ছোটগল্প ।। আনন্দধারা ।। কাকলী দেব
0
আগস্ট ০১, ২০২২
আনন্দধারা
কাকলী দেব
ছোট
ছেলে মৃন্ময়ের বিয়ে হয়েছে মাস তিনেক হল। পরিমল বাবু আর তার স্ত্রী
সুধা, দুজনেই পছন্দ করে বউমা ঘরে এনেছেন। সন্বন্ধ করেই বিয়ে, কিন্ত বউমা
পাওলী ও একই আই, টি কোম্পানিতে কাজ করে। পরিমল বাবু বরাবর ই হাসিখুশী
মানুষ, নিজের বউ কে চিরকাল ই উনি সামলে চলেছেন। ছেলে দের বিশেষ করে এই ছোট
ছেলের সঙ্গে তার সম্পর্ক একেবারে বন্ধু র মত।
পাওলী বিয়ের পর এই বাড়ী তে এসে এমন একটা পরিবেশ পেয়ে খুব খুশী। সে বাবা মার একমাত্র মেয
়ে, বেশ কড়া শাসনে বড় হয়েছে। বাড়ীর কাছে র গার্লস স্কুলের পড়াশোনা সেরে সবচেয়ে কাছাকাছি কলেজে পড়েছে, যাতে বাবা মা র তাকে চোখে চোখে রাখতে সুবিধা হয়। পাওলী স্বভাব গত ভাবে ও বাধ্য মেয়ে। তবে শ্বশুর বাড়ি তে এসে একটু বেশীই স্বাধীনতার স্বাদ পাচ্ছে। বিয়ের আগে, মৃন্ময়ের সঙ্গে কয়েকবার আলাদা করে দেখা হয়েছে।
সবচেয়ে ভাল লেগেছিল ওর মুখের সরল হাসি টা। এই বাড়ীতে এসে দেখল, শ্বশুর মশাই মানে এখন যিনি বাপী, তিনি আরও মজার মানুষ। তার মুখে সবসময়ই একটা আলতো হাসির ছোঁয়া!
মৃন্ময়ের সঙ্গে তার বন্ধুত্ব টা ও দানা বাঁধছে ক্রমশঃ!
তার থেকে মাত্র একবছরের বড় এই সদা চঞল প্রানবন্ত যুবকটিকে তার মাঝে মাঝে 'তুই ' বলে সম্বোধন করতে ইচ্ছে করে! মুখ ফসকে দু একবার সান্ধ্য আড্ডায় বলে ও ফেলেছে! শ্বশুর শাশুড়ীর সামনেই। শাশুড়ী এমনি একটু ভুলো টাইপ হলেও, যদি কোনও বিষয়ে নিজের বক্তব্য রাখতে চান, তাহলে সেই কথা নিয়ে ক্রমাগত একনাগাড়ে বলে যাওয়ার ক্ষমতা রাখেন। উনি সচরাচর নিজেকে নিয়েই ব্যস্ত থাকেন। ছেলে বউ এর ওপর মোটেও কোন খবরদারি করেন না। তবে এই তুই তোকারি টা বোধহয় কানে গিয়েছে।
গত কয়েক দিন ধরে ঘুরতে ফিরতে পাওলী র কানের কাছে নানারকম আপ্তবাক্যের বর্ষণ করে চলেছেন, তার মধ্যে 'পতিদেব' কথাটা কয়েক বার ই শোনা গেছে!
পাওলী আর মৃন্ময়ের এই নিয়ে চোখাচোখি, মুখ টিপে হাসাহাসি চলছে। শ্বশুর, খবরের কাগজের আড়ালে নিজেকে সীমাবদ্ধ রাখছেন।
আজকে রবিবার, ছেলে, বিশেষ করে বউমা পাওলী কে সারাদিন বাড়ীতে পাওয়ার মহার্ঘ্য সময় টা কে, সুধা দেবী কাজে লাগিয়ে চলেছেন। নানারকম উপদেশ বাণী দিচ্ছেন, পতিদেবের সঙ্গে কীরকম ব্যাবহার হওয়া উচিত,ইত্যাদি বিষয়ে। উনিও বলছেন রান্নাঘর থেকে, মৃন্ময়ের পাল্টা জবাব ও কানে আসছে, পাওলীর। সে নিজের ঘরেই আছে। হাসিও পাচ্ছে। হঠাৎ দেখল, শাশুড়ী একাই কথা বলে যাচ্ছেন। মৃন্ময় বা শ্বশুরের কোনও সাড়াশব্দ নেই। কী হল দেখার জন্য, পাওলী উঠে ড্রইং রুমে এল। দেখল, বাবা আর ছেলে খুব চুপিচুপি কথা বলছে।
মৃন্ময় ,বাবু হয়ে সোফার ওপর বসে পড়েছে উত্তেজনায় , "বাবা, তুমি কি মা'র "পটিদেব?"মিচকে হেসে বাবা বলছেন, "আর বলিস না, এদের সব বোন গুলো ই একরকম, একবার শুরু করলে আর শেষ করতে পারেনা, বকবক করেই চলে! তবে দ্যাখ এই বোন টার ভাগ্য টা কিন্ত সবচেয়ে ভাল, সে তুই যাই বলিস, আমার মত ' পটিদেব', আর তোদের দুই ভাইয়ের মত সুপুত্র পেয়েছে বলে তাই এর জীবন টা কি সুন্দর চলে গেল!" বাবা, ছেলের এইরকম গুজগুজ ফুসফুস শুনে, পাওলী হাসি চেপে নিজের ঘরে চলে আসে। একটু পরে, মৃন্ময়ের জোর গলা শোনা যায়, "মা, ওমা, বাবা কি তোমার পটিদেব ?" সুধা দেবী রান্না ঘর থেকে বেরিয়ে আসেন। " একদম আজেবাজে কথা বলবিনা, তোদের মুখে কি কিছুই আটকায়না?"
"কেন, বাবা তো বলছিল , তোর মার তো কনস্টিপেশন আছে, তাই সব কিছুতেই 'পটি ' র কথা মনে পড়ে!"
সুধা একটা খুন্তি ওপরে তুলে ধরে ছেলের দিকে তেড়ে গেলেন, " ওই মিচকে বুড়ো কে তো আমি পরে দেখছি, ছেলে-বৌ কে একটু ভাল শিক্ষা দেব, তার উপায় নেই, ওঃ কী জ্বালায় পড়েছি, আর তোর এই সারাক্ষণ ফাজলামী মারা টা একটু বন্ধ কর!"
" মা, মা, শোনো না, আমি কিন্ত, পাওলীর, ' পটিদেব ' হতে পারবনা। " মা আর ছেলের এই নিয়ে চলল, কিছুক্ষণ।
পরিমল বাবু, দুপুরে খেতে বসে বললেন, "তোরা দুই বন্ধু মিলে যা আজকে, 'অভিযান ' সিনেমা টা দেখে আয়। সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের জীবনের কাহিনী, রিভিউ পড়লাম, ভাল হয়েছে মনে হয়! " পাশ থেকে সুধা চোখ গোল করে তাকিয়ে রয়েছেন বুঝেও, পরিমল সাহসী হলেন। মুখোমুখি বসা পাওলীর চোখের কৃতজ্ঞতা র ভাষাও পড়তে পারলেন।পাওলীর এই ষাটোর্ধ মানুষটি র প্রতি ভালবাসা দিনে দিনে বেড়েই চলে। জীবন কে অত সিরিয়াসলি না দেখে, একটু হালকা দার্শনিক ভাবে দেখার চোখ আছে মানুষটার।
নিজের স্ত্রী, ছেলে মেয়ে কে সবাই ভালবাসতে পারে, কিন্ত অন্য একটি মেয়ে কে সমান ভাবে ভালবাসার ক্ষমতা কম লোকের ই থাকে। তিনি যে, এ যুগের স্বামী স্ত্রীর মধ্যে বন্ধুত্বের সম্পর্কটা বেশী পছন্দ করেন, তা স্পষ্ট ভাবেই ঝুঝিয়ে দিলে।
=================================
এপ্রিল ৩০, ২০২২
পাওলী বিয়ের পর এই বাড়ী তে এসে এমন একটা পরিবেশ পেয়ে খুব খুশী। সে বাবা মার একমাত্র মেয
়ে, বেশ কড়া শাসনে বড় হয়েছে। বাড়ীর কাছে র গার্লস স্কুলের পড়াশোনা সেরে সবচেয়ে কাছাকাছি কলেজে পড়েছে, যাতে বাবা মা র তাকে চোখে চোখে রাখতে সুবিধা হয়। পাওলী স্বভাব গত ভাবে ও বাধ্য মেয়ে। তবে শ্বশুর বাড়ি তে এসে একটু বেশীই স্বাধীনতার স্বাদ পাচ্ছে। বিয়ের আগে, মৃন্ময়ের সঙ্গে কয়েকবার আলাদা করে দেখা হয়েছে।
সবচেয়ে ভাল লেগেছিল ওর মুখের সরল হাসি টা। এই বাড়ীতে এসে দেখল, শ্বশুর মশাই মানে এখন যিনি বাপী, তিনি আরও মজার মানুষ। তার মুখে সবসময়ই একটা আলতো হাসির ছোঁয়া!
মৃন্ময়ের সঙ্গে তার বন্ধুত্ব টা ও দানা বাঁধছে ক্রমশঃ!
তার থেকে মাত্র একবছরের বড় এই সদা চঞল প্রানবন্ত যুবকটিকে তার মাঝে মাঝে 'তুই ' বলে সম্বোধন করতে ইচ্ছে করে! মুখ ফসকে দু একবার সান্ধ্য আড্ডায় বলে ও ফেলেছে! শ্বশুর শাশুড়ীর সামনেই। শাশুড়ী এমনি একটু ভুলো টাইপ হলেও, যদি কোনও বিষয়ে নিজের বক্তব্য রাখতে চান, তাহলে সেই কথা নিয়ে ক্রমাগত একনাগাড়ে বলে যাওয়ার ক্ষমতা রাখেন। উনি সচরাচর নিজেকে নিয়েই ব্যস্ত থাকেন। ছেলে বউ এর ওপর মোটেও কোন খবরদারি করেন না। তবে এই তুই তোকারি টা বোধহয় কানে গিয়েছে।
গত কয়েক দিন ধরে ঘুরতে ফিরতে পাওলী র কানের কাছে নানারকম আপ্তবাক্যের বর্ষণ করে চলেছেন, তার মধ্যে 'পতিদেব' কথাটা কয়েক বার ই শোনা গেছে!
পাওলী আর মৃন্ময়ের এই নিয়ে চোখাচোখি, মুখ টিপে হাসাহাসি চলছে। শ্বশুর, খবরের কাগজের আড়ালে নিজেকে সীমাবদ্ধ রাখছেন।
আজকে রবিবার, ছেলে, বিশেষ করে বউমা পাওলী কে সারাদিন বাড়ীতে পাওয়ার মহার্ঘ্য সময় টা কে, সুধা দেবী কাজে লাগিয়ে চলেছেন। নানারকম উপদেশ বাণী দিচ্ছেন, পতিদেবের সঙ্গে কীরকম ব্যাবহার হওয়া উচিত,ইত্যাদি বিষয়ে। উনিও বলছেন রান্নাঘর থেকে, মৃন্ময়ের পাল্টা জবাব ও কানে আসছে, পাওলীর। সে নিজের ঘরেই আছে। হাসিও পাচ্ছে। হঠাৎ দেখল, শাশুড়ী একাই কথা বলে যাচ্ছেন। মৃন্ময় বা শ্বশুরের কোনও সাড়াশব্দ নেই। কী হল দেখার জন্য, পাওলী উঠে ড্রইং রুমে এল। দেখল, বাবা আর ছেলে খুব চুপিচুপি কথা বলছে।
মৃন্ময় ,বাবু হয়ে সোফার ওপর বসে পড়েছে উত্তেজনায় , "বাবা, তুমি কি মা'র "পটিদেব?"মিচকে হেসে বাবা বলছেন, "আর বলিস না, এদের সব বোন গুলো ই একরকম, একবার শুরু করলে আর শেষ করতে পারেনা, বকবক করেই চলে! তবে দ্যাখ এই বোন টার ভাগ্য টা কিন্ত সবচেয়ে ভাল, সে তুই যাই বলিস, আমার মত ' পটিদেব', আর তোদের দুই ভাইয়ের মত সুপুত্র পেয়েছে বলে তাই এর জীবন টা কি সুন্দর চলে গেল!" বাবা, ছেলের এইরকম গুজগুজ ফুসফুস শুনে, পাওলী হাসি চেপে নিজের ঘরে চলে আসে। একটু পরে, মৃন্ময়ের জোর গলা শোনা যায়, "মা, ওমা, বাবা কি তোমার পটিদেব ?" সুধা দেবী রান্না ঘর থেকে বেরিয়ে আসেন। " একদম আজেবাজে কথা বলবিনা, তোদের মুখে কি কিছুই আটকায়না?"
"কেন, বাবা তো বলছিল , তোর মার তো কনস্টিপেশন আছে, তাই সব কিছুতেই 'পটি ' র কথা মনে পড়ে!"
সুধা একটা খুন্তি ওপরে তুলে ধরে ছেলের দিকে তেড়ে গেলেন, " ওই মিচকে বুড়ো কে তো আমি পরে দেখছি, ছেলে-বৌ কে একটু ভাল শিক্ষা দেব, তার উপায় নেই, ওঃ কী জ্বালায় পড়েছি, আর তোর এই সারাক্ষণ ফাজলামী মারা টা একটু বন্ধ কর!"
" মা, মা, শোনো না, আমি কিন্ত, পাওলীর, ' পটিদেব ' হতে পারবনা। " মা আর ছেলের এই নিয়ে চলল, কিছুক্ষণ।
পরিমল বাবু, দুপুরে খেতে বসে বললেন, "তোরা দুই বন্ধু মিলে যা আজকে, 'অভিযান ' সিনেমা টা দেখে আয়। সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের জীবনের কাহিনী, রিভিউ পড়লাম, ভাল হয়েছে মনে হয়! " পাশ থেকে সুধা চোখ গোল করে তাকিয়ে রয়েছেন বুঝেও, পরিমল সাহসী হলেন। মুখোমুখি বসা পাওলীর চোখের কৃতজ্ঞতা র ভাষাও পড়তে পারলেন।পাওলীর এই ষাটোর্ধ মানুষটি র প্রতি ভালবাসা দিনে দিনে বেড়েই চলে। জীবন কে অত সিরিয়াসলি না দেখে, একটু হালকা দার্শনিক ভাবে দেখার চোখ আছে মানুষটার।
নিজের স্ত্রী, ছেলে মেয়ে কে সবাই ভালবাসতে পারে, কিন্ত অন্য একটি মেয়ে কে সমান ভাবে ভালবাসার ক্ষমতা কম লোকের ই থাকে। তিনি যে, এ যুগের স্বামী স্ত্রীর মধ্যে বন্ধুত্বের সম্পর্কটা বেশী পছন্দ করেন, তা স্পষ্ট ভাবেই ঝুঝিয়ে দিলে।
=================================
এপ্রিল ৩০, ২০২২
কাকলী দেব, কলকাতা।