কথাকাহিনি # ইভেন্ট ।। স্বাধীনচেতা নবনীতাদি ।। তপতী মণ্ডল
স্বাধীনচেতা নবনীতাদি
তপতী মণ্ডল
বসন্তের ফুরফুরে বিকেল।দখিনা বাতাসের মায়াবী পরশে দেহ-মন উৎফুল্ল।তার সাথে কোকিলের একটানা কুহুডাকে মন মাতোয়ারা।স্বর্ণাভ গোধূলিতে আকাশ বর্ণময়। এমনই এক খুশির বিকেলে শুরু হল আমাদের স্কুলের বাৎসরিক সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। দর্শক আসনে উপবিষ্ট ছাত্রী-অভিভাবক ও এলাকার কিছু সংস্কৃতি প্রিয় মানুষ। প্রধান অতিথির আসন অলংকৃত করে আছেন স্থানীয় পৌরপ্রধান।উপস্থিত আছেন বিদ্যালয় পরিচালন সমিতির সদস্য-সদস্যাবৃন্দ,শিক্ষিকা ও শিক্ষাকর্মীরা। ঘোষিকা সুনন্দাদি সুন্দর ছন্দময় সাবলীলভঙ্গীতে অনুষ্ঠানের ঘোষণা করলেন। ঠিক বিকাল সাড়ে পাঁচটায় অনুষ্ঠান শুরু হল। নবনীতাদি ছাত্রীদের সঙ্গে নিয়ে উদ্বোধনী সংগীত পরিবেশন করলেন--'আনন্দলোকে মঙ্গলালোকে বিরাজ সত্য সুন্দর...'। এরপর একে একে অতিথিদের বরণ করে নিল স্কুলের ছাত্রীরা। অতিথিরা বক্তব্য রাখলেন স্বল্প সময়ের জন্য। তারপর সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের জন্য মঞ্চ ফাঁকা করে দেওয়া হল। পৌরপ্রধান বক্তব্য রেখে চলে গেলেন।একে একে ছাত্রীদের নাচ,গান,আবৃত্তি পরিবেশিত হচ্ছে। আর মিনিট কুড়ি পরে নবনীতাদি একক সংগীত পরিবেশন করবেন। উনি খুব ভালো নজরুল গীতি গান।ঘোষিকা নাম ঘোষণাও করে দিয়েছেন।সবাই একাগ্রচিত্তে অনুষ্ঠান উপভোগ করছেন। হঠাৎ দেখলাম নবনীতাদিকে নিয়ে ছাত্রীরা কেমন যেন অস্থির হয়ে উঠেছে। শুনলাম নবনীতাদির শরীরটা নাকি খুব খারাপ লাগছে। এই অনুষ্ঠান নিয়ে কয়েকদিন খুব খাটাখাটনি হয়েছে তার। চোখে মুখে ছাত্রীরা জল দিচ্ছে। কয়েকজন শিক্ষিকা ও ছুটে এলেন। প্রধান শিক্ষিকা অর্থাৎ বড়দির কাছে খবরটা গেল। উনি এসে নবনীতাদিকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাওয়ার পরামর্শ দিলেন। নবনীতাদির কাছ থেকে নাম্বার নিয়ে ওনার ছেলেকে ফোন করা হলো। সব শুনে এখনই আসছি বলে ফোনটা কেটে দিল। স্কুলের পাশেই নবনীতাদির বাড়ি। তবে ছেলে মায়ের সঙ্গে থাকে না। বিয়ে করে কিছুটা দূরে চলে গেছে। গতকাল এসেছে মায়ের কাছে। তাই তাড়াতাড়ি নিজের ALTO গাড়ি নিয়ে চলে আসল। এদিকে নবনীতাদির শারীরিক অবস্থা দেখে মোটেও ভালো লাগছে না। কেমন যেন করছেন উনি। তাকে কোন্ ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাওয়া হবে ভেবে না পেয়ে তার ছেলে অবশেষে নার্সিংহোমে ভর্তি করে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিল।বড়দির কথামতো আমি আর সূচনা ওই গাড়িতে উঠে গেলাম নার্সিংহোমে। গাড়িতে যখন উঠতে যাচ্ছি তখন নবনীতাদির ছেলের কন্ঠস্বর পেলাম--তুমি একটু সাবধানে থাকতে পারো না? বয়স হয়েছে তোমার, এটা তো মাথায় রাখতে হবে। আমি যদি না আসতাম এখানে।
নবনীতাদি কোনো উত্তর দিলেন না। তারপর স্থানীয় একটি নার্সিংহোমে নবনীতাদিকে ভর্তি করে দেওয়া হল। ওনার ছেলে ছিল তাই আমরা দুজন রাত্রি আটটা নাগাদ বাড়ি ফিরে আসি।ততক্ষণে স্কুলের অনুষ্ঠান শেষ। চারদিন পর নার্সিংহোম থেকে ছাড়া পান নবনীতাদি। শুনলাম ডাক্তার বলেছেন--মাইল্ড স্ট্রোক। দুদিন পর আমি আর আমার সহকর্মী সূচনা নবনীতাদিকে দেখতে যাই। সকালে মেয়েদের কাজের শেষ থাকে না তাই আমরা বিকালেই গেলাম। বাড়িতে ঢুকতেই দেখি বেশ আট-দশ জন ছোটো বাচ্চা উঠোনে লাফালাফি করে খেলেছে।তাদের বয়স ৮ থেকে ১০ বছরের মধ্যে হবে।আমরা ভাবলাম হয়তো বাড়িতে আত্মীয়-স্বজন এসেছে নবনীতাদিকে দেখতে।একপা-দুপা করে এগিয়ে যাচ্ছি বাড়ির ভিতরে। হঠাৎ একটা বছর পনেরোর ছেলে এসে বলল-- আপনারা পিসির স্কুল থেকে আসছেন? আমরা দুজনেই মাথা নেড়ে সম্মতি জানালাম। তখন আসুন আসুন বলে আমাদের দোতালায় নবনীতাদির ঘরের সামনে নিয়ে গেল।তখন সেখানে দুজন মাঝবয়সি ভদ্রলোক নবনীতাদির সঙ্গে কথা বলছিলেন।'ওই যে পিসি'--বলে ছেলেটি চলে গেল।আমরা দরজার বাইরে একটু দাঁড়িয়ে রইলাম। একজন ভদ্রলোক বলছেন--তাড়াতাড়ি সুস্থ হয়ে উঠুন।আমাদের বাচ্চাদের কাছে যেতে হবে তো। ওরা আপনার গান শুনতে খুব ভালোবাসে। নবনীতাদি ধীরে ধীরে বললেন-- হ্যাঁ যাবো,নিশ্চয়ই যাবো। ভদ্রলোক দুজন চলে যাওয়ার পর আমরা ঘরের মধ্যে প্রবেশ করলাম।আমাদের দেখে নবনীতাদির সে কি আনন্দ! বললেন--আরে এসো এসো,তোমরা না থাকলে আমি যে এতক্ষণ কোথায় থাকতাম তা স্বয়ং ঈশ্বরই জানেন।
সূচনা বলল--আমরা আর কী করলাম,যা করার তো আপনার ছেলেই করেছে। আমরা শুধু ওকে ফোন করে জানিয়েছি।
বেশ আধঘন্টা কথা বলার পর সূচনা বলল-- নবনীতাদি আপনাদের উঠোনে কয়েকজন বাচ্চাকে খেলতে দেখলাম। আত্মীয় নিশ্চয়ই আপনাদের।
কিছুক্ষণ চুপ থেকে নবনীতাদি শান্ত গলায় বললেন-- হ্যাঁ,ওরা আমার শুধু আত্মীয় নয়,ওরা আমার পরমাত্মীয়।
আমি বললাম--আর ওই দুজন যারা আপনার গানের কথা বলছিলেন?
নবনীতাদি একটু হাসলেন। মুখটা মুহুর্তে কেমন অন্ধকার হয়ে গেল।
বেশ গম্ভীর হয়ে গেলেন। জানলা দিয়ে বাইরে যতদূর চোখ যায় স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে আস্তে আস্তে বললেন--অনেকদিন আগের কথা। ভালো গান গাইতাম বলে আমার বাবা ছোটো থেকেই গানের মাস্টার রেখেছিল। একদিন রবীন্দ্র-নজরুল জয়ন্তী উপলক্ষে রবীন্দ্রভবনে একটি সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। সেখানে আমি একটি নজরুল গীতি পরিবেশন করি। পরের দিন সন্ধ্যায় আমাদের বাড়িতে আসলেন বাবার বন্ধু কমলকাকু।আগে কোনোদিন আমার সঙ্গে আলাপ হয়নি। মা-বাবার সাথে কথা হল। আমাকে বললেন--একটা গান শোনাও তো মা, ওই যে ওই গানটা--'চরণ ধরিতে দিওগো আমায়......'।আমি আবার কেউ গান শুনতে চাইলে বেশ আনন্দ পেতাম। তাই ওনার পছন্দের গানটা গেয়ে শোনালাম। খালি গলায় গাইলাম। গান শুনে কেমন যেন মোহিত হয়ে পড়লেন। তারপর মায়ের হাতের চা খেয়ে ঘণ্টা দুই পরে চলে গেলেন। পরে শুনলাম--ওনার ছেলের সঙ্গে আমার বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে এসেছিলেন। ছেলে সরকারি কর্মচারী। ছয় ফুট উচ্চতা,ফর্সা হ্যান্ডসাম। দেখলে কারো অপছন্দ হবে না বলে গেছেন নাকি উনি। তারপর কথা কতদূর এগিয়ে গেল তা জানি না কারণ আমার বাবা-মা এ ব্যাপারে আমার মতামত জানতে চাইনি। তবে যেহেতু ছেলে চাকরি করে আর চেহারার বর্ণনা যা শুনেছি তাতে আমার অমত হওয়ারও জায়গা ছিল না।তাই আমি নিজে থেকে এ প্রসঙ্গে কিছু বলিওনি মা-বাবাকে।পরে শুনেছি ছেলের বাবাও নাকি বিয়ের ব্যাপারে ছেলের মতামত নেননি। তবে শ্বশুরবাড়ি যাওয়ার পর শুনেছি ওনারা ছেলের জন্য অনেক মেয়ে দেখেছেন কিন্তু কোথাও ছেলের মেয়ে পছন্দ হয় না। তাই কমলকাকু নাকি ঠিকই করে নিয়েছিলেন যে ভালো মেয়ে পেলে আর ছেলেকে দেখাবেন না। মেয়ের বাড়ি থেকে রাজি হলে একেবারে ছাতনাতলায় শুভদৃষ্টিতেই হবে প্রথম দেখা। হলোও তাই। তবে কমলকাকু বিয়ের আগে একবার আমাদের বাড়িতে এসে আমাকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন যে তার ঘরে আমি যেতে চাই কিনা। আমি কোনো কথা না বলে অন্য ঘরে চলে গিয়েছিলাম।মৌনং সম্মতি লক্ষণম্--ভেবে বিয়ের দিন ঠিক হয়। বিয়েও হয় শুভ লগ্নে। বেশ ভালোই চলছিল সবকিছু। শুধু চলছিল না আমার গানের রেওয়াজ। শ্বশুরবাড়িতে কোনো হারমোনিয়াম ছিল না।তবে মাঝে মাঝে আমার শ্বশুরমশাই এর অনুরোধে সন্ধ্যায় আমি গান শোনাতাম। শ্রোতা বলতে শ্বশুরমশাই আর শাশুড়িমা। অমিতকে শ্বশুরমশাই বলেছেন কয়েকবার--নবনীতা খুব সুন্দর গান গায়।শুনেছিস কখনো? উত্তরে অমিত শুধু বলেছে--হ্যাঁ জানি তো।
অমিত গান-টান অত পছন্দ করে না। আসলে ও যে কী পছন্দ করে তা আমিও তখন বুঝে উঠতে পারিনি। শুধু ও বাড়ি থাকলে শাশুড়ির কথা মত হাতের কাছে তার প্রয়োজনীয় জিনিস এগিয়ে দিয়েছি। যখন যেটা চেয়েছে সেটা যত দ্রুত সম্ভব হাজির করেছি।বাথরুমে গামছা নিতে ভুলে গিয়ে ভিতর থেকে ডাকলে দ্রুত গিয়ে সেটা দিয়ে এসেছি। খাওয়ার সময় সবকিছু থালার পাশে সাজিয়ে আসন পেতে দিয়ে সামনে বসে থেকেছি। আর কত কথা বলেছি। ও শুধু শুনতো,খুব একটা উত্তর দিত না।এমনিতে খুব চুপচাপ অমিত।দশটা কথা বললে একটা উত্তর দিত। আমিও কম কথা বলতাম ঠিকই তবে অতটা নয়। যাইহোক এইভাবে চলল একটা বছর। তার মধ্যে দুবার এসেছি বাপের বাড়ি। অমিতও এসেছিল আমার সঙ্গে। এই এক বছরে সেই ভাবে গানের সাথে সময় দিতে পারিনি।একদিন রাতে খাওয়ার সময় বললাম--আমি আবার গানটা শুরু করব ভাবছি।আমার বর অমিত আর আমার শাশুড়িমা হ্যাঁ-না কোনো কথা বলেনি। তবে শ্বশুরমশাই বললেন--হ্যাঁ শুরু করো, কোন অসুবিধা তো নেই।একাই তো থাকো বেশিরভাগ সময়। গানের সাথে থাকলে তোমার মনটাও ভালো থাকবে। বাপের বাড়ি থেকে হারমোনিয়াম নিয়ে আসা হল। কিন্তু গানের টিচারের বাড়ি কোলকাতায়। উনি বাড়িতে এসে শেখাতে পারবেন না।সপ্তাহে একদিন যেতে হবে গান শিখতে। কিন্তু কার সঙ্গে যাব?নাকি একাই যাবো? শ্বশুর মশাই কে জানাতে উনি বললেন--আমি তোমাকে নিয়ে যাব।
শ্বশুরমশাই সদ্য অবসর নিয়েছেন। সময় কাটতে চায় না। ছাদে লাগানো কিছু ফুল গাছ আর সামনের উঠোনের কিছু ফল গাছ নিয়ে সকাল বিকালের কিছু সময় কাটিয়ে দেন। সন্ধ্যায় একটু চায়ের দোকানে আড্ডা দিতে বের হন। তারপর বাড়ি এসে খেয়ে শুয়ে পড়েন।অবশ্য বাজারটা নিজেই করেন। বয়স ষাট হয়ে গেলেও বেশ কর্মঠ আছেন। কিন্তু যখন রাতে জানালাম অমিতকে কোলকাতায় গান শেখার কথাটা,ও বিরক্তি প্রকাশ করে বলল--বাড়িতে আছো, মায়ের সঙ্গে সংসারের কাজকর্ম করছ--তাই করো না।আবার সেজেগুজে কোলকাতায় গান শিখতে যাওয়ার কী আছে?আমার এসব ভালো লাগেনা।
সকালে অমিত অফিস চলে গেলে জানালাম শ্বশুরমশাইকে। শ্বশুরমশাই বললেন--ছাড়ো তো ওর কথা।সারাক্ষণ অফিস আর মোবাইল--এই ওর জগৎ।ও এসবের মর্ম কী বুঝবে? তুমি চিন্তা করো না। সপ্তাহে একটা তো দিন। ও ঠিকই বুঝবে পরে। আরে সংগীত নিয়েও তো প্রতিষ্ঠিত হওয়া যায়। মেয়ে হয়েছো বলে রান্না ঘরেই থাকতে হবে সারাক্ষণ--এ আমি মানি না।
আমাকে বললেন--যেতে হবে কী বার?
আমি বললাম--শনি আর রবি-এই দুইদিন উনি শেখান।
----------আচ্ছা,আসলে রবিবার ছুটির দিন অমিত বাড়ি থাকবে আর তুমি থাকবে না সেটা ভালো হবে না।তুমি শনিবারে যাবে।
ওর মা একটু বুঝিয়ে বলবে না হয়।
তবে শাশুড়িমা যে কোন্ পক্ষে তা বোঝা যায় না। না ছেলের কথায় মাথা নাড়েন, না স্বামীর কথায়।বড্ড বেশি চুপচাপ।তবে আমি কী করবো ভেবে উঠতে পারলাম না। শ্বশুরের কথার যুক্তি আছে বুঝলাম কিন্তু স্বামী অখুশি এটাও ভালো লাগলো না। শেষে আমার বাবাকে বললাম। বাবা অবাক হয়ে গেল। বলল--গান শিখবে তাতে আবার আপত্তি থাকতে পারে? ঠিক আছে আমি অমিতের সঙ্গে এ ব্যাপারে কথা বলে নেব।সপ্তাহে একদিন। এক ঘন্টা শেখাবে। যেতে আসতে দুই ঘন্টার পর। অর্থাৎ মোট তিন ঘন্টা বড়োজোর চার ঘন্টার ব্যাপার। এটা কোনো সমস্যা হতে পারে না।
যাই হোক,আমি গান শিখতে যেতে শুরু করলাম। অমিত আর এ ব্যাপারে আমাকে একটি কথাও বলেনি। ভেবেছিলাম বুঝেছে বিষয়টা কিন্তু ও যে মনে মনে এতটা খারাপ ভাবনার মধ্যে দিয়ে যাচ্ছিল তা আমি স্বপ্নেও কল্পনা করতে পারিনি। মাস ছয়েক গান শিখতে গিয়েছিলাম। দু-একটি অনুষ্ঠানও করেছি স্যারের সাথে।তারপর আমার বান্টি পেটে আসে।শরীরটা খারাপ হতে থাকে। ডাক্তার রেস্ট নিতে বলে। গানের ক্লাসে যাওয়া বন্ধ তখন। আমার প্রেগনেন্সির খবর পাওয়ার পর থেকে দেখি অমিত বেশ রাত করে ফিরতে শুরু করল। একদিন শাশুড়ি বললেন--তোর রোজ রোজ এত দেরি হয় কেন? বৌমা না খেয়ে বসে থাকে। একটু আগে আসতে পারিস না। আগে তো এত দেরি হতো না। জানিস না বৌমার শরীরটা ভালো নেই।
অমিত মায়ের কথার কোনো উত্তর না দিয়ে সোজা ঘরে এসে আমাকে বলল--আর যেন কোনোদিন না দেখি বা শুনি যে তুমি আমার জন্য না খেয়ে বসে আছো।আমাকে কেউ এত ভালবাসুক আমার ভালো লাগেনা। তারপর রাতে খেয়ে মেঝেতে বিছানা করে শুয়ে পড়লো। আমি অভিমান করেছে ভেবে ওর কাছে গিয়ে ওকে জড়িয়ে আদর করলাম। বললাম--কী হয়েছে তোমার? এত রাগ করছ কেন? ঠিক আছে এবার থেকে আমি সময় মতো খেয়ে নেব।
ও শুধু বলল--তোমার শরীর খারাপ,যাও খাটে গিয়ে শুয়ে পড়ো। আমার ভীষণ ঘুম পাচ্ছে।
এভাবেই দিন কাটতে লাগলো।আমার সঙ্গে ওর খুব কম কথা হত। রোজই ও বেশি রাত করে ফিরতে শুরু করল যাতে আমি ঘুমিয়ে পড়ি। কিন্তু আমি জেগেই থাকতাম। একদিন আর সহ্য করতে পারিনি। ভীষণ রাগে মাথাটা কেমন গরম হয়ে উঠল। বললাম--এত রাগ কীসের তোমার? কী হয়েছে? ভালো করে কথা বলো না।কী অপরাধ করেছি আমি?
অমিত ও রেগে আমাকে বলল--পারবে ওই সন্তানকে নষ্ট করে দিতে?
-----------মানে?
-----------মানে ও আমার সন্তান না।
-----------তবে কার?
------------কার আবার,ওই গানের মাস্টারের। মাথায় বাজ পড়লো যেন। অজান্তেই জিভে কামড় খেলাম। মুখ দিয়ে আর কোনো কথা বের হচ্ছিল না। শুধু বললাম--এত বড় কথা বলতে পারলে? ছিঃ! ছিঃ! এমন কথা শোনাও যে পাপ।
ও আর কোনো কথা বলল না। রোজকার মত নীচে বিছানা করে শুয়ে পড়ল। এতক্ষণে বুঝলাম ওর এমনভাবে আমাকে এড়িয়ে যাওয়ার কারণ কী।কিন্তু সারারাত আমি দু- চোখের পাতাএক করতে পারলাম না। কিছুক্ষণ কাঁদলাম। তারপর কেমন জেদ চেপে গেল। আর না। আর সহ্য করা যাচ্ছে না। এত মানিয়ে সংসার করা যায় না। সকালে কাউকে কিছু না বলে এক কাপড়ে চলে এলাম বাপের বাড়ি। সবাই অবাক হলো এত সকালে আমাকে দেখে। কারণ জানতে চাইল। আমি হাউমাউ করে কেঁদে ফেললাম। বাঁধভাঙ্গা গতিতে বেরিয়ে আসতে লাগলো আমার চোখের জল। তারপর একটু স্বাভাবিক হয়ে সবটা বললাম।বিয়েটা আমি নিজে দেখে করিনি তাই আমার লজ্জা পাওয়ারও কিছু ছিল না। সবাই শুনে নির্বাক নিস্তব্ধ।কেউ বলল না--তুই ভুল করেছিস, চল্ তোকে শ্বশুরবাড়ি রেখে আসি।
সেই আমার চলে আসা আর ফিরে যায়নি। শ্বশুরমশাই এসেছিলেন কয়েকবার আমাকে নিয়ে যেতে কিন্তু আমি যাইনি। বলেছিলাম-- অমিত না এলে যাব না।আসেও নি অমিত। ফোনও করেনি আমাকে কোনোদিন।
আমি আর সূচনাও কেমন হতবাক হয়ে গেলাম। এমন করেও স্ত্রীকে সন্দেহ করা যায়! হঠাৎ সূচনা বলল--আপনি কখনো ফোন করেননি আপনার স্বামীকে?
বললেন--ইচ্ছে হয়নি তা নয়।তবে যখনই ভাবতাম ফোন করবো হঠাৎ কেমন একটা অশান্তি বুকটাকে ভারাক্রান্ত করে দিত। নিজের উপর খুব রাগ হতো। মনে হতো,যে এত বড় অপমান করল তার সাথে কোনো কথা হতে পারে না। তবে মা-বাবার অনুরোধে একবার ফোন করেছিলাম ছেলেটার কথা ভেবে। তখন আমার বান্টির বয়স ৬ মাস। কিন্তু দেখলাম ওর মধ্যে কোনো অনুশোচনা বোধ নেই। ফোনটা ধরে কিছুক্ষণ চুপ করে থাকলো। তারপর বলল--আমি তোমাকে তো বিরক্ত করছি না। তুমি তোমার মতো থাকো, আমি আমার মতো। আমি ভালো আছি, আমাকে নিয়ে চিন্তা করো না--বলে ফোনটা কেটে দিল।
তারপর জেদ আমার আরো বেড়ে গেল। ঠিক করলাম একাই মানুষ করবো ছেলেকে। আর কোনোদিন ফোন করিনি ওকে।
পিঠের বালিশটাকে নেড়েচেড়ে একটু সোজা হয়ে বসলেন নবনীতাদি। তারপর বললেন-- শ্বশুরমশাই এত বড়ো আঘাত সহ্য করতে পারেন নি।আমি চলে আসার বছর পাঁচেক পর হঠাৎ অসুস্থ হয়ে তিনি ইহলোক ত্যাগ করেন।তার দুবছর পর শাশুড়িমাও চলে গেলেন।অমিত বাড়িঘর বিক্রি করে ওর অফিসের কাছে ঘরভাড়া নিয়ে থাকছিল।আমার বাবাই ওর সব খবর রাখতো। বান্টির বয়স যখন পাঁচ বছর আমার বাবা ওকে নিয়ে গিয়েছিল অমিতের সঙ্গে দেখা করাতে।আমি জানতাম না। আসলে বাবা বোধহয় চেয়েছিল সব ঠিক হয়ে যাক। কিন্তু না কিছুই ঠিক হয়নি। অমিত বাবার সঙ্গে খুব খারাপ ব্যবহার করেছিল আর বান্টিকে দেখে ভ্রুকুঁচকে ঘরে ঢুকে গিয়েছিল। ওদের বসতেও বলেনি। বান্টিকে এটাই বোঝানো হয়েছে যে তোমার বাবার অফিস ছুটি হয় না।যখন ছুটি হবে তখন আসবে। যখন বুঝতে শিখেছে তখন ও বোধহয় বাড়ির অন্যদের কাছে শুনেছে যে ওর বাবার সাথে আমার ভালো সম্পর্ক নেই। তাই ও আর কিছু বলে না।এখন চাকরি করছে,বিয়েও করেছে। ও খুব ভালো আছে। মাঝে মাঝে এসে আমাকে দেখে যায়। কিছু টাকাও দিয়ে যায়।
আমরা ওনাকে একটু থামিয়ে দিতে গেলাম এই ভেবে যে এত অসুস্থ মানুষ এত কথা বলছেন কিন্তু নবনীতাদির কোনো দিকেই খেয়াল নেই। তিনি একইভাবে বলে চলেছেন--আমার বান্টির বয়স তখন ১৫ বছর। বাবা একদিন ইচ্ছা করেই ওকে অমিতের অফিসে নিয়ে যায়।ওখানে অমিতের বন্ধু প্রণয়বাবুর সঙ্গে দেখা করে। প্রণয়বাবুর সাথে আমাদের কথা হয় মাঝে মাঝে।উনি ভীষণ খুশি হয়ে দুটো চেয়ারে ওদের বসতে দেন। তারপর অমিতকে ডাকেন। একে একে অফিসের অন্যান্য স্টাফরা আসে। সবাই বান্টিকে দেখে এক বাক্যে একটা কথাই বলেছিল সেদিন--এ তো দেখছি একেবারে অমিতের মুখ বসানো।একই ছাঁচে গড়ে দিয়েছেন ভগবান।
সেদিন অফিসে সবার সামনে আর খারাপ আচরণ করেনি আমিত। বাবা কিছুক্ষণ থাকার পর বান্টিকে নিয়ে চলে এসেছিল।সেদিন আমার বুক থেকে যেন একটা ভারী পাথর সরে গিয়েছিল। যদিও আমার পাড়াপ্রতিবেশী আর আত্মীয়স্বজন অনেকদিন আগেই একথা বলেছে। একসপ্তাহ পর একদিন সন্ধ্যায় প্রণববাবু ফোন করলেন।আমি হ্যালো বলতেই কান্নাভেজা গলায় বললেন--অমিত আর নেই।
---------নেই মানে?
-----------আত্মহত্যা করেছে অমিত। গতকাল অফিসে ছেলের সঙ্গে কথা বলেছে,ছেলেকে একটা চকলেটও কিনে দিয়েছে। ভাবলাম এইবার বোধহয় ওর মান ভাঙবে কিন্তু এটা কি করল অমিত আমি বুঝতে পারছি না। নবনীতাদি একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস ছাড়লেন। কিছুক্ষণ চুপ করে থাকলেন। তারপর বললেন-- শ্রাদ্ধের দিন প্রণয়বাবু আসলেন। আমাকে একটা ঘরে ডেকে একটা চেক বের করে দেখালেন। আমি অবাক হয়ে বললাম--এটাতো ব্যাংকের চেক,তাও দেখছি আপনার নাম লেখা।
প্রণয়বাবু বললেন---বান্টি ওর বাবার অফিসে যাওয়ার দুদিন পর অমিত আমাকে দুলাখ টাকার একটা চেক দেয়। বলে--শরীরটা ভালো নেই।বাইরে কোথাও ঘুরতে যাব ভাবছি।এই চেকটা তোর অ্যাকাউন্টে জমা করে রাখ। আমি ফিরে এসে নেব।তারপর হাসি হাসি মুখ করে বলল---আর যদি না আসি তাহলে তুই নবনীতার হাতে তুলে দিস। ও যেন ছেলের জন্য এই টাকাটা খরচ করে। কিছুই তো করলাম না ওদের জন্য।
আমার তখন চোখের জল ফেলা ছাড়া আর কিছুই করার ছিল না।শুধু বলেছিলাম--এ ব্যাপারে পরে কথা হবে।
সূচনা অবাক হয়ে বলল---শেষ পর্যন্ত ঐ টাকার কী হল?
নবনীতাদি বেশ গম্ভীর হয়ে বললেন--না, নিইনি ঐ টাকা আমি।সব অনাথ আশ্রমে দান করে দিয়েছি।তবে এসব কথা ছেলেকে কিছুই বলিনি যদি অশান্তির সৃষ্টি হয়।ঐ যে বাচ্চাদের খেলতে দেখেছো আমাদের উঠোনে, ওরা সেই অনাথ আশ্রমেরই শিশু।
তারপর নবনীতাদি একটু থেমে বললেন-- আচ্ছা তোমাদের কী মনে হয় আমি ঠিক করিনি?
আমি আর সূচনা ভাষা হারিয়ে ফেলেছি ততক্ষণে। কিছু বলার নেই আমাদের। নবনীতাদি আবার বলছেন--শ্বশুরবাড়ি ছাড়ার পর আমি কোথায় যাচ্ছি, কেন যাচ্ছি, এই প্রশ্ন আর কেউ করেনা।আগে কিছু কিনতে ইচ্ছা হলে স্বামীর কাছে চাইতে হত। এখন আমি স্কুল থেকে যা পাই তাতেই চলে যায়।ছেলেও কিছু দেয়।কিন্তু আমার বুকের গভীর ক্ষতটা মাঝে মাঝে ভীষণ কষ্ট দেয় আমায়।
আমি তখন বললাম--নবনীতাদি অতীতকে আঁকড়ে আপনি ভালো থাকতে পারবেন না। অতীতকে ভোলার চেষ্টা করুন।
নবনীতাদি আমার দিকে তাকিয়ে মাথা নাড়লেন।
দেখতে দেখতে সাতটা বেজে গেল। আমরা দুজনে এবার উঠে দাঁড়ালাম। নবনীতাদির গায়ে হাত দিয়ে বললাম--তাড়াতাড়ি সুস্থ হয়ে উঠুন।
হঠাৎ একজন ভদ্রমহিলা মিষ্টির প্লেট হাতে
ঘরে ঢুকলেন---ম্যাডাম যাবেন না একটু মিষ্টিমুখ করবেন। ছেলেটাকে সেই কখন পাঠিয়েছি,এই আসলো মিষ্টি নিয়ে। এখনকার ছেলেপুলে কী যে হয়েছে! একবার বাইরে বেরোলে আর ঘরে ঢুকতে চায় না।
মুখটা দেখেই বুঝতে পারলাম নবনীতাদির দিদি। একই রকম দেখতে। নবনীতাদি পরিচয় করিয়ে দিলেন--আমার দিদি।
উভয়পক্ষে নমস্কার বিনিময় হলো। তারপর মিষ্টি খেয়ে আমরা তড়িঘড়ি বিদায় নিলাম। বাইরে জ্যোৎস্নার আলোয় আলোকিত চারদিক। আমরা দ্রুত পায়ে এগিয়ে চললাম বাড়ির উদ্দেশ্যে।
এক সপ্তাহ পর নবনীতাদি স্কুলে আসলেন। স্বাধীনচেতা নবনীতাদি তার অন্তরের ক্ষত ঢেকে আবার হাসিমুখে আমাদের গান শোনালেন। আর আমরা আবার আগের মতোই মুগ্ধ হলাম একইভাবে।।
------------------&&&&&&&---------------------------
-তপতী মণ্ডল।
রহড়া উঃ২৪ পরগণা।