অমন মেঘ বৃষ্টি আর পিছল খাড়াই ঝুঁকিপূর্ণ পাহাড়ি পথে চাপে অমন দক্ষ ড্রাইভার প্রিয়মেরও প্রায় কোষ্ঠকাঠিন্য হওয়ার সামিল এবং তার পাশে এই গাড়ি চালানোটা সামনে থেকে দেখে প্রায় ভূত দেখার মতন ঘাবড়ে যাওয়া নিশা; দু'জনের কাছেই সময়টা কেমন যেন শুকনো ঠেকে। অন্যদিকে গাড়ির পেছনে বসে প্রয়াসের সাথে হেসেই শুধু চলেনি শ্রীময়ী আর সন্দীপ, শ্রীময়ীকে শ্রীময়ীদি বলার বদলে শ্রীময়ী বলে বেশ ক'বার সম্বোধনও করেছে। পাহাড়ে ওঠার তাদের কিন্তু তখনও দেরি। তার মানে সময় কিন্তু তাদের হাতে অনেকটাই আছে।
--------------------------------
প্রতীক মিত্র
কোন্নগর-712235, পশ্চিমবঙ্গ