Click the image to explore all Offers

গল্প।। থিয়েটার। । শুভাঞ্জন চট্টোপাধ্যায়



 
থিয়েটার
শুভাঞ্জন চট্টোপাধ্যায়
 

ছাত্র পড়িয়ে বাড়ি ফিরেছি কিছুক্ষন আগে। জামাকাপড় চেঞ্জ করে বাইরে ড্রয়িং রুমে বসে চা সেবন করতে করতে খবরের কাগজ পড়ছিলাম, এমন সময় সদর দরজার দিক থেকে বেশ গুরুগম্ভীর গলায় কার একটা কন্ঠস্বর ভেসে এলো...' জয়ন্ত আছে?'
তাকালাম। নতুন গলা শুধু নয়। নতুন মুখও বটে। জানলার ওপারে এক ভদ্রলোক দাঁড়িয়ে। পরণে কটকির পাঞ্জাবী, পাজামা, বেশ লম্বা, ফর্সা, ঋজু গড়ণ, মুখে যত্ন করে কাটা হালকা ফ্রেঞ্চকাট দাড়ি, মাথাভর্তি ধবধবে সাদা চুল, চোখে মোটা কালো পাওয়ারের চশমা...সব মিলিয়ে চেহারায় একটা অন্য ধরণের আভিজাত্যের ছাপ বেশ স্পষ্ট। সবই ঠিক ছিল, শুধু এই পোষাকের সঙ্গে হাতের কালো অ্যাটাচি কেসটা বড্ড বেমানান হয়ে গেল। 
একটু হেসে বললাম, ' ভাই তো নেই। অফিসে গেছে। '
' ও আচ্ছা। একটু দরকার ছিল আসলে।'
আবার সেই রাশভারী গলা। 
' আপনি বসুন না। চলে আসার সময় হয়ে গেছে। '
ভদ্রলোকের বয়সটা ঠিক কত হতে পারে, চেহারার সঙ্গে গলার আওয়াজ মিলিয়ে সেটাই ঠাওর করার চেষ্টা করছিলাম। তবে যা ই হোক, ওভারঅল ইম্প্রেশনে সত্তর এখনো না হওয়ারই কথা। 
সৌজন্য বশত চেয়ারখানা এগিয়ে দিলাম ভদ্রলোকের দিকে।  
' আপনি বসবেন না?'
' না না ঠিক আছে, আপনি বসুন। '
কথাটা হয়তো স্বাভাবিক সৌজন্যের খাতিরেই বললাম, কিন্তু এও ঠিক, ভদ্রলোককে দেখলে আপনা থেকেই যেন সম্ভ্রম চলে আসে মনে। 
' জয়ন্ত আপনার ভাই বুঝি?'
ব্যারিটোন কন্ঠস্বরের আড়ালে মিশে থাকা একটা অন্যরকম সুর, মডিউলেশন, সফিস্টিকেশন। 
আলগা হেসে বলি, ' আজ্ঞে হ্যাঁ। আপনি কোথা থেকে আসছেন? ' 
' ধরে নিন এই কাঁচরাপাড়ারই লোক..'
পাঞ্জাবির হাতাটা কিঞ্চিৎ তুলে ঘড়ি দেখলেন ভদ্রলোক...
' আগে থেকে না জানিয়ে আসাটা হয়তো ঠিক হয়নি। ওর নাম্বারটাও নেই, ছিল, কোথায় হারিয়ে ফেলেছি...থাকলে একটা অ্যাপয়েন্টমেন্ট...'
' আমি বরং ফোন করে দেখছি..'
' না না ব্যস্ত হতে হবেন না। এই জিনিসটা ওকে একটু দিয়ে দেবেন, তাহলেই হবে...এই কারণেই আমার আসা..'
বলতে বলতে ভদ্রলোক অ্যাটাচিটা খুলে তা থেকে যে বস্তুটি বের করে স্বযত্নে টেবিলের ওপর রাখলেন, তাকিয়ে দেখি সেটা একটা আদ্যিকালের রেকর্ড প্লেয়ার। 
' জয়ন্ত এলে বলে দেবেন থিয়েটারের কমলদা এটা দিয়ে গেছেন...আমার নাম কমল গুহ। বেশ কিছু অভিনয় রেকর্ড করা আছে এর মধ্যে। ওর কাজে লাগতে পারে। তাই নিয়ে আসা। আচ্ছা, তাহলে উঠলাম..'
' আপনি থিয়েটার করেন বুঝি? ' কথাটা যেন মুখ ফসকে বেরিয়ে এলো আমার। 
উঠতে গিয়েও কি যেন ভেবে থমকে গেলেন ভদ্রলোক। এক ঝলক আমার দিকে তাকিয়ে মাথাটা কিঞ্চিত নীচু করে গম্ভীর হয়ে কি ভাবলেন। তারপর ধীর কন্ঠে অত্যন্ত স্পষ্ট উচ্চারণে বললেন, ' আপনার ভাই আর আমি একসাথে থিয়েটার করি বটে, তবে জয়ন্তর সঙ্গে পরিচয় তারও  আগে। সেটা সম্ভব হয়েছে একসঙ্গে অনেকগুলো বছর কাঁচরাপাড়া রেলওয়ে ওয়ার্কশপে কাজ করার সুবাদে। সেখান থেকেই হাইন্ডমার্চ ইনস্টিটিউটের অপেশাদারি মঞ্চে জয়ন্তদের শখের নাট্যদলে যোগদান। অবিশ্যি ভবানিপুরে যেখানে আমার পৈতৃক বসতবাড়ি, সে বাড়ি সংলগ্ন অঞ্চল ছিল এককালের নাট্যচর্চার আড়ৎখানা। সে মহল্লা ছেড়ে যখন আধাশহুরে এ জায়গায় কাজের সূত্রে আস্তানা গাড়লাম, প্রথম প্রথম একেবারেই মন বসতো না কিছুতে...সকাল বিকেল  লোহালক্কড়ের আওয়াজ শুনতে শুনতে ভেতরকার মানুষটাতে কিরকম যেন জং ধরে যাচ্ছিল বুঝতে পারতাম। মনে হতো ছেড়েছুড়ে চলে যাই। ওখানকার থিয়েটার গ্রুপগুলো যেন স্বপ্নের মাঝেও হাতছানি দিয়ে ডাকতো। পেটের দায়টুকু না থাকলে হয়তো বাক্স প্যাঁটরা নিয়ে পাততাড়ি গোটাতাম। তারপর একদিন জয়ন্তর সাথে পরিচয় হল, পরিচয় থেকে অল্পদিনেই বন্ধুত্ব...যদিও বয়সে ও অনেক ছোট, তবু বন্ধুই বলছি...হাইন্ডমার্চ ইন্সটিটউটের মাঠে সৃষ্টি নামক নাট্যপ্রযোজনা সংস্থায় জয়ন্তই আমায় প্রথম হাত ধরে নিয়ে আসে৷  নাট্যজগতে ওরা তখন নতুন। দলও নতুন। বছর পাঁচ সাতেক হলো স্টেজ শো-তে নেমেছে। ওদের সাথে অভিনয় করতে করতে একদিন ওরাই আমাকে কিভাবে যেন সিনিয়র মেন্টার বানিয়ে নিল। দেখতে দেখতে কত বছর কেটে গেল। চাকরি জীবন শেষ করে বার্ধক্যে চলে এলাম। এর মাঝে নিজেকে কতটুকু ভাঙতে পেরেছি বা গড়তে পেরেছি জানি না, তবে এটা ঠিক, জয়ন্তর কাছে আজও আমি ঋণী থেকে গেলাম। ঐ প্লাটফর্মটুকু না পেলে...যে জায়গা ছেড়ে একদিন ভেবেছিলাম পালিয়ে যাবো, তাকে এমনভাবে আঁকড়ে ধরে পড়ে থাকতে আজও পারতাম কিনা ঠিক জানি না। কিছু কিছু প্রশ্নের উত্তর সারাজীবনেও হয়তো খুঁজে পাওয়া যায় না। আসলে হয়তো উত্তরটাই নেই। শুধু প্রশ্নের মাঝে বাঁধা পড়ে থাকে যাত্রাপথটুকু। 
যাক গে, আবার ভাববেন না যেন এগুলো আমার অভিনয়ের রেকর্ড...এসবই সংগৃহিত ...'
রেকর্ড প্লেয়ারের দিকে তাকিয়ে কৌতুহলী চিত্তে জিজ্ঞেস করলাম,, ' কোন সময়কার এগুলো? এখনো চলে ঠিকঠাক?'
' বহুদিন চলার পর ডিস্টার্ব করতে শুরু করে। অনেক কষ্ট করে কলকাতার একজনকে দিয়ে ডিজিটাইজ করিয়েছি। চোখের সামনে নষ্ট হবে। দেখি না চেষ্টা করে। যদি চলে। শেষমেশ হলো। পঁয়ষট্টি, সত্তর বছর আগেকার থিয়েটারে করা সব অভিনয় এর মধ্যে সঞ্চিত রয়েছে। '
' বলেন কি!'
' কথা প্রসঙ্গে একদিন জয়ন্তর কাছে গল্প করছিলাম রেকর্ড গুলোর বিষয়ে। ও সেগুলো শুনবে বলে বিশেষ আগ্রহ প্রকাশ করেছিল৷ যাকে তাকে তো আর এসব জিনিস দেখানো যায় না। কারো যদি আগ্রহ থাকে তবেই...। তাছাড়া নিতান্ত কাছের জন্য না হলে আমি এগুলো বেরও করিনা। আগামীতে জয়ন্তদের শাহজাহান নাটক মঞ্চস্থ হতে চলেছে। সেখানে ওর মুখ্য চরিত্র। মানে সম্রাটের চরিত্র। এই রেকর্ডগুলো শুনলে হয়তো ওর উপকার হতে পারে। শুনে শুনেও তো টেকনিক্যালি অনেক কিছু শেখা যায়। আমি নাটক থেকে বাদ পড়লাম কি পড়লাম না সেটা বড় কথা নয়। আমাদের জেনারেশন শেষের পথে। এই সত্তরে এসে নতুন কি ই বা পাওয়ার থাকতে পারে। ওদের এখন অনেকদূর যেতে হবে। তার জন্য আমার শুভকামনা রইলো। নাইনটিন ফিফটি সেভেনে মিনার্ভায় অহিন্দ্র চৌধুরী শাহজাহান নাটকের মুখ্য চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন। আগা গোড়া গোটা থিয়েটারটা এতে রেকর্ড করা রয়েছে। সেসব দৃশ্যাবলী তো আর এ জন্মে দেখতে পেলাম না। বলবেন যেন মন দিয়ে শোনে। আমি পরে ওর সঙ্গে কথা বলে নেবো...'
' নাইনটিন ফিফটি সেভেন...শাহজাহান... ওটা তো বিশেষ সাড়াজাগানো একটা থিয়েটার! '
ভদ্রলোককে যতই দেখছি, কথাবার্তা শুনছি,  ততই যেন জড়িয়ে পড়ছি কোথায় একটা....আরো কিছু কথা শোনার আগ্রহ যেন আপনা থেকেই জন্ম নিচ্ছে মনে। কিন্তু এবার আর কৌতূহলকে দমন করতে পারলাম না। 
বললাম, ' ভাবতে সত্যিই অবাক লাগছে, এমন জিনিস তো সচরাচর খুঁজে পাওয়া যায় না..!'
' ওগুলো সবই আমার পিতা স্বর্গীয় প্রতাপাদিত্য গুহর সংগ্রহের। সরাসরি থিয়েটার আর্কাইভ থেকে কালেক্ট করা...শুনলেই বুঝতে পারবেন...অহীন্দ্র বাবুর বিভিন্ন সময়ের এরকম আরো বেশ কিছু নাটকের রেকর্ড আমাদের পরিবারে রয়েছে। বিফোর ফিফটি সেভেনের। কারণ সাতান্নর পর নটসূর্য চৌধুরী বাবু আর কখনো কোনোদিন থিয়েটারে অভিনয় করেন নি। নাট্যজগতের শাহজাহান বিদায় নিলেন রঙ্গমঞ্চ থেকে। অভিনেতা বিদায় নিলেন, নাট্যাচার্য নয়। সূর্যের বিদায় নেই। এক গোলার্ধে তার অস্ত, আর এক গোলার্ধে উদয়। মিনার্ভা থিয়েটার হলে বসে বিধান রায়ের সেই আবেগমোথিত স্মরণীয় উক্তি বাবা যখন স্মৃতিচারণ করতেন আমারো কেন জানি না সে না দেখা দৃশ্য চোখের সামনে ভারি অদ্ভুত ভাবে ভেসে উঠতো...
"সংসার এমনই, এ সংসারে সবই একদিন সয়ে যায় জাহানারা..."
দ্য লাস্ট ডে অব অহিন্দ্র চৌধুরী অ্যাট দ্য স্টেজ অব মিনার্ভা...রঙ্গমঞ্চের শাহজাহানের ঐ ছিল শেষ সংলাপ....মুখ্য চরিত্রাভিনেতা নরেশ মিত্তির অসুস্থ হয়ে পড়লেন...তাঁর অনুপস্থিতিতে ডাক পড়লো অহিন্দ্র বাবুর...সময় অল্প, তার মধ্যেই কাজ উতরে দিতে হবে...বাকিটা ইতিহাস...সে ইতিহাসের যারা স্বাক্ষী তেমন লোক আজ আর হয়তো খুঁজলেও পাওয়া যাবে না...তাদেরই একজন আমার বাবা...আর ছায়ার অন্তরালে থাকা এই রেকর্ড গুলো...ভাবিনি আর কখনো বাজবে...'
প্রত্যেকটা শব্দ যেন কন্ঠের ঝংকারে আলাদা আলাদা ভাবে কানে এসে প্রতিধ্বনিত হয়। 
প্রশ্নটা ভেতর থেকে উঠে এলো। জিজ্ঞেস করলাম, ' যদি কিছু মনে না করেন তাহলে বলি...নাট্যজগতের সঙ্গে জড়িয়ে থাকা আপনাদের পারিবারিক ইতিহাসটা একবার শুনতে খুব ইচ্ছে করছে। শুরু যখন করলেনই তখন শেষটা...'
তাকিয়ে আছেন কমল বাবু, স্থির চোখে আমারই দিকে। তীক্ষ্ণ, উজ্জ্বল দৃষ্টির আলোটুকু যেন আমার ভেতরকার কৌতুহলী আমি টাকেই পড়ে নিতে চাইছে। 
দৃষ্টি সরে আসে আসতে আসতে, বারান্দার বাইরে শেষ বিকেলের ঝাপসা বেলায়...কালো চশমার কাঁচের গায়ে যেন তারই এক খন্ড প্রতিফলন...
' টুকরো টুকরো কথা থেকে অনেক কথা চলে আসে। আগে এমনটা হতো না। এখন হয়। সময়। বয়স। আপনি আমার ভ্রাতৃসম জয়ন্তর দাদা। সেদিক থেকে আমারো  কাছের। এ দাবী আমি কি তাহলে করতে পারি?'
' অবশ্যই পারেন। দেখেছেন এতক্ষণ কথা বলছি, নামটাই বলা হয় নি। আমি সমর, সমর রক্ষিত। '
' বেশ। তা আপনিও কি জয়ন্তর মতো নাটক থিয়েটার পালা...? '
' আঞ্জে না। আমার যাত্রা আগ্রহতেই সীমাবদ্ধ। তবে ভাইয়ের অভিনয় দেখার সুযোগ সচরাচর মিস করি না। '
' বার কয়েক আমার সঙ্গে কলকাতায় এসে আমাদের ভবানীপুর নাট্যগ্রূপের সঙ্গে স্টেজ শো করে গেছে। সেখানেও তারিফ কুড়িয়েছে। খুব প্রমিসিং। আগামী দিনে আরো অনেক বেশি সাইন করবে। '
' আমার অবশ্য কলকাতার শোগুলো দেখা হয়নি। অফিসের কাজ পড়ে গেছলো।'
' এবারের শাহজাহান নাটকটা দেখবেন। পীযুষ মল্লিকের পরিচালনা। অনেক বড় মাপের নির্দেশক। চিত্রনাট্যও পীযুষেরই। এটা অবশ্যই জয়ন্তর কেরিয়ারে একটা সাড়া জাগানো প্লাটফর্ম! সেখানে দাঁড়িয়ে এই রেকর্ড গুলো যদি ওর কোনোভাবে কাজে লাগে, বুঝবো একসময়কার পরামর্শদাতা হিসেবে কিছুটা হলেও ছাপ রাখতে পেরেছি আমার এই ছোট ভাইটার মধ্যে। তার চেয়ে বেশি স্বার্থকতা এ বয়সে আর কি হতে পারে। মুখিয়ে রয়েছি নাটকটা দেখবো বলে। পীযুষ আমার অনেক দিনের প্রিয় নাট্যকার। বর্তমান প্রজন্মের মধ্যে ওর পাশে আর বিশেষ কাউকে দেখি না। একবার আমার পৈতৃক বাড়িতেও এসেছিল ভবানীপুর রয়্যাল ক্লাবে নাটকের শো করতে গিয়ে। ইন্দু মুখোপাধ্যায়, তিনকড়ি চক্রবর্তী, দূর্গাদাস বন্দোপাধ্যায়, আর অহীন্দ্র বাবুর অভিনীত কর্ণার্জুন নাটকের রেকর্ড শুনে বাড়ি গেছে।  বলেছিল এমন আর্কাইভ শুনতে আবার আসবে। আসে নি। ওদের কাছে সত্যিই আমি আর্কাইভ হয়ে গেলাম। কে বোঝাবে এ জিনিসগুলোর ওপর আমার কোনোরকম হাত নেই। আমি জড়ো করে রেখে দিয়েছি এই অবধি...এর বেশি কিছু না....যেদিন চলে যাবো আদি বাড়ির দেরাজেই হয়তো পড়ে থাকবে...তারপর একটু একটু করে সত্যিই একদিন বার্ধক্য এসে ধরবে...সেদিন আর দেখার কেউ থাকবে না...যত্ন করারও থাকবে না...এসব রেকর্ড...যত পরিণতির দিকে সময় এগোচ্ছে, ওদের ভবিষ্যৎ থেকে থেকে আমায় বড় ভাবায় ...যখন কাঁচরাপাড়ায় থাকি, ওরাও আমার সাথে থাকে...যখন ভবানীপুরে যাই তখন ওরাও আমার সাথে সাথে...আমার তো আর কোনো পিছুটান নেই... তাই ওদেরকে নিয়েই পড়ে আছি...ওদেরকে আগলে...এক কথায় থিয়েটারকে আগলে....কাঁচরাপাড়া ছেড়ে চলে যাবার কথা ভাবলে যেমন জয়ন্তদের মুখগুলো ভেসে ওঠে, ঠিক সেরকমই ওদেরকে ভবানীপুরে ফেলে রেখে একা একা এখানে চলে এলে মন টেকে না। এক ভয়ানক চিন্তা মাথায় এসে ঘুরপাক খায়...অপগন্ড ভাইদুটো খুঁজে খুঁজে জিনিসগুলো বের করে পয়সার লোভে গায়েব করে দেবে না তো? আমার দৃঢ় বিশ্বাস, আমার অবর্তমানে ওরা তাই করবে। বংশের কুলাঙ্গার...।  দেখেছেন, কত কথা বেরিয়ে এলো! '
হেসে বলি, ' আসল কথাই যে হলো না কমল বাবু। অহীন্দ্র চৌধুরী আমারো যে একজন প্রিয় অভিনেতা! তাঁর অভিনয় আমি টিভিতে দেখেছি, কিন্তু তাঁর অভিনীত রেকর্ড এভাবে কোনোদিন নিজের চোখে আমি দেখিনি...'
বেলা আরো ঝাপসা হয়ে আসছে। আমাদের বাড়ির সামনেকার দেবদারু গাছের ছায়া দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হয়ে আমার ঘরের মেঝেতে এসে পড়েছে। অবসন্ন আলোটুকু পাতার ফাঁকে, শাখা-প্রশাখায় ক্লান্ত বাঁশির সুরের রেশটুকুর মতো জড়িয়ে রয়েছে এখনো। সে নরম আভার খানিকটা প্রলেপ কমল বাবুর চশমার কাঁচের এক কোণে প্রতিফলিত হচ্ছিল। 
ভদ্রলোক বলতে শুরু করলেন....
'  বাবার চোখ দিয়ে যেটুকু দেখা কিংবা মুখে মুখে যা যেটুকু শোনা, সেটুকুই বলতে পারবো। ওর চেয়ে বেশি বলবার ক্ষমতা বা সাধ্য কোনোটাই আমার নেই। কারণ এসব সম্পত্তির মালিক বা উত্তরাধিকারী আমি নই। বাবার শেষ স্পর্শ টুকু আগলে রেখেছি মাত্র। আমার বাবা প্রতাপাদিত্য গুহ যাত্রা, থিয়েটার মহলে রিসিভারের কাজ করতেন। নতুন নতুন পালা কিংবা নাটকের শিল্পী জোগাড় করে দিতেন। স্টার অভিনেতা ছাড়াও পর্দায় অনেক নতুন শিল্পীরও দরকার হয়। সেসব আনকোরা, নতুন মুখের আর্টিস্ট দের খুঁজে এনে দিতেন বাবা। সে আর্টিস্ট কাজে লাগবে কি লাগবে না সেটা ছিল অবিশ্যি পরিচালক, নির্দেশকের সীদ্ধান্ত। তবে বেশিরভাগ সময় থিয়েটারওয়ালারা বাবার ওপরেই নির্ভর করতেন। কারণ বাইরে তাঁর একটা বিশেষ পরিচিতি ছিল। আর তাই বিভিন্ন মহলে যোগাযোগও ছিল। সেই সময়কার থিয়েটার পাড়ায় একজন প্রসিদ্ধ ল্য ইয়ার ছিলেন বাবা। ওটাই ছিল তাঁর মুখ্য প্রফেশন। থিয়েটার মহলে প্রায় সময়েই মামলা মোকদ্দমা লেগে থাকতো।  আর্টিস্ট দের বেতন ঠিকমতো হতো না, কাজের অভাবে বন্ধ হয়ে যেত কত নাটক, যাত্রা...তাই নিয়ে কেসখামারিরও অন্ত ছিল না। বিভিন্ন সময়ে সেই সব মামলাগুলো বাবার এজলাসে গিয়ে জমা হতো। থিয়েটারে কাজ পাওয়ার  স্বার্থে  কিংবা নিজেদের দরকারে কালীঘাটে গঙ্গা স্নান সেরে পুজো দিয়ে মানত করে ফেরার পথে প্রযোজক, অভিনেতা থেকে শুরু করে কত যে নাট্য অনুরাগীর দল বাবার সাথে দেখা করার জন্য আমাদের সে বাড়িতে আসতো যেত তার বোধহয় ইয়ত্তা নেই। অন্যান্য মামলার চেয়ে যাত্রা, থিয়েটারের মামলাই বাবাকে দেখতাম বেশি লড়তে। 
অহীন্দ্র চৌধুরীর সঙ্গে বাবার একটা অন্যরকম সখ্যতার সম্পর্ক ছিল, যেটা ঠিক থিয়েটারের মাধ্যমে  গড়ে ওঠে নি৷ তখনকার কালের ইম্পেরিয়াল লাইব্রেরিতে প্রায়সময়েই অবসরে বাবা বইটই পড়তে যেতেন। শখ ছিল খুব বইপত্র পড়বার। অহিন্দ্র চৌধুরী নিজেও ছিলেন ব্যক্তিগত জীবনে পুস্তকপ্রিয় মানুষ। লাইব্রেরি রুমে দুজনে একসাথে বই পড়তে পড়তেই কথা হতো। তা থেকেই একটু একটু করে হৃদ্যতা। আমাদের বাড়িতে বার দুয়েক এসেছিলেন অহিন্দ্র বাবু। তখন আমি কলেজ স্টুডেন্ট। ছোটো পিসিমার বিয়ের অনুষ্ঠানে এসে চলচ্চিত্রের ইতিহাস নামে ওঁর নিজের সই করা একটা বই উপহার দিয়ে গিয়েছিলেন, যা আজও পিসিমার শ্বশুর বাড়িতে রয়ে গেছে। বড্ড সহজ মনের মানুষ ছিলেন তো, তাই সবার সঙ্গে মিশে যেতে পারতেন। বড় অভিনেতা হলে সাধারণত যা জন্ম নেয়... স্নবারি... তা ওঁর মধ্যে ছিল না।
একটা সময় ছিল যখন অহিন্দ্র বাবুকে স্টপ গ্যাপ আর্টিস্ট বা নির্ধারিত শিল্পীর অনুপস্থিতিতে কাজ চালানোর লোক হিসেবে থিয়েটারে ডাকা হতো। পড়ে পাওয়া চোদ্দ আনার মতো তিনি সেখানে মনপ্রাণ ঢেলে অভিনয় করতেন।  
এটা যে সময়ের কথা ... কলকাতায় তখন তিন চারটে থিয়েটার হলের রমরমা ব্যবসা।  মিনার্ভা, মনোহর, স্টার, রঙমহল। স্টারে তখন কর্ণার্জুন নাটকটা চলছিল। অর্জুনের ভূমিকায় যার অভিনয় করার কথা ছিল, তিনি মাঝপথে অসুস্থ হয়ে পড়লে পরবর্তী শো গুলোতে  অহিন্দ্র চৌধুরীকে বেছে নেওয়া হয়। বাবার সংগ্রহ করা সে নাটকের রেকর্ড আজও আমার কাছে রাখা রয়েছে, আপনাকে বোধহয় আগেই বলেছি সেকথা। 
সেসব অভিনয় আর কখনো ফিরবে না। বাবা বলতেন," শাহজাহান যদি ইতিহাস হয়ে থাকে, কর্নার্জুন তাহলে সে ইতিহাসের মাইলস্টোন...নির্দেশক অপরেশ মুখোপাধ্যায় তাঁর জহুরির চোখ দিয়ে ঠিক খাঁটি জহরত টিকে চিনে নিয়েছিলেন..."
 ঐ নাটকে অভিনয়ের পর আর কখনো অহিন্দ্র বাবুকে স্টপ গ্যাপ অ্যাক্টারের মতো পাঠ পাবার জন্য হাপিত্যেশ করে বসে থাকতে বা পিছন ফিরে তাকাতে হয়নি। এমন একটা সময় আসে যখন যাত্রা, থিয়েটার কর্তৃপক্ষ চৌধুরী মশাইকে ধরে রাখার জন্য তাঁকে নিয়ে গোপনে পালিয়ে গিয়ে সইসাবুদ করিয়ে নিয়ে চলে আসতো...আর তাই নিয়ে প্রায়শই মামলাও ঠুকে বসতো অন্য থিয়েটার ওয়ালারা। অহীন্দ্র চৌধুরী নামটা ততদিনে থিয়েটার মহলে নটসূর্য নামে স্বমহিমায় অধিষ্ঠিত। নির্বাক যুগ থেকে সবাক যুগ...,মাঝে চার দশকের অভিনয় জীবন একদিন সূর্যের মতো বিদায় নিল বটে, রেখে গেল বাংলা রঙ্গমঞ্চের এক এবং অদ্বিতীয় শাহজাহানকে....আগামীর জন্য...আজও যে নাটকের বিকল্প তৈরি হয় নি। যখনই কোনো থিয়েটার ব্যবসা মন্দার মুখ দেখেছে, তখনই অহীন্দ্র চৌধুরীর ডাক পড়তো শাহজাহান করবার জন্য। ব্যবসার পয়সা ওতেই উশুল...'
কথাগুলো বলে ভদ্রলোক থামলেন। সত্যিই যেন নাটকের মতো মনে হচ্ছিল সবটা! যেন জীবন থেকে নেওয়া এসব ঘটনার স্বাক্ষী তিনি নিজেই।
স্থির দৃষ্টিতে রেকর্ড প্লেয়ারটার দিকে তাকিয়ে ভদ্রলোক এবার ধীর কন্ঠে বললেন, ' আমার কাছে অবিশ্যি এই একটি শাহজাহানই রয়েছে। এক এবং অদ্বিতীয়। আরো বেশ কিছু রেকর্ড...রামচন্দ্র, অশোক, চন্দ্র গুপ্ত, মিশরকুমারী...সেগুলোও রয়েছে। সবই কালেক্টেড ফ্রম থিয়েটার আর্কাইভ। সবকটাতেই অহীন্দ্র বাবুর অভিনয় দাগ রেখে যায়...যখন ঘরে একা বসে বসে রেকর্ড গুলো শুনি, তখন ভাবি কতখানি দূর্ভাগা আমি যে ঐ পৌণে সাতফুট লম্বা চেহারার মানুষটির কোনো স্টেজ শো নিজের চোখে দেখে যেতে পারলাম না! শিশির -অহীন্দ্র যুগ, সে তো বহুকাল আগেই শেষ হয়ে গেছে...ভুলে যাওয়া বিস্মৃতপ্রায় অতীত। সাতান্নর পর শত শত অনুরাগী দর্শককে কাঁদিয়ে আচমকা থমকে দাঁড়িয়ে পড়লো অহীন্দ্র যুগ নামে আরো একটা ঐতিহাসিক অধ্যায়। থমকে দাঁড়ালো চলচ্চিত্র, বেতার, মঞ্চ সবকিছু। কেরিয়ারের মধ্যগগণে এসে আর কেউ এভাবে চিত্র, মঞ্চকে বিদায় জানিয়েছেন কিনা মনে পড়ে না। এ এক বিরল দৃষ্টান্ত! এইভাবেই বোধহয় ছেড়ে দিতে হয়।  ছাড়াটাও একটা আর্ট। শিল্প। ওতে মানুষের মাঝে দীর্ঘস্থায়ী হয়ে বেঁচে থাকা যায়...'
নীরবে দীর্ঘশ্বাস ফেলেন কমল বাবু। ঝুপ করে কখন সন্ধ্যা নেমে এলো। স্ট্রিট লাইটের আবছা আলোয় ছায়া হয়ে হেঁটে চলেছে মানুষ। পাশের বাগানের শিউলি ফুলের হালকা গন্ধ ভেসে আসে জানলা দিয়ে। 
মনের কৌতুহল যেন এখনো কাটতে চাইছে না। কমল বাবুকে বললাম, ' বাকি রেকর্ড গুলো শোনার আগ্রহও কিন্তু রয়ে গেল। তবে তার আগে একটা জিজ্ঞাস্য ছিল। আপনি অভিনয় জগতে কি করে এলেন? সেটা কি অনেকটাই পারিবারিক প্রভাব?'
চা এসে গিয়েছিল। সঙ্গে বিস্কুট। অন্যদিন ভাই এলে একসাথে চা খাই। আজ পরিস্থিতি কিছুটা আলাদা হয়ে গেল। কমল বাবু এসেছেন। তাঁকে কিছু না খাইয়ে কি করে ছাড়ি? ভদ্রলোক কখন যেন অজান্তেই অতিথি হয়ে উঠেছেন আমার। 
চায়ে আলগা চুমুক দিয়ে আগের মতোই ধীর লয়ে ভদ্রলোক বলে চললেন, ' পরিবারে ছেলেমেয়েরা লেখাপড়া বাদ দিয়ে নাটক, থিয়েটার, যাত্রাপালায় নাম লেখাক,  বাবা ছিলেন এসবের ঘোর বিরোধী। যেটা করতেন, সেটা নেহাৎই পেশাগত প্রয়োজনে। তখন ভবানীপুর অঞ্চলের পুরোনো বনেদি বাড়িগুলোতে যাত্রাপালার আয়োজনের একটা রেওয়াজ ছিল ৷ দিন কয়েক আগে থেকে লিফলেট বিলি করা শুরু হত। বাজারঘাট, রাস্তার পাঁচিল, দেওয়ালে দেওয়ালে সেই সব রঙচঙে লিফলেটের কাগজ সিনেমার পোস্টারের মতো করে সাজানো হত। বাড়ির মেয়েরা এসে লিফলেট দিয়ে যেত অন্যবাড়িগুলোতে। সেই রঙীন কাগজগুলোকে দেখতে সত্যিই ভারি ভালো লাগতো। একবার আমাদের বাড়ির পাশে প্রসিদ্ধ ব্যবসায়ী চিত্ত লাহার বাড়িতে মায়ের সঙ্গে চুপিচুপি গেছি নিমাই সন্ন্যাস পালা দেখতে। খোল, করতাল, মৃদঙ্গ, কর্নেট, ক্ল্যারিওনেট সহযোগে চারপাশে লোকজন তৈরি। যেই না সামনে দাঁড়ানো লোকটি নিমাই সন্ন্যাসের গানের তালে বাঁশি বাজাতে শুরু করলো, আমি একেবারে মোহিত হয়ে একলাফে লোকটার পায়ের কাছে এসে বসলাম বাঁশির  আওয়াজ শুনবো বলে। ক্ল্যারিওনেটের ঐ যে মধুর আওয়াজ, সে সুর শোনার পর বাড়ি এসে মায়ের কাছে আবদার করেছিলাম ওরকম একটা বাঁশির। বাবার চোখকে ফাঁকি দিয়ে  মা চুপিচুপি একটা জাপানি বাঁশি কিনে দিয়ে ছিলেন আমায়। স্কুল থেকে বাড়ি ফিরে ঘুঘু ডাকা দুপুরে চিলেকোঠার ছাদে উঠে যখন বাঁশিটা নিয়ে আপন মনে বাজাতাম, বহুদূর থেকে ক্ল্যারিওনেটের সেই সুর যেন কোনো এক স্বপ্নের রাজ্যে হাতছানি দিয়ে ডাকতো আমায়! সবকিছুরই যেমন একটা শুরু থাকে, আমার জীবনেও ভালোলাগার শুরু হয়তো সেখানেই। তাছাড়া ভবানীপুরে আমাদের বাড়ির আশপাশ জুড়ে নাটক, যাত্রা, থিয়েটারের কালচার তো ছিলই, জীবনে সেটাও কাজে লেগে গেছে। 
'.....চাকরি বাকরি না করে শেষে কিনা শখের থিয়েটার! যেখানে দুপয়সাও আয় নেই, তার পেছনে ছুটে বেড়ানো...এ কেমন কথা! জীবন কি ছেলেখেলা নাকি? ওসব চলবে না....
এই নিয়ে একটা সময়ে বাবার নিষেধাগ্যার বিরুদ্ধে গিয়েছি অনেক। পরে অবশ্য বাবা আর তেমন কিছু বলতেন না। যখন দেখলেন ছেলে সত্যি সত্যি  নিজের পায়ে দাঁড়াতে শিখে গেছে। এইভাবে এক এক করে সময়গুলোকে টপকে টপকে এগিয়ে চলা, আর কি। জানি না শেষটা কোথায়। তবে এখন বুঝতে পারি নিজের পথটুকু ক্রমশ ফুরিয়ে আসছে। আর্কাইভে রেখে দেওয়ার মতো তেমন কোনো দামী কাজ আমি করিনি, যে পরবর্তী কালে লোকে আর মনে রাখবে...'
এবার যেন কিরকম অন্যমনস্ক হয়ে পড়েন ভদ্রলোক। তাঁর ব্যক্তিগত জীবনের সাফল্য, অসাফল্যের ক্ষেত্র গুলো নিয়ে নাড়াচাড়া করাটা শোভন নয় মনে করেই ও নিয়ে আর কিছু বললাম না। 
কমল বাবু মৃদু হেসে আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, ' একদিন আসুন না আমার বাড়ি। হাইন্ডমার্চ ইনস্টিটিউটটা পার করে কিছুদূর হাঁটলেই.....। এলে হাতে সময় নিয়ে আসবেন...রেকর্ড গুলো সব শুনিয়ে দেবো...'
' বলছেন?'
' অবশ্যই।'
' তাহলে তো যেতেই হয়। আর একটা কথা না বলে পারছি না। সত্তর বছরেও এরকম অদ্ভুত গলা আমার কাছে কিন্তু অ্যাসেট হয়েই রইলো।'
কিছু বললেন না ভদ্রলোক। কি যেন একটা চিন্তা করছেন। চা টুকু খেয়ে আস্তে আস্তে উঠে পড়লেন। সদর দরজার কাছে এসে চৌকাঠ পেরোতে গিয়ে হঠাৎই থমকে গেলেন। আমার দিকে মুখ ফিরিয়ে বললেন, ' মরা হাতির প্রবাদটা সময়ের কাছে কিরকম মিথ্যে বলে মনে হয় এখন...'

ভাই আজ একটু দেরী করেই বাড়ি ফিরলো। একসাথে চা খেতে খেতে ওকে রেকর্ড প্লেয়ারটা দেখিয়ে বলি, ' বিকেলের দিকে এক বয়স্ক ভদ্রলোক এসেছিলেন। নাম কমল গুহ। তোদের সাথেই নাকি থিয়েটার করেন। এটা দিয়ে গেছেন। '
' জানি। আসার সময় কমল দার সঙ্গে দেখা হয়েছে। '
' ও। একটা খটকা লাগছে জানিস...আমি তো তোদের কত থিয়েটারই দেখেছি...কোনো নাটকে ওনার মতো চেহারার কাউকে তো কোনোদিন লক্ষ্য করি নি! হতে পারে খেয়াল করিনি।' 
আমার ভাই জয়ন্ত চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে আনমনে রেকর্ড প্লেয়ারটা দেখছিল। দেখতে দেখতেই বলতে লাগলো, ' হয়তো তাই। খেয়াল করো নি। কিংবা এমন ভাবে মেকআপ করা ছিল তার আড়ালে আসল মানুষটা....।
তবে অনেকদিন হয়ে গেল, এখন আর তেমন একটা কাজ পান না ভদ্রলোক। একটা সময় আমাদের অভিনয়ের ব্যাপারে হাতে ধরে অনেক কিছু শিখিয়েছেন, টিপস্ দিয়েছেন...যতদিন গেছে, ততই যেন ওঁর অভিনয়ের ধারা ফেড হতে শুরু করেছে....এই সেদিন পীযুষ দা, মানে নাট্যনির্দেশক পীযুষ মল্লিক কথা প্রসঙ্গে বলছিলেন, "কমল দার ঐ অভিনয় এখন আর চলে না। পাবলিক স্টেজ শো করার আনন্দ যেমন আছে, বিড়ম্বনাও কম নয়। পারফরম্যান্স ভালো হলে লোকে ঐখানেই বাহবা দেবে ...আর না হলে অভিব্যক্তির তাৎক্ষনিক প্রতিক্রিয়া সোজাসুজি গালাগাল খেতে হবে।  লোকে যাবে, পয়সা দিয়ে টিকিট কিনে নাটক দেখুক আর বিনা পয়সাতেই দেখুক...জনসংযোগটাই এক্ষেত্রে বড় কথা। পাবলিক ইন্টারেস্ট। এ যুগে দাঁড়িয়ে যদি ষাট সত্তর বছর আগেকার সংলাপের স্টাইল...দানী বাবু, তিনকড়ি চক্রবর্তী, অহিন্দ্র চৌধুরী, নরেশ মিত্তির কিংবা দূর্গাদাসকে সামনে এনে ফোকাস করা হয়...সে নাটক চলবে কেন? কমল দাকে এটা মেনে নিতে হবে। সবেতেই ঐ একই ধারার অভিনয় কখনো চলতে পারে না। চলা সম্ভব নয়। লোকে নতুন কিছু না পেলে নেবে কেন? আর সেটা যদি না বোঝেন, এককথায় ভ্যানিস!'
বলতে বলতে আরো কিছুটা অন্যমনস্ক হয়ে পড়ে জয়ন্ত। রেকর্ড প্লেয়ারটার গায়ে আলগা হাত বোলাতে বোলাতে সগতোক্তির সুরে বলে, '  আমাদের শাহজাহান নাটকেও ঐ একই কারণে ছেঁটে দিতে বাধ্য  হলো পীযুষ দা। অথচ একদিন এই সৃষ্টি নাট্য সংস্থায় অভিনয়ের টানেই কমল দার শেষমেশ কাঁচরাপাড়ায় থেকে যাওয়া। ওরকম ব্যারিটোন ভয়েস, ওরকম হাইট, স্ট্যাচার...স্রেফ নিজেকে ভাঙতে পারলো না বলে....'
কথায় ছেদ পড়ে যায়। আমার পকেটের মোবাইলটা হঠাৎই বেজে ওঠে। ভুরু কুঁচকে রিসিভ করলাম। 
' হ্যালো।'
' আমি কমল গুহ বলছি।'
' হ্যাঁ দাদা বলুন।'
' জয়ন্ত আছে? ওর সঙ্গে দেখা হল, অথচ নম্বরটাই নেওয়া হলো না। আপনার নম্বরটা তখন নিয়েছিলাম, তাই ফোনটা করতে পারলাম।'
' ভাইকে দেবো?'
' একটু দিন।'
প্রায় মিনিট পাঁচেক কথা বলে ফোনটা রেখে দিল জয়ন্ত। মুখে একটা অন্যরকম ছাপ। উত্তেজনা,  সিরিয়াসনেস সবকিছু মিলে মিশে...
' কী হয়েছে?'
' কমল দা...'
' কী হয়েছে বলবি তো! '
' মানুষ যেরকম উইল করে যায়, দেবত্র করে যায়... উনি নিজের সংগ্রহে রাখা যাবতীয় থিয়েটারের  রেকর্ড গুলো ওঁর অবর্তমানে আমাদের থিয়েটার গ্রূপের হাতে তুলে দিয়ে যেতে চান। সেই চূড়ান্ত সীদ্ধান্তের কথাটাই আজ এই মুহূর্তে আমায় জানিয়ে দিলেন....'
মুহূর্ত কয়েক চুপ করে থেকে কি যেন ভাবে জয়ন্ত। বারান্দার ওপারে তারাভরা আকাশটার দিকে তাকিয়ে আস্তে আস্তে বলে, ' স্টার, মিনার্ভা, রঙমহল...সেখান থেকে সৃষ্টি নাট্যসংস্থার থিয়েটার আর্কাইভ... কি অদ্ভুত যাত্রাপথ তাই ভাবছি! এককালে বাবার কাছে গল্প শুনেছিলাম... থিয়েটার দেখার গল্প...স্টারে দূর্গাদাস বন্দোপাধ্যায় অভিনয় করতে আসবেন...কি বেশ নাটক...হল ভর্তি দর্শক টিকিট কেটে  মুখিয়ে রয়েছে...বাবা একেবারে সামনের সারিতে বসা...আকন্ঠ মদ্যপানের গুনে মেকআপ রুম থেকে বেরিয়ে সে লোক আর স্টেজেই পা দিলেন না...শূণ্যস্থান পূরণের জন্য অহীন্দ্র চৌধুরীকে নিয়ে আসা হলো...তিনি তখন আর্টিস্ট হিসেবে নবাগত...তাতে শূন্যস্থান তো পূরণ হলোই না...উল্টে হল ই ফাঁকা হয়ে গেল। সে গল্প একদিন করেছিলাম কমল দার কাছে। শূন্যতা। ভ্যাকুয়াম। এমন দিন আসবে, গল্পগুলোও শেষ হয়ে যাবে। বাবার গল্প। কমল দার গল্প। আজ বাবা বেঁচে থাকলে এসব রেকর্ড আঁকড়ে ধরতেন। বেঁচে থাকার আর একটা মানেই বোধহয় আঁকড়ে ধরা...এই মুহূর্তে বেশি করে ফিল করছি.... একটু রেকর্ডটা চালিয়ে দিতে পারো দাদা?'

রাতের দিকে ঢলে পড়া অন্ধকারকে বিদীর্ন করে  বাহাত্তর পাকের রেকর্ড বাজতে শুরু করে.... উনিশশো সাতান্নর, দ্য ভয়েস অব অহীন্দ্র চৌধুরী....বাংলা রঙ্গমঞ্চের শেষ শাহজাহান....আগামী দিনের সৃষ্টি নাট্যসংস্থার থিয়েটার আর্কাইভ।।  
=======================
 
ছবি- ইন্টারনেট ।
----------------------------
Subhanjan Chatterjee, 
185, Baro jonepur, 
post office - Kanchrapara, 
District - 24 Parganas (north),

Post a Comment

0 Comments
* Please Don't Spam Here. All the Comments are Reviewed by Admin.