গল্প ।। বিরিয়ানি ।। দেবাশীষ মুখোপাধ্যায়
বিরিয়ানি
দেবাশীষ মুখোপাধ্যায়
রেস্টুরেন্টটার পাশে হারু ভিক্ষা করে। মাঝে মাঝে দোকানের বাসনপত্রও মেজে দেয়।দোকানী খুশি হয়ে কিছু পয়সা দেয়। একটা গলির মুখ এটা। একটা পলাশ গাছ দাঁড়িয়ে গলির মুখটাতেই। গাছটার নিচে একটু জায়গা করে বসে পড়ে হারু । প্রতিদিন কিছু না কিছু জুটে যায়।চালডাল কিনে বাড়ি ফিরলে রান্না বসায় চম্পা।ও দুবাড়ি কাজ করে সকালে।বাসনমাজা ঘর ঝাঁট দেওয়া।চলে যায় ওদের মোটামুটি। ওদের শুধু চিন্তা ছোটনকে নিয়ে। খিচুড়ি স্কুলে এখন যায়।তাও তো বন্ধ কতোদিন। বাড়িতে চম্পা রোজ সন্ধ্যায় পড়তে বসায় ওকে। চম্পা ক্লাস এইট পর্যন্ত পড়েছে।তারপর তো হারুর সাথে পালিয়ে বিয়ে। বাড়িতে এখনো মেনে নেয়নি।ওর বাড়ির অবস্থাও খুব একটা ভালো নয়। বাড়ির ভয় যদি মেয়ে এসে আবার ও বাড়িতেই জোটে।
হারু আগে দেশলাই কারখানায় কাজ করতো।মাইনে খারাপ ছিল না।তার ওপর উপরিও জুটতো ওভারটাইম করে। চম্পাকে বিয়ে করবে বলে হারু তখন পয়সা জমাতে মরিয়া। জন্ম থেকে বাবাকে দেখে নি হারু।মা ওকে মানুষ করে।ওর যখন পাঁচ বছর বয়স তখন মাও মারা যায়। খুব জ্বর। হাসপাতালে নিয়ে গেলেও বাঁচে নি মা। বড়ো দেরি করে ফেলেছিল ডাক্তার দেখাতে।হারুর খুব আফসোস হয়। যদি আগে খেয়াল করতো!
মা মারা যাবার পর একাই থাকতো।পরে চম্পা এলো ঘরে। ওদের তখন সুখের সংসার।সব কিছু খুব তাড়াতাড়ি শিখে গেল চম্পা। ও বলে, প্রত্যেক মেয়ের মধ্যেই একটা সংসারের স্বপ্ন লুকানো থাকে। হাসি পেত হারুর চম্পার বলার ভঙ্গি দেখে।সবই ঠিকঠাক চলছিল। হঠাৎ একদিন দেশলাইয়ের কারখানায় আগুন লাগে। বিরাট আগুন।এলাকায় ছড়িয়ে পড়ে দ্রুত। চারটে দমকলের ইন্জিন এসে আগুন নেভায়।রাতের বেলায় আগুন লাগার ফলে ক্ষতি বেশি হয়।কেউ তখন ছিল না কারখানায়।পরে শোনে,কারা যেন রাতের অন্ধকারে আগুন লাগিয়ে দেয়। মালিকের ব্যবসার রমরমা শত্রু তৈরি করে দিয়েছিল অনেক। তাদেরই কেউ হবে হয়তো।কাজ হারিয়ে এদিক ওদিক চেষ্টা করেছে হারু অনেক। কিছু সে সব বেশিদিন টেকেনি। শেষে এই ভিক্ষা বৃত্তি ! কি আর করবে ! প্রথম দিকে লজ্জা করতো।লোকে অনেক কথা শোনাতো।এখন গা সওয়া হয়ে গেছে। প্রতিদিন খারাপ পয়সা হয় না। নেশা নেই ওর।তাই চলে যায় ওদের তিনজনের সংসার।
ইদানিং সন্ধ্যার পর আর বসতে পারে না জায়গাটায়। কিছু ছেলে বাইক নিয়ে আসে ঐখানে ।ওর সামনে একদিন বাইক রাখলে একটু সরিয়ে রাখার কথা বলতেই ওরা তিনচারজন ছেলে মিলে খুব মেরেছিল হারুকে।ওর মুখ ফেটে রক্ত পড়ছিল। রেস্টুরেন্টের ছেলেগুলো ছুটে এলে লোকজন দেখে পালায় ঐ বাইক বাহিনী।তারপর থেকে একটা ভয় ঢুকে গেছে হারুর মনে। যদি আবার ওরা আসে। যাবার সময় বলেছিল ওকে দেখে নেবে ওরা। ওদের চেহারা পোষাক দেখে মনে হয়েছিল , ওরা সব পারে। চম্পা ওকে সন্ধ্যায় আর বেরতে দেয় না।হারু বোঝে, চম্পা মনে মনে ভয় পায় খুব।
সেদিন সকালে রেষ্টুরেন্টের মালিক ওকে সন্ধ্যায় একবার আসতে বলল। ওনার ছেলের জন্মদিন।তাই একটু খাবার দেবে হারুর ছেলের জন্য। চম্পাকে বলে সন্ধ্যায় বের হলো হারু।আজ মনে খুব আনন্দ।ছোটন প্রায়ই বায়না করে একটু বিরিয়ানি খাবে।হারুর মনে হতে লাগল আজ বোধহয় ছোটনের জন্য বিরিয়ানিই দেবে। বিরিয়ানিরই দোকান ওটা !হারুর ভাবনা মিলে গেল।এক প্যাকেট গরম বিরিয়ানি। ছাগলের মাংস দেখলো ও। আনন্দে প্রায় ছুটতে ছুটতে বাড়ি এসে পৌঁছাল। চম্পার হাতে তুলে দিল ছোটনের জন্য। চম্পারও সারা মুখ জুড়ে অন্য এক আনন্দ। বিরিয়ানির গন্ধে মাইকে শোনা গানটা গাইতে গাইতে ছোটনের সেকি নাচ আনন্দে। ওরা স্বামী স্ত্রী ছোটনের খাওয়া দেখতে লাগল বসে বসে। আনন্দে ছোটন খাচ্ছে আর বকবক করছে। খাওয়া শেষ করে হঠাৎ একমুখ আনন্দে ছোটন বলে উঠল :" রোজ কেন এমন খাওয়া হয় না বাবা ?" হারু মজা করে ছেলের খাওয়া হাড়ের টুকরোটা জাদুকরের লাঠির মতো ঘোরাতে ঘোরাতে বললো ,"ছু মন্তর ! জাদু লাঠি রোজ যেন আমার ছেলের জন্য বিরিয়ানি, ভালো ভালো খাবার আসে !"বাবার কান্ড দেখে ছোটন হেসে লুটিয়ে পড়ছে মেঝেয়।ওর হাসি দেখে চম্পাও "হো হো' করে হেসে উঠলো।হারু দেখলো চাঁদ তার সমস্ত জোছনা নিয়ে কখন যেন আকাশ থেকে নেমে ওর ঘরে বাঁধভাঙা হাসি ছড়িয়ে দিয়েছে !
=====================
লেখক : দেবাশীষ মুখোপাধ্যায়
ঠিকানা : রয়্যাল কমপ্লেক্স, ব্লক-ডি, ফ্ল্যাট নম্বর :২০৪,
দ্বিতীয় তল,
৪৬/১ চড়কডাঙ্গা রোড,
কাঁঠাল
বাগান,
উত্তরপাড়া, হুগলি।