অমরনাথ গুহা হিন্দুদের কাছে এক পবিত্র তীর্থ। কাশ্মীরের পহেলগাঁও থেকে ৪৮ কি.মি
দূরে ৩৮৮৮ মিটার (১২,৭৫৬ ফুট) উচ্চতায় এই তুষারতীর্থ অবস্থিত। এখানকার অধিদেবতা হলেন দেবাদিদেব মহাদেব। অমরনাথ গুহার দৈর্ঘা ১৬ মিটার, প্রস্থ ১৫ মিটার এবং উচ্চতা ১১ মিটার। এই গুহা দেবাদিদেব মহাদেবের ত্রিশূল দিয়ে পাহাড় কুঁদে তৈরি বলে কথিত। এই গুহার ডানদিকের একেবারে শেষপ্রান্তে আছে স্বয়ম্ভু তুষারলিঙ্গ। এই নৈসর্গিক গুহার ভিতরে পাহাড়ি ফাটল দিয়ে চুঁইয়ে পড়া জল বরফের আকারে জমতে জমতে শিবলিঙ্গের রূপ ধারণ করে। কঠিন এবং উজ্জ্বল এই শিবলিঙ্গের রঙ ঈষৎ নীলাভ। তিথি অনুযায়ীএই লিঙ্গের হ্রাসবৃদ্ধি হয়। কখনাে কখনাে এই লিঙ্গমূ্র্তি ৮ ফুট পর্যন্ত উঁচু হয়। এই লিঙ্গমূর্তির দু'পাশে আরাে দুটি মূর্তি আছে। বামদিকে মহাগণেশ এবং ডানদিকে দেবী পার্বতী। যথারীতি এই মূর্তিগুলােও বরফ দিয়ে তৈরি। এছাড়া দুটি শুকপাখিও নাকি যুগ যুগ ধরে এই গুহায়
আছে।
প্রবাদ আছে, সত্যযুগে সর্বপ্রথম এই তুষারলিঙ্গের দর্শন পেয়েছিলেন মহর্ষি ভৃগু। তিনি তক্ষককে অমরনাথ দর্শনে পাঠিয়েছিলেন। জানা যায়, জগৎগুরু শঙ্করাচার্য এই তীর্থযাত্রায় সূচনা করেন। আবার জনশ্রুতি, আক্রামবাট মল্লিক নামে এক মেষপালক নাকি দেবাদিদেব অমরনাথজীকে আবিষ্কার করেন।
প্রত্যেক শ্রাবণী পূর্ণিমায় (জুলাই-আগষ্ট) মাসে সারা ভারতের হাজার হাজার পুণ্যার্থী
পহেলগাঁও থেকে অমরনাথ যাত্রা শুরু করেন। অনেকক্ষেত্রে আষাঢ় মাসের (জুন-জুলাই)
গুরুপুর্ণিমা থেকে শ্রাবণী পূর্ণিমা – এই একমাস যাবৎ যাত্রা চলে অমরনাথে। শ্রাবণ
মাসের শুক্লপক্ষের দ্বাদশী তিথিতে পহেলগাঁও থেকে শুরু হয় "ছড়ি মিছিল"। এই মিছিলের
নেতৃত্ব দেন কাশ্মীরের ধর্মার্থ সংঘের মােহন্ত। সাধুসন্তদের সঙ্গে নাগাসন্ন্যাসী, তীর্থযাত্রী
ও পর্যটকেরা অংশগ্রহণ করেন এই মিছিলে।
প্রথম দিনঃ
যাত্রাপথ ১৬ কি.মি। যাত্রাশেষ ২৮৯৫ মিটার উঁচুতে "চন্দনবাড়ি"-তে। হাঁটাপথে যেতে হয়। গাড়ীতে যাওয়ারও রাস্তা আছে। এখানে স্থায়ী এবং অস্থায়ী বা সাময়িক দোকানপাট আছে। চা থেকে ভাতের হােটেল সবই এখানে মেলে। এখানেই রাত্রিবাস।
দ্বিতীয় দিনঃ
চলার পথ ১৩ কি.মি। চন্দনবাড়ি থেকে ৩ কি.মি পথ গেলে পাওয়া যাবে "পিসু" চড়াই। অত্যন্ত পিচ্ছিল এবং প্রাণান্তকর এই চড়াই পথ। লাঠিতে ভর করে খুব সাবধানে ১২০০০ ফুট উঁচুতে উঠেই "পিসু টপ"। এখানে সাময়িক বিশ্রাম। যাত্রীসেবার ব্যবস্থাও আছে এখানে। পুরাণমতে, দৈত্যরা দেবতাদের আক্রমণ করার জন্য যখন এই পথ দিয়ে ওপরে ওঠার চেষ্টা করতাে, তখন দেবতারা ওপর থেকে পাথর গড়িয়ে দিয়ে দৈত্যদের পিষে ফেলতাে। এজন্য এখানকার নাম "পিসু"। এখান থেকে ১ কি.মি গেলে "শেষনাগ"।
শেষনাগ হ্রদটি ৩৭১৮ ফুট উঁচুতে। হ্রদের জলের রঙ পান্না-সবুজ। জনশ্রুতি, সুশ্রবনাগ এই হ্রদ খনন করান এবং সেই থেকে তিনি এই হ্রদের জলে বাস করছেন। যাইহােক, এই ছােট হ্রদের পাশেই গড়ে ওঠে সাময়িক যাত্রী-কলােনি। এখানেই বিশ্রাম এবং দ্বিতীয় রাত্রিবাস। অনেকে এখান থেকে কিছুটা এগিয়ে বায়ুযানের বিশ্রামগৃহে কিংবা আগে যােজিপালে রাত্রিবাস করেন।
তৃতীয় দিনঃ
পথের দূরত্ব ১২.৫ কি.মি। শেষনাগ থেকে ৪ কি.মি পথ পেরােলেই ৪৭১৮ মিটার উচ্চতায় মহাগুণা পাস। আর আধ (.৫) কি.মি গেলেই বায়ুযান বা ওয়াবযান। এখানে যেমন আছে বাতাসের তাণ্ডব, তেমনি আছে শীতের প্রকোপ। কোনো কোনাে যাত্রীর শ্বাসকষ্ট হওয়াও অসম্ভব নয়। এখানেই ১৯২৮ খ্রিঃ ছড়িমিছিলে অংশগ্রহণকারী হাজার হাজার তীর্থযাত্রী তুষারঝঞ্ঝায় প্রাণ হারান। কিছু সাবধানতা অবলম্বন করা সত্ত্বেও ১৯৯৬-এর প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে এখানে বহু তীর্থযাত্রী প্রাণ হারিয়েছেন।
মহাগুণা পাস পেরােতেই উৎরাই শুরু। এখান থেকে ৮ কি.মি গিয়ে ৩৬৫৭ মিটার উচ্চতায় নেমে পঞ্চতরণীতে তৃতীয় দিনের যাত্রাশেষ তথা রাত্রিবাস। পাঁচটি পাহাড়ী নদী এখানে মিলিত হয়েছে – এজন্য এখানকার নাম পঞ্চতরণী। এখানে স্থায়ী বিশ্রামগৃহও আছে।
চতুর্থ দিনঃ
পথের শেষ ৬.৫ কি.মি দূরত্বে। পায়ে হেঁটে যাত্রা শুরু ভাের চারটেয়। ঘােড়ায় চড়ে যেতে সকাল ৬টায় এবং ডাণ্ডি বা কাণ্ডিতে সকাল ৭টায় যাত্রা শুরু করতে হয়। প্রথমে চড়াই পথে ৩ কি.মি দূরে "সাধােসত টপ" গিয়ে আবার সেখান থেকে ৩.৫ কি.মি উৎরাই পথ পেরিয়ে ৩৮৮০ মিটার অর্থাৎ ১৩৫০০ ফুট উচ্চতায় পথের শেষ, পবিত্র অমরনাথ গুহায়।
অমরনাথ গুহার নীচ দিয়ে বয়ে চলেছে অমরাবতী নদী, যেটি মিলিত হয়েছে অমরগঙ্গায়। অমরাবতীর জল বরফ-ঠাণ্ডা। বহু তীর্থযাত্রী এখানে স্নান সেরে পথের ক্লান্তি দূর করেন, দর্শন করেন অমরনাথ। শােনা যায়, স্বামী বিবেকানন্দ ইচ্ছামৃত্যুর বর এখানেই পেয়েছিলেন।
জনশ্রুতি, অমরনাথ গুহা দেবাদিদেব মহাদেবের বাসস্থান। "কাশ্মীরে ভ্রমণ" নামক বইতে (১৮৪২ খ্রিঃ) ডাঃ ভীন (Vigne) লিখেছেনঃ তীর্থযাত্রীগণ যখন অমরনাথ গুহার সামনে দাঁড়িয়ে উচ্চৈস্বরে প্রার্থনা করেন, তখন যদি গুহার ভেতরের পায়রারা উড়ে বাইরে বেরিয়ে আসে,তাহলে যাত্রীরা তাদের প্রার্থনা সফল হয়েছে বলে মনে করেন।
এছাড়া গুহার ভিতরের তুষার লিঙ্গের হ্রাসবৃদ্ধি চন্দ্রের কলার হ্রাসবৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে হয় বলে তীর্থযাত্রীরা মনে করেন।
===========
ঠিকানা :
কাশীনাথ হালদার
জেলেরহাট • পোঃ - দোলতলা ঘোলা •
থানা - বারুইপুর • জেলা - দক্ষিণ ২৪ পরগনা • পশ্চিমবঙ্গ • ভারত • ডাকসূচক - ৭৪৩৩৭৬।
☆☆☆