আত্মপ্রকাশেই আশা জাগিয়েছেন যে ঔপন্যাসিক
– অরবিন্দ পুরকাইত
গল্প-উপন্যাস তথা কাহিনি-সাহিত্য নতুন আর কী দিতে পারে পাঠককে! এমনিতেই বহু বছর ধরে দক্ষ-অদক্ষ অজস্র লেখকের হাতে তাদের রচিত হয়ে ওঠার পরিমাণ প্রভূত, এমনকি এক মহাভারতকে কাহিনির আকর বলে ধরা হয়; তার উপর প্রচুর পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত গল্প থেকে যাত্রা-পুতুলনাচ-নাটক-ছায়াছবি ইত্যাদির কাহিনি, দূরদর্শনে ধারাবাহিক থেকে বিশেষত মুদ্রিত এবং দৃশ্য-শ্রাব্য সংবাদমাধ্যমের এই বিস্ফোরণের যুগে। আরও বিশেষ করে বিভিন্ন সামাজিক মাধ্যমের এই রমরমার দিনে। সরকারি কেন্দ্রীয় ও স্থানীয় মাত্র এই দুই চ্যানেলের বাইরে অজস্র বেসরকারি দূরদর্শন চ্যানেলের সেই বোধহয় সূচনার দিকে, একটি বাচ্চা সম্ভবত খেলতে খেলতে পড়ে গেল এক খোলা কুয়োর মধ্যে। পাঞ্জাব বা হরিয়ানায়। কুয়োটাতে বেশি জল ছিল না। তো কুয়ো থেকে তাকে তোলার দীর্ঘ প্রচেষ্টা সেই প্রথম সরাসরি – যাকে বলে লাইভ – দেখানো হল দূরদর্শনের পর্দায়। প্রায় সারাদিন ধরে কী অসীম আগ্রহে দেখল সারা দেশের অগণিত উৎসুক উদ্বিগ্ন মানুষ! সেই প্রথম জোরদার এক প্রতিযোগী আসরে অবতীর্ণ হল সাহিত্যের। সেই থেকে আজ পর্যন্ত, বিশেষত সাম্প্রতিক কয়েক বছর বিবিধ মাধ্যমে বিভিন্ন সময়ে বিবিধ ঘটনা থেকে সুখী-সুখী জীবনের কথা থেকে দ্বন্দ্বময় যেসব জীবনের – তাদের লড়াইয়ের কথা, উত্তরণের কথা, ভাবনার বিশেষত ব্যতিক্রমী ভাবনার কথা মুদ্রিত অক্ষরে বা দৃশ্য-শ্রাব্য মাধ্যমে সরাসরি উঠে আসছে তা অনুধাবন করলে বুঝতে আদৌ অসুবিধা থাকে না যে কল্পকাহিনির থেকে নিত্যবাস্তব কম বিচিত্র নয়, বরং অভিঘাতে অনেক ক্ষেত্রে সুদূরপ্রসারী ও তাৎপর্যময়। এটা তো বাস্তব যে গল্প-উপন্যাসপাঠকের থেকে খবরের পাঠক এবং বিভিন্ন সংবাদ বা সামাজিক মাধ্যমের দর্শক-স্রোতা অনেক বেশি। আর কারও কথা তুলে ধরার জন্যে তেমন কসরত করতে যেমন হয় না, প্রতিভা না থাকলেও তেমন কিছু এসে যায় না। শুনে টুকে নেওয়া বা রেকর্ডিং করে নেওয়া কিংবা আরও সহজ হল ক্যামেরা তাক করে মাইক্রোফোন মুখের কাছে এগিয়ে দেওয়া। চলভাষ যন্ত্রটি তো এ বিষয়ে এখন কম কদম এগিয়ে নয়। এদিকে গল্প-উপন্যাসপাঠ যতটা নিভৃতির জগৎ, বিভিন্ন সূত্রে আগত এইসমস্ত বাস্তব অনেক বেশি প্রচার-প্রসারমুখী। এসব বিষয়ে দৃষ্টান্ত তুলে ধরা নিশ্চয়ই বাহুল্য।
গল্পকার-উপন্যাসকারের জন্যে কী পড়ে রইল তবে! রসসৃজন, গভীরতা, উপস্থাপন, মৌলিকতা, স্বতন্ত্রতা ইত্যাদি এবং সর্বোপরি নিজস্বতা। প্রায় যে-কোনো ভাষায় দীর্ঘ সাহিত্যযাত্রায় কাহিনির মৌলিকতা মেলা বিরলপ্রায় আজ, উপস্থাপনেও খুব বেশি বৈচিত্র্যেরও তেমন অবকাশ কম, বিশেষত একই লেখক যখন বহু লেখা লেখেন। আপন ভাবনাজাত হোক বা বাইরের কথা-ঘটনা, ভিতরে ঢুকে অন্তরঙ্গ দেখা এবং পাঠকের মধ্যে তা চারিয়ে দেওয়াটাই বলতে গেলে মূল। বলতে গেলে নিবিড় গোয়েন্দাগিরি – সাহিত্যের ক্ষেত্রে আরও উপযুক্ত শব্দ বোধহয় ডুবুরি। লেখক কর্তৃক কাহিনির কুশীলবের মানস-পরিক্রমা। গল্পকার কেবল গল্পটা বিবৃত করবেন না, যাবতীয় আবেগ-অনুভূতি-দ্বন্দ্ব ইত্যাদি নিয়ে গল্পের চরিত্ররা প্রত্যক্ষ হয়ে উঠবে পাঠকের কাছে। কুশীলবের অনুভূতির সঙ্গী হয়ে পড়বে পাঠক, জড়িয়ে পড়বে ঘটনা পরম্পরায়। সেসব বড় সহজ কাজ নয়, আর নয় বলেই বাস্তব হোক বা কল্পিত – একটা গল্প সাজিয়ে তুললেই তা পড়ে কেন সময় নষ্ট করবে পাঠক যদি কেবল ঘটনা ও চরিত্রের সমাচার প্রদান করেন লেখক – ভাল-মন্দ মিলিয়ে তাদেরকে জীবন্ত হয়ে উঠতে না দেন, পাত্রপাত্রীর অনুভূতিকে সূক্ষ্মভাবে তুলে ধরতে না পারেন বা তাদের মনের খবর না দিতে পারেন! খবরও গল্প হতে তো বাধা নেই কোনোকালে, কিন্তু তাকে প্রমাণ দিতেই হয় যে সে গল্প বা আখ্যান – নিছক খবর নয়। দুইয়ের পাঠকও ভিন্ন সচরাচর। এসব বলতে গেলে গল্প-থাকা গল্প সম্বন্ধে, বিবর্তিত কালে গল্পহীন গল্পের দাবিকেও অস্বীকার করা যাচ্ছে না। আর তাই সব মিলিয়ে বলতে গেলে, সংবাদ-সমাচার সচরাচর স্বল্পায়ু – পরের পর সংবাদে সাধারণত ঢাকা পড়ে যায় আগেরগুলো, বিপরীতে গল্প-উপন্যাস তুলনায় দীর্ঘায়ু এবং ভাল মানের গল্পের হীরকদ্যুতি বহুদিন ঝলকায় – ব্যক্তিমানুষের ক্ষেত্রে ভিন্ন ভিন্ন বয়স বা মানসিক স্তরে এবং সমাজের ক্ষেত্রে ভিন্ন ভিন্ন যুগে তার যুগলক্ষণ অনুযায়ী ভিন্নতর ব্যঞ্জনা নিয়ে উঠে আসতে পারে।
পাঠক ক্ষমা করবেন, অনেক দিনের ভাবনা কিঞ্চিৎ লিপিবদ্ধ হয়ে পড়ল একটি বই পড়ার সূত্রে।
বইটার নাম হল গে 'রাঙা মাথার চিরুনি'। নেখক বিশ্বজিৎ সরদার। এট্টু ছোট আকারের বই, তার পঞ্চান্ন পিষ্টা পুরো বইটা, নেখক বলেচেন 'ক্ষুদ্র উপন্যাসিকা'।
শী সদ্দারের ধন্যবাদ দিতি হয় এরম এট্টা বই নেকার জন্যি। নেখক-জেবনের পথম বই উপন্যাসিকা কোম দেকা যায়। কবিতা, গল্প, ছড়া এইসবের বই দে আরম্ব হয় বেশির ভাগ। পথমেই উপন্যাসিকা, তার ওপরে সত্যিকারের চালচুলোহীন মা ও মেয়ে দুজনের কতা তাদের মুক দে বলানো – শী সদ্দারের সাওস আচে বলতি হবে! আর আচে চলতি সোতের বিপরীতি হাঁটার ইচ্ছা।
এ গল্প পড়তি পড়তি মন ককন বলে ওটে, হায় গিহহারা, হায় পতবাসী! কি, সকল গিহ হারাল ঝার! বলতি পার সব্বহারা, বলতি পার দলিত, পিছড়ে বগ্গ কত কী! নেম্নবগ্গ বা সাব-অলটার্ন বললিও কেউ ভুল বলবেনে। এ কাহিনির পাঞ্চালী-উত্তরারা নিম্নবগ্গের থেকেও বোধায় নেচয়। ঝাদের কোনো আচ্ছারায় নি, টেনে, টেনের ইস্টাশনে কি পেলাটফরমে, বিজির নিচয়, এলনাইনির পাশে জেবন কেটে যায় ঝাদের, হয়তো তাড়া খেয়ে কি অন্য ভয়ে একেন থেকে সেকেন। ছাত দূ্রির কতা, ছাউনিটোকাও অনেকসোমায় মেলে না মাতার ওপর। ককনও এট্টুখুনি আচ্ছারা মিললি দেহ-মনের আরও বড় আচ্ছারা হারানোর ভয়! তার মদ্যি সোংসার, তার মদ্যি স্বপ্ন। হায় সোংসার! দিনির পর দিন ভেসে ভেসে বেড়ানো পাঞ্চালী-উত্তরাদের! থাকার ঠিক নি, খাওয়ার ঠিক নি, কাজের ঠিক নি। ঘেন্না-ঘেন্না শরীর পাঞ্চালীর। কিন্তু ভোগ করবার সোমায় ভদ্দনোকের আর ঘেন্না নাগেনা সে শরীরি। পেটে ভূত ঢুইকে দবার সোমায় ঘেন্না থাকে না! তারপর আর কোনো দায়িত্ব নি, এঁটো-কাঁটার মতন ফেলে দাওয়া – সমাজে মাতা হ্যাঁট হবে যে ভদ্দনোকের! কী চ্যায়ছেল সে, না, পোড়া পেটে দুটো দানা, আর এট্টু আচ্ছারা। গড়াতি গড়াতি গতরটোকা আর তার সঙ্গে পেটের ভূতটা নে আবার ঠাঁইনাড়া! কত চেনা এরা আমাদের, কিন্তু পরিচয়! সে পরিচয় আমরা নিতি পারি ক'জন সেইভাবে! নিতি পাল্লিও, তা নেকায় সেভাবে আনতি পারে ক'জন! নেখক নিকেচে, 'যাকে দেখে এ কাহিনি লেখা শুরু করেছি তার কাছে লেখকের কৈফিয়ৎ হল এই যে সেও আর এ গল্প পড়ে নিজেকে চিনতে পারবে না।' সেটাই, যারে বলে শিল্প – তার ধম্ম। তেবু তার কাচে নেখক 'বিনীত' থেকেচেন কেন-না 'বিনা অনুমতিতে তার জীবন-কুটুরিতে উঁকি' মেরেচেন। ব'য়ের মোলাটের ভিদরির নেকায় তাদের জেবনের কাচাকাচি আসার কতাও আচে সেকেনে, 'বারুইপুর, দমদম, রানাঘাটের মতো বড় বড় স্টেশনগুলোতে পাগলিগুলোকে ঘুরতে দেখেছি তিন চার পাঁচ ছয়টা বাচ্চা নিয়ে। পাগলি। গায়ে দুর্গন্ধ। জামাকাপড়ের ছিরিছাঁদ নেই। জঞ্জালের মত মাথার চুল। কোন মহাপুরুষের আশীর্বাদ ধন্য হয়ে তারা বছর বছর সন্তান সৌভাগ্য লাভ করে? - এই কঠিন প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে খুঁজতে পাঞ্চালী আর উত্তরার জীবনের কাছাকাছি পৌঁছে যাওয়া।' নেকার ভিতটার এট্টা আভাস পেতি পারি আমরা এত্থেকে।
এট্টা সিনেমা হচ্চে, তা আগে দেকেচে এরম এগজন বলতি শুরু কল্ল এরপর কী কী হবে; অমনি আগে দ্যাকেনে এরম ক'জন বলে উটল, এই আগে থেকে বলিসনিদেন। তার মানে ঝারা দেকেনে তারা ভাল-মন্দ সবঅকম নাগার মদ্যি দে যেতি চায় – বুজতি চায়। তাই গল্পটা বেশি বলা ঠিক হবেনে। জেবনযুদ্ধু কতাটা নেকাজোকার জগতে খুব চলে, অনেক সত্যিকারের যুদ্ধু আমাদের চোকির অবারিই থেকে যায়! বস্তির পরিবেশ সয্য না হওয়ায়, বস্তির সোঙ্গে সোঙ্গে নিজের পরিবার ছেড়ে-আসা পাঞ্চালীর জেবন এমন বেড়ম্বনার হয়ে উটল যে পেরায় অথব্ব অবস্তায় দেহব্যবসায়ীদের পাড়ায় যকন আশ্শয় পেল – একসোমায় খদ্দের আসতি শুরু কল্ল, বইটা ঝারা পড়বে তারা ঝেন সেই ক'দিন এট্টু স্বস্তি পায় – ঝাই হোক, পাঞ্চালীটা পেটে তেবু দুটো দিতি পাত্তেচে, এট্টু থাকার জ্যায়গা প্যায়চে। পতই ঝাদের ভস্সা, তাদের মদ্যি কেবল মেয়ে হবার জন্যি নাটাঝামটা, বেপদ-আপদ বেশি মেয়েদের। শুদু ভদ্দনোক নয়, ওই পতের নোকদের থেকেও তাদের নাটাঝামটা কোম নয়। তা পেটের মেয়েটার ঝাতে তার মতন দশা না হয়, নেকাপড়া শেকাতি গে তার এট্টা পরিচয়ের জন্যি নেতার ধত্তি হল পাঞ্চালীর নিজের শরীর দে। পরিচয় এট্টা ঝাহোক খাড়া হল তো ভদ্দনোকের বাচ্চারা কী করে জেনে, ঠেলে ইস্কুলির সিঁড়ি দে ফেলে পঙ্গু করে দেল ডান হাতখান। টেনে হকারি করেচে পাঞ্চালী। উত্তরারে এট্টা হোমে দেচে। সেকেনে এট্টু নেকাপড়া শিকতি শিকতি, খুঁড়ি মা'টার দিনির পর দিন আর দেকতি না পেয়ে সে বেইরে পড়ে এগদিন। এগগাদা ছাবালপনের মদ্যি মা'র নে পাঞ্চালীর তেমন সিতি না থাগলিও, পাঞ্চালীর নে উত্তরার ছেল। আর পতের মাজে ঝে গৌরকে পেল! পেয়ে হারাল! মা বের স্বপ্ন দেকেছেল, কী হল! মেয়ের বের স্বপ্ন ঝকন জাগল, তকন দেরি হয়ে গেচে। এই ক'পাতার গল্পে মা-মেয়ের পরপর আনতি হল কেন! নেখক বুইজে দেলেন কারও এক জম্মে এ গল্প শেষ হবার নয়। সম্ভব নয় নিষ্কিতি মেলার।
শী সদ্দার তাদের মুক দে তাদের কতা এমনভাবে বইলেচে, ঝে পড়বে সে মাজে মাজে ভুলে যেতি পারে ঝে এটা কেউ নিকেচে। এটা কোম কতা নয়। এদের নে নেকাজোকা এগবারেই হয়নে বা হয় না তা নয় নিশ্চই, তেবু শী সদ্দার এদের নে কোনো উপকতা নেকেনে – দুক্খু-কষ্টর শেষে সুকি হলর মতন; উনি কতাউপ দেচেন তাদের জেবন, তাদের যন্তন্নার। এমনকি নিউপায় তাদের ভগবান ধাওয়ানো, ভগবানের ওপর মানকরা, দোষ দাওয়া উটে অ্যায়চে নেখকের কলমেও – ব'য়ের বেলার্বের নেকায়। 'যে জীবন পাগলের, পথ-বালকের, ভবঘুরে ভিখারির সেখানে কি স্বপ্নের চাষ হয়?...হয়। সেখানে এই আকাশের সমান্তরাল আরো এক আকাশ আছে। কিন্তু ভদ্রলোকের বিষাক্ত লালায় সেই আকাশের নিচের অন্ধকারটুকুও আর নিরাপদ থাকে না। ভগবান নামের অদৃষ্ট দৈবশক্তিও এক্ষেত্রে পক্ষপাতী। কখনো তিনি পাঞ্চালী ও উত্তরার জীবনের লড়াইয়ের সহযোগী হন না।' আসলে এও এক অন্য 'এ জীবন লইয়া কি করিব'র গল্প। 'মরে যাব মনে হয়। ভালো হয়। মরে গেলি সব ঝঞ্ঝাট মিটে যায়। সত্যি তো! মরে গেলি কোন চিন্তা নি।'
উপন্যাসিকার আগে আবার খুদ্দ বলেচেন নেখক। দিব্যি মোটাসোঁটা উপন্যাসও হতি পারত, হতি পারেনে নেখকের ঝারে বলে পরিমিতিবোদ বা সংযমির কারণে। শেষ পজ্জন্ত ভালই হয়চে তাতে।
এই সোমায়ের কোনো উপন্যাসিকা বা উপন্যাসে 'লেখকের কথা'য় এমন কতা দেকা গেচে কি – 'ভাষা গবেষকদের চোখের আড়াল বেয়ে প্রতিদিন শব্দরা ভাঙছে গড়ছে, নতুন চেহারা নিচ্ছে। গ্রাম পরিসরে শহুরে লোকের শব্দচ্চারণ(?) এর অনুকরণ প্রবণতা, প্রকৃত শব্দরূপ সম্পর্কে অজ্ঞতা ও আঞ্চলিক উচ্চারণ বিশিষ্টতা মিলে নতুন ও মিশ্র ভাষার জন্ম হচ্ছে। তেমনি রেল স্টেশন বাজার শহরের ফুটপাতের ভবঘুরেদের মধ্যেও তৈরি হচ্ছে নতুন ভাষা চরিত্র, নতুন শব্দরূপ ও উচ্চারণ প্রকৃতি। কখনো কখনো একই মানুষ একই শব্দকে আলাদা আলাদা ভাবে উচ্চারণ করছে।' 'কাগুজে ভাষা'কে মানেননি নেখক – ঝাদের গল্প তারা তাদেরই মুকির ভাষা তাদের নিজের ভঙ্গিই উচ্চারণ করেচে। এজন্যি অবশ্যই নেখকের সাধুবাদ দিতি হয়। গল্প-উপন্যাসির চরিত্তদের মুকির ভাষায় এস্থানীয় ভাষা দেকা যায় অনেক, পুরো কবিতার বইও হয়, কিন্তু পুরো উপন্যাস তেমন চোকে পড়ে না। তা হবেনে কেন! পুরো বইটাই তো মুকির ভাষায় – পাঞ্চালী ও উত্তরার। মাজঘানে অন্য চরিত্ত এলি তারা তাদের মতন উচ্চারণ করেচে। আমার তো মনে হয় ব'য়ের নাম 'রাঙা মাতায় চিরুনি' হলি আরও ভাল হত। তাতে বোজা যেত বইটা এস্থানীয় ভাষায় নেকা। বইয়ে 'দোল দোল দুলুনি' দু-বার অ্যায়চে, দু-বারই 'মাতায়' নেকা হয়চে। 'আঙা' নেকা হয়নে, সে ঠিক আচে, কেন-না অনেক 'র', 'রা'-কে 'অ', 'আ' ইত্যাদি উচ্চারণ করেনে। তারা 'রাতে' বলে, 'রোজ' বলে, বলে 'রক্কা', 'রান্নাবাটি', 'রাকবুনি', 'রুমালগুলো' আর কক্ষনোই এগুনোকে অ, আ বা ও দে উচ্চারণ করে না। লজ্জ, লুকোচুরি, লোক, লাভ-কে তারা নজ্জা, নুকোচুরি, নোক, নাভ বা নাব বলে না। সুন্দর-কে সোন্দর, জিজ্ঞেস-কে জিগেস, জন্ম-কে জম্ম, যতক্ষণ বা ততক্ষণ-কে যৎক্ষণ বা তৎক্ষণ, বাড়িওলা-কে বাড়িঅওলা ইত্যাদি বলে না। মিশ্শ ভাষাচরিত্তের দিগ দে সেসব ঠিক আচে, কেন-না পুরো বইজুড়েই তারা এই উচ্চারণ করেচে, অন্যরকম করেনে। আসলে মাচবা-য় কাহিনি নেকা হলিও, এমনকি শহুরে সিক্খুত মানুষরাও সবাই সবসোমায় সব কতা মাচবা-য় বলে না (কতার মদ্যি ইংরিজি, হিন্দি এসব বাদ দে-ই বলতিচি)। তেমনিই খাঁটি এস্থানীয় উচ্চারণও খুঁজে পাওয়া দুরোহ। তার মদ্যি একেকটা চরিত্তের উচ্চারণের একেকটা ধরন গড়ে ওটে। দেকতি হয় চরিত্ত অনুযায়ী সেই ধরনটা বরাবোর মোটামুটি ওইল কি না। সত্যি বলতি কী, একই জ্যায়গায় পাশাপাশি বাস-করা মানুষির মদ্যিও কোনও কোনও উচ্চারণের তপাৎ থাকতি পারে আর তাই মাচবা-তে কাহিনি নেকা হলিও চরিত্তের মুকির কতার বেলা পধান-অপধান পেরায় সব চরিত্তের মুকির কোনও কোনও উচ্চারণে সেই তপাৎটা থাকার কথা। বিশেষ করে পাশাপাশি বাস-করা ভেন্ন সম্পদায় বা বন্নের মানুষ হলি। এমন কতা এগবার নিকেওছেল এই আলোচক। ঝাই হোক, তেবুও কথাবার্তা, আগ্রহ, নিরাপদ, নিরুপায়, যাত্রায়, আশ্রয়, নিশ্চয়ই ইত্যাদির মতন কোনও কোনও শব্দ নে এই আলোচকের সন্দেও ওয়ে গেল। সন্দেওর বিশেষ করে কারণ হল, পতিদিন বিভিন্নভাবে মাচবা-র সোঙ্গে ঘর কত্তি কত্তি নিদ্দিষ্ট এস্থানীয় মানুষদেরও আঙুলির ডোগায় অনেক সোমায় নিজের মাটির উচ্চারণির জ্যায়গায় মাচবা চলে আসা নিতান্ত অসোম্ভাব নয়। বিশেষ করে পরে ঝারা শহর বা শহত্তলিতে চলে যায়।
কাহিনি বোনার মদ্যি দে কিচু কিচু কতা এমন সোন্দরভাবে অ্যায়চে! দু-এট্টা ছোট করে শোনাতি নোব হচ্চে। 'যেমন যেমন লোক তার তেমন তেমন ভগবান। ভালো ভালো ভদ্দলোকেদের ভালো ভালো ভগবান হয়। তারা ভালো ভালো কিপা করে।আমরা যেমন ছোটলোক তেমনি আমাদের ছোটলোক ভগবান। আমার ভগবান এনে আমার একেনে ফেলেচে।' 'বাবার নাম দিতি হবে? বাবা নি তো ওর। বাবা কোতায় পাবো? বীজটা শুদু পেটের মদ্যি ঢুইকে দিলি বাবা হয়ে যায়? ও বাবু ভদ্দলোক ওর বাবা?...রাক্কস! বাবা হবার জন্যি আমার টেনেছেল নাকি? ও কি আমার মেয়েটার জন্যি ওর নাম দেবে? কক্ষনো দেবেনা। মুকি কালি লাগবেনে? লোকে কি বলবে?' 'ভগবান তোমার কি আক্কেল!... কোনটা আমি ইচ্ছা করে করিচি? নিজের শক মেটানোর জন্যি? তুমি যেকেনে নে ফেলেচো সেকেনে সেরাম ভাবে বাঁচবার চেষ্টা করিচি। এইটা আমার অপরাদ?' 'পিথিবীটার অনেক রকম রূপ আচে। আমি যে রূপটা দেকতিচি বাবুদের ছেলেমেয়েরা সেরাম রূপ দেকেনা। আবার বড় বড় গুন্ডা মস্তান ডাকাতরা পিথিবীটার অন্যরূপ দেকতেচে।...' 'আমাদের আবার ভাবনা কি? তোরা আমাদের কি জব্দ করবি রে শালার বাচ্চা শালা। আমরা যেকেনে শুব সেটাই আমাদের ঘর। তোরা কোতায় যাবি? ডাসবিন দে ফেলে দাওয়া কত খাবার কুকুরির মুকদে কেড়ে খেইচি শালো তবু দিব্যি বেঁচে আচি। তোরা বাঁচতিশ? আয় একরাত এই কনকনে ঠান্ডায় আমার সঙ্গে ওই রেললাইনের ধারে শুয়ে দেক। দেক কেরাম লাগে।' 'কিন্তু জানি এক্ষুনি আমার মরণ নি। এরাম করে করে এট্টা ভবঘুরে মেয়ের জীবন লেকার জন্যিই ভগবান আমার ব্যবহার কত্তি চায়। তাই আবার আমি পতে। এই পতই আমার শুরু এই পতই আমার শেষ।'
চরিত্তচিত্তনে নেখকের মুনশিয়ানা স্বীকার কত্তিই হয়। গৌরইর জন্যি উত্তরার আক্ষেপ, আত্তি, আকুতি নাড়া দেয়।
আত্মপকাশেই পত্যাশা জেইগেচেন এই নেখক। মন বলে এ নেখক হেইরে যেতি আসেননি। আমাদের শুভকামনা ওইল।
প্রুফ দেখা হতাশ করেছে। সারা বইয়ে 'কি' ছাড়া একটাও 'কী' দেখেছি কি! অথচ অধিকাংশই 'কী' হওয়ার কথা। বিস্ময়সূচক চিহ্নের কী বিস্ময়কর অনুপস্থিতি! পূর্ণ বাক্যের উদ্ধৃতিচিহ্ন শুরু হওয়ার আগে সচরাচর একটি অর্ধবিরতি চিহ্ন দেওয়া হয় এবং উদ্ধৃতিতিহ্ন পূর্ণচ্ছেদ চিহ্নের পরে বসে শেষ হয়। এখানে তা হয়নি। বানানে অসঙ্গতি রয়ে গেছে।
সুশোভন দত্তকৃত প্রচ্ছদ ভাল।
* এই লেখার পাঠকদের উদ্দেশে জানানোর যে উপন্যাসিকাটির আলোচনায় স্থানীয় ভাষার ঠাট বজায় রাখতে, আঙুলে চলে-আসা কোনও কোনও শব্দ, শব্দবন্ধ ইত্যাদির ব্যবহারে মন সায় দেয়নি অথবা অন্যভাবে বলতে হয়েছে, এই সীমাবদ্ধতাকে স্বীকার করতে হচ্ছে।
=====================
পুস্তকের নাম : রাঙা মাথার চিরুনি
লেখকের নাম : বিশ্বজিৎ সরদার
প্রকাশকের নাম : অনন্যা প্রকাশনী
প্রকাশকাল : ৮ মে ২০২২ (মোড়ক উন্মোচন ১৯ জুন ২০২২)
প্রচ্ছদ : সুশোভন দত্ত
মূল্য : ১৩০ টাকা
খুব ভালো আলোচনা হয়েছে, খুব ইচ্ছে হয় .....বারবার পড়তে ...বইয়ের আলোচনা একাধিক বার পড়তে ভালো লাগছে , একঘেয়ে লাগছে না ...সত্যি তোমাকে আরো একবার প্রণাম
উত্তরমুছুন