Click the image to explore all Offers

ছোটগল্প ।। পাকাদেখা ।। হারান চন্দ্র মিস্ত্রী



 

পাকাদেখা
হারান চন্দ্র মিস্ত্রী  
 

    বিফল মাথা হেঁট করে পথ চলে রাস্তা দিয়ে। বেশ চিন্তিত দেখায় তাকে। রাস্তায় কারো কথার উত্তর সে হাঁটতে হাঁটতে দেয়। ছাদের উপর থেকে তাকে অনেকবার দেখেছে অপু। বিফলের সঙ্গে পরিচয় হলে একবার সরাসরি কথা বলার ইচ্ছা আছে তার। 
   বিফল লম্বা গড়নের ছিপছিপে তরুন। একদিন তার জরুরি কাজ থাকার দারুণ দ্রুতপায়ে হেঁটে যাচ্ছিল। তার কিছুক্ষণ আগে এক পশলা বৃষ্টি হয়ে গিয়েছে। এখন রোদ উঠেছে।  বাতাস বয়ে গেল গাছের উপর দিয়ে। ঝর ঝর করে পাতায় জমে থাকা বৃষ্টি ফোঁটা তার শরীর ভিজিয়ে দিল। উপরের দিকে তাকাতেই তার চোখে পড়ল এক মিষ্টি মুখ। মেয়েটি হাসছে। সুফলও রাস্তা দিয়ে বেরিয়ে গেল মৃদু হেসে। 
    অপু খুব বেশিদিন ধরে তাকে চেনে না। দিন পনের হলো এই রাস্তা দিয়ে  যাতায়াত করে ছেলেটি। 
আজ উপরের দিকে তাকাতেই সে বুঝতে পারল, ছেলেটি এ পাড়ায় নতুন এসেছে। সে ভাবে, কাদের বাড়িতে সে থাকে জানতে হবে। 
    পরদিন বিকালে একটি টুল নিয়ে বাড়ির সামনে ফুটপাতে গিয়ে বসে অপু। রোদ প্রখর ছিল। কখনও আবার ঝিরি ঝিরি বৃষ্টি হচ্ছে। এমন সময় বিফল সেখান দিয়ে যাচ্ছে। অপু টুলটা কোনো রকমে দরজার ওপারে দিয়ে বিফলকে অনুসরন করতে লাগল। 
      অপু দেখল, সে একটি পার্কে গিয়ে বসেছে। অপুও পার্কের একটি সিট দখল করে তাকে লক্ষ্য করছে। বিফল পকেট থেকে একটি পকেট ডায়েরির মতো ছোটো খাতা বের করে কী সব লিখল! কারো দিকে সে তাকায় না। ঘন্টাখানেক এভাবে কাটিয়ে সে উঠে পড়ল। তারপর সে হন হন করে বাজারের দিকে হাঁটতে লাগল। অপু তার পিছু নিল। 
     বিফল বাজারের ভিতরে গিয়ে একটি বড় মুদির দোকানে ঢুকল। সে  একটি একশ টাকার নোটের বান্ডিল এবং  একটি ফর্দ দোকানদারের হাতে দিয়ে কোনো কথা না বলে বেরিয়ে এলো। অপুর কাছে ব্যাপারটা বেশ রহস্যজনক মনে হলো। 
      বিফল একটি সব্জির দোকানে গিয়ে বেশকিছু টাকা ও ফর্দ দিল। সব্জি ব্যাপারী বললেন,"একটু চা চলবে?" 
বিফল সংক্ষেপে উত্তর দিল,"না।" তারপর সেখান থেকে বেরিয়ে এলেন মাছের দোকানে। সেখানে ফর্দ ও টাকা দিয়ে বেরিয়ে এলো। অপু চিন্তা করতে লাগল, যে ছেলেটি এখানে মাত্র কদিন এসেছে, সে এতো টাকার মাল কিনে কী করে? মালগুলো নিয়ে যায় কারা? খাবে কারা? 
     বিফল সেখান থেকে বেরিয়ে পড়ে। পিছু নিয়ে এগিয়ে চলেছে অপু। এবার সেখান থেকে টানা দক্ষিণ দিকে হেঁটে এসে একটি জিমখানায় ঢুকল।
অপু মনে মনে বলল, কাঠির মতো শরীর। সে ঢুকেছে জিম করতে। দেখি কতক্ষণ জিম করতে পারে। এক ঘন্টা? নয়তো দু'ঘন্টা? তার বেশি তো নয়? আমি অপেক্ক্ষা করব।
       জিমখানার  সামনে দাঁড়িয়ে রইল অপু। কুড়ি মিনিট পরে জিমখানা থেকে বেরিয়ে এলো বিফল। আবার কোনো দিকে না তাকিয়ে হাঁটতে লাগল। পেছনে পেছনে প্রায় ছুটতে শুরু করল অপু।   একটা মোড় পেরিয়ে আস্তে আস্তে হাঁটতে লাগল বিফল। অপু ভাবল, এইবার জব্দ হয়েছে। আমাকে হাঁটিয়ে জব্দ করে দিচ্ছিল! দেখি এখন কোথায় য়ায়? 


      বিফল এবার বাড়ির পথ ধরল। ধীর গতিতে চলেছে সে। কুড়ি পঁচিশ ফুট দূরত্ব বজায় রেখে পিছনে আসছে অপু। আজ অপু বিফলকে অনুসরণ  করতে গিয়ে নাজেহাল হয়ে পড়েছে। সে ভাবে, আমাদের বাড়ি পেরিয়ে ছেলেটা আর কত দূর যায় দেখতে চাই।
       অপুদের বাড়ি পৌঁছানোর ঠিক তিনটে বাড়ি আগে একটি আশ্রম আছে। প্রতিদিন সন্ধ্যায় সেখানে নাম সংকীর্তন হয়। সেখানে বিফল ঢুকল। এটা পছন্দ হয় নি অপুর। অপু আশ্রমের মধ্যে প্রবেশ করল না। সে আশ্রম-গেটে দাঁড়িয়ে তাকে দেখতে লাগল। 
        অপু দেখল, বিফল সটান মহারাজের ঘরে  গিয়ে ঢুকল। প্রায় একঘন্টা অতিবহিত হয়ে গেছে।সে কিছুতেই বেরিয়ে আসছে না। রাতও বেড়ে যাচ্ছে। অধৈর্য হয়ে অপু সেদিন বড়ি চলে গেল।
        
        পরদিন অপু ভাবল, আজ আমার হাত থেকে কোনোভাবে পালাতে পারবে না ছেলেটি। এদিক সেদিক  ঘুরে খুব নাকাল করেছে আমাকে। আশ্রমে ঢুকে আর বেরোতেই চাইল না। মহারাজের সঙ্গে তার কিসের সম্পর্ক আজ দেখতে হচ্ছে আমাকে। আশ্রমের ভিতরে ঢুকে পড়া উচিত ছিল। আমাকে খালি হাতে ফিরতে হতো না। আজ সম্পূর্ণ ব্যাপারটি সুদে-আসলে উসুল করে নিতে হবে। তবে, ছেলেটি কোনো দিকে নজর রাখে না। তার পিছনে গোয়েন্দাগিরি করা অবশ্য সহজ কাজ। 
         বিকাল চারটে বাজে। রাস্তায় টুল নিয়ে বসল অপু। হাতে পার্স। পার্সে নিয়েছে কিছু টাকা। রাস্তায় দরকার হতে পারে। টুলে বসতে না বসতেই পাশ  থেকে হেঁটে বেরিয়ে গেল বিফল। টুল তুলে রাখার সময় নেই। ফুটপাথে টুল রেখে হাঁটতে শুরু করল অপু।  
      বিফল আজ নতুন রাস্তা ধরে এগিয়ে চলেছে। পথ চলতি এক-দুজন মানুষ তাকে কুশল জিজ্ঞেস করছে। একজন বয়স্ক ভদ্রলোক তার হাতজোড়া নিজের কপালে ঠেকিয়ে বললেন, "তোমার জন্য এ যাত্রায় বেঁচে গেলাম, বাবা। তুমি সুখি হাও।" 
বিফল বলল,"আপনি সাবধানে থাকুন। সুস্থ থাকুন।" 
লোকটি মাথা নেড়ে সম্মতি জানালে বিফল আবার এগোতে থাকে। 
       রাস্তা পেরিয়ে একটি বড় সোনার দোকানে ঢুকে পড়ে বিফল। আজ সাহস করে তার পিছনে পিছনে ভিতরে ঢুকে পড়ল অপু। অপু দেখল, সে একটি চিরকুট সেলস ম্যানেজারের হাতে দিল। ম্যানেজার একজনকে কোল্ডড্রিঙ্কস আনতে বললেন। বিফল আজ খাব না বলে বেরিয়ে গেল দোকান থেকে। অপুও বেরিয়ে এলো। 
     বিফল একটি পাড়ার ভিতর দিয়ে একটি বৃদ্ধাশ্রমে হাজির হলো। বৃদ্ধাশ্রমের গেট খোলা। সে ঢুকে পড়ল ভিতরে। বৃদ্ধাশ্রম পরিচালকের সঙ্গে দেখা করল সে। তারপর একটি চেক তুলে দিল তার  হাতে। গেটের সামনে দাঁড়িয়ে পরিস্কার দেখতে পেল অপু। তার মোবাইল ফোনে চেক দেবার চাবিটা তুলে নিল সে। 
     অপুর মনে মনে বলল,ছেলেটিকে মোবাইল ফোন ব্যবহার করতে দেখলাম না। সে কি কাজ করে জানতে পারলাম না। সে কোথাও বেশি সময় খরচ করে না, কোনো গাড়ি ব্যবহার করে না, এমনকি সাইকেলও নয়।
    ততক্ষণে বেরিয়ে এসেছে বিফল। রাস্তা বরাবর হেঁটে চলেছে। অপু তাকে আনুসরন করে চলেছে। হঠাৎ একটি ট্যাক্সি সামনের দিক থেকে বেপরোয়া ছুটে আসছে। বিফল পিছনে তাকিয়ে দেখল, মেয়েটিকে রাস্তা থেকে সরিয়ে না নিলে ট্যাক্সি এসে চাপা দেবে। সে ছুটে পিছিয়ে এসে অপুকে টেনে তুলল ফুটপাথের উপর। হুশ করে বেরিয়ে গেল ট্যাক্সি। বুক কেঁপে উঠল অপুর। বিফল বলল,"একটু সাবধানে রাস্তা চলবে।" 
সে আবার এগিয়ে চলল। 
      অপু মনে মনে বলল,"আচ্ছা বেরসিক মানুষ তো। আমি মরছিলাম গাড়ি চাপা পড়ে। এখনো বুক ধড়ফড় করছে। আর উনি জ্ঞান দিয়ে সোজা বেরিয়ে গেলেন। কোনদিকে যায় আমি দেখে নিচ্ছি। ফুটপাথ ছেড়ে আমি সহজে নিচে নামছি না।" 

        অপু প্রায় দৌড়ে গিয়ে বিফলের পিছু নিল। বিফল একটি কারখানার গেটের সামনে যেতেই দরোয়ান তাকে স্যালুট দিয়ে গেট খুলে দিল। দরোয়ান আবার গেট বন্ধ করে দিল। গেটের বাইরে একটি গাছের তলায় দাঁড়িয়ে রইল অপু। 
         অনতিবিলম্বে সূর্য পশ্চিমে অস্ত গেল। বিদ্যুতের আলোয় রাজপথ ঝলমল করছে। ফুটপাথ দিয়ে লোক চলাচল করছে। কিন্তু, অপুর মনটা পড়ে আছে কারখানার ভিতর। সে কখন কারখানা থেকে বেরুবে আর অপু তার পিছনে গোয়েন্দাগিরি করবে! 
      সময় গড়িয়ে যায়। তখন রাত অটটা। গেটের দরোয়ান বদলে গিয়েছে। গাছের ছায়ায় দাঁড়িয়ে আর মশার কামড় সহ্য করতে পারে না অপু। দীর্ঘ তিন ঘন্টা এক জায়গায় একা বোবার মতো ঠায় দাঁড়িয়ে থাকা যে কী কষ্ট, তা বুঝল অপু। একঘেয়েমি কাটতে মোবাইল বার করে এক বান্ধবীকে ফোন করল সে। সেই সময় কারখানার গেটের দরজা খুলে গেল। ঘর্ ঘর্ আওয়াজ করে একটি প্রাইভেট কার্ বেরিয়ে গেল কারখানার গেট থেকে। আবার কারখানার গেট বন্ধ হয়ে গেল। 
       এবার রাত গভীর হচ্ছে। বিফল কারখানা থেকে বেরোচ্ছে না। হয়তো রাত আটটায় বেরিয়ে যাওয়া প্রাইভেট কারে সে চলে গেছে। এসব ভাবতে ভাবতে তার কাছে একটি ট্যাক্সি এসে থামল। অপু ট্যাক্সি চালককে বলল,"ভাড়ায় যাবেন কাকু?" 
ট্যাক্সি চালক বললেন,"যাব।" তারপর ট্যাক্সি থেকে নেমে এসে গেট খুলে দিলেন। অপু তাতে উঠে বসে। ট্যাক্সি চলতে থাকে। একসময় অপু বলে ওঠে,"কাকু, এখানে নামব।"  
ট্যাক্সি থামল। নেমে গেল অপু। 
অপু বলল,"কত টাকা বিল উঠেছে?" 
"এইটুকু রাস্তা এলে। ভাড়া দিতে হবে না। আর এদিকে আমার আসতেই হতো। তোমাকে এনে আমার লোকসান হয় নি" বলেই তিনি ট্যাক্সি ছেড়ে চলে গেলেন। 
      হতভম্ব হয়ে গেল অপু। সে রাতের খাবার খেয়ে শুয়ে পড়ে। কিছুতে ঘুম আসে না তার চোখে। সে ভাবে, আর একটু দেরিতে সে আমার হাত ধরে টানলে ট্যাক্সির তলায় পড়ে রাস্তায় প্রাণ চলে যেত আমার। সে কি খুব ধনী? কোনো কিছু কেনে না। শুধু টাকা  দিয়ে আসে। অনেক  মানুষ তাকে সম্মান করে। কত বয়স হবে? হয়তো আমর থেকে সে তিন-চার বছরের বড়। দেখে মনে হয় প্রচুর দায়িত্ব সামলায়। 
       দিনের পর দিন কেটে যায়। অপু তার ব্যাক্তিগত তদন্তের কিনারা করতে পারে না। কোথাও না কোথাও গিয়ে নদী স্রোত হারিয়ে ফেলছে।  এভাবে তিন মাস কেটে গেল, বিফলের বাড়ির ফটক দেখতে পায়নি সে। তবু সে হাল ছাড়তে নারাজ। আজ সে টুল না নিয়ে রাস্তায় গিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। বাড়ির সামনে এলেই সরাসরি কথা বলবে সে। মিছে পেছনে ঘুরে সময় নষ্ট হয়েছে তার।  রাস্তায় দাঁড়িয়ে অপু ভাবে, কেন আমি তাকে অনুসন্ধান করছি। সে আমার কে? আমি তার কে? এখনও তার নাম জানতে পারলাম না। আজ তার নাম ও ঠিকানা আমি জানবই। 
ইতিমধ্যে সেখান থেকে পেরিয়ে যাচ্ছে বিফল। অপু তাকে দাঁড় করিয়ে কথা বলবে ভেবেছিল। তাকে দেখার পর তা আর পারল না। তখন তার পিছু নিতে বাধ্য হলো। 
   বিফল দু-তিন জায়গায় কাজ সেরে একটি সুপার মার্কেটের দোতলায় উঠল। তারপর একটি ধাবার মধ্যে ঢুকে একটি কেবিনে বসে পড়ল। অপু আজ মরিয়া হয়ে উঠেছিল। সে গিয়ে বসল বিফলের মুখোমুখি বিপরীত চেয়ারে। ম্যানেজার ও বয়েরা সেখানে এলো। বিফল বলল,"যে যার কাজে যাও। ম্যানেজার, দুটো লস্যি পাঠাও। আগে ঠান্ডা করি।" 
ম্যানেজার চলে গেলেন। অপু বলল,"আমাকে বললে?" 
বিফল বলল,"তোমর কি মনে হলো, আমি তোমাকে বলেছি?" 
অপু চুপ করে যায়। একজন বেয়ারা এসে দুই গ্লাস লস্যি দিয়ে গেল। বিফল একটি গ্লাস অপুর দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল,"খেয়ে নাও।" 
অপু বলল,"আমাকে বললে?" 
বিফল লস্যিতে চোঙা ডুবিয়ে চুমুক দিয়ে বলল,"এখানে তুমি ছাড়া দ্বিতীয় কোনো ব্যক্তি নেই।  আমি তোমাকেই বলছি।"  
অপু বলল,"আমি তোমার নাম জানি না, চিনি না। কেন তোমার দেওয়া লস্যি খাব?" 
"তুমি অপু। আমি বিফল। তুমি আমাকে তিনমাস ধরে খুঁজছ। আমাকে এখনো চিনতে পারলে না?" বলল বিফল। 
মাথা নিচু করে লস্যির মধ্যে চোঙা ঢুকিয়ে মুখ দিয়ে টানল। তারপর বলল," কী সুন্দর ঠান্ডা! মনটা শান্তি হয়ে গেল।" 


বিফল বলল,"মন শান্তি করার জন্য লস্যির ব্যবস্থা করেছি।" 
অপু খানিকটা বিরক্ত হয়ে বলল,"আমার মনে কি হয়েছে?"
বিফল বলল,"সে কথা তুমি বলতে পারবে। কারণ, তুমি তিন মাস ধরে আমাকে অনুসন্ধান করছ।" 
"কথাটা ঠিক। কিন্তু, কেন অনুসন্ধান তা কি তুমি জান?" জিজ্ঞাসা করল অপু। 
"তুমি জানতে চাও আমি হঠাৎ কথা থেকে এলাম এবং আমি কোন বাড়ির ছেলে। ঠিক বলেছি?" জবাব চাইল বিফল। 
"হ্যাঁ। কিন্তু তুমি জানলে কি করে?" জানতে চাইল অপু। 
"আমাকে তিন মাস ধরে তদন্ত করছে কে জানতে হবে না আমাকে? সেই সুন্দরী চোর না, সন্ত্রাসবাদী জানা আমার উচিত কিনা?" পালটা জানতে চাইল বিফল। 
অপু রাগ করে দাঁড়িয়ে উঠে বলল,"আমি চোর, সন্ত্রাসবাদী?" 
বিফল বলল," আমি সে কথা বলেছি? তোমাকে চোর, সন্ত্র্রসবাদী মনে করলে এখানে আনতাম না। আধিকাংশ রাতে তুমি আমার গাড়িতে বাড়ি ফিরেছ।" 
অপু বলল,"চালক কে?" 
বিফল বলল,"ও আমার গাড়ির ড্রাইভার।" সে আবার বলল," প্রতিদিন তুমি জিন্স টপ পরো। আজ শাড়িতে তোমাকে অন্য রকম দেখাচ্ছে।" 
অপু বলল,"পরের মেয়েকে এভাবে প্রশংসা করতে তোমর লজ্জা করে না?" 
বিফল বলল,"তুমি আমার কে? আমার পিছনে এতদিন ঘুরছ?" 
অপু বলল,"মানে?" 
বিফল বলল,"মানে পরে হবে। একটা কথা শোনো।"
অপু বলল,"কি?" 
বিফল বলল,"ছয় মাসের জন্য তোমার গোয়েন্দাগিরি বন্ধ।"
অপু জানতে চাইল,"কেন?" 
বিফল জানাল,"আগামীকাল আমি ছয় মাসের জন্য লন্ডন যাচ্ছি। আমি ফিরে এলে আবার দেখা হবে।" 
মন খারাপ হয়ে গেল অপুর। বিফল জিজ্ঞাসা করল,"কি হলো তোমার?" 
অপু বলল,"যেদিন তোমার সঙ্গে সত্যিই পরিচয় হলো, সেদিন তুমি চলে যাচ্ছ বিদেশে।" 
বিফল বলল,"আমার জন্য তোমার মন খারাপ হবে কেন?" 
"জানি না। যাও," বলে উঠে দাঁড়াল অপু। 
বিফল বলল," তোমার এখানে ভালো লাগছে না। চলো যে যার মতো চলে যাই।" তারপর সে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। তার পেছনে চলেছে অপু। সিঁড়ি দিয়ে নামার সময় অপু তাকে জিজ্ঞেস করল,"লস্যির দম দিলে না?" 

"আমি গরিব মানুষ। তাই আমার কাছ থেকে টাকা নেবে না ধাবার ম্যানেজার। তুমি দিতে পারতে। শুনেছি বড়লোকের মেয়েরা গরিব ছেলেদের সঙ্গে ভালবাসা করে নিজের পয়সায় ভালো খাবার খাওয়ায়।" বলল বিফল। 
অপু আওয়াজ করল,"হুঁ।"  
নিচের তলায় নেমে একটি ঘরের দরজা ঠেলে ভিতরে ঢুকল বিফল। অপুও ঢুকে পড়ল একইভাবে। ঘরের ভিতরে এসে সে অবাক হয়ে গেল।ফুল দিয়ে খুব সুন্দর করে সাজানো। কত রকমের আলো জ্বলছে। এখানে তার মা-বাবা আছেন। জমিদারবাবু এবং তাঁর মা আছেন। অপু ভাবল,আমাকে এখানে কেউ ডাকেনি। আমি স্বেচ্ছায় এখানে এলাম। এখন কি উত্তর দেব? শুনেছি এককালে লাটে ওনাদের বহু জমি ছিল। কলকাতায় ওনাদের অনেকরকমের ব্যবসা আছে। বাড়িতে এখনও অনেক চাকর-চাকরাণী কাজ করে।
    বিফল অপুর বাবা-মাকে প্রণাম করে  জমিদারবাবুর মায়ের পাশে গিয়ে বসল। অপুর মা অপুকে বললেন,"গুরুজনদের প্রণাম করো, মা।"  
অপু একবার তার মায়ের দিকে তাকিয়ে বিফলকে বাদ দিয়ে অন্য সকলকে প্রণাম করে সোজা হয়ে দাঁড়াল। অপুর মা বলল,"জামাই কি তোমার গুরুজন নয়?" 
     অপু লজ্জিত হলো। সে ভাবল, মা বিফলকে জামাই বলে ইঙ্গিত করছে কেন? সবার সামনে মাকে প্রশ্ন করলে অসম্মানিত হবেন। কিন্তু, মা আমাকে এভাবে বলে ঠিক করেননি। 
যাইহোক, সে কোনো মন্তব্য না করে বিফলকে প্রণাম করল। বিফল তাকে খুব আস্তে বলল,"এখন কেমন লাগছে?"
অপু তেমনই আস্তে বলল,"তুমি খুব দুষ্টু।" 
সে মনে মনে ভাবল, আমি কি সত্যি সত্যি জমিদার বাড়ির বউ হচ্ছি? এগুলো সব স্বপ্ন নয়তো? 
জমিদার মাতা অপুকে বললেন,"তুমি আমার কাছে এসে বসো।" 
অপু তাঁর পাশে গিয়ে বসল।  জমিদার মাতা বললেন,"তুমি খুব সুন্দরী। আমার নাতি আর বিদেশে থাকতে পারবে না। " তারপর বিফলের দিকে তাকিয়ে বলল,""তুই যে বলেছিলি মেয়ে তোর মতো জামা প্যান্ট পরে।" 
"পরে তো। আজ ও কেন যে শাড়ি পরে এসেছে জানি না।" বলল বিফল। 
জমিদার মাতা বললেন,"আমার নাতবউ পছন্দ হয়েছে।" 
জমিদার এখন একটি প্রাক্তন পেশা। তবু কেমন একটি মিথ খুঁজে পাচ্ছে অপু। জমিদারবাবু বললেন,"আমার মা মেয়ে পছন্দ করেছে। আমারও পছন্দ। আমার ছেলে ছয়মাস বিলেতে থাকবে। ফিরে এলে তবে বিয়ে হবে। এবার আপনারা বলুন।" 
অপুর বাবা বললেন,"আমার মেয়েকে আপনারা পছন্দ করেছেন। এটা আমাদের সৌভাগ্য। জমিদারবাবু, আপনারা ধনী মানুষ। দেশে-বিদেশে ব্যবসা আছে আপনাদের। আপনাদের সঙ্গে আমাদের কুতুম্বিতা টিকবে কি করে?" 
জমিদারমাতা বললেন,"বিফল, আমি যখন মেয়ে পছন্দ করেছি, এই বিয়ে হবে। এটাই পাকা দেখা। তুই তোর শ্বশুরকে তোর যে কোনো একটা ব্যবসা দিয়ে দে।" 
অপুর বাবা বলল,"না না। ওসব চাপ আমি নিতে পারব না। আমরা যেমন মধ্যবিত্ত তেমন থাকাই ভালো। আমি শুধু বলছি আমাদের মানিয়ে নেবার কথা।" 
জমিদারবাবু বললেন,"ভাববেন না। আজ থেকে আপনিও আমাদের পরিবারের একজন হয়ে গেলেন।"
অপুর মা-বাবা নতুন পোশাক এনেছিল। সেগুলো  বিফলকে পরতে দিল। জমিদারবাবুর আনা শাড়ি পরানো হলো অপুকে। এতো দামি শাড়ি কখনও পরতে পাবে ভাবেনি সে।
 একজন ক্যামেরাম্যান এলেন। তিনি ফটো তুলতে লাগলেন। অপুকে ও বিফলকে ফুল, ধান-দূর্বা দিয়ে আশীর্বাদ করলেন দুই পরিবারের গুরুজনেরা।" 
বিফল অপুর আঙুলে একটি আংটি পরিয়ে দিল। অপুর বাবা বললেন,"আংটিটা মনে হয় হীরের। ওটার দাম কত?" 
বিফল বলল,"এটার দাম পঞ্চাশ লাখ টাকা।" চমকে উঠল অপুর মা-বাবা।" 
অপু ভাবল, এত দামী আংটি আমার হাতে। আমার মা-বাবা সামান্য একটা সোনার আংটি দিয়ে আশীর্বাদ করেছে জামাইকে। এই বেমানান সম্পর্কে না জড়নো উচিত ছিল। 
জমিদারবাবু বললেন, খাবার এসে গেছে। রাতও হয়েছে। চলুন আহার করে নেওয়া যাক। সবাই পাশের ঘরে খাওয়ার টেবিলে গিয়ে বসল। 
বিফল ও অপু সেখানে তখনও বসেছিল। বিফল অপুকে বলল,"আর দিনে চার ঘন্টা গোয়েন্দাগিরি করবে?"  
অপু বলল,"তুমি খুব দুষ্টু। এবার আমি দিনে চব্বিশ ঘন্টা গোয়েন্দাগিরি করব।" 
হেসে ওঠে দুজনে।
___________   
 

হারান চন্দ্র মিস্ত্রী
পেশা-প্রাথমিক শিক্ষক 
গ্রাম ও পো- আমতলা,
থানা-ক্যানিং,
জেলা-দক্ষিণ ২৪ পরগনা,
পশ্চিমবঙ্গ, ভারতবর্ষ,
পিন নং-743337
মোবাইল নং- +91 9733702450
হোয়াটস অ্যাপ  নং-+91 9733702450

Post a Comment

0 Comments
* Please Don't Spam Here. All the Comments are Reviewed by Admin.