গল্প ।। তেপান্তরের পাথার পেরোই… ।। অভিষেক ঘোষ
তালপুকুর মিনি তেঁতুলতলার ফ্লাইওভারের নিচে দাঁড়িয়ে ছিল। এখন সকাল দশটা। অফিসের লোকের দৌড়োদৌড়ি। বৈশাখ মাস। দলে দলে লোক ঝগড়া করতে করতে জীবনযুদ্ধে যাচ্ছে। তার ওপর আজ সোমবার। ছোটো ছোটো অটোগুলো কোলকাতার চারদিকে ছোটাছুটি করে লোক তুলছে লোক নামাচ্ছে। তালপুকুর মিনি সেদিকেই তাকিয়ে ছিল।
তালপুকুর ঠোঁট উল্টে বলল "ট্রিপ না ছাই! কাজ নেই, দাঁড়িয়ে আছি"।
শালুকডাঙা বলল "শরীর ভালো তো দাদার? যা চেহারা করেছো। কতদিন পরে দেখলাম তোমায়, আগের থেকে অনেক ঝরে গেছো কিন্তু"।
তালপুকুর আনমনে বলে "শরীরের আর দোষ কী। শরীর তো যন্ত্রই।
"সেইইই…." শালুকডাঙা বলে "শরীরের নাম মহাশয়, যা সওয়াবে তাই সয়, পেট্রোল-ডিজেল-কাটাতেল-মালিকের খিস্তি সব খেয়েই দিব্যি আছি। বেশি দামি খাবার খাচ্ছি, চলছি কম, আয় নেই, আজ পায়ে লাগছে তো কাল পিঠে ব্যথা"।
তালপুকুর ভুরু কুঁচকে বলে "দাঁতটা ভাঙলি কী করে এই বয়সে?"
"আর বোলো না, "শালা একটা দুচাকা ঠুকে দিয়ে গেল, আগের মাসে, চোখটা একটুর জন্য বেঁচে গেছে, মালিক ব্যাটা দেখেশুনে বলল, এখন চলে যাবে, ব্যাটা হাতির মত খাবে, আজ এই বিগড়োয় তো কাল ঐ নড়ে যায়, লোহার দরে বেচে দেব ব্যাটাকে, দাদা আমি বাঁচতে চাই"।
"এ লাইনে কোনও সিওরিটি নেই ভাইটি, আজ আছো তো কাল গেছো। যতদিন চলতে পারবে, ততদিন তোমার কদর, রাস্তায় নামলে বিপদ, না নামলে পেট চলে না, মানুষ জাতটাই বজ্জাত"।
শালুকডাঙার বাস তার বড় বড় চোখ মেলে আপাদমস্তক দেখে মিনিটাকে। ঐটুকু ছোট শরীর। বিবর্ণ হয়ে যাওয়া রঙে হালকা হালকা পানের ছোপ, সিট ছিঁড়ে ফোম উঁকি দিচ্ছে।
কষ্ট হয় দেখে, একী চেহারা হয়েছে। এককালে রাস্তায় নামলে লোক হাঁ করে দেখত বটে।
তালপুকুর উদাস হয়ে বলে, "চোখে দেখি নারে ভাইটি, মালিকও আমায় চোখে দেখতে পায় না মোটে। বুড়ো হয়েছি। যতক্ষণ শ্বাস ততক্ষণ আশ"।
"আজ তোমার মালিকের এত ঠাটবাট, এতগুলো চাকর দৌড়চ্ছে এরুটে সেরুটে সেতো তোমার ওপর ভর করেই গো দাদা।
তালপুকুর বলে "ধম্মে কম্মে মতি হয়েছে তা-হলে, বেশ তো বাণী কপচাচ্ছিস। জীবনে ঠুকেছিস কজনকে"
"সে কি আর হিসাব আছে গো। তবে তোমার মালিককে পেলে ঠুকে দেব"।
"খবরদার!!" খেঁকিয়ে ওঠে মিনিবাস, "অন্নদাতার নামে খারাপ কথা বললে কিন্তু…
"ঘাট হয়েছে!"
"হ্যাঁ, নুন খেলে তো গুণ গাইতেই হয় রে।
ভাল করে সামনে তাকায় শালুকডাঙা। হ্যাঁ তো, ঐ তো কুপন হাতে এগিয়ে আসছে বাসের খালাসি দুলাল। আরক্ত চোখে অস্পষ্ট গাল দিয়ে খোকনকে বলে, "দিলি
খোকন এ লাইনে নতুন। হটসিটে বসলে নিজেকে পাইলট মনে হয়। তখন লাল, সবুজ সব বাতি সমান লাগে। সে কাঁচুমাচু হয়ে বলে "হঠাত্ করেই বাতিটা বদলে গেল গো, আমি কি আর এমনি এমনি…"
"ঐ বাতি তোমার কপালে জ্বেলে দেবো", বিচ্ছিরি একটা গাল দিয়ে দুলাল বলে, "চল্ আজ! মালিককে বলে দূর করে দেব"….
শালুকডাঙা মনে মনে হাসে।
"আহা! বাচ্চা ছেলে, ওর কী বা দোষ! আমারই তো সাবধানে চলা উচিত ছিল" মিনি বলে, "আমার দোষেই খামখা…"
"বাচ্চা ছেলেএএ" মুখ ভেটকিয়ে শালুকডাঙার বাস বলে, "তুমি আর ওর হয়ে কাঁদুনি গেয়ো না, এই করেই তো আজ এই হাল, তোমার কী দোষ অ্যাঁ? যেমন চালাবে তেমনই তো চলবে নাকি!"
চারপাশ দিয়ে হু হু করে বেরিয়ে যায় বাস অটো ট্যাক্সি।
শালুকডাঙার বাস শিস দিয়ে ধোঁয়া ছেড়ে বেরিয়ে যায়।
মিনি আনমনে হাসে, "ওড়ো ওড়ো, ওড়ারই বয়স তো, যেদিন খাঁচাকলে পড়বে সেদিন বুঝবি"।
খোকন অপরাধীর মতো চা খায়। তারপর ভাঁড়টা ছুড়ে ফেলে রাস্তার পাশে। তেতো মুখে দাঁড়িয়ে দুলাল খৈনি ডলেডলে হাঁক পাড়ে- "দক্ষিণপাড়া, কলের ঘাট, ঘোড়াডাঙা, কদমতলা, কমলাপুর, তিন নম্বর গেট…"
খোকন স্টিয়ারিং ধরে। গিয়ারে চাপ দেয়। বিড়বিড় করে কিছু একটা বলে, তার দু'চোখ ঝাপসা হয়ে আসে।
দুপুরের ঠা ঠা রোদ। মেঘ আরো ভারি হয়ে ঝুলে পড়ে উড়ালপুলের মাথায়, আজ কি কালবৈশাখী হবে? নাকি কাল? নাকি পরশু?
স্টিয়ারিং থেকে হাত সরে না তার, সরবে কী করে, বুড়ো দাদুর মতো তার হাত দুটো কেউ চেপে ধরে বুঝি, তাকে বোঝায়, রাস্তায় নামলে এসব হয়, আচ্ছা, আমি বলে দেব এখন তোর মালিককে, নে নে এবার ছাড় তো দেখি, একটু হাওয়া খেয়ে বাঁচি।
খোকন আনমনে হাসে। হাত বোলায় সামনের কাঁচে। সামনের রাস্তায় ধুলো পাক খায়, জোরে জোরে হাওয়া দেয়, বাসের পিছনে ছুটে আসা দুলালের কাতর স্বর কানে আসে না তার, পক্ষিরাজ হয়ে একাই উড়ে যায় পাইলট। কোথাও আমার হারিয়ে যাওয়ার নেই মানা… আজ বুঝি পঁচিশে বৈশাখ।
শহরের মরা রূপকথাগুলো চারপাশে ভিড় করে আসে।
--------------------------------
ডঃ অভিষেক ঘোষ
সহকারী অধ্যাপক, সংস্কৃত বিভাগ
বাগনান কলেজ
কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়