ভরত আর কাশেম সহপাঠী ছিল। দু'জনের গ্রাম পাশাপাশি। ভরতকে স্কুল যেতে হতো কাশেমের গ্রামের উপর দিয়ে। অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত তারা একসাথে পড়াশুনা করেছিল। তারপর ছাড়াছাড়ি হয়ে যায়। কারণ ওই স্কুলটা ছিল অষ্টম শ্রেণী পর্যন্তই। তারপর কাশেম চ'লে যায় শহরের স্কুলে পড়তে। ভরতের বাবার তেমন সামর্থ্য ছিল না যে তাকে আর বাইরের স্কুলে রেখে পড়াতে পারে।তাই তার বাবা বাদল দাস তার এক দূর সম্পর্কের দাদাকে ধরে তার ভরতের জন্য একটা যে কোনো কাজের ব্যবস্থা ক'রে দিতে। আর তাকে ভরতের কাগজপত্রের নকল দিয়ে আসে। বাদল দাসের সেই দাদা ইলেক্ট্রিক অফিসে কাজ করার সুবাদে তার বেশ কিছু মাঠকর্মী নিয়োগের সুযোগ ছিল। একসময় সেই কাকা ভরতকে ডেকে পাঠায়। আর সবার কাগজপত্র যাচাই করার সময় ভরতও তাতে অংশ নেয়। তারপর সে আরো অনেক ছেলের সাথে মনোনীত হয় মাঠকর্মী পদের জন্য। এটা কেবল পুরুষ মানুষের কাজ। বিদ্যুতের খুঁটির উপর উঠে কাজ করতে হয়। তাদের সবার একসাথে ব্লকের অফিসে এক সপ্তাহের একটা ট্রেনিংও দেওয়া হয়। এসব অনেক পুরনো ঘটনা। যাক ভরত এখন বিদ্যুৎ দপ্তরের কর্মী। তার বাবা মা একটু সুখের মুখ দ্যাখে।
ছেলে চাকরি করে। তাই তার জন্য অনেক বিয়ের প্রস্তাব আসতে থাকে।চাকরি পাওয়ার এক বছর ঘুরতে না- ঘুরতেই বাদল ও তার স্ত্রী হারানি দেখাশুনা ক'রে দুটি গ্রামের পর সাওড়াইল গ্রামে তার ছেলের বিয়ে দিয়ে দ্যায়। পাত্রীটির নাম নমিতা, দেখতে শুনতে ভালো, শ্যামলা রঙ, ক্লাশ এইট পর্যন্ত সেও লেখাপড়া করেছে। আর তারা স্বগোত্র। কাজেই দেখাশুনার অল্পদিনের মধ্যেই তাদের শুভ বিবাহ সম্পন্ন হয়। কিন্তু বছর চার পাঁচ হ'য়ে গেলেও ভরত আর নমিতার কোনো সন্তানাদি হয় নি। এর জন্যও নমিতাকেই দোষ দেওয়া হতো।
হঠাৎ একদিন অঘটন ঘ'টে গেল।একদিন একটা উঁচু বিদ্যুতের খুঁটিতে উঠে সেখান থেকে পাশের বাড়ির গ্রাহকের বাড়িতে বিদ্যুৎ সংযোগ দেওয়ার সময় সে আচমকা শক খায় । হাই ভোল্টেজ লাইনে আটকে যায়। নীচে থাকা তার সহকর্মীরা কিছু বোঝার আগেই সে উঁচু মই থেকে ছিটকে' থরথর করতে করতে মাটিতে প'ড়ে যায় আর মারা যায়। তার পরিবারের উপরে বিরাট শোক দুঃখ নেমে আসে। ভাগ্যের লেখাকে (অথবা খেলাকে ) তাদের মেনে নিতে হয়।
সবাই বলে ভরতের বৌ এবার তার স্বামীর চাকরিটা পাবে।কারণ বাদলের ছোট ছেলেটা সবে ক্লাশ ফাইভে পড়ছে, সে তো চাকরির জন্য যোগ্য হবে না। ভরতের কয়েক জন সহকর্মীর পরামর্শে নমিতা বিদ্যুৎ দপ্তরে 'ডাই-ইন- হারনেস'-য়ের নিয়মে একটা চাকরির আবেদন করে। ভরতের সহকর্মীরা তাকে আবেদন করতে সাহায্য করে।এর জন্য অনেক ঘুরে ঘুরে পঞ্চায়েৎ প্রধানের কাছ থেকে ভরতের সাথে নমিতার বিয়ের সাট্টিফিকেট যোগাড় করতে হয়। মৃত্যুরও কাগজপত্র যোগাড় করতে হয় স্থানীয় স্বাস্থ্যকেন্দ্র থেকে যেখানে ভরতকে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল দুর্ঘটনায় তার মৃত্যুর পর। ভরতের বাবাকেও বৌমার দরখাস্তের উপর সই ক'রে দিতে হয় যে তার বৌমা এই চাকরি পেলে তার কোনো আপত্তি নাই। কিন্তু সে তো মহিলা। সে তো আর পোল খাটাতে বা বিদ্যুতের সংযোগ দিতে পোলে উঠতে পারবে না। তাই তার জন্য ব্লকের বিদ্যুৎ অফিসে একটা অন্য কাজ তার জুটে। এর জন্য তাকে আর তার শ্বশুরকে অনেক দৌড়ঝাঁপ করতে হয়েছিল। খরচখরচাও দিতে হয়ে ছিল। তবুও অনেক দিন অপেক্ষা করতে হয়েছিল।
এবার নমিতা শ্বশুর বাড়ি থেকে অনেকটা পথ হেঁটে তারপর ভ্যান গাড়িতে ক'রে অপিসে যায়। কখনো দেরী হ'লে তার শ্বশুর তাকে ফেরার সময় এগিয়ে নিতে আসে। তারপর বর্ষাকাল পড়লো। এভাবে তার অফিস করা বেশ অসুবিধা বোধ হওয়ায় শ্বশুরের সাথে পরামর্শ ক'রে অফিসের কাছাকাছি একটা ভাড়া ঘর ঠিক ক'রে ও সেখানে উঠে আসে। তার শ্বশুর প্রাথমিক কেনাকাটা ক'রে থাকার মতো ব্যবস্থা ক'রে দিয়ে যায়। ইতিমধ্যে কাজ পাওয়ার প্রায় ছ'-সাত মাস গত হয়েছে। নমিতার অল্প বয়স, বিধবা। অফিসের শ্যামল নামের এক কর্মীর সাথে তার ক্রমে ক্রমে ঘনিষ্টতা হ'য়ে যায়। শ্যামল তার কাজে মাঝেমধ্যে সাহায্য করে। নমিতা কোনো কোনো শনি-রবিবার শ্বশুরবাড়ি আসে, কখনো আসে না। তবে যখন যেতো তখন ও শ্বশুরবাড়িতে কিছু টাকাকড়ি দিতো। বছর ঘুরতেই সে শ্যামলকে বিয়ে ক'রে বসে। আর শ্বশুরবাড়ি আসা বন্ধ ক'রে দ্যায়। তার শ্বশুর শাশুড়ি ভাবে বৌমা আসছে না কেন ? মাসখানেক পরে শহরে খোঁজ নিতে এসে তার শ্বশুর জেনে যায় যে নমিতা আবার বিয়ে করেছে। তার দেখা পায় না। এক রবিবার তার বাসার সামনে এসে তার শ্বশুর অপেক্ষা করে, একবার কথা বলার জন্য। ডাকাডাকিতে এক সময় শ্যামল বেরিয়ে এসে বলে , সে বাসায় নাই। বাজারে গেছে। তার সাথে কী দরকার তা জানতে চায়। বাদল বলে, নমিতা তো আমাদের বৌমা, সে আর ছুটির দিনে আমাদের বাড়ি যায় না।এতোদূর এসেছি তাই একবার খোঁজখবর নিতে। শ্যামল বললো, সে এখন আমার বৌ। সে আমাকে বিয়ে করেছে। এইসব কথাবার্তার মধ্যেই নমিতা এসে পড়ে আর অপ্রস্তুত হ'য়ে যায়। তাকে দেখে বাদল বলে,একি শুনছি মা, তুমি আবার বিয়ে করেছো ! তা আমাদেরকে না ব'লেই করলে ? আমরা কি বাধা হ'য়ে দাঁড়াতাম ? সত্যিই তো তুমি অল্প বয়সী বিধবা।একা একা কতো দিন থাকবে ? আমাদেরকে জানালে আমরাই তোমার বিয়েটা দিয়ে দিতাম। তুমি তো শুধু আমাদের বৌমা নও, তুমি আমাদের মেয়ের মতো। একটা সম্পর্ক থাকতো। আমাদেরকে একদম ভুলে গেলে ? বৌমা মুখ নীচু ক'রে থাকে। ঘরে ডাকতেও পারে না, চ'লে যেতেও বলতে পারছে না। বাদল বললো, যাক, যা করেছো ভালোই করেছো, সুখে থাকো। যদি মনে হয় তো একদিন এসো।তোমার শাশুড়ি-মাকে একবার দেখে আসবে। এই ব'লে বাদল ওই বাসা থেকে চ'লে আসে।
আসলে বাদল আর তার স্ত্রী হারানি তাদের বিধবা বৌমার সাথে তাদের ছোট ছেলে শরতের বিয়ে দেওয়ার ইচ্ছা পুষেছিল। ছেলেটা প্রাপ্তবয়স্ক হ'লে তার প্রস্তাব দিবে ভেবে রেখেছিল। কিন্তু তা আর হলো না। তারা বৌমার কান্ডে নিরাশ হলো। বাড়ি এসে হারানিকে বললো, সে আর আসবে না গো আমাদের ঘরে। সে ওখানে অপিসের একজনকে বিয়ে করেছে আর তারা একসাথে থাকছে।ভরতের ভাইও বিমর্ষ হলো। পাড়ার সবাই সব জেনে গেল একসময়। নানান জন নানান টিপ্পনী কাটে।কেউ কেউ বাদলের পরিবারের প্রতি সমবেদনা প্রকাশ করে।
নমিতা আর শ্যামল বেশ সুখেই সংসার করছিলো। এমন সময় এসে পড়লো ভয়ানক করোনা মহামারী। প্রথমে ওসব কেউ পাত্তা দিচ্ছিল না। সরকারী নির্দেশিকাকে অনেকেই অমান্য করেছে। যখন খুব বাড়াবাড়ি সংক্রমণ হ'তে লাগলো তখন পুরো লকডাউন চালু হলো। কিন্তু বিদ্যুৎ সরবরাহ তো জরুরী পরিষেবার মধ্যে পড়ে, তাই তাদের অফিসে সাপ্তাহিক শিফ্ট ক'রে অফিস চালু রাখা হলো। তবু মানুষের মধ্যে দেদার করোনা ছড়াতে লাগলো। অফিসের অনেকেই আগেপিছে আক্রান্ত হলো। একদিন শ্যামলেরও করোনা উপসর্গ দেখা দিলো। চরম শ্বাসকষ্ট নিয়ে তাকে হাসপাতালে ভর্তি করানো হলো। ওর বৌকেও কোয়ারান্টাইন করা হল।কিন্তু শ্যামলকে রক্ষা করা গেল না। কারণ তার নাকি আগে থেকেই ফুসফুসের হাঁপানি ছিলো। তার সাথে করোনার বাড়াবাড়িতে একেবারে দম বন্ধ হ'য়ে মারা গেল। ওদিকে নমিতাও কোয়ারান্টাইনে বাসায় বন্দী। কারো করোনা হয়েছে শুনলে লোকে তো এমনিতেই দূরত্বে পালাচ্ছে। শ্যামলের সৎকার্য কীভাবে হাসপাতাল করলো কেউ জানলো না। তখন তো ত্রাহি ত্রাহি ভাব।বেশ কিছুদিন কোয়ারান্টাইনে থেকেও নমিতারও করোনা ধরা পড়লো। তাকে স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার লোকজন হাসপাতালে নিয়ে ভর্তি ক'রিয়ে দিল। তারপর গতানুগতিক টেস্ট, কীট্স্ এর অভাব, ভ্যাকসিন তো তখনো বাজারে আসেনি, তবু নমিতা দিন কুড়ি হাসপাতালে করোনার সাথে যুদ্ধ ক'রে চিকিৎসা শেষ হ'লে সুস্থ হ'য়ে ঘরে ফিরে এলো। কিন্তু ভীষণ ভীষণ দুর্বল । তার এখন সাহায্যের লোক দরকার।তার মা-বাবা তো অনেক আগেই গত হয়েছিল। শুধু এক দাদা বৌদি ছিল, তাদের খবর দেওয়া সত্ত্বেও কেউ এলো না। সবাই শহরের ঘর ছেড়ে গ্রামের দিকে পালাচ্ছে।তখন নমিতা নিজেই একটা ভ্যান বেশি ভাড়ায় ঠিক ক'রে তার পুরনো শ্বশুরবাড়ি বাদল দাসের কাছে এসে পড়লো। নমিতা তার করুণ অবস্থা সংক্ষেপে বর্ণনা ক'রে আপাততঃ কিছুদিন এ বাড়িতে আশ্রয় চায়লো। বাদল দাস অনিচ্ছা সত্ত্বেও একটা মৌকা পেয়ে গেল। তারা স্বামী স্ত্রীতে পরামর্শ ক'রে বললো, তোমাকে আশ্রয় আমরা দিতে পারি বৌমা, তবে তার একটাই শর্ত আছে।তুমি সুস্থ হওয়ার পর আমার এই ছোট ছেলেটাকে বিয়ে করতে হবে। মানে, তোমার দেওরকে বিয়ে করতে হবে। তুমি যদি রাজী থাকো তো থাকো এ বাড়িতে , তোমাকে তো আর ফেলে দিতে পারি না, আবার রাখলেও অনেকে অনেক কথা শোনাবে।সে শোনাক, তবে চাকরিতে যোগ দেওয়ার আগে আমার ছোট ছেলেকে বিয়ে করতে হবে। নমিতা তখন এতো দুর্বল যে দাঁড়িয়ে থাকতে পারছিল না। সে মেঝেতেই ধপাস ক'রে ব'সে পড়লো। সে ভাবছিল , সে তার ব্লকের বাসাতেই ফিরে যাবে নাকি ? কিন্তু বাড়িঅলাই তো ওখানে থাকার বিষয়ে আপত্তি ক'রে ঘর ছেড়ে দিতে বলেছে। আপাততঃ ঘরে তালা দিয়ে এসেছে। অফিস খুললে আবার যেতে হবে তো , না হলে তো চাকরিটাও হয়তো থাকবে না।সে আর ঝুঁকি নিয়ে ফিরে যাওয়ার কথা ভাবতে পারলো না।এখন ফিরে গেলে যদি আবার করোনা হয় ! নির্ঘাত মারা পড়তে হবে। তার থেকে এখানেই থাকি।যদি বেঁচে থাকি তো তখন ভাবা যাবে। এরকম ভাবতে ভাবতে সে তার শ্বশুরের প্রস্তাবে রাজী হলো। শরৎ , মানে তার দেওর ঠিক সেই সময়েই কোথা থেকে এসে পড়লো। ওর বাবা বললো, শরৎ, তোর বৌদি এসেছে। সে খুব অসুস্থ ওকে ধ'রে নিয়ে গিয়ে ওসরায় বসা। শরৎ ব্যস্ত হ'য়ে পড়লো । ওকে ওর পুরনো ঘরটা দেওয়া হলো।
একদিন বাদল ও তার স্ত্রী শরৎকে ডেকে পরামর্শ করলো আর তাদের ইচ্ছার কথা বললো।আর বললো, ওর যদি কিছু হয় তো ওর চাকরিটা তুই পাবি, তুই আর অমত করিস না।বৌদি হলো তো কী হলো ? তোর থেকে সামান্য পাঁচ/ ছ' বছরের বড়ো। আজকাল এমন কতো বিয়ে হচ্ছে । যাই হোক, ওরা নমিতার আলাদা থাকার ব্যবস্থা ও সেবাযত্ন ক'রে ওকে সুস্থ ক'রে তুললো। তখনো সমানে লকডাউন চলছে।এর মধ্যেই দিনক্ষণ দেখে পুরুত ডেকে নমিতা ও শরতের শুভ পরিণয় সম্পন্ন হ'য়ে গেল।- - -
যথারীতি লকডাউন শেষ হ'তেই আবার নমিতা শরৎকে নিয়ে বিদ্যুৎ অফিসে গেল। কিন্তু নমিতা তার পুরনো কাজে আর যোগ দিতে পারলো না। অফিস থেকে বললো, তোমাকে ছাঁটাই করা হয়েছে।এমন আরো অনেককেই ছাঁটাই করা হয়েছে। তোমার কাজ তো স্থায়ী কর্মীর ছিল না। তুমি ছিলে ক্যাজুয়াল কর্মী। মানে, ঠিকা কর্মী। ভরত যখন বিদ্যুৎস্পৃষ্ঠ হয়ে মারা যায় তখন সেও ঠিকা কর্মী ছিল। ভরতের পরিবারের প্রতি সহানুভূতিতে আর তোমার উপর আগের সাহেবের মায়া পড়ায় একটা ঠিকা কর্মী ক'রে তোমাকে ঢুকিয়ে নেওয়া হয়েছিল। কাজের দিনের উপর মাইনে পেতে।এখন সেই সাহেবও নাই , অন্য জায়গায় বদলি হ'য়ে চ'লে গেছে, আর তুমি দীর্ঘ দিন হাজির ছিলে না, তাই ইউনিয়ন নিজেদের লোক ঢুকিয়ে দিয়েছে। শ্যামলের ব্যাপারটাও ঐ একই। তাও অফিস থেকে তারা বেরোচ্ছে না দেখে বড়ো বাবু বলে, তোমাকে কি কোনো অ্যাপয়েন্টমেন্ট লেটার দেওয়া হয়েছিল ? তারা বুঝতে পারে না। তখন বড়ো বাবু বুঝিয়ে বলেতোমাকে যে কাজে রাখা হয়েছিল, সাহেবের সই-করা তার কোনো কাগজ কি তোমাকে দেওয়া হয়েছিল ? থাকলে দেখাও।নমিতা বলে, ছ্যার তো কাজে লাগিয়ে দিয়েছিল, কোনো কাগজ তো দ্যায় নি। তাহলে ? তখনকার সাহেব থাকলে হয়তো তুমি কাজ পেতে । উনি নাই, এখন ইউনিয়ন অন্য লোক নিয়েছে বা আদৌ নেয় নি আমি বলতে পারবো না । তোমার কাজ আর নাই। তুমি বাড়ি যাও। এনিয়ে বেশ কয়েক দিন ঘোরাঘুরি করেও নমিতা কোনো সুরাহা করতে পারে না। চেনাজানা লোকগুলোকে কেমন অচেনা মনে হয়। মনে হয়, সে যেন পাতালে ঢুকে যাচ্ছে। সে বাইরে এসে ধ্বস ক'রে এক জায়গায় ব'সে পড়ে। শরৎ তাকে পানি খাওয়ায় , মুখচোখ ধুইয়ে দ্যায়, তারপর বলে, চলো বাড়ি চলো, এখানে আর আসবো না। কেউ কেউ শরৎকে বিদ্যুতের ঠিকা মাঠকর্মীর জন্য দরখাস্ত করতে পরামর্শ দ্যায় যদি কিছু করা যায় । নমিতা এক কথায় 'না ' ব'লে দ্যায়। ওই কাজে তার এক স্বামীকে সে হারিয়েছে, আর ওই কাজে সে যেতে দিবে না। তারা হতাশ হ'য়ে ভ্যান ধ'রে বাড়ি ফিরে আসে। শরৎ বাবাকে সব জানায়। শুনে ওর বাবা বলে,তাহলে এতোদিন বৌমা অপিসের কর্মচারী ছিল না , ঠিকা কর্মী ছিল ! ভরতও ঠিকা কর্মী ছিল ? আমরা মুরুক্ষু মানুষ এতো আটঘাট কে জানতো ? - - - যাক , যা হবার তা হলো। এবার বাড়িতেই অন্য কাজ দ্যাখো। এই শহরের মানুষগুলো সব মুখোশ -পরা, প্যাঁচালো। কে কোন্ ধান্দায় থাকে বুঝা মুশকিল। যেই ফাঁক পেলো, অমনি বৌমাকে সরিয়ে অন্য আত্মীয়কে ঢুকিয়ে নিল। দুঃখ কোরো না বৌমা , বাড়িতেই কিছু একটা করার কথা ভাবো। ভরতের মা ওসব ঘোরপ্যাঁচ কিছুই বুঝতে পারলো না, শুধুই শুনে গেল।
ক'দিন পরামর্শ ক'রে নমিতা শরৎকে বললো, বাড়িতেই তো জায়গা আছে, মুলিবাঁশের একটা ঘর তুলে' একটা মুদির দোকান দাও।তুমি শহর থেকে সপ্তাহে সপ্তাহে জিনিসপত্র আনবে আর আমরা দু'জনে চালাবো। এ পাড়ায় তো মুদির দোকান নাই, চলতে পারে। তারা বাবার পরামর্শ নিল। শুনে বাবা বললো, সে তো অনেক খরচ ! আমার তো তেমন জমানো টাকা নাই যে দিবো।কী ক'রে হবে ? নমিতা বললো, আমার কিছু জমানো টাকা আছে ।সে সব ভাঙিয়ে কোনো রকমে চালু তো করি।দেখিই না। আপনার ছেলে মুনিশ খাটতে পারবে না।তার বাবা বললো, ঠিক আছে বৌমা, দরকার হ'লে ছাগল দুটো না-হয় বিচে দিবো। সংসার চালাতে গেলে কিছু আয় তো চায়।
যেমন ভাবা , সেই ভাবেই একটা চালা খাটিয়ে একদিন শরৎ টুকিটাকি জিনিস ব্লকের বাজার থেকে এনে সত্যিই মুদির দোকান শুরু করলো। দোকানে সুবিধামতো শরৎ নমিতা পালা ক'রে বসে। রোজ বিক্রিত জিনিসের ও টাকার হিসাব রাখে, কি কি জিনিস আনতে হবে তার তালিকা বানায়।পরের সপ্তাহে বাজার থেকে শরৎ সেসব জিনিস নিয়ে আসে।সংসারের তেল নুন আটা চাল হলুদ তেজপাতা কাঁচা লঙ্কা থেকে চাপাতা বিস্কুট লজেন্স টফি মাথার ফিতে চিরুনী ক্লিপ খাতা কাগজ ছোটদের বই শ্লেট পেন্সিল ইত্যাকার নানাবিধ জিনিসে ধীরে ধীরে দোকানটা সাজিয়ে তুললো।বেশীর ভাগই সস্তা জিনিস।কারণ গ্রামের লোকজন বেশীর ভাগই গরীব। তাদের কোনো ক্রেতাকে ওরা সহজে ফেরায় না। তবে যেহেতু চোরের উপদ্রব আছে , তাই রোজ দোকান সাজাতে হয় আর রাত আটটা হ'লেই গুটিয়ে বাড়ির ঘরে সেগুলো তুলে রাখতে হয়।এটাই হ্যাপা। এতে মাস গেলে তাদের গড়ে চার সাড়ে চার হাজার টাকা আয় হয়। কখনো পাঁচ হাজারও হয়।
এর মধ্যে নমিতা অন্তঃসত্বা হলো আর আট ন'মাস পর তাদের সংসারে একটা কন্যা সন্তান জন্মালো।শরতের মা ওর নাম রাখলো ভারতী। তার মায়ের কাজের সময় ভারতী তার দাদু দিদার কাছে থাকে।উঠানে খেলে বেড়ায়, শরতের ও নমিতার কোলে কোলেও ঘুরে বেড়ায়। এখন এটা প্রমাণ হলো যে সন্তান না হওয়ায় ভারতীর কোনো দোষ ছিল না।ভরতের বাবা মা বুঝলো।হয়তো ভরতেরই কোনো খুঁত ছিলো।
কাশেম তো সেই শহরে পড়তে গেল। আর গ্রামের বাড়িতে সে থাকার জন্য ফিরলো না। ছুটিছাটায় সে গ্রামে আসতো।পাশের গ্রামের ভরতের কথা সে ভুলেই গেছিল । এশহর ওশহরে পড়াশুনা ক'রে সে নিজের চেষ্টায় একটা স্কুলে চাকরি পেয়েছে। তার আগে সে টিউশন পড়াতো। এটাই তার স্কুলে শিক্ষকতা পাওয়ায় কাজ দিয়েছে সবচেয়ে বেশি।ধারাবাহিক পড়াশুনার চর্চা তাকে প্রতিষ্ঠা দিয়েছে। সে বাপমার দেখা পাত্রীকে বিয়ে করেছে। তাদের দুটো ছেলেমেয়ে হয়েছে।তারা সুখী। লকডাউনের পর পূজার ছুটির সময়ে তারা গ্রামের বাড়িতে বেড়াতে এলো। সে একদিন পাশের গ্রামের রাস্তা দিয়ে ঘুরতে বেরোল।এতো পরিবর্তন চারিধারে,মাটির বাড়ির পাশাপাশি অনেক পাকাবাড়ি উঠেছে। ফাঁকা জমি ডাঙা প'ড়ে নাই বললেই চলে। বলতে গেলে, পাশাপাশি দুটো গ্রাম এখন এক হ'য়ে গেছে। সে এইসব আনমনে ভাবতে ভাবতেই রাস্তার ডানপাশে একটা বাড়ির দিকে তার চোখ পড়লো। দেখলো, বাড়ির দাওয়ায় একজন বুড়ো লোক ব'সে আছে। বাড়িটার কথা তার মনে পড়লো। এটা তো ভরতদের বাড়ি ব'লেই মনে হচ্ছে। পায়ে পায়ে এগিয়ে গিয়ে চিনলো, উনি তো বাদল কাকা। যেচে কথা বললো,কাকা আপনি ভরতের বাবা, না ? চোখ তুলে দেখলো, তারপর বাদল দাস বললো, কে বাবা ? চিনতে তো পারলাম না ? কাশেম বললো, আমি কাশেম, পূর্বপাড়ার হাশেম আলির ছেলে। ভরত আর আমি কৈওড়ের স্কুলে একসাথে পড়তাম। তা, ভরত এখন কী করছে ? সে কই ? - - - শুনে বাদলকাকার চোখে জল ভ'রে এলো। - - - সামলে' নিয়ে বললো, সে তো আজ বহু বছর হলো মারা গেছে। বিদ্যুতের তার ফিট করতে উঠে শক খেয়ে মারা যায়।- - - সব ঘটনা শুনলো। নমিতা শরৎ শরতের মা সবাই এসে দাঁড়িয়েছে। এতো দিন পর ভরতের খোঁজ করছে কে লোকটা !? ভারতী ছোট্ট ফ্রক প'রে ঘুরঘুর করছে ওর দাদুর কাছে। ভারতীর জন্মবৃত্তান্তও শুনলো।সহপাঠী শরতের জন্য সে আন্তরিক দুঃখ প্রকাশ করলো। ভারতীকে কোলে নিল। শান্ত শিষ্ট মেয়ে।কাঁদলো না। মুখের পানে চেয়ে রইলো। তার মাথায় হাত দিয়ে আশীর্বাদ করলো।নমিতার সাথেও পরিচয় করালো ভরতের বাবা। বললো , হাশেম ভাইও তো মারা গেছে, বাবা।আমরাও বন্ধুলোক ছিলাম। কথায় কথায় সাঁঝ ঘনিয়ে এলো। মনখারাপ নিয়ে কাশেম বিদায় নিলো।তবে ভরতের কাহিনীটা তো জানা গেল।অন্যদিকে আর যাওয়ার তার ইচ্ছা হলো না । ধীর পায়ে আনমনে সে বাড়ি ফিরছে। ভরতের সাথে স্কুল যাওয়া ও ফেরার ছোট ছোট স্মৃতিগুলো তাকে যেন পিছু টানছে।সে এখন কৈশোরের দিনগুলোয় অতীতচারী। অজান্তে এক সময় একটা দীর্ঘশ্বাস পড়লো তার। নির্জনতায় দীর্ঘশ্বাস বড়ো করুণ শোনায়।
====================
বদরুদ্দোজা শেখু
ঠিকানা-- 18 নিরুপমা দেবী রোড , বাইলেন 12 ,
শহর+পোঃ- বহরমপুর , জেলা--মুর্শিদাবাদ,
PIN -742101
পঃ বঙ্গ , ভারত ।