খেলা
নিরঞ্জন মণ্ডল
শ্রাবনের পড়ন্ত বিকেল।মাঝারি মাপের একটা খেলার মাঠ।মাঠের উত্তর পাশ ঘেঁষে একটা জুনিয়র হাইস্কুল ভবন।দোতলা স্কুল বাড়ি। খুব বড় নয়।মাঠের তিন দিকের সীমানা বরাবর কিছু গাছ।শিরিষ লম্বু আর জারুল।গাছ গুলোও খুব বড় নয়।বিদ্যালয়ের তিন দিকে তিনটি গ্রাম।কোনোটা বড় কোনোটা ছোটো।স্থানীয় শ্রাবনী মেলা উপলক্ষ্যে বিদ্যালয় আজ বন্ধ।সকাল থেকে বেশ কয়েক পশলা মাঝারি বৃষ্টি হয়ে গেছে।আকাশে এখনো কিছু টুকরো মেঘের আনাগোনা।মেঘ জমাট বাঁধলে আবার বৃষ্টি হতেও পারে।কিন্তু তার তোয়াক্কা না করে মাঠে জড়ো হয়েছে কিছু কিশোর ছেলে।সংখ্যায় পঁচিশ তিরিশ জন হবে হয়তো।মাঠে এখানে সেখানে জমে আছে সামান্য জল।ভিজে মাটি।তবে মাঠটায় লম্বা ঘাসের পরত থাকায় কাদা তেমন দেখা যাচ্ছে না।গত কাল বিদ্যালয় ছুটির পর ছেলের দল মাঠে ফুটবল খেলেছিল।যে টুকু কাদাজল তৈরি হয়েছিল কয়েক পশলা বৃষ্টিতে ধুয়ে গেছে।বর্ষায় এমন বৃষ্টি তো হবেই।তাই বলে কি খেলা থেমে থাকবে? মাঠে জড়ো হওয়া কিশোররা সকলেই এই বিদ্যালয়ের ছাত্র।কেউ পড়ে ষষ্ঠ শ্রেণিতে।কেউ বা সপ্তম আবার কেউ অষ্টম শ্রেণিতে।মাঠে এখন ফুটবল খেলবে তারা।নিজেদের ইচ্ছে মতো বেছে নিয়ে তারা তৈরি করে দুটো দল।এক দলে রণো ওরোফে রণজিৎ।পড়ে অষ্টম শ্রেণিতে।এলাকায় ভালো ফুটবল খেলোয়াড় হিসেবে তার নামডাক।এই সূত্রে একটু অহঙ্কার ও আছে তার।বিদ্যালয়ের ফুটবল দলে সেই-ই ক্যাপ্টেন।খেলে ফরোয়ার্ডে।অন্য দলে ভিকি ওরফে ভবপ্রসাদ।সে পড়ে সপ্তম শ্রেণিতে।সে ও ভালোই খেলে ফুটবলটা।বিদ্যালয়ের দলে তাকে খেলতে হয় স্টপার হিসেবে।যদিও এতে তার বেশ আপত্তি।তার ইচ্ছা ফরোয়ার্ডে খেলার।কিন্তু ক্যাপ্টেন রণো নিজের জায়গা পাকা করে নিতে তাকে ঠেলে দিয়েছে স্টপারে।এ জন্যে রণোর উপর ভিকির একটু চাপা ক্ষোভ ও আছে।
আজ পাড়াগত ভাবে গড়া দু-দলে দুজন।পরস্পরের প্রতিদ্বন্দ্বী।ভিকি মনে মনে ভাবে--ফরোয়ার্ডে খেলতে না দেওয়ার শোধ সে আজ তুলবে।কিন্তু সমস্যা আছে এতে।তার দলে একমাত্র গোলকিপার ছাড়া বাকিরা বেশ দুর্বল খেলোয়াড়।অন্য দিকে রণো।তার মনেও আছে চাপা একটা রাগ ভিকির উপর।একবার অকারনে গেম টিচারের কাছে তার বিরুদ্ধে নালিশ জানিয়েছিল ভিকি।ভিকি ক্লাশের এক নম্বর ছাত্র।সে নিজে কোনোমতে উতরে যায় পরীক্ষায়।সেটা নিয়েও ভিকি তাকে টিটকিরি করেছিল বেশ কয়েকবার।একবার তো প্রথম হওয়ার পুরষ্কার নিয়ে মঞ্চ থেকে নেমে তার হাতে দিয়ে ভিকি বলেছিল--নে ধর ;ছুঁয়ে দেখ একবার।জীবনে তো একবারও পেলি না।এর আনন্দ তুই আর বুঝবি কি করে! শুধু ভালো ফুটবল খেলাটাই সব নয়। গায়ে জ্বালা ধরে গেছিল রণোর।তখনই পুরষ্কারের বইটা ভিকির হাতে ধপাস করে ফেলে দিয়ে সে বলেছিল--ভারি তো একটা বই! অমন বই আমার পড়ার টেবিলে ঠাসা।কত আর হবে দাম? একশ দেড়শ টাকা!এমন বই আমি একসঙ্গে দু-তিনটে কিনতে পারি।
রণোর দলটা আজ বেশ ভালো হয়েছে।বিদ্যালয়ে ক্যাপ্টেন্সির প্রভাবে হয়তো।যারাই ভালো খেলে একটু সবাই ভিড় করেছে তার দলে।কিন্তু ভালো গোলকিপারটা দলে টানার আগেই ভিকি তাকে দলে টানে।ছেলেটি ভিকির পাশের বাড়ির যে! রণো মনে মনে ঠিক করে নেয় আজ গোলের মালা পরাবে ভিকিকে।প্রথম হওয়ার পুরষ্কারের জ্বালাটা আজ সুদে আসলে ফিরিয়ে দেবে সে। ভিকি তো আজ ফরোয়ার্ডে খেলবে।তাকে দেখিয়ে দেবে কেন সে তাকে ফরোয়ার্ডে খেলতে দেয় নি।নিজের দলের খেলোয়াড়দের সঙ্গে দু মিনিটের পরামর্শ সেরে নেয় রণো।ওদিকে ভিকি ও তার দলের সবাইকে নিয়ে একটু দূরে ফিসফাস করে কিছুক্ষণ।তার পর গোলকিপারকে নিয়ে আলাদা করে কিছু শরামর্শ করে সে।
খেলা শুরু হয়।রেফারি করা হয় বিদ্যালয় থেকে বছর দুয়েক আগে পাশ করে যাওয়া শনুকে।সে এখন দূরের উচ্চমাধ্যমিক বিদ্যালয়ে একাদশ শ্রেণির ছাত্র।সে ও ভিকির পাড়ার ছেলে।ভিকির সঙ্গে তার একটু ভাব ভালোবাসা আছে।মূলত তার পড়াশুনোয় ভালো হওয়ার জন্যে।রণো আর ভিকির দ্বৈরথ দেখার মজাই আলাদা।খবর ছড়িয়ে পড়ে ধীরে ধীরে পাশাপাশি গ্রাম গুলোতে।পাড়াগুলোর সব ছেলেরাই মাঠের পাশে জড়ো হতে থাকে।খেলা এগোয়।ভিকিকে রণোর দলের দুজন সব সময় আগলে রাখছে।ভিকি বল পেলেই বেপরোয়া পা চালিয়ে বল পাঠিয়ে দিচ্ছে মাঠের বাইরে।ফাউল ও হচ্ছে দু এক বার।কিন্তু তাতে কিছু আসে যায় না রণোদের।যে কোনো মূল্যে ভিকিকে আটকাতে হবে।অপর দিকে রণো বল পেলেই প্রবল গতিতে ঢুকে পড়ছে ভিকিদের পেনাল্টি বক্সে।আর তখনই ভিকির দলের সবাই ঘিরে ধরছে তাকে।চিলের মতো গোলকিপার হাজির হয়ে হাত বা পা দিয়ে বল পাঠিয়ে দিচ্ছে মাঠের বাইরে।থ্রোইং হচ্ছে।তা হোক।ভিকি তো তখন পৌঁছে গেছে সেখানে।বিদ্যালয় দলে স্টপারে খেলার অভিজ্ঞতা কাজে লাগাচ্ছে।সবাইকে কেমন ভাবে যেন টপকে বল ধরে নিচ্ছে সে।পাঠিয়ে দিচ্ছে মাঠের বিপরিত প্রান্তে।খেলা এগোচ্ছে।কিন্তু কোনো দলই গোল করতে পারছে না।এতে ভিকি উত্তেজিত হয়ে পড়ছে।রণোর মেজাজ ও বিগড়ে যাচ্ছে একটু একটু করে।রণোর মেজাজ আরও বিগড়ে যায়।পেনাল্টি বক্স থেকে তার একটা জোরালো কিক ভিকিদের গোলকিপার কি ভাবে যেন রুখে দিল গোলে ঢোকার মুহূর্তে।অমন ফাঁকা অবস্থা!সামনে ভিকিদের কোন খেলোয়াড় নেই।কেবল গোলকিপার।তা ও বলটা গোলে ঢোকাতে পারল না সে।মেজাজ হারিয়ে ফেলে রণো।গোলের মালা পরাতে চেয়ে শেষে কি না গোল শূন্য অবস্থায় খেলা শেষ হওয়ার যোগাড়!
অন্য দিকে ভিকি খুবই খুশি তার দলের গোলকিপারের উপর।নিশ্চিত গোল বাঁচিয়ে দিয়েছে সে।কিন্তু বিরক্তি জন্মায় অন্য ছেলেদের উপর।এ ভাবে সবাই কি করে একসঙ্গে রণোদের পেনাল্টি বক্সের কাছে চলে গেল?তার পরামর্শ সবাই এক সঙ্গেই ভুলে গেল! না কি ইচ্ছে করেই----!ভিকি বুঝে যায় যা করার তাকেই করতে হবে আজ।রণোর ভালো খেলোয়াড়ের অহঙ্কারটা মাটিতে মেশাতেই হবে।তাকে ফরোয়ার্ডে খেলতে না দেওয়ার শোধ আজ নিতেই হবে।
এমন ভাবতে ভাবতেই হঠাৎ তার দলের একজনের একটা পাশ তাকে ঘিরে থাকা রণোর দলের দুজনকে টপকে তার পায়ে জমা হয়।রণো তখন মাঠের মাঝ বরাবর তাদের অংশে।দৌড়ে বলের কাছে আসার চেষ্টা করছে সে।দ্রুত সিদ্ধান্ত নেয় ভিকি।বলটা লিফ্ট করে মার্কার দুজনের মাথা টপকে বাইরে আনে ভিকি।তার পর যেন হাওয়ায় ভেসে সে পৌঁছে যায় রণোদের পেনাল্টি বক্সে।রণো সহ তার দলের সব খেলোয়াড় তখন তার পিছনে।সামনে কেবল গোল কিপার।বলটা আলতো ঠেলে গোলের আরও কাছাকাছি ভিকি।গোলকিপার বলটা তুলে নেবে ভেবে গোল পোষ্ট ছেড়ে বেরিয়ে এসেছে।ফাঁকা----স-অ-অ-ব ফাঁ-কা!একটু জোরে বলটা ঠেলে দিলেই গোল।বলটা কিক করতে ডান পা তুলেছে ভিকি।ঠিক তখনই পাশ থেকে জোরালো একটা গুঁতো তার ডান কাঁধে।আচমকা ধাক্কা আর উর্ধ্বশ্বাস দৌড়ে হাঁফিয়ে ওঠা ভিকি সামলাতে পারে না নিজেকে।সপাটে পড়ে যায় মাঠে মুখ থুবড়ে।কাঁধে গুঁতোর চোট।তার উপর মুখ থুবড়ে পড়ে যাওয়ায় বুকেও চোট লাগে সামান্য।মাথা তুলে তাকায় ভিকি।রণো দাঁড়িয়ে তার সামনে।হাসছে শয়তানের হাসি।গুঁতো মারা শয়তানকে চিনে যায় ভিকি।রেফারি বাঁশি বাজিয়ে দেয়।ফাউল---ফ--উ--ল শব্দের মধ্যেই জ্ঞান হারায় ভিকি।
খেলা বন্ধ হয়ে যায়।সবাই ধরাধরি করে ভিকিকে মাঠের বাইরে নিয়ে যায়।দর্শক খেলোয়াড় সবাই ঘিরে ধরে ভিকিকে।রেফারি দৌড়োয় জলের খোঁজে।চোখে মুখে জলের ছিটে দিতেই জ্ঞান ফেরে ভিকির অল্পক্ষণে।উঠে বসে সে।বল খুঁজতে থাকে চারপাশে।কিন্তু তার চারপাশের হট্টমেলায় মনে পড়ে যায় কয়েক মিনিট আগের ঘটনা।সে যে এখন মাঠের বাইরে তা ও বোঝে।বুঝে যায় খেলা বন্ধ হয়ে গেছে।রেফারি তাকে জিজ্ঞেস করে ঠিক আছে কি না সে।মাথা নাড়ে ভিকি।এত কিছুর মধ্যে বৃত্তাকার ভিড় ঠেলে ভিকির সামনে এগিয়ে যায় রণো।বসে পড়ে তার সামনে।মাথা নিচু করে বলে--ভুল হয়ে গেছে ভিকি।মাফ করে দে আমাকে।আজকের খেলায় তোরাই জিতেছিস।তুই এতো ভালো খেলতে পারিস আমি জানতাম না ভাই।এবার থেকে স্কুলের হয়ে বাইরে কোথাও খেলতে গেলে তুই ফরোয়ার্ডে খলবি।কথা দিচ্ছি।আমি হাফব্যাক।সত্যিই তুই আমাদের সবার থেকেই আলাদা।সবকিছুতেই তুই ভালো।চেষ্টা করলেও তোকে ধরা বা ছোঁয়া যাবে না।
রণোর দিকে সোজা দৃষ্টিতে তাকায় ভিকি।দেখতে পায় তার চোখের কোণে টলটল করছে দুফোঁটা জল।সবটা বুঝে যায় ভিকি।রণোকে সপাটে জড়িয়ে ধরে বুকে।একটাই শব্দ বেরিয়ে আসে তার মুখ থেকে---ব--ন্--ধু--উ--উ--উ-----।
==============
নিরঞ্জন মণ্ডল
উত্তর24পরগণা।